উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭৭
রেখার স্কুল যাবার পথে
মমতা রায় চৌধুরী
পার্থ একেবারে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে মনোজদের বাড়ির দরজায এসে কলিং বেল বাজালো 'জয় গনেশ ,জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা... ।'বেশ কয়েকবার কলিংবেল বেজে গেল। লিলি ,পাইলটদের ভৌউ ভৌউ গলা শোনা যাচ্ছে।
পার্থ ভাবছে 'কি ব্যাপার বৌদিরা দরজা খুলছে না কেন?'
এবার পার্থ জোরে জোরে ডাকতে লাগল 'ও মনোজদা ,মনোজদা .আ.আ ,মনোজদা...।
রেখা বাথরুমে ঢুকেছিল আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরোতে গিয়ে দরজায় এমন জোরে ধাক্কা লাগল , জান মনে হচ্ছে বেরিয়ে যাবে।শীতকাল তো খুব কষ্ট হচ্ছে । যন্ত্রণাগ্রস্থ অবস্থায় এসে দরজাটা খুলল।
দরজা খুলেই রেখা বলল 'ও পার্থ তুমি?'
পার্থ বলল' কি বৌদি কখন থেকে আপনাদের ডাকছি।'
রেখা বলল ' আর বোলো না ভাই, আমি একটু বাথরুমে ছিলাম বেরোতে পারছি না। দরজার কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কি করবো বলো?'
পার্থ বলল' মনোজ দা কোথায়?'
রেখা বলল 'আজকে একটু বলল ওর এক বন্ধুর বাড়িতে যাবে।তাই সকাল সকাল একটু বের হল?'
রেখা বলল ' দরজায় দাঁড়িয়ে কথা কেন ?ভেতরে এসো।'
পার্থ ভেতরে ঢুকে আসলো।
রেখা চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল 'এখানে বসো।'
পার্থ চেয়ারটায় বসে বলল'বৌদি, আজকে তো ভাইয়ের কাজ ।সকাল সকাল বাড়িতে আসবেন কিন্তু?'
রেখা বলল 'কিন্তু আজকে তো আমাকে একটু স্কুলে যেতে হবে ভাই?'
পার্থ বলল' আজকে স্কুলে যেতেই হবে বৌদি?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ভাই।'
পার্থ বলল 'তাহলে দাদাকে অন্তত পাঠিয়ে দেবেন।'
রেখা বলল' হ্যাঁ ভাই ।সে তো যাবেই।'
পার্থ বলল ' মা কিন্তু আপনার জন্য ওয়েট করবে।'
রেখা বলল' মাসিমাকে একটু বুঝিয়ে বলে দিও।'
পার্থ বলল 'তাহলে আর বেশিক্ষণ বসবো না বৌদি ।কথাও বাড়াব না। আপনাকে যে তুই স্কুলে যেতেই হবে ।আপনার তৈরি হবার ব্যাপার রয়েছে।'
রেখা শুধু হেসে সম্মতি জানায়।
পার্থ বেরিয়ে গেল রেখা দরজাটা দিল । তারপরই মিলির আর বাচ্চাদের খাবারটা গিয়ে দিয়ে আসলো।
মিলি আর ওর বাচ্চারা কত প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রেখার দিকে' ।যেন ওদের আশাভরসা সবকিছু রেখা।
আজকে রেখার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদেরকে খাওয়ানোর সময় ছিল না। তাই খাবার থালা টা রেখে দিয়ে আসলো তারপর দুপুরের খাবারটা রেডি করল। পার্থ আসার আগেই গ্যাসে চাপানো ছিল তরকারি বেশি কিছু করতে পারে নি ।ডিমের কারি, ইলিশ মাছ ভাজা আর পালং শাকের ঘন্ট।
এবার ব্রেকফাস্ট রেডি করল। একটা ডিমের পোচ তৈরি করার জন্য একটা প্যান বসিয়ে দিল, তারপর কিছুটা পরিমাণ বাটার দিয়ে দিলil একটু নাড়াচাড়া করতেই ডিমটা ফেটিয়ে ওর উপর দিয়ে দিল, তার ওপর গোলমরিচের গুড়ো , একটু নেড়েচেড়ে নিয়ে ডিমের পোচ রেডি করে দিল। এরপর ঝটপট টোস্টার মেশিনে ব্রেডগুলো সেঁকে নিল।
রেখা ভাবতে লাগলো ' মনোজ এখনো আসলো না পোচটা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এরপর গাজরের জুস কাঁচের গ্লাসে ঢেলে টেবিলে র ওপর রেডি করে রাখল।
তারপর ফেসওয়াশ দিয়ে ফেস ক্লিন করার সময় হঠাৎ দরজায় কলিংবেল আওয়াজে চটপট মুখটা ধুয়ে নিয়ে দরজাটা খুলল।
খুলে দেখল মনোজ।
রেখা বললো 'কি ব্যাপার এত দেরি করলে?'
মনোজ বলল' এতদিন পর গেছি ,বন্ধুকে কাছে পেয়ে
ছাড়তে কি চায়?'
মনোজ রেখা বলল' 'তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমার তো ব্রেক ফাস্ট টাইম হয়ে গেছে। ওদিকে ডিমের পোচ করেছি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ।
মনোজ বলল 'হ্যাঁ যাচ্ছি ,ভেতরে ঢুকে জুতোটা বারান্দায় রেখে একবার ভালো করে হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে গামছা দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে খাবার টেবিলে বসলো।
মনোজ বলল' আজ ব্রেডের সাথে ডিমের পোচ ?
কাঁচের গ্লাসে কি রেখেছো?'
রেখা ঘরে থেকে সাড়া দিলো ।তাই রাখলাম দেখো বাস্কেটে কলা আছে নিয়ে নাও।'
মনোজ বলল' কাঁচের গ্লাসে ওটা কি রেখেছো? জুস?
রেখা বলল হ্যাঁ। গাজরের জুস।
মনোজ বলল' অ্যাই রেখা ,গাজরের জুস খাবো না।
প্লিজ।'
রেখা বললো "তা কি করে হয় ছোটদের মতো বায়না করলে তো হবে না ।তোমাকে খেতে হবে।'
মনোজ আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নাস্তা করতে লাগলো। জানে ,রেখা যদি একবার বলে দিয়েছে তার কথার নড়চড় হবে না।
রেখা বললো 'মিলিদের খাবারটা তুমি দিয়ে দিও দুপুর বেলায়। যদি অসুবিধা হয় ,বাচ্চারা তো বড় হয়েছে ।তাহলে তোমার ওই গৌরীসেন দাদাকে ডেকে নিও।'
মনোজ বলল' ঠিক আছে।'
রেখা বলল'আর শোনো পার্থর ভাইয়ের আজকে কাজ আছে। পার্থ এসেছিল ।তুমি একবার ওখানে দেখা করে এসো কেমন?'
মনোজ বলল 'আজকে তোমাকে স্কুলে যেতেই হবে?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ। এত মেডিকেলে নিয়ে নিলাম।আজকে যেতে হবে এই কারণেই সবার প্রশ্ন জমা পড়ে গেছে ।12 ক্লাসের যে 50 নম্বরের প্রশ্ন করেছি সেই প্রশ্নটা তো আমার জমা দেয়া হয় নি ।এদিকে সামনে টেস্ট পরীক্ষা।"
রেখা বাইরে বেরিয়ে এসে জুতো পড়ে পরতে পরতে বলল 'আসছি। সাবধানে থেকো।'
মনোজ বলল' তুমি খেয়েছ?'
রেখা বলল 'না খাবার সময় পাই নি ।আমি টিফিন বক্সে নিয়ে নিয়েছি।'
মনোজ বলল ''তা কি করে হয়? এতটা বেলা হয়ে গেছে, না খেয়ে চললে?"
রেখা বললো' 'আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ঠিক খেয়ে নেবো।"
মনোজ বলল 'ঠিক আছে সাবধানে।'
রেখাবলল"আমি কলাপসিবল গেট টেনে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি খেয়ে উঠে লক করে দিও।'
বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখতে পেল অটো ।রেখা হাত নেড়ে বলল' অটো দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও।'
অটোআলা কাছে আসতেই দেখতে পেল রেখার পরিচিত মুখ বিধান।
অটো ড্রাইভার বিধান বলল' দিদি ,আপনি এতদিন পর?'
রেখা বলল'-কিছুদিন স্কুলে যেতে পারি নি গো।'
বিধান বলল 'ভাল ছিলেন তো?'
রেখা বলল "হ্যাঁ ছিলাম এক রকম।'
স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনের খবর হয়ে গেল দু নম্বর প্লাটফর্মে ট্রেন আসছে। রেখা ছুটতে শুরু করলো।
ট্রেন থামতেই রেখা যাত্রী নামার পর উঠে পড়ল গাড়িতে ।তারপর জিজ্ঞেস করতে লাগল কে কোথায় নামবে ।
এক যাত্রী বলল 'সে মদনপুর নামবে।
রেখা তার দিকে মুখ করে দাঁড়াল আর বলল'আমাকে জায়গাটা দেবেন দিদি।'
রেখা তার জায়গার দিকে দাঁড়িয়ে একটা ফোন করল রিম্পাদিকে।রিম্পাদির ফোন কল হয়ে গেল সাড়া দিল না।
এরপর রিম্পাদি নিজেই ঘুরিয়ে রেখাকে ফোন করল
। রেখার ফোন বেজে উঠল' 'আমি কার, কে আমার ,কি যে তার আমি হই..?'
রেখা ওই সময় ব্যাগের থেকে ফোন বের করতে করতেই ফোনটা কেটে গেল ।ইতিমধ্যে সেই দিদি মদনপুরে নামার জন্য তৈরি হতে লাগল । লাগেজ গুলো সব নিজের কাছে রাখলো,উপর থেকে নামাল এবং ধীরে ধীরে গেটের কাছে এগোতে লাগল।ভদ্রমহিলা উঠে যেতেই রেখা সেই জায়গায় বসল ।এরপর নিজে মিসকলটা দেখে ফোন করলো।রিং হতেই রিম্পাদি ফোন তোলৈ।
রেখা জিজ্ঞেস করল' তুমি কি কৃষ্ণনগর লোকালেই আছো?'
রিম্পাদি বলল 'হ্যাঁ আছি।'
রেখা বলল 'সামনের লেডিসে আছো, না পেছনে লেডিসে আছো?'
রিম্পাদি বলল 'সামনের। তুই?'
রেখা বলল' পেছনের।'
রিম্পাদি বলল 'ঠিক আছে।'
রেখা সে বলল ' স্টেশনে নেমে কথা হবে।'
রিম্পাদি বলল' হ্যাঁ রে ,তোদের কম্পার্টমেন্টে
স্মৃতিদি আছে?'
রেখা বলল 'কই নজরে পড়ছে না তো। কেন কিছু দরকার আছে?'
রিম্পাদি বলল 'আরে গত বছর যে সোয়েটারগুলো নিয়েছিলাম ।মনে আছে তোর ব্লু কালারের?'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,তুমি আমি সেম কালারের নিয়েছিলাম।"
রিম্পাদি বলল 'আর ও দুটো কালার নেব আমি ।সেটা এবছর আছে কিনা?'
রেখা বললো' তোমার নিজের জন্য ,না অন্য কারো জন্য?'
রিম্পাদি' আরে না। মাসতুতো ননদ নেবে।'
রেখা হেসে বলল 'আচ্ছা।'
রিম্পাদি বলল 'যদি দেখা হয় তাহলে এই কথাটা বলে দিস ,কেমন?'
রেখা বললো' ঠিক আছে। রাখছি।
রিম্পাদি বলল 'ওকে'।
রেখা জায়গাটাকে পেয়ে ঘুম দেবে বলে চোখটা বুঝলো।
ক্লান্ত শরীরে ঘুম এতটাই পেয়েছিল যে স্টেশনে গাড়ি পৌঁছালে সব যাত্রী খালি হয়ে যাবার পর হঠাৎ বাইরের প্যাসেঞ্জার সব উঠতে শুরু করলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি রেখা নেমে পড়ে।
কিছুটা দূর স্টেশনের দিকে এগোতে রিম্পাদি দেখল সেই পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি একটু এগিয়ে আসলো তারপর দুজনে হেসে কথা বলতে শুরু করল ওভার ব্রিজ পেরিয়ে এবার টোটো ধরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
রিম্পাদি বলল জানিস তো'কাল এ আই অফিস থেকে যে নতুন স্যার এ আই হয়ে এসেছেন। তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করছিলেন?'
রেখা বুঝতেই পারল একাধিক যার কথা বলছে সে তার কত পরিচিত।
রেখা কোন উত্তর করলো না।
রিম্পাদি বলল 'কিরে শুনতে পাচ্ছিস কি বললাম?'
রেখা বলল' হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।'
রিম্পাদি বলল ' বারবার বড়দিকে জিজ্ঞেস করছিলেন আপনাদের রেখা ম্যাম নেই?'
বলতে বলতেই টোটো এসে স্কুল গেটের কাছে দাঁড়াল।