উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৪২
আনমনে বিয়ে বাড়ি
মমতা রায়চৌধুরী
ঘরটা কেমন গুমোট লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে কল্যাণের কল্যাণের। খোলা জায়গায় যেতে পারলে খুব ভালো হতো, এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না ।সানাইয়ের সুরে আনন্দের বন্যায় ভেসে যাওয়ার কথা ছিল। এই দিনটার জন্যই চির আকাঙ্খিত ছিল মন প্রাণ । যে দিনটার প্রত্যাশায় এতগুলো দিন গুনেছে। অথচ কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। কল্যান ভাবছে 'তবে কি শিখাকে চায় নি?
এখনও কি মনে মনে প্রভাকেই চায়।
এরপর পাগল হয়ে যাবে। অথচ প্রভা ও তার জীবনটাকে নিয়ে খেলেছে ।বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে নি। যে দুরন্ত ঝরনার বেগে এসেছিল। সেই গতিতে কল্যান ও ভেসে গেছিল।
আজকে কেন এসব কথা মনে করছে, এটা তো একদমই ঠিক হচ্ছে না। বিয়ের পরপরই যেতে হবে চেন্নাই ।ফ্লাইট এর টিকিট কাটা হয়ে গেছে। গলাটার কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
ঘরেতে মন টিকছে না।
বিকেল বেলায় ছাদে পায়চারি করে আসি। সারা বাড়ীতে লোকজন ভর্তি কোথাও একটু একা থাকার উপায় নেই ।আজকে বড্ড একা থাকতে ইচ্ছে করছে। এই কথা ভাবতে ভাবতে কল্যাণ তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে এমন সময় সরজু বলল"আরে এই সময় কোথায় যাচ্ছিস?"
একা কোথাও যাবিনা।'
'ওহ,দিদি, আমি তো একটু ওপরে যাচ্ছি।'
'তাহলেই বা তুই একা কেন যাবি? তোর জাইবু কোথায় গেল?
এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যাবে না, কতবার বলেছি এই সময় কল্যাণের কাছে কাছে থাকবে আমার কোন কথা শোনে?'
কল্যান মনে মনে ভাবছে 'একটু একা থাকতে চাইছে। ,দিদি ,আবার কি যে করতে চাইছে না একদম ভালো লাগে না।'
'ঠিক আছে সন্ধ্যার আগে নেমে আসবি।'
'তোর জাইবুর কপালে ভীষণ কষ্ট আছে, দেখ না?'
', জাইবু ,দিদি হেব্বি ক্ষেপে আছে। আজ তোমার কপালে চরম কষ্ট। সত্যি বাবা, বিয়ে করা মানে একটা ঝুঁকি আর অধিকার ফলানো ,ওহো।'
ছাড়া পেয়ে কল্যান উপরে চলে আসলো ।ছাদে দাঁড়িয়ে দিগন্তবিস্তৃত আকাশটাকে দেখল।
একদল পাখি উড়ে যাচ্ছে বেলা শেষে তারা নিজেদের ঠিকানায়।
কল্যান উদাস দৃষ্টিতে যতদূর দেখা যায় তাদের ততদূর পর্যন্ত দেখল।
তারপর ভাবল প্রত্যেকেরই একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে স্থান আছে। কল্যাণের ও ছিল ।কল্যান চাইতো এরকম একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থান থাকুক যেখানে তারা পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে ।ভালোবাসার ,বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হবে। সারাদিন ক্লান্তি শেষে নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় যেখানে আলতো করে ভালোবাসার ছোঁয়া ঝরে পড়বে চোখে মুখে।
শিখা কি সেই জায়গাটা তৈরি করতে পারবে?শিখা খারাপ মেয়ে নয়। যতদূর তাকে দেখেছে, তাতে মনে হয়েছে পরিবারের প্রতি সঠিক দায়িত্বই পালন করবে এ তার বিশ্বাস।'
কিন্তু…?
'সিগারেট খাওয়া বারণ আছে কিন্তু বিকেলের এই মুহূর্তে যে সিগারেটের নেশাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আরো নস্টালজিক হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।'
'প্রভা যত তোমাকে সরিয়ে দিতে চাইছি, প্রভা ততই আমার সারা শরীরে দ্যুতি ছড়াচ্ছ'।
মনে পড়ে একদিন সেই রাতের কথা। প্রভার কথা। বলা যায় অনেকটা জোরজবস্তি করেই প্রভা কল্যানের ফ্ল্যাট দেখতে এসেছিল। সেটাও বেশ খানিকটা রাত্রে। ওর ভেতরে যে কি ছিলো কিছুতেই না করতে পারতাম না। ওর চোখের দিকে তাকালেই যেন সবকিছু এলোমলো হয়ে যেত।
কত সন্তর্পণে সেদিন আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিলাম।
রুমে ঢুকতেই প্রভা বুকের কাছে আছড়এ পড়েছিল ।কল্যাণের ভেতরেও রক্ত ক্রমশ গরম হয়ে উঠছিল কেমন যেন একটা নাচন ধরে গেছিল। প্রভা কল্যাণকে আরো পাগলের মতো আঁকড়ে ধরে ছিল ,ঠোঁটের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়েছিল সারা অঙ্গে ।কল্যান কি করবে ভেবে উঠতে পারছিল না ।সত্যি ভেবে উঠতে পারছিল না কি করা উচিত? কল্যাণের ভেতরেও তখন কালবৈশাখী ঝড় সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে পারে বাধা , রীতিনীতির আড়ষ্ঠতা,সংযম। কিছু একটা বিপর্যয় যখন তখন ঘটে যেতে পারে এমন সময় বেজে উঠল ফোন দুজনাই ছিটকে গেল পরস্পরের কাছ থেকে। সত্যি সেই সময় যদি ফোনটা না আসতো তাহলে যে কি ঘটত ঈশ্বর ও বোধহয় জানেন না। তারপর অনেকক্ষণ পরস্পর পরস্পরের দিকে তারা তাকিয়ে ছিল হাতে হাত রেখে ।প্রভা যেন তার চোখের হাসিতে অনেক কিছু বোঝাতে চেয়েছিল কিন্তু কল্যাণ আর বুঝতে চায় নি ।কারণ কল্যান জানে এটা কখনো সম্ভব নয়। সেদিন রাতের বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে গেছে দুজনে ই ।হয়তো ঈশ্বর সেটা চেয়েছিলেন নইলে আজকে কি নিজেকে ক্ষমা করতে
পারত ? যদিও সেদিনের বিপর্যয় ছিলনা কোন ভন্ডামী ।ছিল না কোন ভেতরের কলুষতা। দুটি মন দুটি হৃদয় এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছিল। পাগল পাগল লাগছে প্রভা ।আমি আজও তোমাকে ভুলতে পারিনা ।তোমার সেই আঁকড়ে ধরা তোমার সেই ভালোবাসায় একে দেওয়ার টিকা। আমি পারি না ।ভুলতে পারিনা। আমি জানি না কি করে আমি সংসারী হব। হয়তো সংসারী হব কিন্তু মনের ভেতরে হয়তো তুমি থেকেই যাবে। কেন এরকম করলে তুমি আমার সাথে ?প্রভা আমি তো কখনো তোমাকে ধোঁকা দিতে চাই নি ।অথচ তুমি আমার সাথে কেন জীবনটা নিয়ে খেললে ?আমি তোমাকে তো ভীষণ ভালবেসেছিলাম প্রভা। আজও হয়তো ভালোবাসি ,নইলে তোমার কথা কেন বারবার আমার মনটাকে নাড়া দিয়ে
যায় ।বসন্ত আসলে বাসন্তিক নানা রঙ যেন আমার মন প্রাণ গ্রাস করে। পলাশ শিমুল আমাকে পাগল করে দেয় প্রভা ।তুমি যে জীবনটা বেছে নিয়েছ তাতে কি তুমি সুখে আছো ?অথচ আমরা তো চেয়েছিলাম ছোট্ট একটা ভালোবাসার নীড় গড়ে তুলবো পরস্পর পরস্পরে। কেন করলে তুমি এসব?
কল্যাণের চোখে তখন জল ।বুকটা যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় ছাদে আসার কারোর আওয়াজ পেল 'হ্যাঁ ঠিক তাই জাইবু কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে উপরে উঠে আসছে।'
'কিরে তোদের কি খবর? তোরা এখনো আসলি না কবে আসবি?
বিয়ে পেরিয়ে যাক তারপর আসিস। ফাঁকা মাঠে গোল দিস।'
অপরপ্রান্ত থেকে কি বলছে বুঝতে পারছে না। তবে অনুমান করতে পারছে কল্যান ।যাই হোক কাউকে বিয়েতে আসার জন্য বলছে।'
"আরে নিশা কে নিয়ে তুই আসবি কিনা আগে
বল ?বাসর রাতে কিন্তু নিশার গান শুনবো মাথায় রাখিস ।আমি কোন কথা শুনতে চাই না জমিয়ে আড্ডা দেব কালকে আসবি তো?
'দেখি না ,তোদের আগেই বলেছিলাম এক সপ্তাহ আগে আসতে আর বিয়েএসে গেল তবু তোদের পাত্তা নেই।'
ধুত্তোর রাখ তো তোদের কাজ। সারা জীবনই কাজ থাকবে।,, লোক ,-লৌকিকতা ও তো রাখবি নাকি?
'ঠিক আছে ,ছাড়ছি যদি না আসবি আর তোদের সাথে কোন কথা নেই।'
কল্যাণ ভাবছে জাইবু তো রীতিমতো একদম রাশিয়া-ইউক্রেন এর মতো একে অপরকে হুমকি দিচ্ছে।
ফোন ছেড়ে দিয়ে কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বলল "ভাইয়া আজকে তোমার দিদির কাছে যা ঝাড় খেয়েছি জীবনেও ভুলতে পারবো না ।বাপরে বাপ।'
"দিদি তোমাকে বকেছে জাইবু ?"
"হ্যাঁগো ভাইয়া, দাঁড়াও তুমিও ফাঁসির দড়ি পড়তে চলেছ। তখন এত হাসা বেরিয়ে যাবে আজ আমাকে দেখ হাসছো তো 'ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে।'
শিখা ,আসুক তারপর তোমার হবে।
থাক তোমাকে আর বেশি কথা বলতে হবে না তোমার তোমার গলার অবস্থা।'
"এবার ভাইয়া বলতো হঠাৎ চুপি চুপি ছাদে কেন আসলে? কল্যাণ মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল এমনি।
না না কিছু তো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। তাই তো তুমি বাবা ছাদে এসেছিল কাউকে আবিষ্কার করতে?'
কল্যান মনে মনে ভাবছে 'একি জাইবুর চোখে ধরা পড়ে গেল?'
চলো, চলো, চলো, নিচে চলো ।তোমার দিদি কিন্তু রেগে লাল হয়ে যাবে ?'
'তোমায় তো কিছু বলবে না? যা কিছু আমার জন্যই তোলা আছে ।'
কল্যান বলল'জাইবু তুমি কি দিদি কে ভয় পাও,,?
কি বলছিস ?
'ওই অবলা নারীকে
এমন সময় দিদি এসে বললো'তোমরা চা নাস্তা চা নাস্তা খাবে তো?
আরে ভাই তুই কি খাবি?
দিদি, ধমকের সুরে জাইবু কে বলল,, কি হল তুমি উঠলে না। ফোনটা একটু রাখো না কাজের কথা বলছি তো?
গজ গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে
গেল । এমন সময় হইহই করে ঢুকলো ঢুকলো ছোটো পিসি।
কই রে সরজু,কল্যাণ সব কোথায় তোরা?
ওরে বাবা ছোটো পিসি এসে গেছে।
যাই না হলে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেবে।
এই তো পিসি যাই।
সরজু গিয়ে ছোট পিসি কে প্রণাম করলো।
বেঁচে থাক মা ,কল্যাণ হোক।
কল্যান টা কোথায় গেল রে? নাকি ওর বিয়ে বলে খুব পা ভারী হয়েছে।'
'না গো পিসি ওর গলাটা তো ভালো নেই ,সেজন্য একটু মুষড়ে আছে।'
বিয়ে তো অতটা উচ্ছ্বাস নেই।'
"সে কিরে গলায় কি হয়েছে ?কিছু জানাসনি তো?"
"গলার একটা কড গেছে একদম।
অপারেশন করাতে হবে।'"
বিয়েটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম।যাই হোক শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হচ্ছে ।না বাবা ,এখনও বলবো না কারণ যতক্ষণ না হয়।'
"না ,মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল রে ।ডাক্তার দেখিয়েছিস তো ?যাইহোক ডাক্তার যেভাবে বলেছেন সেভাবে চলতে হবে।'
"লাগেজ গুলো কোথায় রাখবো?"
"ঐতো পাশের ঘরটায় রাখো। "শোন,আমি যখন এসে গেছি। বিয়ে হবেই, হবে ।এখন বিয়ের যাবতীয় সব প্রস্তুতির জন্য যা করার দরকার সেগুলো তো এখন কোমর বেঁধে লেগে পড়ি।
তত্ত্ব সাজানো অনেক কাজ বাকি আছে।"
তোমরা এসেছ এটাই ভরসার কথা। চলো আগে ফ্রেস হও , নাস্তা পানি খাও।তার পরে গুছিয়ে নিও।"
"ছোট পিসি অমিত দা আসলো না।"
ছুটি পায়নি?'
'না রে ছুটি পায় নি ।তাই তোর পিসেমশাই আর অমি আসবে বিয়ের দিন।'
মেহেন্দি লাগাকে রাখনা…, ডো লি সাজাকে রাখনা…।'
গান করতে করতে পিসি বাথরুমের দিকে
গেল ।
'পিসি সেই আগের মতই স্প্রিট ধরে রেখেছে পিসি না আসলে যেন বিয়েবাড়ির আড্ডাটাই জমে না।