২৬ মার্চ ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৭৭




ধারাবাহিক উপন্যাস 

শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭৭)
শামীমা আহমেদ 

অফিসে নিজ রুমে পৌঁছাতে  শিহাবের প্রায় সকাল এগারোটা বেজে গেলো। শিহাব দ্রুতই তার মেইল চেক করতে বসে গেলো। গতকাল বেশ কিছু বায়ার ফ্যাক্টরী পরিদর্শন শেষে  মেইলে তাদের মতামত জানাবে বলে বিদায় নিয়েছে।আর এর সাথে শিহাবের ফ্যাক্টরির  জন্য অনেক অর্ডার প্লেস হওয়াও জড়িত। শিহাবের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল তাদের স্যাটিসফাই করার। দেখা যাক,তাদের কেমন রেস্পন্স আসে। তবে এখনো কোন মেইল ইন করেনি। শিহাব অপেক্ষায় রইল। কবির এসে নাস্তার কথা জেনে গেলো।
শিহাব নান রুটি আর বুটের ডাল আনতে বলে একটু রিল্যাক্স ভঙ্গিতে  চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। শিহাব নিজের জীবনের সবকিছু খুব গভীরভাবে ভাবছে। শায়লা  আর রিশতিনা, অতীত আর বর্তমানের মাঝে শিহাব নিজেকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে। এই একার জীবনের অবসান ঘটাতে চাইছে। নাস্তা আনার আগে কবিরকে এক কাপ কফি দিয়ে যেতে বললো। কবির কফি রেডি করে সামনে দিতেই শিহাব জানতে চাইলো, আচ্ছা কবির তুমি কি আমাকে বলবে জীবনটা কি সহজ না জটিল ? মাঝে মাঝেই শিহাব কবিরের কাছে এমন ভাবনার কথাগুলোর মতামত নেয়। শিহাব জানে,যারা স্বল্প আয়ের মানুষ  তাদের কাছে জীবনের অর্থ খুবই সহজভাবে ধরা দেয়।খুব বেশি চাওয়া পাওয়া তাদের থাকে না।কবির বুঝতে পারলো,স্যারের মনটা আজ বোধহয় ভালো না।কবির জানালো, স্যার জীবনটারে সহজভাবে দেখলেই জীবন সহজ আর জটিলতারেও সহজভাবে নিয়ে সমাধান করলে পেরেশানি কম হয়।কথাগুলো বলে কবির নাস্তা আনতে বেরিয়ে গেলো।  
শায়লাকে একটা  কল করতে হবে। বেশ কয়েকদিন হলো, শায়লার সাথে ঠিকমত কথা হচ্ছে না। শিহাব মোবাইল হাতে নিতেই মেইলের নোটিফিকেশন এলো।শিহাব হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে রেখে ল্যাপটপ স্ক্রিনে  চোখ দিতেই মোবাইল বেজে উঠলো।  শিহাব আড়চোখে দেখে নিলো।শায়লার কল।কিন্তু মেইলটা দেখা জরুরি। শিহাব কলটি কেটে দিয়ে কাজে মনযোগী হলো। 
ওপ্রান্তে শায়লা ভীষণভাবে বিব্রত হলো। আজ এতদিনের পরিচয়ে শিহাবতো কখনো তার কল কাটেনি।ব্যস্ততায় রিসিভ করতে না পারলে পরে কল দিয়েছে।শায়লা বুঝতে পারছে না কেন শিহাব এমন করছে ? কেন তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে ?  তবে কি সে রিশতিনার প্রতি কোন সিদ্ধান্তে এসেছে ? শায়লার ভেতরে ক্রমাগত নানান প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে। শিহাবকে না পাওয়ার আশংকায় ভীষণ উৎকন্ঠা হচ্ছে। কিন্তু  যা-ই হউক না কেন, এ ব্যাপারে শিহাবের সাথে তার কথা হতেই হবে। তার কাছ থেকে সরাসরি শুনতে হবে সে কি চাইছে ? সে তার নিজের পরিবারের মান সম্মানের দিকে না তাকিয়ে শিহাবের জন্য কঠিন সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে। আর শিহাব  ঘরে রিশতিনাকে  নিয়ে তার সংসার জীবন যাপন করছে ? শায়লা অস্থিরতায় ঘরের এপাশ ওপাশ করছে। শায়লা আবার শিহাবকে কল দিলো। তিনবার রিং হওয়াতেই শিহাব কল রিসিভ করলো। আর হ্যালো বলেই শায়লার উত্তরের
অপেক্ষা না করেই বললো, শায়লা আমি একটু বিজি।একটা টেলি কনফারেন্স চলছে। শেষ হলেই আমি কল দিচ্ছি। বলেই সে কল কেটে দিল।রাগে দুঃখে অপমানে শায়লা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।শিহাব যে একরাতেই এমন করে বদলে যাবে শায়লা তা ভাবতে পারছে না। 
তাদের বাড়িতে তার বিয়ের আয়োজন চলছে। তার জন্য গোটা বাড়ি উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। যেখানে শায়লার মন পেতে নোমান সাহেব বারংবার শত কাকুতি মিনতিতে শায়লার কান ভারী করে তুলছে আর সেখানে শিহাবের এমন অবজ্ঞা ভরা আচরণ, শায়লাকে ভীষণ অবাক করে দিচ্ছে।  
দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ মিনিটের টেলিকনফারেন্স শেষ করে বিভিন্ন দিকে শিহাব তার প্রয়োজনীয় মেইল পাঠালো। ঘড়ির কাটা তখন দুপুর বারোটা পার হয়ে গেছে।টেবিলে নাস্তা পড়ে আছে। শিহাব ওয়াশরুম থেকে  ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তায় হাত লাগাতেই শায়লার কলের কথা মনে পড়লো।শিহাব ভাবলো, একেকদিন যে কেমন ব্যস্ততা যায় ! 
সে নাস্তা খেতে খেতেই শায়লাকে কল করলো। 
এই ফোন কলটি শায়লার ভীষণ রকম কাঙ্খিত  হলেও, শিহাবের প্রতি প্রচন্ড অভিমানে শায়লার চোখের  জল উপচে পড়লো।একবার সম্পূর্ণ কল হয়ে যাবার পর দ্বিতীয় কলে শায়লা রিসিভ করলো।কিন্তু নীরবতায় মনের কষ্ট বুঝাতে চাইলো যেন!
শিহাবই প্রশ্ন করলো, শায়লা আমি দুঃখিত তখন তোমার কলটি ধরতে পারিনি।দেখো, অনেক ব্যস্ততা ছিল। তাইতো এই এখন সকালের নাস্তা করছি। শায়লা ভীষণ অবাক হলো। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এলো,আর শিহাব কিনা এখন নাস্তা করছে ! তাহলে শিহাব তাকে এড়িয়ে যায়নি, সত্যিই ব্যস্ততা ছিল। আর সে কিনা শিহাবকে নিয়ে কতকিছুই ভাবলো। 
কেমন আছো তুমি শায়লা ? 
আমি ভালো আছি কিন্তু আমার মনে হয় তুমি আমার চেয়ে আরো বেশি ভালো আছো !
কেন এমন কথা শায়লা? তোমাকে দূরে রেখে তোমার চেয়ে কেমন করে ভালো থাকবো ? 
কেন? আমাকে ছাড়াওতো ভালো থাকা যায়, আর সেটা দোষেরও কিছু না। শায়লার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়লো।
শিহাব বুঝতে পারছে না কেন শায়লা তার সাথে আজ এভাবে কথা বলছে?কিন্তু বরাবরই শিহাব শায়লার সাথে সব ব্যাপারে  স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলছে।তার বুঝতেই হবে আজ কেন শায়লা তার সাথে এতটা বৈরী আচরণ করছে ? তবে কি সে তার কাছ থেকে সরে যেতে চাইছে ? শিহাবের জানা মতে শায়লার স্বামী শীঘ্রই দেশে আসছে।তবে কি শায়লা তার সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন এনেছে? নাহ! শায়লার সাথে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলা প্রয়োজন। শিহাব কথাটি ভাবতেই শায়লার দিক থেকেই প্রস্তাব এলো,শিহাব তুমি আমার সাথে আজ একটু দেখা করতে পারবে।শায়লা দেখলো, শিহাব খুব সুচারুভাবেই রিশতিনার প্রসংঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে।
শিহাব বললো, অবশ্যই, তবে এখুনি বেরুতে পারবো  না।আমার কিছু ইম্পর্টেন্ট আরো কিছু মেইল আসবে।তুমি চাইলে আমার অফিসে চলে আসতে পারো।চলে আসো। আমার অফিসটা দেখে যাও।একসাথে দুজনে কফি খাই। 
শায়লা শিহাবের কথায় অবাক হলো। শিহাব যদি তাকে এড়াতেই চাইতো তবে তো তাকে অফিসে যেতে বলতো না! মূহুর্তেই শায়লার মনে শিহাবকে নিয়ে সব দ্বন্দ্ব ঘুচে গেলো,তবে রিশতিনার বিষয়টি আড়ালেই রইল।
শিহাব পুনরায় শায়লাকে তার অফিসে আসতে অনুরোধ করলো। শায়লা রাজী হয়ে শিহাবের কাছে প্রস্তুতির জন্য সময় চেয়ে নিলো। কারণ  এখন বাড়ির  বাইরে যেতে হলে বাড়ির লোকজনকে ম্যানেজ করতে হবে। যেভাবে রুহি খালা তাকে নজরবন্দি করে রেখেছে। শায়লা বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেতে  রাহাতকে কল করলো।

রাহাত অফিসেই ছিল।শায়লার এমন আব্দারের কল পেয়ে রাহাত বেশ চিন্তিত  হলো। আবার কোন অঘটন ঘটে যাচ্ছে নাতো ? পরক্ষণেই শায়লার উপর তার আস্থা এলো। আপু যদি এমন কিছু করবেতো আর বাইরে যেতে তার অনুমতি চাইতো না। তাছাড়া শিহাব ভাইয়াও খুবই ভাল মানুষ  নিশ্চয়ই তিনি ব্যাপারটা বুঝবেন।ভাল লাগা ভালবাসা হঠাৎই  হতে পারে কিন্তু আমরাতো কেউ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নই।ফোন কলের জবাবে রাহাত শুধু এটুকুই বললো, আপু আমাদের পরিবারের মান সম্মান এখন তোমার হাতে আর দুদিন পরেই নোমান ভাইয়া আসছেন।বাড়িতে অনেজ লোকজন আত্মীয়স্বজন।
শায়লা রাহাতকে আশ্বস্ত করলো, এমন কিছুই ঘটবে না যা পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন করবে। শিহাবের সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।আমি দ্রুতই  ফিরবো। মনে রেখো, আমি চিরকাল নিজের  সুখের চেয়ে তোমাদের জন্যই বেশি ভেবেছি।
কথাটা শতভাগ সত্য বলে রাহাত একমত হয়ে নিশ্চুপ রইল।
শায়লা রাহাতকে অনুরোধ করলো, ঠিক আছে, মাকে  আর রুহি খালাকে কল করে জানিয়ে দিও যেন আমাকে বাধা না দেয়।আমি পার্লারে যাচ্ছি বলে বেরুবো। 
শিহাব ভাইয়া আর শায়লা আপুর জন্য রাহাতের মনটা কেঁদে উঠলো। রাহাত বেশ বুঝতে পারছে, শুধু তার একটু সহযোগিতা থাকলে আপু আর শিহাব ভাইয়াকে এক হওয়া থেকে কেউ ফেরাতে পারতো না। সবকিছু ভেবে রাহাত নিজেকেই দোষী ভেবে নিলো।
ফোন কল শেষ করে শায়লা তৈরি হওয়ায় ব্যস্ত হলো। ট্রুং করে মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। শায়লা মোবাইল মেসেঞ্জার  ওপেন করেতেই মূহুর্তেই তার মনটা আনন্দে উছ্বসিত হয়ে উঠলো!
অফিস এড্রেসের সাথে  দারুণ এক সেল্ফি পাঠিয়েছে শিহাব ! পরনে কালো শার্ট, সামনে কয়েকটি বোতায় খোলা,আহ !  শিহাবকে মনে হচ্ছে যেন কোন মুভির হিরো ! তার অফিসের চেয়ারে বসে তোলা। শায়লা স্থির দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।যেন শিহাবের চোখ কথা বলছে,...তাড়াতাড়ি চলে আসো শায়লা। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much