অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার মতো আকর্ষণীয় মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" পড়ুন ও অপরকে পড়তে সহযোগিতা করুন ।
টানাপোড়েন ( পর্ব-৮ )
চেনা-অচেনা গল্প
রেখা আজ ক মাস পর একটু স্বাভাবিক । দীপ্তিদির মারা যাবার পর ক্রমশই মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করত ।সব পুরুষই প্রায় একইরকম। রেখাকে কাউন্সিলিং করানো হয়েছে ।এখন রেখা আগের মতো স্কুলে যাচ্ছে। একি কাণ্ড যতসব ঘটনা কি রেখার সামনেই ঘটতে হয়।দীপ্তিদির মেয়ে ঋদ্ধিমা কি বাবার গুণটাই পেল?লাজ -লজ্জার মাথা খেয়ে কখনো স্টেশন চত্বরে একটা ছেলের কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে পারে। জানে তো যে ,মাসিমনিরা এখান থেকে ট্রেন ধরে ,দেখতে পেলে কি হবে? আজকালকার মেয়ে সে সব ধর্তব্যের মধ্যে নেই।
রেখাও রিম্পাদি একসঙ্গে রিক্সায় আসে যায় ।
রিম্পা দি বলল 'রেখা এসব ধরতে যেও না তো। দীপ্তিদিদি থাকলে কষ্ট পেত ।সঙ্গে আমরাও।'
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে।
রিম্পা দি বলল 'রেখা ফোনটা তোলো।'
বেরোনোর সময় ফোন আসলে ভীষণ বিরক্ত লাগে। বিরক্তি ভরে ফোনটা রিসিভ করে বলল- হ্যালো'।
ওপারের কন্ঠ ভেসে এলো- 'আমি কি রেখার সঙ্গে কথা বলছি?'
রেখা-হ্যাঁ বলছি। আপনি কে?
ওপার থেকে আবার কন্ঠ হল'-আমি বিপাশা।'
'কোন বিপাশা? 'রেখা বলল।
আরে মনে করতে পারছিস না। আমরা স্কুল লাইফে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি ।ধর্ম ডাঙ্গা বাড়ি।
রেখা-'আরে বিপাশা, কেমন আছিস?
বিপাসা 'শোন না একটা খবর দেওয়ার ছিল।'
রেখা বললো- কি?
আরে এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কাকিমা আর কাকুর খবর নিলাম। ওরা খুব কষ্টে আছে রে? পারলে একবার গিয়ে দেখা করিস। তোর দাদা বৌদি কলকাতার ফ্ল্যাটে চলে গেছে। ঠিক আছে রে ওখান থেকেই তো ফোন নম্বরটা যোগাড় করে ছিলাম। অনেকদিন পর তোর সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো।
ভালো থাকিস।'ফোন কেটে গেল।
'কি উটকো ঝামেলায় পড়লাম বল তো রিম্পা দি।'
রিম্পা দি বলল- 'সে তো বুঝলাম। কিন্তু কাকু কাকিমা বলতে কার কথা বোঝাতে চাইল। যতদূর জানি...?
রেখা কথাটি সমাপ্ত করতে না দিয়েই বলে 'আমার বাবা-মা নয় ।আমার কাকা কাকিমা। আমার বৌদি খুব সুবিধার নয় ।এই জন্য তো আজকাল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু কাকু -কাকিমা খুব করে যেতে বলেন। আমার কাকাতো বোন সোমদত্তা শুনেছি কিছুদিন আগে কাকিমা কাকু নাকি ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে ।
সেজন্য ও যাওয়া আসা ছেড়ে দিয়েছে।
রিম্পা দি বললো 'একবার যাও ঘুরে আসো ,শুনলে যখন।'
রেখা বলল-হ্যাঁ দেখি নেক্সট উইকে যাব। তার আগে মনোজকে বলতে হবে। ওকে তো ছুটি নিতে হবে। রিম্পাদি বলল ,জানো তো রেখা,ওই আমাদের পাশের বাড়ির অনুমিতা। তাকে চেনো তো?
রেখা বলল-আরে হ্যাঁ ,।ওই মুনাইকে পড়াতে আসতো তাই তো?
'একদম ঠিক বলেছ 'রিম্পা দি বলে।
কেন কি হয়েছে গো ?ওর কি বিয়ে ঠিক হয়েছে? মেয়টি কিন্তু বেশ।
রিম্পাদি চুপ করে থেকে বলল- 'জান তো একটা ঘটনা ঘটেছে।'
রেখা উৎসুকভরে বলল - কি?
এই যা ট্রেন ঢুকে গেছে। রেখা তাড়াতাড়ি ছোটোওভারব্রিজ পেরোতে হবে- বলেই রিম্পাদি ছুটতে শুরু করলো। আর একবার পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করল রেখা কত দূর। রেখা সাথে একজনের ধাক্কা লেগে গেল। ছেলেটি বলল আরেকটু আগে বের হতে পারেন না ।ট্রেন ঢুকলেই আপনারা ছুটতে শুরু করেন।
রেখা বলল- সরি সরি।
ছেলেটি আপন মনে গজগজ করতে লাগলো। ইতিমধ্যে রেখা কম্পারমেন্টে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দুটো সিট ও পেয়ে গেছে। এবারে রেখা জলের বোতলটা বের করে একটু জল খেয়ে নিল ।তারপর বললো 'এই বলো না কি হয়েছে?'
রিম্পাদি বলল-'আরে যে ছেলেটির সাথে সম্পর্ক ছিল সেই ছেলেটি তো এখন চাকরি টাকরী পেয়েছে। এখন তো ওকে আর পাত্তা দিচ্ছে না। এদিকে হয়েছে কি অনুমিতা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। ও আমার কাছে এসেছিল। কি সিদ্ধান্ত নেবে বুঝে উঠতে পারছে না।'
রেখা মাথায় হাত দিয়ে বলে 'সর্বনাশ। ওই ছেলে কী অন্য মেয়ের প্রেমে পড়েছে নাকি?
রিম্পা দি বলল 'হ্যাঁ ।তাছাড়া আবার কি। শরীরটা পাওয়া হয়ে গেলে কি আর কোনো চাহিদা থাকে। এবার মেয়েটার কী হবে বল তো?
রেখা বলল 'এবরশন করে নিক না।'
রিম্পা দি 'হ্যাঁ সেটা আমিও বলেছি।'
কিন্তু ওর মনে একটু কিন্তু কিন্তু আছে ।একে তো বাচ্চাটা ম্যাচিওর করে গেছে আর সমানে বলছে ,ওর ভালোবাসার স্মৃতি ।ও এবরশন করবে না ।এখন রিক্স ও আছে। একটা কাজ খুঁজছে।আর বলছে যে এখন তো সিঙ্গেল মাদার হওয়া যায় ।নিজেই বাচ্চাকে মানুষ করবে। ভাবো একবার।
রেখা বলল- 'কেন ও কি সারাটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে নাকি?
রিম্পা দি বলল-ও বলছে একজন জীবনে তাকে ঠকিয়েছে ।আরেকজন যে ঠকাবে না, তার কি মানে আছে? তাছাড়া সুমিতকে যথেষ্ট ভালোবাসে ।ও যদি কখনো ফিরে আসে ।আবার ওকে গ্রহণ করবে।
রেখা বলল-বাবা এত ফিল্ম কা কাহিনি গো
রিম্পাদি।
মেয়েটার মা নেই মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসত সুমিতকে।
রেখা একটু কৌতূহল পরে জিজ্ঞাসা করল 'এটা কোন স্টেশন গেল? এই যা কল্যাণী এসে গেছে। আমি উঠছি তুমি সাবধানে যেও। আরে বাবা একটু সাইড দিন না আমি তো সামনে নামবো।একটু সরে কথা বলুন না -বলেই ,তাকিয়ে দেখে আর বলে ' দিব্যেন্দু না? বেচারা পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছে। বালিগঞ্জে বাড়ি না? আরে শিখাকে চেনো তো? হ্যাঁ ,করে তাকিয়ে আছে রেখার দিকে। রেখা হাসতে হাসতে নেমে চলে গেল। জানালার কাছে গিয়ে রিম্পাদিকে ইশারায় দেখিয়ে বলল 'রোমিও জুলিয়েট তোমার সামনে ।তাকিয়ে দেখো ।পরে বলব। বাড়ি ফিরে এসেই রেখা ভেবেছিল একটু রেস্ট নেবে। কিন্তু না পুটু কাজে আসেনি। সারা দিন পর বাড়ি ফিরে এসে একটু ফ্রেশ হবে কি সেখানে রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। রেখার তো চক্ষু চড়কগাছ। কি করবে এখন। এজন্যই কাজের লোক একদম পছন্দ হয়না। কিন্তু কিছু করার নেই রাখতেই হবে। কাজের মেয়ে সেটা ভালই বোঝে। তুমি মুখে হম্বিতম্বি করুক পুটু কে ছাড়া চলবে না। রেখা মনে মনে পুটুকে কিছু গালমন্দ করে নিল। কাছে সে মনে মনে ভাবল পুটুকে ছাড়া তো চলতেওপারবে না
কামাই একটু বেশি। কিন্তু মেয়েটি বিশ্বস্ত। তাছাড়াও কি কোন দায়িত্ব দিয়ে গেলে সেটা ভালো ভাবে পালন করে। মোদ্দাকথা পুটু হলো রেখার ভরসার পাত্র।তাই
বলে কাজ কামাই করে, একা মনে মনে গজগজ করলেও পুটু আসলে হেসে কথা বলে। শুধু তাই নয় ফ্রিজে মিষ্টি তরকারি সমস্ত কিছু রেখা রেখে দেয় পুটুর জন্য। রেখা ভাবতে লাগলো আগের দিনের বৃষ্টিতে ভেজার পর পুটুর শরীর খারাপ হয়নি তো? পটু এই সময় কামাই করলে রেখার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রেখা কাজ করতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো কতদিন বলেছে একটা ফোন নম্বর দিয়ে যেতে। সে কার কথা শোনে।
আর ভাবতে লাগলো কালকে যদি না আসে তাহলে 10 ক্লাসের চেকলিস্ট এর সই করানো আছে মেয়েদের কি যে হবে কে জানে? না আজকে কাজ গুছিয়ে রাখতে হবে পুটুর ভরসায় থাকলে হবে না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। রিং হয়ে গেল। রেখা বিরক্তিভরে ফোনটা রিসিভ করল। হ্যালো'।
শোনো ,আজকে আমার ফিরতে দেরী হবে। আমি একটু হসপিটালে আছি। বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
রেখি আপন-মনে এক গজ গজ করতে করতে বলল অন্তত কার কি হয়েছে সেটা তো বলবে। মিনিমাম ভদ্রতাবোধটুকু পর্যন্ত নেই যে চিন্তা করবে।
শুধু একটা ফোন করে দিয়েই খালাস ।কার কী হলো,কে জানে? অজানা অচেনা চিন্তায় রেখার মন ডুবেগেল।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"৮ ক্রমশ