টানাপোড়েন ৬৪
মন কাড়া উৎসব
জীবন নদী পারাপারে কত বাধা-বিপত্তি সংগ্রাম ,টানাপোড়েন এ তো চলতেই থাকে। জীবনটাই যেন যুদ্ধক্ষেত্র। তবুও মানুষ এসব ভুলে গিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে।রেখার ভাবনায় আলোড়ন তোলে রেখার জা।
সাতসকালে রেখার জা রীতা হঠাৎই চিৎকার"আরে বাবা গুরুদেব আসবেন ।আর সিঁড়ির অবস্থা যদি এরকম থাকে। '
রেখা জানলাগুলো বন্ধ করে দিতে লাগলো।
মনোজ অবাক হয়ে বলল''জানলা বন্ধ করছো কেন?'
রেখা বলল' যাতে কোনো চিৎকার কানে না আসে?'
মনোজ বলল' এটা তো নিত্যকালের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের ঝামেলাটা কে করছে জেঠিমা ?নাকি তার ছেলের বউ?'
রেখা বলল 'তোমার সাধের বৌদি ভাই।''
মনোজ বলল 'এতে কি লাভ আছে বলো তো? কে যে ক'দিন থাকে পৃথিবীতে ?তার আবার লড়াই?'
রেখা বলল' যাই দেখে আসি কেন চিৎকার করছে?'
রেখা মনোজকে বলল 'গরম জলের ভ্যাপারটা নেবে?'
মনোজ বলল 'না আগে তুমি দেখে এসো ।'
রেখা বললো 'তাহলে এসে দেবো কেমন?'
মনোজ একটু হাসলো। রেখা বেরিয়ে গেল। রেখা মিলিদের ওখানে গিয়ে দেখল দুটো বাচ্চা সিঁড়ির কাছে বসে আছে। আর তা নিয়েই সমস্যা।
তুলি ,লিলিকে কোলে করে আবার তাদের সঠিক জায়গায় এনে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
ওপর থেকে রেখার জা সব দেখতে লাগলো।
রেখা কথা না বাড়িয়ে মনোজ যে ঘরে সেই দিকে চলে আসলো।
মনোজ বললে' :কি গো কি হয়েছে?'
রেখা বলল 'কি আর হবে আসলে ওদের পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া না করলে দিনটা ভালো যায় না।'
মনোজ বলল 'রেখা এসো' বসো আমার পাশে।'
রেখা ভালো করে হাত ধুয়ে এসে বসলো।
মনোজ বলল 'তোমাদের গ্রামের পুজোর ছবি দেখলাম সংবাদপত্রে।"
মনোজ বলল 'কেমন কাটালে?'
রেখা বললো' খুব ভালো।'
মনোজ বলল 'আমি অবশ্য এর আগেও গল্প শুনেছি।তোমাদের ওখানে পুজোর গল্প করো একটু শুনি।
রেখা বলল 'ছোটবেলার সেই সোনালী দিনগুলোর গল্প তো তোমার কাছে করেছি। পূজাতে ওখানে যাই নি । তবুও সেখানকার আন্তরিক মনোভাব সত্যি নজর কাড়ে।'
রেখা বলল 'শুধু তাই নয় গো ।এবার নাকি পুজোর থিম ছিল ।নানারকম বিষয়। সেখানে নাকি নারীর মুক্তি বিষয়টাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।'
মনোজ বলল-হ্যাঁ ,পেপারেও সেটা দিয়েছিল।'
রেখা বললো 'জানো তো। আমরা সব সময় শহরের পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকি ।কিন্তু গ্রামের পুজো কমিটির উদ্যোগে কত সুন্দর করে বিষয়গুলো ভাবতে পারে ,তা আমাদের গ্রামে না গেলে কেউ বুঝতেই পারবে না।'
মনোজ বললো 'আর কি কি ছিলো গো ভাবনায়?'
রেখা বলল 'প্রতি বছর পুজোর দিনগুলোতে স্থানীয় গ্রামবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে প্রসাদ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা হয় । এবছরও সে বিষয়টা ছিল।তাছাড়া... ছিল। তাছাড়া আর কয়েকটি অভিনব চিন্তা?'
মনোজ বলল- "কি ?'
রেখা বলল 'যেমন নারীমুক্তির বিষয়টাকে দেখানো হয়েছে ।তেমনি তাদের থিমে ছিল 'মন মেলুক পাখনা ,মেঘ,তারা ,ফুল ,পাখি ,প্রজাপতির অপরূপ সৌন্দর্য আর আলো-আঁধারিকে তুলে ধরা হয়েছিল যেন একটা পরীদের দেশ।'
মনোজ অবাক হয়ে বলল 'তার মানে বলতে চাইছো শিশুদের জন্য মণ্ডপের থিম ভাবনা অনেকেই করে না তাই তো?'
রেখা বলল' একদমই তাই। এখানে শিশুদের উপযোগী করে এক আলাদা যেমন পরীদের দেশ যে ভাবনাটা গড়ে তুলেছে ,তেমনি ছিল কিছু চেনা কার্টুন ।শিশুদের জন্য আনন্দ দিতে।'
মনোজ বলল 'দারুন ভাবনা।'
রেখা একটু উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল 'জানো তো ,এখানে বাংলার শিল্পটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল?'
মনোজ অবাক হয়ে বলল 'বল কি গো?'
রেখা বলল ' তাহলে আর কি বলছি?'
মনোজ বলল' কিরকম 'কিরকম ।রেখার লাল টুকটুকে গাল যেন আহ্লাদে আরো সুন্দর হয়ে উঠলো ।'তারপর খুব প্রফুল্ল চিত্তে বলল বাংলার কুটির শিল্প ঝুড়ি, কুলো, ধামা ,লক্ষ্মীর ঝাঁপি ইত্যাদি দিয়ে বাংলার শিল্পকে তুলে ধরা হয়েছিল।'
মনোজ বলল 'কিন্তু তোমাদের গ্রামের পুজোতে শুনেছি যে সাবেকিয়ানাটাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।'
রেখা বলল' 'ঠিকই শুনেছো ।ওখানে যে একচালা ছিল তাতে ডাকের সাজে প্রতিমা করা হয়েছে।'
মনোজ বলল'ভোগের ব্যাপারটা কি রকম ছিল?'
রেখা বলল :'কোনদিন অন্নভোগ,কোনদিন খিচুড়ি ,কোনদিন পুষ্পান্ন ,বিভিন্ন রকমের ভাজা।'
মনোজ বলল 'কিন্তু তোমাদের নবমী ?নবমীতে তো অন্যরকম ভোগ দেয়া হয়? '
রেখা বলল ' হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি ।প্রথমে নবমীতে দেবীকে অন্নভোগ দেয়া হয়। তার সাথে কচুর শাক আর বিভিন্ন পিঠা ভোগ নিবেদন করা হয়।'
মনোজ বলল 'তাহলে তো বেশ পিঠে খাওয়ার আনন্দটাও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায়।'
রেখা বলল' আর একটা মজার জিনিস কি হয়েছে জানো ?এবার নাকি বিভিন্ন শহর থেকেও মানুষ এই থিমের পুজো দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিল।'
মনোজ বলল 'তাই?'
রেখা একটু মন খারাপের সুরে বলল শুধু আমরাই যাই না।
মনোজ বলল-'আচ্ছা আগামীবার যাব কেমন।'
রেখা বলল 'কথা দিলে।'
মনোজ বলল 'পাক্কা। যদি এই পৃথিবীর রূপ -রস -গন্ধের আসাদ নিতে পারি।'
রেখা বলল' ভালো লাগে না ছাই। যত সব অলক্ষনে কথা।'
মনোজ বলল'রাগ করছো কেন ?আমি তো এমনি বললাম।'
রেখা বলল' খবরদার ,তুমি আর এই ধরনের কথা বলবে না।'
রেখার মনটা কিছুক্ষণের জন্য একটু যন্ত্রণা ও ব্যথাতুর হয়ে উঠলো।
রেখার কাছে এসে মনোজ বললো 'রাগ ক'রো না রেখা।' মনোজ ও কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।
রেখা মনোজের মনটাকে অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য বলল 'জানো তো ,এবার আমাদের গ্রামের এই পুজো কমিটি 'বিশ্ববাংলা শারদ সম্মান' পেয়েছে।'
মনোজবললো-এইসব পুরস্কার পেলে কাজের প্রতি নিষ্ঠা ,ভালোবাসা ,অনুরাগ জন্মায়।'
রেখা বলল' আর একটা কথা বলা হয় নি। জানো তো?
মনোজ বললো 'কি?'
রেখা বলল 'বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে সচেতন করতে একটা থিম ভাবনা করেছিল?'
মনোজ বলল 'বাহ' একটা সচেতনতামূলক বার্তা সমাজের স্তরে পৌঁছে দেবার চেষ্টা। মহতী ভাবনা।'
এরমধ্যে মনোজের ফোন বেজে উঠলো।
রেখা বলল' কে ফোন করছে?'
মনোজ একটু মনে মনে ভয় পেতে লাগলো আবার কি তিথি ফোন করেছে? উফ্ ফ, আর পারা যাচ্ছে না।
রেখা বললো ' কি?'
মনোজ বলল' দেখ তো ফোনটা কে করেছে?'
রেখা একটু অবাক হয়ে বলল 'তোমার ফোন আমি ধরবো ?আমি তোমাকে ফোনটা দিচ্ছি।'
মনোজ বললো 'কি বলো না রেখা ।আমার ফোন তুমি ধরবে না তো, কে ধরবে?'
রেখা আমতা আমতা করে বললো' না মানে...।
মনোজ বললো 'বুঝেছি তুমি সেই দিনের' ব্যাপারটা আজও মনের মধ্যে পুষে রেখেছে না?'
রেখা বলল' আচ্ছা দাঁড়াও দিচ্ছি ফোনটা?'
দু তিনবার মিসকল হয়ে গেল।
এবার রিং হতেই রেখা ফোনটা মনোজের কাছে দিল।
মনোজ একটু বিরক্তিভরে বলল 'হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে কন্ঠ ভেসে আসলঃ কিরে কি খবর?
মনোজ বলল 'ভালো আছি। তুই কেমন আছিস ব্যাটা?'
সুরঞ্জন বলল আমি তো ভালো আছি কিন্তু তোর কোন খোঁজ খবর পাচ্ছি না ,ফোন পাচ্ছি না এই জন্য আজকে ফোনটা করলাম।'
মনোজ বললো' ও তাই ?তা তুই কবার ফোন করেছিস?'
সুরঞ্জন বলল 'আচ্ছা ,আমি যদি না করে থাকি, তাহলে তুই করলি না কেন ?আজকে তো আমি ফোনটা করলাম।'
মনোজ বলল 'দেখতেই পাচ্ছি। বৌদি কেমন আছে রে ?শিখা, বৃষ্টি, ওরা সবাই ভালো তো?'
সুরঞ্জন বলে 'সবাই ভালো আছে। রেখা কেমন আছে রে?'
মনোজ বলল 'ওই আছে একরকম।'
সুরঞ্জন বলল 'কেন এরকম বলছিস? রেখাকে ফোনটা দে তো ।ওর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে।
মনোজ অবাক হয়ে বলল ' কার বিরুদ্ধে,?'
সুরঞ্জন বলল' কে আবার তোর সহধর্মিনী।'
মনোজ অবাক হয়ে বলল 'ও আবার কি করেছে?'
সুরঞ্জন বলল 'ওর লেখা আমরা পাচ্ছি না ।কি করছে?'
মনোজ হো হো করে হেসে উঠলো।
মনোজের এই প্রাণখোলা হাসিটা একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। সুরো, ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলাতে দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব তো কতটা ভালো তা প্রমাণ করে।
এরমধ্যে আবার বাইরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
মনোজ একটু দৃঢ়ভাবে বলল রেখা দিকে তাকিয়ে 'দেখ তো বাইরে কি হচ্ছে?'
রেখা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে দেখল?
সুরঞ্জন বলল'চুপ করে গেলি কিছু হয়েছে?'
মনোজ বলল 'ও একটু ব্যস্ত ছিল। এখানেও ছিল না ।নিজের বাড়িতে গেছিল।'
সুরঞ্জন বলল' ও তাই?'তোরা দুজনে কি করছিলি?'
মনোজ বলল-'ওর গ্রামের পূজোর গল্প শুনছিলাম।'
সুরঞ্জন বলল 'হ্যাঁ ,এবার পেপারে ওদের গ্রামের পূজা নাম বেরিয়েছে।'
মনোজ বলল' গ্রামীণ ঐতিহ্যটাই অন্যরকম।'
সুরঞ্জন বলল' এ বিষয়ে সহমত পোষণ করি।'
মনোজ বলল'জানিস শুরু এবার নিজের বাড়িতে গিয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছিল। নেহাত আমার..?
সুরঞ্জন বলল 'সে কিরে ?তোর আবার কি হয়েছে ?সত্যি কথা বল তো?'
মনোজ একটা মেসেজ ফরওয়ার্ড করল সুরঞ্জন কে।
তারপর বলল 'তোর মেসেজটা চেক কর বুঝতে পারবি?'
সুরঞ্জন মেসেজটা খুলে দেখে'Manoj your covid-19 test result was positive.....
সুরঞ্জন বলল 'ভয় পাবার কিছু নেই।' ডাক্তার যেভাবে নির্দেশ দেন সেভাবে চল।'
এরমধ্যে রেখা এসে তাড়া দিলো' ভ্যাপারটা নাও।'
সুরঞ্জন বলল 'ঠিক আছে ।এখন রেখা যা করতে বলছে ,তাই কর। পরে আমি আবার খবর নেব ।ভালো থাকিস বন্ধু। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।'