শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ২৬)
শামীমা আহমেদ
ঢাকা এয়ারপোর্ট রোড ক্রস করতেই শিহাবের রাত পৌনে দশটা হয়ে গেলো।
শায়লা অপেক্ষায় আছে ভাবতেই শিহাব বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিলো। ভাগ্যিস যানজট নেই! শিহাব বাইক দ্রুত চালিয়ে আজমপুর দিয়ে উত্তরায় ঢুকল। একপাশে বাইক থামিয়ে শায়লাকে মেসেজে জানালো আমি আর দশমিনিটের মধ্যেই আসছি! শায়লাদের বাসার রোডটা শিহাবের চেনাই আছে। প্রায়ই কুশল সেন্টারের ওর অফিস থেকে বেরিয়ে সেক্টর সাত দিয়ে এই পথেই শিহাব নিজের বাসায় ফেরে। শুধু বাসার নম্বরটা মিলিয়ে নিতে হবে। ফোনে শায়লার সেই কান্না জড়িত কন্ঠ এখনো শিহাবের কানে ভাসছে।আজ শায়লসর সাথে দেখা করে তবেই বাসায় ফিরবে। নয়তো রাতে তার কিছুতেই ঘুম হবে না।। শিহাব আজমপুর রোডে ঢুকে রোড নম্বর মিলিয়ে বাইক ঢুকালো। একে একে বাড়ির নম্বরগুলো দেখে এগুচ্ছে।
আজ সন্ধ্যাবেলায় শিহাবের ফোনে শায়লা কেন যে এতটা আবেগী হয়ে উঠেছিল! সে কথা ভাবতে এখন লজ্জাই লাগছে।শিহাব কথা দিয়েছে আজ দেখা করে যাবে। এতে শায়লা ভীষণ পুলকিত! আর শিহাব যখন বলেছে তখন সে আসবেই।শায়লার সে আস্থা শিহাবের উপর আছে। কোনদিন কথা দিয়ে কথা রাখেনি তেমনটি হয়নি। শায়লা বারবার ঘড়ি দেখছিল।কতদূর এগিয়েছে শিহাব জানতে ইচ্ছে হলেও চলন্ত বাইকে কল দিয়ে শিহাবকে বিরক্ত করতে চাচ্ছে না শায়লা। শুধু দেয়াল ঘড়িটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে আর একটা একটা সেকেন্ডের কাঁটার চলন দেখছে। শায়লা মায়ের জন্য রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখলো।মা এশার নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে একটু অবাকই হলো।আজ এত জলদি কেন খাবার দিচ্ছে শায়লা! আবার মাকে খেয়ে নেয়ার জন্য শায়লা একটু তাড়াও দিচ্ছিল।মা ভীষণ বিস্মিত চোখে সব দেখছেন!
হঠাৎ মেসেঞ্জার ট্রুং করে উঠল। রাত পৌনে দশটা! শিহাব কি চলে এলো! হায় মাকে কি বলবে? রাহাতকেইবা কিভাবে ম্যানেজ কিরবে।আর নীচতলার রুহি খালা দেখলেতো আরেক ইতিহাস! হয়তো কানাডা পর্যন্ত খবর পৌছে যাবে।শিহাবের ম্যাসেজে চোখ রাখল শায়লা,
আমি আর দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
শায়লা ভাবলো,
শিহাবের সাথে দেখা করে তবেই সে রাতের খাবার খাবে। শায়লা ঘর আর বারান্দা করছে বারবার।ভেতরে তার হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে! কেমন যেন ভালোলাগা আবার কেমন যেন ভয় ভয় মিশ্রিত চাপা উত্তেজনা।
শায়লা আয়না দেখে চুলটা ঠিক করে নিলো।
পরনের সালোয়ার কামিজটায় একবার চোখ বুলালো।ভেবে নিলো, এতেই চলবে।
শিহাব একে একে বাসার নম্বর দেখে আগাচ্ছিলো। সব বাসার দারোয়ান, কেয়ার টেকারদের উৎসুক দৃষ্টি। শিহাব সব কিছু উপেক্ষা করে, কারো সাহায্য না নিয়ে নম্বর মিলাতে লাগল।ঠিক শায়লাদের বাসার সামনে শিহাব দাঁড়িয়ে নম্বরটা নিশ্চিত হয়ে নিলো।দোতলা বাড়ির। রাস্তার দিকে বারান্দা।
শায়লা কী বারান্দায় দাঁড়িয়ে?
শায়লা ডাইনিং টেবিলে মোবাইলটা রেখে জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে নিলো। শায়লার খুব টেনশন হচ্ছিল। হঠাৎই মেসেঞ্জার ট্রুং কিরে উঠলো,
কি করছেন?
কান্না কি থেমেছে?
শায়লা উত্তর দেয়ার জন্য মোবাইলে হাতে নিতেই পরের মেসেজ চলে এলো!
বারান্দায় আসেন।
শায়লার চোখ ছানাবড়া! উত্তেজনায় পুলকিত! শায়লা মোবাইলটা হাতে নিয়ে এক দৌড়ে বারান্দায় চলে এলো। তার উৎসুক চোখ কেবল শিহাবকেই খুঁজছিল। শায়লাদের বাড়ির বিপরীতে স্বপ্নবাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে বাইক স্টার্ট বন্ধ করছে।সুদর্শন ব্যক্তিটি বাইকের পাশে বসে আছে।। হ্যাঁ, ঐতো শিহাব দাঁড়িয়ে!
শিহাব বাইকে বসে মোবাইল ঘাটছে। শিহাব মাথা নিচু করেই ম্যাসেজ রাখল,কোথায়!
শায়লা উত্তর লিখল, বারান্দায়।
এবার শিহাব বারান্দার দিকে তাকালো।বারান্দার আলো আঁধারিতেও শায়লার চোখ চকচক করছিল। এমন দুঃসাহসিক কাজ কেবল শিহাবকেই মানায়। স্বপ্নবাড়ির দারোয়ান অবাক বিস্ময়ে শিহাবকে দেখছে। কেন লোকটি এভাবে এখানে বাইক থামিয়েছে তা জানতে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
শায়লা দূর থেকে প্রান ভরে শিহাবকে দেখে নিচ্ছে আর ভেতরে একটু একটু করে যেন সিমেন্টের শক্ত ঢালাই হচ্ছে।শিহাব আবার শায়লাকে একনজর দেখার ফাঁকে মোবাইলে মেসেজ পাঠালো, কি এবার কান্না থেমেছে।
শায়লা মাথা ঝুঁকিয়ে জানালো হ্যাঁ, যদিও চোখে তার আনন্দ অশ্রু! মনের সাথে মনের যোগ হলে বুঝি এমনই হয়! ইশারায়ও কথা স্পষ্ট হয়।
স্বপ্নবাড়ির দারোয়ান শিহাবের প্রতি খুবই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে।কিন্তু শিহাব চাইছে না ওরা বুঝে যাক।
শায়লা অবাক দৃষ্টিতে শিহাবকে দেখছে।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতি থেকে আলোর বন্যা বইছে।শিহাবের মুখখানি জ্বলজ্বল করছে! শিহাবের পরনে গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। ধবধবে অবয়বে তাকে দেখতে দারুন লাগছে! শায়লা বুঝে না কেমন করে এমন হলো! কোনদিনতো এভাবে কোন ছেলের দিকে সে তাকায়নি।
কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পরে,
শিহাব ভাবলো, অকারণে কারো বাড়ির সামনে বসে সবার মধ্যে একটা সন্দেহ সৃষ্টির কী প্রয়োজন? দশ মিনিট পর শিহাব মাথা দুলিয়ে যাবার অনুমতি চাইলো। শায়লা মাথা ঝুঁকিয়ে অনুমতি দিলো।যদিও ভেতরে তার দীর্ঘ চাওয়া, তবুও এটুকু প্রাপ্তিও কম কি? শায়লা অনুমতি দিতেও প্রচন্ড শব্দে হর্ণ বাজিয়ে বাইকটি ছুটে চললো। শায়লার মনে হলো, হঠাৎ করে কী যেনো হারিয়ে গেলো!
তবুও শিহাবের শায়লাকে মনে করা, কাছে আসা, যেন সারাদিন শায়লার অপ্রাপ্তির দোলনচাঁপার গাছে রাত শেষে হলে পুস্পরাগে প্রভাতের আলোয় বিকশিত হলো! বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার আলসেমিতে উনুনের দুধটুকু শুকিয়ে গেল। কেমন যেন একটা উত্তাপ শায়লার সারাদেহে ছড়িয়ে গেলো!
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much