উপন্যাস
টানা পড়েন ১৪৯
খুশির হাওয়ায় লাগল নাচন
মমতা রায় চৌধুরী
২৫.৩.২২ রাত্রি ৮ ২৩.
গতকাল এত রাত হয়ে গেছিল শুতে, যে ভোরবেলা আর উঠতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু উঠতে তো হবেই আজকে তো দেশের বাড়িতে যেতে হবে। ঘুমের চোখে হাতরে হাতরে মোবাইলটা বের করল টাইম টা দেখলো। ভোর ৪:৩০ বাজে। একবার রেখা মনে মনে ভাবল মনোজকে ডেকে তুলবে? পরক্ষণে ভাবল না ,না ওকে ডাকলেও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে না। বরং অকালে ঘুম থেকে তুলে সমস্ত কিছুই বন্ধ হয়ে যাবে। থাক ও ঘুমাক। কিন্তু এটা তো শিওর হতে হবে আদপে যাবে কিনা? দোমনা করে মনোজকে গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো'কি গো, অ্যা ই
আজ যাবে তো কাকু কাকিমার ওখানে।"
"হু'।
কিন্তু ঘুমের ঘোরে কথা তো বিশ্বাস করাও যায় না। সকালে উঠেই হয়তো মত পাল্টে দেবে।
রেখা আবার মনোজকে ধাক্কা দিল আবার ডাকলো" কি গো শুনতে পাচ্ছ?
আজ যাবে তো কাকু কাকিমার ওখানে? ঠিক করে বলো, তাহলে তো আমাকে উঠে সেভাবে কাজ গোছাতে হবে।
হু।
এ বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়ল ।তারপর ভোস ভোস করে নাক ডাকতে শুরু করল।
একে জাগানো সম্ভব নয়। ঘুম থেকে উঠলে তবেই একে বলতে হবে।
রেখাও আর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল।
এ বাবা সেই ঘুম যে একেবারে মাসির কলিংবেলের আওয়াজে ভাঙবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি রেখা।
বাইরে কলিং বেজে যাচ্ছে। "জয় গনেশ ,জয় "গনেশ জয় ,গনেশ দেবা'। কানে যাচ্ছে কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। আবার কলিং বেলের আর্তনাদ। রেখা কান খাড়া করে ভাবলোএটা তো স্বপ্ন নয় এতো বাস্তব ।রেখাদের বাড়িতেই বাজছে। রেখা ধড়ফরিয়ে উঠে পড়লো। এ বাবা কত বেলা হয়ে গেছে। মনোজকে ধাক্কা দিয়ে দুচার ঘা কিল মেরে দিল। এ বাবা কি করছো তুমি? দু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল মনোজ।
তাকিয়ে দেখছো কি? তোমার জন্য আজকে আমার কত বেলা হয়ে গেল।.
মনোজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলল'এখানে আমার কি দোষ বলো?'
'বাহ রে, আমি তখন তোমাকে ধাক্কা দিলাম। ওঠার জন্য। উঠলে না। আর আমি ও ঘুমিয়ে পড়লাম।'
ওদিকে আবার কলিং বেল বাজছে।
'না ,এবার আমি গিয়ে দরজাটা খুলি। নাহলে মাসিও চলে যাবে খাটুনির শেষ থাকবে না।'
মাসি জিজ্ঞেস করল' কি গো বৌমা আজকে এত দেরি করলে?'
'আর বোলো না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
'"মাসি তাড়াতাড়ি কাজগুলো করে নাও।'
কোথাও যাবার আছে?'
'হ্যাঁ ঠিক তো করেছি। জানি না যেয়ে উঠতে পারব কিনা?'
"কোথায় যাবে বৌমা?"
'ভেবেছিলাম একটু কাকু কাকিমার কাছে যাবো দেশের বাড়ি।'
"কিন্তু কিন্তু করছ কেন যাও না?'
'তোমার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে তো অসুবিধে নেই আমি আছি।'
হ্যাঁ সে তো জানি। তিনি যাবেন কিনা দেখো।'(মনোজকে ইঙ্গিত করে কথা।)
"ছেলেকে গিয়ে তোলো।'
"ঠিক বলেছ?'
রেখা আনন্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে মনোজের ঘরে গিয়ে ডাকে"কিগো যাবে তো?"
'সকাল সকাল কানের কাছে এরকম বাজখাই গলায় কথা বললে না ,ভীষণ বিরক্ত লাগে।'
"এ বাবা এ আবার কি কথা?
রাতে একরকম কথা সকাল হলেই চেঞ্জ?
ফ্রিজে,মাছটা পড়ে আছে, তাহলে কি হবে?
তুমি যদি না যাও বল আমি পার্থকে গাড়ির কথা বলব?'
মনোজ আড়মোরা কেটে বলে
"হ্যাঁ,রে বাবা যাব।"
রেখার হৃদয় আনন্দে ময়ূরের মত নেচে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে লাফাতে লাফাতে রেখা ছুটে এসে
বলল "ঠিক আছে ,তাহলে আমি মাসিকে বলে দিচ্ছি কিন্তু।'
মনোজের উত্তরের প্রত্যাশা না করে রেখা মাসিকে এসে বলল 'মাসি তুমি তাড়াতাড়ি কাজ করে তোমার যা বাড়িতে গুছিয়ে আসার দরকার গুছিয়ে চলে এসো।'
'ঠিক আছে বৌমা।'
'সত্যি, কি আনন্দই না লাগছে। '
মাসি বললো এটাই বাবার বাড়ির টান বুঝেছ বৌমা?
রেখার এক ঝটকায় মনটা চলে গেল সেই নিজের দেশের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি সেখানে যে জেঠিমা কাজ করতে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে। সে মাঝে মাঝেই বলতো'মাইয়াদের বাবার বাড়ি যে কি তা বিয়ার পরেই বুঝা যায়?'
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমা বলতেন, একেবারে হক কথা কইছো।'
সত্যি সেই জেঠিমার কথাটি রেখার মনেপ্রাণে গেঁথে রয়েছে। আজ বুঝতে পারে "মেয়েরা কেন বাবার বাড়ি যেতে চায়? এ যে নারীর টান।'
রেখা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চা বসিয়ে দিল মাসির জন্য ।তারপর ফ্রিজ থেকে ময়দা বের করে ঝটপট পরোটা বানিয়ে ফেলল ।মাসিও তো আজকে খাবে। অন্যদিকে ক্যাপসিকাম আলু ভাজা করবে বলে তরকারি কেটে ফেললো।
চা নামিয়ে মাসিকে চা আর বিস্কিট দিল।
আর বলল "মাসি তুমি পরোটাটা এসে খাবে, না নিয়ে যাবে?'
মাসি চুপ করে আছে।
রেখা বুঝতে পারল কেন চুপ করে আছে? মাসির সংসারে অভাব পরোটা নিয়ে গেলে নাতি-নাতনিদের ভাগ করে দিতে পারবে।
শুনেছে ।মাসির ছেলেটা নাকি দু-দুবার স্টোক হয়েছে তার ফলে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছে, একটা দিক তো পুরো প্যারালাইজড হয়ে গেছে।
এই বয়সে মাসিকে খাটতে হচ্ছে অভাবের সংসার বলে। মাসির বৌমাকেও কাজ করতে হয় তবে বেশি বাড়ীতে কাজে দেয়নি বৌমাকে কারণ ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া জন্য ঠিক টাইমে ভাত রান্না করে দেওয়া এগুলো বৌমাকে করতে।
কথায় কথায় কত কথা বলছিল মাসির দিকে তাকিয়ে রেখার মনের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো আর ভাবল আহা এই বয়সে কি কাজ করার বয়স তবুও কাজ করছে কত নিষ্ঠার সাথে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেখা বলে" ঠিক আছে, তুমি দুটো পরোটা এখানে খাও আর দুটো নিয়ে যাও কেমন?'
মাসি বলল আচ্ছা।
রেখা খেয়াল করল মাসির চোখমুখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ।কতটা খুশি হয়েছে তা বুঝা গেল চোখ মুখ দেখে।
মাসি ঝটপট কাজ গুছিয়ে দিয়ে বলল' বৌ মা আমি আসি তাহলে।'
রেখা বলো হ্যাঁ মাসি, এসো।।
যেতে গিয়ে মাসে আবার থমকে দাঁড়ালো। প্রথম দিকটা খেয়াল করেনি পেছন ফিরে গ্যাসে মিলিদের রান্না চাপাচ্ছিল
হঠাৎ রাক থেকে খুন্তি টা নেবে বলে পেছনের দিকে তাকালো। রেখা চমকে উঠে বলল'একি তুমি যাও নি!"
"আরেযেতে গিয়ে মনে পড়ল শীতলা পূজা আছে কিন্তু। পুজো পাঠাবে? সেই জন্য তোমাকে মনে করালাম।।
'কবে আছে?
"আগামীকাল।'
"ও বাবা তাহলে তো আজকেই তোমাকে টাকা দিয়ে রাখতে হবে।'
'হ্যাঁ বৌমা।'
'তো তুমি কি এখনই নিয়ে যাবে? নাকি এসে নেবে?'
'যা বলবে।'
দাঁড়াও নিয়ে যাও কারণ তুমি তো বললে তোমাদের পাড়ার থেকে যারা যাবে তাদের কাছে তোমাদের পুজো পাঠাবে তাহলে আমারটাও ওদের কাছেই দিতে পারবে।"
"ঠিক আছে।'
'রেখা ৫০ টাকা কিছু কিনে নিতে বলল আর ১১টাকা দক্ষিণা হিসেবে. দিতে বলল।'
মাসি বেরিয়ে গেল।
"ও মাসি দাঁড়াও দাঁড়াও নাম গোত্র এগুলো সব লিখে দিই।'
"হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। নাহলে তো মনে করতে পারব ন।'
রেখা দ্রুত বসার ঘরে গিয়ে রাইটিং প্যাড থেকে একটা পাতা ছিঁড়েনিয়ে খসখস করে লিখলো।
তারপর হাত বাড়িয়ে কাগজটা মাসিকে দিল।
মাসি চলে গেল।
দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে রান্না ঘরে ঝটপট মিলিদের খাবারটা নামিয়ে ফেলল।
অন্যদিকে ফ্রিজ থেকে মাছটা বের করে ফুলকপি আলু দিয়ে মাছের ঝোল করবে বলে মাছগুলোকে ভেজে নিল। ঝোল চাপিয়ে দিয়ে রেখা কয়েকটা কাজ এদিক ওদিক করতে লাগলো।
রেখা খুব তাড়াহুড়ো করছে বুকের ভিতর একটা উত্তেজনা কাজ করছে। বলতে বলতেই কলিংবেল আবার বেজে ওঠে।
মনোজ কলিংবেলের আওয়াজে উঠে পড়ে।
রেখাকে উদ্দেশ্য করে বলে 'কি গো চা জল দেবে?'
'হ্যাঁ দেবো।'
'কে আসলো গো?'
পেপার দিয়ে গেল।
'পেপার টা দাওনা একটু চোখ বুলাই।'
রেখা পেপারটা দিয়ে রান্নাঘরে এসে চায়ের কাপে চা ঢেলে মনোজকে দিয়ে আসলো। মনোজ বললো কটায় বেরোবে?
'তুমি বলো?'
'তোমার এদিকে সব রেডি?খাবারদাবার বানানো হয়ে গেছে?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ।'
তাহলে চলো, ১১:৩০টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ি।
Ok
রেখা দ্রুত পদে রান্নাঘরে গেল। তারপর স্নান করতে ঢুকলো। বাথরুমে থেকে চেঁচিয়ে বললো' পামপটা চালিয়ে দাও।'
দিচ্ছি।
রেখা স্নান করতে করতে আপন মনে গেয়ে উঠল" আমার ভিতর ও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি.…।'
মনোজ মনে মনে ভাবল রেখার বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা শুনলেই কেমন মনটা আনন্দে নেচে ওঠে ।তাই কি সুন্দর গান গাইছে। আসলে সব মেয়েদেরই বোধহয় বাপের বাড়ির প্রতি একটু উইক আছে।
আবার কখনো কখনো কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা আওরাছে
"আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়' ..।"আজ রেখার মন খুশিতে পাল তুলেছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে তার অভিব্যক্তি।