২৫ জুলাই ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৭





উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১৯৭

সুমিতার জীবন

মমতা রায় চৌধুরী


এমনটা কখনো ভেবেছিল কি সুমিতা ,জীবনটা সেই কোঠীঘরের মতোই আবার হয়ে যাবে?
সেই জীবনের দগদগে ঘা শুকানোর আগেই একি হয়ে গেল। আজ মাটির ঘরে বসে বসে সেটাই ভাবছে। আজ সমস্ত মুখখানা যেন সিদ্ধ করা ডিমের মতোন ফ্যাকাশে। কি ভেবেছিল আর কি হলো ?বিয়ের দু'বছরের মধ্যেই তার জীবনের সমস্ত রস নিংড়ে ছোবড়া করে দিয়ে চলে গেছিল জীবন।
অন্য কোন মাধবি লতা বা সুমিতার খোঁজে। তাকে রেখে গেছিল অন্ধকারে। তাতে আর সুখ নেই ,স্বাদ নেই ,তার সবকিছুতেই যেন অরুচি ধরে গেছে।
 হঠাৎ করেই একদিন ফাগুনের রাত ।সেই রাত তার কাছে অনেক মধুর মিষ্টি রসে টইটুম্বুর হওয়ার কথা ছিল।  কিন্তু না, তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু'মাসের মধ্যে ফিরে আসার কথা বলে সেই  যে গেছে ,তার আর কোন পাত্তা 
নেই। ঠিক দুমাস পরে বনোয়ারি তার জীবনে এসেছে ।এর মধ্যে দু বছরে তার সন্তানও হয়েছে। বনোয়ারিলাল এর কাছে শোনা যায় যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। সে এক মরদ বটে তার কো ঠী ঘরেও এরকম মরদ জোটেনি।
প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি  বনোয়ারিলাল এর মতলব। সকালে বাসি উঠোনটা ঝাঁট দিচ্ছে তার আগেই মেয়েটাকে সাবু ফুটিয়ে  খাইয়েছে ,এক ফোঁটা দুধও দিতে পারছে না  মেয়েটির মুখে ।সেই সময়ে কাজ ধরেছে লোকের বাড়ি ,ঘর ঝাঁট দেওয়া ,বাসন মাজা ইত্যাদি ইত্যাদি। রেখার বাড়িতে সেই সূত্রেই কাজে যাওয়া। ঝাড় দিতে দিতে সে ভাবছে তার আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে মানুষটা যে সেই গেল আর কোনো খোঁজ খবর নিল না ।সে ভাবতেও পারেনি যে তার জীবনে একটা পাজি ন চ্ছার লোক 
জুটেছিল ।মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে তাদের সোনালী দিনের কথা। অর্থাৎবিয়ের সীলমোহর যখন দিল কালী মন্দিরে শাঁখা ,সিঁদুর, ঢাকাই শাড়ি পরে। বুঝেছিল এই শাঁখা ,স্বামীর সিঁদুর আসলে সীলমোহর হিসেবেএকটা মেয়েমানুষ রেখেছিল। তার ঘৃণ্য জীবনে ভেবেছিল 'জীবন 'তার আশার আলো । তাকে নতুন জীবন দান করবে। হ্যাঁ নতুন জীবনই তাকে দান করেছিল। সন্তানকে নিয়ে যখন সে দিশেহারা স্বামীর খোঁজ মিলছে না ,তখন বনোয়ারিলাল এসে তাকে হঠাৎ করে হাজার খানেক টাকা ধরিয়ে দেয় বলে তার স্বামী জীবন পাঠিয়েছে সেই সূত্রেই বনোয়ারিলাল মাঝে মাঝে সুমিতার বাড়িতে আসত কিন্তু লোকটার চাহনি বুনো বুনো ছিলো ।মোটেই ভাল লাগেনি ।কেমন যেন একটা উগ্র খিদে দাও দাও করে যেন জ্বলছে ।চোখ মুখের ভেতর দিয়ে ফুটে বের হচ্ছে যেন এক্ষুনি গোগ্রাসে গিলে 
ফেলবে মাঝে মাঝে মনে  হত সুমিতার ।কিন্তু হাসি মুখে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে তার সাথে কথা বলতো ।সুমিতা যখন জিজ্ঞেস করত যে কবে ফিরে আসবে 'জীবন ?'তখন সে একটু  তাচ্ছিল্যভরে হেসে নিতো তারপর বলতো" সময় হলেই আসবে না হলে তো আমি আছি দেখভালের জন্য।"
এর অর্থ সেদিন সুমিতা বুঝ তে পারে নি। বুঝতে পারেনি তার জীবনে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে ।অন্ধকার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। 
সেদিনটা বিকেল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মাটির ঘর জবজবে ভিজে গেছে। মেয়েকে খাইয়ে শুয়ে দিয়ে সে ঘরে বসে তার রঙ চটা তোবড়ানো বাক্সটা খুলে সেই জিনিস গুলো সে দেখতে দেখছিল আর জীবনের কথা ভাবছিল ।তার মধ্যে ছিল তার সেই বিয়ের ঢাকাই শাড়ি। এটা খুব সাধ করে ঢাকাই চেয়েছিল সুমিতা। এনে ও দিয়েছিল। বাক্সের ভেতর থেকে এক এক করে খুলে দেখছিল, রাখা ছিল ঝুটো মুক্তোর মালা ছিল সিটি গোল্ডের হাতের চুরি, ক'টা মাথার কাঁটা। এগুলো হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবছিল আর জীবনের মুখটাকে চিন্তা করছিল।
সেই রাত্রেই আচমকা দরজায় ঘা পড়ে। সুমিতার চমক ভাঙ্গে তার শব্দে।
ঘর থেকে জিজ্ঞেস করে 'কে?'
ঘরের এক পাশে পাটকাঠির ওপর বস্তা রাখা ছিল তার ওপর একটা কালো ছিট কাটা বিড়াল মুখ গুঁজরে ঘুমাচ্ছিল।
সেই শব্দের যেন ঘুম ভেঙে গেল।
না পাওয়াতে আবার জিজ্ঞেস করে গলা জড়িয়ে কে?"
তখন উত্তর দেয় আমি' বনোয়ারী।"
সুমিতা ভেবে পায় না এত রাত্রে কি করতে আগমন ।কথা শুনে তো মনে হচ্ছে নেশাগ্রস্ত।
কি করবে কি করবে ভাবতে না ভাবতেই আবার দরজা পেটানোর আওয়াজ।
 সুমিতা দরজা খোলার সাথে সাথেই বনোয়ারি ঘরে ঢুকে পড়ে।
সুমিতা বলে 'বৃষ্টি জলের রাত্রে আপনি?'
"আমি ছাড়া আর তোমার কি খোঁজখবর রাখে তাই একটু খোঁজ নিতে আসলাম।,"
তখনও মুখ থেকে মদের গন্ধে সারা ঘর ভরে গেছে ,চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে।
কেমন কদর্য চাহনি তবুও সুমিতা বলে "আপনি চলে যান সকালে আসবেন রাত হয়ে গেছে তো?
আমার মেয়েটার বিকেল থেকে জ্বর ।"
"আজ এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি ।চলে যাওয়ার জন্য তো আসি নি সুন্দরী"।

"এসব আপনি কি বলছেন?"
"আমি ঠিকই বলছি ,।আজ রাতে আমি এখানেই থাকব।"
সুমিতা বলে "আমি কিন্তু চেঁচাব।  বস্তির লোক সব জেগে উঠবে।"
"চেঁচিয়ে কি হবে?"
"বস্তির লোক দেখবে রাত্রি বেলায় এক মরদ তোমার ঘরে ঢুকেছে?"
আর তাছাড়া এতদিন ধরে খোঁজখবর রাখছি কি এমনি এমনি টাকা দিচ্ছি?"
সুমিতা  যেন আকাশ থেকে পড়লো ।বলল "টাকা তো আমার স্বামী আপনার হাতে পাঠাচ্ছে।"
বনোয়ারিলালের কদর্য হাসি তে মাটির ঘর ফাটিয়ে ফেললো ।
তারপর আস্তে আস্তে সুমিতার দিকে অগ্রসর হলো সুমিতার হাতটা ধরে টানলো।
বললো "আজকে আমার তোমার সাথে সোহাগ রাত।"
সুমিতা বলল "আপনি মুখ সামলে কথা বলুন।"
বনোয়ারিলাল বলল" সতী সাবিত্রী । কো ঠ  ঘরের থেকে এসেছো বড় বড় কথা ।তাই এবার আমাকে একটু রসে মজাও।
আর তোমার স্বামী তো আমার কাছে তোমাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এতদিন ধরে ভেবেছিলাম যে তুমি আপনা থেকেই আমার কাছে ধরা দেবে তা যখন হলোই না আরে সত্যটা জেনে এবার তো তোমাকে আসতেই হবে আমার কাছে।"
সুমিতা বলল" খবরদার বনওয়ারী লাল বাবু আমার দিকে এগোনোর চেষ্টা করবেন না।"
বনোয়ারিলালের ভেতরে জন্য হিংস্রতা বেড়ে উঠলো।
সুমিতার মুখটা কালো হয়ে গেল ভয়ে ,অপ্রত্যাশিত বিভীষিকার এইরূপ দেখে।
সুমিতা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
তারপর ভয় মিশ্রিত কন্ঠে সুমিতা অনুরোধ করে বনোয়ারীলাল বাবু ,আপনার টাকা আমি শোধ করে দেব কিন্তু আপনি আমার সাথে এরকম করবেন না এই অনুরোধ টা রাখুন।
বনোয়ারিলাল তখনও অর্থহীনভাবে হেসে ওঠে তারপর বলল এতক্ষণ তো হিংস্র বাঘিনীর মত কথা বলছিলে এখন হঠাৎ করে মেনি বিড়াল হয়ে গেলে কি করে?
সুমিতা দু'হাত জোর করে বলে"আপনি আমাকে ছেড়ে দিন আপনার আমি পায়ে পড়ছি।
সুমিতা দু'পা জড়িয়ে ধরে।
বনোয়ারিলাল তখন হিংস্র বাঘ বলে ওঠে আরে আরে করো কি? দুহাত দিয়ে তুলে সুনিতা কে বুকের কাছে আনার চেষ্টা করে আর বলে আমার পায়ের কাছে তোমার জায়গা না তোমার জায়গা আমার হৃদয়ে।
বনোয়ারিলাল এই কথা বলেই সুমিতাকে জোর করে বুকের কাছে চেপে রাখে তারপর তার আঙ্গুলগুলো আস্তে আস্তে পিয় থেকে ক্রমশ তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্পর্শ করতে থাকে সুমিতা অনুভব করে এ যেন বৈশাখ মাসের দুপুরের খড়ের গাদার  মতন গরম গা এক্ষুনি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।

সুমিতা জানে মুখ পোড়া মাগীচাটা পুরুষগুলো সব সময় এরকম কামুক দৃষ্টিতেই মেয়ে মানুষগুলোকে দেখে থাকে ।এ যেন এক মারাত্মক ভাদ্র মাসের কুকুরের মত সে ছটফট করছে। ছ্যাচরা,শয়তান ইতর স্বার্থপর লোককে কি করতে হয় তা সুমিতা জানো। তখন সুমিতা হয়ে গেছে রোদে শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো শক্ত ।তাই সে মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে ,এর বিষদাঁত ভাঙতেই হবে।
দুজনার মধ্যে জোর ধস্তাধস্তি চলছে হঠাৎই বনোয়ারি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সুমিতাকে মেঝেতে ফেলে দেয় আর সুমিতার গায়ের উপর তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের কামতৃষ্ণাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে ।ঠিক সেই সময়ে পাটকাঠির বোঝার পাশেই ছিল একটা বটি কোনরকমে হাতরে হাতরে তার কাছে যাবার চেষ্টা করে ।তারপর পেয়েও যায়  ।সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না ।তার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে।বসিয়ে দেয় এক  কোপ। সুমিতা
 খেয়াল করে বনোয়ারিলাল তখন মারাত্মকভাবে জখম ,যন্ত্রণার বিকারে তার ওঠার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ তখন আরো বেড়েছে ঢোবাটাতে  জল পড়াতে ব্যাংগুলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দে গান তুলেছে আর সুমিতা তখন নিজেকে বাঁচিয়ে ভাবছে যে 'জীবন 'তার নতুন জীবন দিতে চেয়েছিল, সেও তাকে এইভাবে ঠকিয়ে জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়ে গেল। কি চেয়েছিল সে জীবনে স্বামীর একটু ভালোবাসা ,দারিদ্রতা ও তার কাছে হার মানবে । কি এক টানা-পোড়েনে একি হয়ে গেল তার জীবনে।

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৬




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১৯৬

অস্তিত্বের লড়াই

মমতা রায় চৌধুরী



বিদ্যালয়ে রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী উৎসব মোটামুটি ভালোভাবেই পালিত হয়েছে ।যদিও সেই দিনটা ছিল ঝড়ো মেঘলা দিন। ঝোড়োমেঘলা দিনের গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য গুরুদেবের গান  দিয়েই "আজ ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে"স্নিগ্ধা"অপূর্ব গাইল। রাজশ্রী কবিতা আবৃত্তি করল "আফ্রিকা'। 'অনবদ্য কবিতা আবৃত্তি।
সোহিনী তার শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে রবি ঠাকুরের অনবদ্য রচনা "গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে…।' নৃত্যের মধ্যে দিয়ে । আরো যারা ছিল মিত্রা ,দেবাংশী প্রত্যেকে খুব সুন্দর পারফর্ম করেছে।
সবার শেষে বিদ্যালয়ের সিনিয়ার দিদি ঘোষণা করলেন আমার নাম। তিনি বললেন একজন লেখিকা আর তার নিজের স্বরচিত  কবিতা আবৃত্তি না শুনলে আজকের দিনটার আনন্দঘন শ্রদ্ধার্ঘ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।তাই শুনবো না এটা কখনো হতেই পারে না ।সত্যিই দিনটা এমন ছিল মনের ভেতরে গুনগুনাচ্ছিল রবি ঠাকুরের প্রতি আমার প্রাণপ্রিয় গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব। তাই রেখা আর কালবিলম্ব না করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাল "অপেক্ষার বৃষ্টি হয়ে ফিরে এসো রবি ঠাকুর। "অনবদ্য কবিতা আর তার পাঠিয়ে সকলেই মোহিত হয়ে গেল 
সারাটা দিন বেশ সুন্দর একটা শেষ ভাবের মধ্যে দিয়ে যেন উদযাপিত হল  মনটাও একটা আলাদা তৃপ্তি অনুভব করল। বড়দি ভীষণ খুশি হলেন যে হঠাৎ করেই প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করে এত সুন্দর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন হবে কল্পনার অতীত ছিল। বড়দি প্রোগ্রাম নিয়ে খুব প্রশংসা করলেন।
আজ অনিন্দিতা এসেছিল স্কুলে। ওর শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। রিপোর্ট পেয়েছে হাতে ক্যান্সার ফাস্ট স্টেজ।ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কি একটা দুশ্চিন্তা সবসময় ওকে ঘিরে আছে ।রেখা ওকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে নি ।প্রোগ্রাম শেষে যখন বড়দির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন অনিন্দিতা এসে বলল "রেখাদি তুমি ভালো আছো?"
 রেখা হেসে বললো"হ্যাঁ, ভালো আছি ।তুই কেমন আছিস?"
 রেখার কথা শুনে অনিন্দিতার চোখে জল আসে আর বলে -" আর আমার ভালো থাকা, ভালো থাকার চেষ্টা মাত্র ।শুধু একটাই চিন্তা জানো তো আমার ছেলেটার জন্য।"
বড়দি আর রেখা বলল" এতো ভাবছো কেন সব ঠিক হয়ে যাবে ।তুমি তো ট্রিটমেন্ট 
করাচ্ছো ।ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রাখ।"
"এই রোগের আর ঠিক হওয়া দিদি"বিষন্ন সুরে বলল অনিন্দিতা।
বড়দি আর রেখা কি বলবে জানে তো এই রোগ সম্পর্কে এজন্য কিছুটা চুপ থেকে বলল "এই রোগের ট্রিটমেন্ট করাচ্ছো টিটমেন্ট অনুযায়ী তোমাকে ভালো থাকতে হবে।"
 অনিন্দিতা একটু ম্লান হেসে বলল
"কি যে পাপ করেছি সেজন্য তার শাস্তি ভোগ করছি,।"
রেখা বললো "এভাবে কেন বলছো? শরীর থাকলে তো অসুখ হতেই পারে ।এতে পাপ-পুণ্যের কথা কেন আসবে ,তুমি মনটাকে ভালো রাখার চেষ্টা করো। সবসময় এরকম নৈরাশ্যজনক কথা ব'লো না।  পজিটিভ ভাবো।"
*ভাবি কিন্তু পেরে উঠি না গো রেখাদি।'
রেখা বলল"তুমি আজকে শরীর খারাপ নিয়ে স্কুলে আসলে কেন? এখন তো সামার ভ্যাকেশন চলছে ।আজকে তো কারো বাধ্যতামূলক ছিল
 না । বড়দি সেভাবে কাউকে আসতে বলেন  নি।'
"না গো ,বাড়িতে থেকেও তো বোরিং হচ্ছিলাম এইতো কদিন আগেই ফিরেছি চেকআপ
 করিয়ে ।ভাবলাম, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী তো হবেই আর তুমি যেখানে আছো সেখানে তো হবেই ।তাই চলে আসলাম।"
"খুব ভালো করেছ "
বড়দি রেখার দিকে তাকিয়ে বললেন 'যে কয়জন মেয়ে এসেছে অভিভাবক এসেছেন, তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করেছ টিফিনের?
"ওই পঞ্চমীদিকে বলাই ছিল কাউন্ট করে নিয়ে কয়েকটা কেক আনিয়ে দিতে।"
বড়দি বললেন* অনিন্দিতা, রেখার উপর কেন আমি ভরসা করি এবার বুঝতে পারছ?ওকে যেকোনো কাজ দিলে ও কতটা দায়িত্বের সঙ্গে করে। আমাকে কোন টেনশন করতে হয় না "
রেখা বুঝতে পারল বড়দি  অনিন্দিতাকে একটু খোঁচা দিয়ে কথা বললেন "কারণ এর আগে অনিন্দিতা খুব সমালোচনা করেছে রেখাকেনিয়ে।"
"দিদি ,আপনারা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আপনাদের চোখকে কখনো ফাঁকি দেয়া যায়?আপনি যোগ্য লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন।"
রেখা অনিন্দিতার কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়লো মহৎ বানী'কেউ আঘাত করলে প্রতিশোধ নেবার দরকার নেই। ধৈর্য ধরলে আঘাত নিজেই তার কর্মের জন্য পাবে।
সেদিন যে অকারনে রেখাকে আঘাত করেছিল কন্টিনিউয়াসলি, আজকে ভাগ্য কোথায় নিয়ে গেলো অনিন্দিতাকে ।সেই রকম মেজাজি অহংকারী মনোবৃত্তি কোথায় চলে গেছে।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার ভিতর যেন একটা আর্তনাদ রয়ে গেছে বুকের ভেতরে যে এতদিন শুধু প্রত্যেককে অপমান আঘাত করার আগুন  জ্বলছিল, সেটা এখন নিভে যেতে বসেছে আপনা থেকেই। হয়তো এটা তার অনুশোচনা অনুতপ্তবোধ তাকে বিবেকবোধের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
কাউকে কখনো ছোট করে দেখা উচিত নয়।
বড়দি বললেন" রেখা আমার সঙ্গে দুজন ভদ্রলোক কথা বলতে আসছেন ,তোমরা বরং স্টাফ রুমে গিয়ে বাকি কথাটুকু সেরে নাও কেমন?"
রেখা বলল" হ্যাঁ বড়দি ,ঠিক আছে।"
স্টাফ রুমে যেতে যেতে রেখা অনিন্দিতাকে বলল "তোর বর সুরেন  ঠিক আছে তো?
তোকেনিয়ে খুব ভাবছে না?"
রেখা বলল "সে তো একটু ব্যস্ত আছে, ভাবনা তো রয়েছে  বাচ্চাটা ছোট।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার কথার মধ্যে যেন একটা ঔদাসীন্য আর অবহেলায় ভরা সুর। 
সেই অস্তিত্বটাকেই  বুঝাতে চাইছিল ।যদিও ভাষাতে তার  অভিব্যক্তি নেই কিন্তু চোখে-মুখে 
 বিষন্নতার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে।
রেখা বলল "অনিন্দিতা বাড়ি যাবে না?"
"তোমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে।"
"না ,এখনো মিনিট দশেক বসতে পারব।"
আমি বাড়ি গেলে তো হাজারো চিন্তা মাথায় আসে এখন শুধু মনে হয় কত তাড়াতাড়ি স্কুল টা খুলবে আমি কাজের মধ্যে নিজেকে এখন জড়িয়ে রাখতে চাই।"
"কিন্তু তোমার বাড়িতেও তো একটা বাচ্চা আছে ওকে নিয়েই তো তোমার সময় কেটে যাবে।"
জানি রেখাদি ,কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালে না শুধু মনে হয় কেন আমি ওকে পৃথিবীতে আনলাম আমি যদি ওকে সঠিকভাবে লালন পালন করে ওকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারি তাহলে আমার মা হবার কোন অধিকারই নেই।"
"এভাবে বোলো না অনিন্দিতা।"
অনিন্দিতা অঝোরে কাঁদছে আর বলছে" আমি কতদিন এই পৃথিবীতে আছি রেখাদি আমি জানি না ।যেহেতু ফাস্ট স্টেজে  ধরা পড়েছে ,হয়তো থাকবে কিছুদিনের জন্য কিন্তু কতদিন?"
একটা হতাশাগ্রস্থ বেদনা ,যন্ত্রণা অনিন্দিতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে ভেতরে ভেতরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে একটা ভয়। সর্বদা যেন কুকুর তাড়া করছে।
রেখা অনিন্দিতার মাথায় হাত রেখে বলল "যে কটা দিন থাকো তুমি হেসে খেলে পজেটিভ ভাবনা নিয়ে থাকো ।সেই কটা দিনই  তুমি তোমার সন্তানের জন্য মূল্যবান সময় অতিক্রম করো।
" রেখা দি তুমি সন্তানের মা হতে পারোনি তুমি অনেক লাকি।"
কথাটা শুনে রেখার চোখ ছল ছল করে উঠলো আর বললো "বলছো আমি লাকি ।আমি জানি আমি কতটা লাকি। আসলে আমাদের জীবনটা এরকম জানো তো যে যা পায় ,সেটা নিয়ে খুশি হতে পারে না ।আমরা যদি প্রত্যেকেই সেটুকু অংশ নিয়ে খুশি থাকতে পারতাম, তাহলে মনেহয় সব থেকে বেশি সুখী হতে পারতাম।"
"রেখাদি আমি অনেক ভুল করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
অনিন্দিতা হাতজোড় করে রেখার কাছে ক্ষমা চাইছে  ।রেখা উপলব্ধি করলো আজ অনিন্দিতা ক্ষমা সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখছে।
অনিন্দিতা অনর্গল বলে যাচ্ছে " জানো আমি তোমাকে খুব ঈর্ষা করতাম আর ভেতরে ভেতরে খুব জ্বলতাম।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার স্বপ্নময় দুটি চোখ যেন এখন ক্লান্ত শুধু খুঁজে বেড়ায় তার অস্তিত্ব টিকে থাকার লড়াই, একটা সচকিত আতঙ্ক যেন ক্রমশ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে টেনে।
রেখা বলল "শান্ত হও অনিন্দিতা, শান্ত হও।"
অনন্দিতা চঞ্চল ,অস্থির ,উদ্দাম হয়ে বলতে লাগলো আমাকে বলতে দাও রেখা দি।
আমি এই কথাগুলো বলে যেতে না পারলে আমি যে আমার জীবন শেষে শান্তি পাব না।"
কন্টিনিউয়াসলি অনিন্দিতা কেঁদে চলেছে ।রেখা দেখল কাঁদারপ্রয়োজন রয়েছে ।
শুধু এইটুকু বলল "আমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে অনিন্দিতা। আমাকে এবার উঠতে হবে তুমিও বাড়ি যাও  মাঝে মাঝে ফোন ক"রো আমিও তোমাকে ফোন করবো ।ওকে সান্ত্বনা দিয়ে রেখা বেরিয়ে পড়ল টোটো ধরবে বলে । টোটোতে উঠে বসে বসে রেখা ভাবছে অনিন্দিতা কাঁদুক। ওর অসাড় দেহ অন্ধের মত হাতরে হাতরে খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধু অস্তিত্ব টিকে থাকার 
লড়াই ।অন্ধকারে মনে হচ্ছে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না ।চারিদিক শুধু অনন্ত অন্ধকার ।অঙ্গার এর আগুন যেমন পুড়ে পুড়ে নিজে শেষ হয়ে যায় তেমনি যেন মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নগুলো আর বাস্তবায়িত হবে না।চারিদিক চোখ বন্ধ করে দিচ্ছে।

রেখা আজ রবি ঠাকুরের জন্মদিনে তাই বারবার মনে করছে "হে গুরুদেব , হে ঠাকুর,সকলের ভেতরে তুমিই উদ্যম ,প্রাণশক্তি জোগাতে পারো তুমিই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ ।মনেপ্রাণে সেই শক্তি দাও। সেই শক্তি ওকেও দান করো "

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৫




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১৯৫

অভিনয়

মমতা রায় চৌধুরী

নারী যেন নদীর মত আপন বেগে প্রবাহিত হতে চায় কিন্তু তার গতি রুদ্ধ করে দেয়া হয় ।একদিকে যদি ভরাট হয়, অন্যদিকে ভাঙ্গন  ।তাই দুই কুলকে  সযত্নে রক্ষা করে চলতে হয় 
নারীকে ,আর সংসার প্রবেশ করলে তো কথাই নেই ।একদিকে সংসার অন্যদিকে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই। এই দুটো দিক সযত্নে যখন ব্যালেন্স করে রাখা যায় বা চলা যায় তাহলে সেই ক্ষেত্রে সেই নারী সংসারে তত বেশি প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুনাম। মাধুরী বরাবর এটা ব্যালেন্স করে চলেছে। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তা নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে বসেছে ,কখনো স্বামীর মন রক্ষা করা ,সেখানে তার অভিনয়টা খুব পাকাপোক্তভাবে করতে হয় ।কখনো বা সন্তানদের ক্ষেত্রে কখনো বা   শাশুড়ির সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত্রে তার নিজের শাশুড়ি নেই । এখন সবই পিসি শাশুড়িদের সঙ্গে।
এই তো শিখার বিয়ের পর থেকে মেজো পিসি শাশুড়ি রয়েছেন ,তার আবার শরীর খারাপ একটুতেই অভিমান।  সব দিকে মাধুকে নজর রাখতে হয় ,বিরক্ত হলেও সে বিরক্তিভাব প্রকাশ থাকে না ।সব সময় হাসিমুখে চলে, সর মাধুর্যে একটা আলাদা চমক আছে।

এইতো গত পরশুদিন শিখা ফোন করেছিল বলেছিল বৌদি ভাই এসো না কদিন এখানে বেরিয়ে যাও। বাড়ি ছেড়ে তো নড়ার কোন অবসর তুমি পাও না।".
মাধুরী হেসে বলেছিল 'যাব বৈকি ।"
শিখা উৎফুল্ল হয়ে বললো ' কবে আসছো
 বলো ?বলো ,বলো?"
"এইতো মেজ পিসিমা রয়েছেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন ।"
শিখা হতাশ হয়ে বলে "তারপর?''
মাধু বলল " হ্যাঁ তার পরই তো।
রেখে যাই বল কার ভরসায়।"
"বলে আচ্ছা ,বৌদি সব দায়িত্ব কি শুধু তুমিই নিয়ে রেখেছো ?তোমার নিজস্বতা বলে কিছু 
নেই ।এখন আমি বড় হয়েছি to আমার বিয়ে দিয়েছ। এবার আমি যেটা বলবো তোমাকে সেটাই শুনতে হবে।"
"হ্যাঁ জানি তো ।এরপর আমাদের বয়স হয়ে যাবে তোরাই তো আমাদেরকে সবকিছু বুঝাবি, শাসন করবি। তোরা ছাড়া কে আছে বল?"
এই কথা বলে এড়িয়ে যাবার মতলব না? বাহরে  কোথায় গেলাম বল?'
"তবে না  না তো কি বলো?'
"বাববা পিসিমা জানতে পারলে খাপ্পা হয়ে যাবে রে?"
বলার আগে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল 'পিসিশাশুড়ি আবার শুনতে পেলেন কিনা?''
  শিখা বলল "তুমি আবার এ কথাগুলো বলছে আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নাও।
মাধু মনে মনে ভাবল সে আর বলতে ।সে তো দেখে নিয়েছে  শিখা কি করে মাধুর মনের কথা জানে কে জানে?"
কি হলো বৌদি চুপ করে আছো যে?
পিসি কবে যাবে বল তো ?আমার বিয়ের আগে এসেছে, এখনো পড়ে আছে।"
"আমি কি করে বলি বল ?তাদের বাপের,! বাড়ি আসতেই পারেন।"
"বৌদি এতকিছু সহ্য করো অন্য কেউ বলে না কবে মুখের উপর বলে দিতো।"
কি করব বলো? সবকিছুই তো মেনে নিতে হবে
আর কত মানাবে বলতো? "
"দাদারা আর ফোন করে নি পিসির ব্যাপারে?"
'কই।এখন তোর দাদার কাছে করেছে কিনা জানিনা?'
'ও মাধু ও মাধু চা টা পাবো নাকি গো?'
'কে পিসির গলা না?'
'হ্যাঁ রে ,বলতে না বলতেই।'
শিখা বলল 'যেন বোমা বর্ষণ হচ্ছে।'
মাধু একটু শিহরিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সাড়ে চারটে বাজে সর্বনাশ।"
শিখা বলল-হঠাত সর্বনাশ করে উঠলো যে?
"বাবা এই টাইমে যদি চা না পান ,তাহলে  হার্টের  ট্রাবল দেয় নাকি ওনার খুব।"
"বলছো কি বৌদি ভাই"? শিখা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। বাববা যাই হোক তোমার মুখ থেকে তবু এই কথাটা বেরোলো।'
"এবার আমি ফোনটা রাখছি বুঝেছিস, পরে কথা বলব।
"কেন রানুদি আসেনি ।রানুদিকে বলো না আজ চা করে দিতে?"
"রানু ঘর ঝাঁট দিচ্ছে।"
রানু "একটু চায়ের জলটা বসা তো?
পিসি শাশুড়ি উপর থেকে সব লক্ষ্য রাখলো আর মনের ভেতরে গজ গজ করতে লাগলেন তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে বসলেন।
এমনি তুই  ভালো আছিস তো? কল্যাণের খবর কি?"
শিখা একটু চুপ করে থেকে বলল' চলছে ।'
"সামার ভাকেশন পড়েনি ?কদিনের জন্য একটু বেরিয়ে যা।'
'আর ব'লো না তো, আজ এই সেমিনার ,কাল ওই সেমিনার করে বেড়াচ্ছে ।'
"আর আমার ননদিনীকে সময় দিচ্ছে না তাই তো?"
শিখা চুপ করে থেকে বলেন আমার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বৌদি ভাই?

রানু চা করে এনে মাধু কে এক কাপ দিয়ে বললো" বৌদি এই নাও চা " 
মাধু শিখা কে বলল "এই দেখ, রানু চা করে এনেছে  । তোর চা কোথায়? আর পিসিমা চা দিয়েছিস?
রানু বলল 'হ্যাঁ দিয়েছি।
কার সাথে কথা বলছো গো, দিদিভাই? আমাকে একটু দাও না কথা বলি।
মাধু বলল "এই শিখা ,এই নে, রানু কথা বলবে তোর সাথে?''
আরে কেমন আছিস রানু?
আছি দিদি তুমি ভালো আছো কবে আসবে?
ভালো আছি আমি গেলে তো তোর বাসন বাড়বে।
দিদি কোনদিন আমি বলেছি !যতদিন এই বাড়িতে কাজে লেগেছি তোমরা আসলে বাসন বাড়বে,?
"না রে পাগলী ,আমি এমনি বললাম  আসলে ম্যাক্সিমাম কাজের লোক না ,এই আমার বাড়িতেই দেখ না দু একজন লোক আসলেই আগে জিজ্ঞেস করবে কদিন থাকবে !বল, খারাপ লাগে না ?এর  মধ্যে ভদ্রতা নেই রে বাবা ।আমি এমনি বলেছি মনে কিছু করিস না ।"
একগাল হেসে বলল 'না গো দিদি ,আমি কখনো তোমাদেরকে না পর ভাবতে পারি না ।আসলে এরকম ভালোবাসা আমি আর কোন পরিবারে পাই নি।"
"ঠিক আছে শোন, আমি এরপরে গেলে তোর একটা ভালো কানের দুল আর হারের সেট নিয়ে যাচ্ছি কেমন ?তোকে খুব মানাবে দেখিস আর বৌদি ভাইয়ের যেন কষ্ট না হয় দেখিস কিন্তু ,।রানু , বৌদি ভাই কিন্তু কখনো বলবে না নিজের থেকে একটু করে দিস।"
হ্যাঁগো ,বৌদি ভাই তো কথাই শোনে না ।দেখবো আমি আসার আগে কত কাজ করে 
নিয়েছে ।আমি মাঝে মাঝে রেগে যাই জানো 
তো ? রেগে গিয়ে বলি' আমাকে রাখার কি দরকার ?তুমি তো নিজেই করতে পারো।"
"আমাদের বৌদি ভাই বুঝলি রানু ,সবার দুঃখ নিজে ভাগ করে নিতে জানে  আচ্ছা শোন, যাই বলুক তুই কিন্তু কামাই করিস না   ।বাবা না না আমি এগুলো আমার নিজেরই ভালো লাগে না অন্য বাড়িতে কামাই করলে তোমাদের বাড়িতে আমি কামাই করব না কখনো হয়তো দেরি হতে পারে?
তারপর বৌদি ভাইয়ের দিকে তাকে বললো" বল বৌদি ভাই ,আমি কামাই করি?"
তুই মেলা বকেছিস তোকে আর বকতে হবে
 না ।যা দিয়ে এবার ভাল করে বাসন টাসন মেজে নে । আবার তো বাড়ি যাবি ?ঠিক আছে ।না রে কামাই করে না ।করলে ও বলে যায় । বাববা আগের যে কাজে ছিল  যা ভুগিয়েছে ।সত্যি কথা রানুর মত মেয়ে পেয়েছি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। ও খুবই ভালো মেয়ে।"
কথাটা শুনে খুব রানু খুশি হলো ।তারপর হাসতে হাসতে নিজের কাজ করতে গেল।
"ফোন করাটা কমেছে বৌদি ভাই ?"
"ওইটাই তো  রোগ।যেদিন ফোন নিয়ে আসবে কাজ করার আগে ফোনে গল্প,।
" কার সাথে কথা বলে,  সেই হাঁদু?
ছেলেটি কি করে গো বৌদি ভাই?"
"জানি না বাবা ,রানুই জানে। রানুর কাছে ওই ছেলেই সর্বেসর্বা  ওর ব্যাপারে কিছু বলা যাবে
 না ।ও বাবা এ যে তোকে বলছি আবার শুনে ফেললে তো একেবারে  মুখ হাঁড়ি করে ফেলবে।'
"ঠিক আছে, রাখছি রে  সন্ধে দেব কেমন? ভালো থাকিস।"
ফোনটা কেটে দিয়ে মাধু দেখছে, রানু চলে যাচ্ছে "কি রে রানু ,আজকে তুই আমাকে না বলেই চলে যাচ্ছিস? কি ব্যাপার?"
"এমনি তুমি ফোনে কথা বলছো তো তাই?"
মাধু বুঝল নিশ্চয়ই হাদুর  ব্যাপারটা বলেছি শুনে নিয়েছে।
"বুঝেছি তুই আমার উপর রাগ করেছিস, তোকে চা করতে হয়েছে বলে?"
বাববা এত রাগ। একটু চা করতে গিয়ে, তুই তো চা করে খাওয়াস তো। তোর হাতে চা কত ভালো?"
এ নিয়ে মুখ ভার করি নি বৌদিভাই ।আমি কখনো চা করতে গিয়ে এরকম করেছি?'
"তাহলে এত গোসা ক্যান,? তোমার মুখে অমাবস্যা লেগেছে?ও বাবা তোর চোখে জল।"
 মাধু রানুকে কাছে টেনে বললো' আমি কি এমন কথা বলেছি রে। যার জন্য তুই কষ্ট পেয়েছিস?"
"কি করব বলো আমি তো হাদুকে ভালোবাসি।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালোবাসা অপরাধ নাক
 রে ?ভালবেসেছিস বেশ করেছিস ।তুই ওকেই ভালোবাসবি। হাদুর মতো ছেলে হয় নাকি? তোকে কতো ভালবাসে?
একদিন আমার কাছে হাদু কে নিয়ে আসবি তো?"
রানু খুব খুশি হয়ে বলল" তুমি দেখবে 
বৌদিভাই ?তুমি দেখবে ?ঠিক আছে নিয়ে আসব।"
"আমি তো এমনি শিখার আছে ইয়ার্কি
 মারছিলাম ।একটা ক্ষেপি মেয়ে। রানুকে কাছে টেনে আর একটু আদর করে দিলো।"
রানু খুশি হয়ে বাড়ী চলে গেল।
এরপর মাধু গেল পিসিমার কাছে ।তার এখন ওষুধ খাওয়ার টাইম ।সন্ধ্যের নাস্তার আগে ওষুধ আছে।
মাধু ঘরে ঢোকার আগে বলল" পিসিমা, পিসিমা ঘুমিয়ে গেলে ন নাকি পিসিমা? আপনার ওষুধ খাবার আছে খেয়ে নিন ।না হলে আবার সেই সন্ধ্যেবেলার নাস্তা খেতে পারবেন না । উঠুন, 
উঠুন।শুয়ে আছেন ?কি ব্যাপার শরীর খারাপ?"
"একি চা খাননি কেন?"
"ইচ্ছে হয়নি তাই?"
"ওমা সেকি কথা !আপনার ওই টাইমে চা না খেলে শরীর খারাপ করে মাথা ছাড়ে না। আচ্ছা খান নিকেনো?"
"আজ সুরো অফিস থেকে  আসলে একটু ফোন করতে ব'লো তো  ,আমার ছেলের কাছে।"
"সে কি হঠাৎ ফোন? মন খারাপ করছে সবার জন্য?"
"না মা কে আর কতদিন এখানে ফেলে রাখবে 
বলো ?নিজের বাড়িঘরেও তো যেতে হবে নাকি?"
মাধু জানে কিভাবে পেট থেকে কথা বের করে নিতে হয়। তার মানে শিখার সাথে  যখন পিসি মাকে নিয়ে কথা বলছিল, তখন কিছু একটা শুনে নিয়েছেন। তাই এত গোসা।'
"ঠিক আছে পিসিমা, সব কথা হবে আরো ক'দিন থেকে যান। আপনি না থাকলে কি আমাদের ভালো লাগে বলুন? কেমন বটবৃক্ষের মতো আছেন  আমরা তার ছায়ায় নিশ্চিন্তে কাটাচ্ছি।
"আমি না থাকলে তোমাদের খারাপ লাগবে?"
"১০০বার লাগ বে।"
"কি বলছ বৌমা তাহলে যে শিখার সাথে বলছিলে..।
এবার পথে এসো চাঁদু মাধু মনে মনে বলল।তারপর কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলল মাধু " ওতো শিখাকে একটু রাগানোর জন্য বলছিলাম  ।আপনার সাথে খুব আড়ি আছে না?*
"ও তাই ,?রাগ করো না মাধু ।আমি তোমাকে কতো কথা শোনালাম। মাধুকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় আশীর্বাদ করে বললেন "তোমার মত লক্ষ্মীমন্তবউ এ বাড়িতে এসেছ বলেই ,এই সংসার টা এখনো সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলছ।
ভগবান তোমাদের কল্যান করুক।'
আসলে এই সংসারটাই হচ্ছে একটা নাট্যশালা তাই এই রঙ্গমঞ্চে যে যত বেশি ভালো অভিনয় করতে পারবে ,তার তত বেশি প্রতিষ্ঠা ,প্রতিপত্তি সুনাম-সুখ্যাতি ।সংসারে এই অভিনয়ের যথেষ্ট দরকার রয়েছে ।মাধু যেমন এখানে অভিনয় করেছে ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে একটা মমতাময়ী নারী সত্বেও আছে। সে সে যেন তার বিশাল পক্ষপুটের আড়ালে সযত্নে আশ্রয় দিয়েছে সকলকে।
 

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৪




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১৯৪

মনোজের মৌউল নেশা

মমতা রায়চৌধুরী


মনোজ আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল প্রায় রাত্রি নটার পরে।  ক্লান্ত শ্রান্ত মন নিয়ে যখন সে তার কলাপসিপল গেট খুলে ঘরে ঢুকলো তখন মনে হল সে বেশি বড্ড ক্লান্ত হয়ে 
পড়েছে ।তাড়াতাড়ি কোনরকমে আলোটা জ্বাললো । জোরালো আলো আরও বেশি ক্লান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে , তাই মৃদু আলো জ্বাললো।ওদিকে পুবের জানালার শার্সি দেয়া ছিল তার ভেতরে প্রচুর চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের 
মধ্যে ,ঘরের প্রায় সবকিছুই আবছা দেখা 
যাচ্ছে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না দেখতে lনিজের প্যান্ট, শার্টটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে রাখল তারপর এক এক করে ঘরের জানলাগুলো
 খুলে মনে মনে ভাবছে  "কি ব্যাপার আজকের জানলা গুলো বন্ধ? রেখা কি এখনো বাড়ি ফেরেনি ?কি হতে পারে? কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই সোফায় গিয়ে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিলো।
"এইসময় রেখা থাকলে, এক কাপ কফি হলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত ।আজকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন ?মনে মনে ভাবছে  তারপর চোখটা বুজে আসলো। এরমধ্যে দেখা গেল তুতু এসে মনোজের পাশটাতে বসে" কিউ কিউ" আওয়াজ করছে ।মনোজ চোখ বন্ধ করেই বললো " কি ব্যাপার ,তোর আবার কি হলো ?তোর মালকিন কোথায় গেল ,কিছু বলে গেছে ?'
তারপরও দেখা গেল কিউ ,কিউ আওয়াজ করে যাচ্ছে  তখন মনোজ আবার উঠলো ,উঠে দেখল সামনেই ফ্লাক্স রাখা রয়েছে  মনোজ এতক্ষণে খেয়াল করে। ফ্লাক্স এর ঢাকা খুলে
খুলে দেখল' সত্যিই কফি রাখা আছে ।'
"উফ এইজন্যেই রেখা কে এত ভালো লাগে কিন্তু সত্যিই কি এত ভালো লাগে ?"
ভাবতে ভাবতে তু তুর  কাছে গেল  ।
দেখা গেল ও আবার দরজার কাছে যাচ্ছে, বুঝল তুতু বাইরে বেরোবে ।
মনোজ আবার গেটটা খুলে দিল । গেটটা
  বন্ধ না করে সোফায় এসে বসলো আর মনে মনে ভাবল একটু পরেই তো আবার তুতু
 ঢুকবে  কাজেই গেট বন্ধ করে লাভ নেই । সামনেই কাপ রাখা ছিল তাতে কফি ঢেলে খেল। কফি খেতে ই মাথাটা যেন ছেড়ে গেল ,ক্লান্তি দূর হয়ে গেল ।এবার রিমোট নিয়ে নাড়াচাড়া করল টিভিতে সেই একই নিউজ শুনতে আর ভালো লাগছে না ।সেই ভোটের তরজা।'
তার চেয়ে মনোজ সিগারেট হাতে নিয়ে জানলার কাছে গেল তারপর লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো ,ধরিয়ে চাঁদের আলোর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে লাগলো। মনটা যেন আজ কেমন কেমন সিগারেট পাশে এক সুন্দরী নারী।
মনোজের মন ক্যানভাসে নাড়া দিয়ে গেল আরো কিছু তুলির আচড়  মনে পড়ে গেল মনোজ যখন গ্রামের বাড়িতে ছিল সেই সময় প্রতিবেশী এক দিদি তাকে খুবই স্নেহ করত কিন্তু দিদিকে দিদি হিসেবে ভাবতেই পারতো না ।মনে মনে তাকে নিয়ে কত কিছুই কল্পনা করেছিল কিশোর মনে। সেই অলিখিত মনে দোলা দিয়ে গিয়েছিল প্রথম  দিদি নারী ।তার জীবন তখন ভোরের সদ্যফোটা আলোর মত ছড়িয়ে পড়তে চাইছিল চারিদিক। শীতের ভোরের কুয়াশা যখন দূর্বা ঘাসের উপর পড়ে তার ওপর যদি রোদের ছটা পরে তা যেমন চিকচিক করতে থাকে ,এক অপরূপ মুক্তার মত আলোয় ভরে যায় চারিদিক । ঠিক জুঁই দিদিকে দেখে মনোজের মনপ্রাণ হিন্দলিত হত ।এভাবেই মনাকাশে চলতো মেঘের আনাগোনা ।কিন্তু কোথাও দ্বিধা কোথাও যেন একটা লজ্জা, বোধের জগতে কাজ করছিল। ভালোবাসার প্রকাশ করতে পারেনি একটা অনাবিল সর্বদা তার ভেতরে কাজ করেছে কাউকে শেয়ার করতে পারেনি কারন সেটা সমাজের কাছে সেখা নিজে অসম বয়স এ ভালোবাসা কখনো মর্যাদা পাবে
 না  মনোজের থেকে বয়সে তিন বছরের বড় তার সমবয়সী পিন্টুর দিদি । পিন্টুর সঙ্গে একসঙ্গে খেলাধুলা করত ,পিন্টুদের বাড়ি প্রায়শই যেত, পরে বুঝতে পেরেছিল তার কিসের এত টান ওই বাড়ির প্রতি। আসলে দিদির ওই সৌন্দর্য সেই বয়সেই তার মনে দাগ কেটে গেছিল অপরূপ কাঁচা রুপের সাজ , মনোজের মনের ভিতরে জুই দিদির  মাধুর্যএর ছটা সর্বদা ঘুরপাক খেত। তাই কারণে-অকারণে পিন্টু দের বাড়িতে হাজির হতো মনোজ। জুই দিদির অপরূপ সৌন্দর্য। সুন্দর ফর্সা দেহ খানি কোকড়ানো চুল, পটলচেরা চোখ সেই চোখের দৃষ্টি যেন অনেক গভীরে পৌঁছে যেত মনোজ। সাঁতার কাটতো ।নিটল বক্ষের ভেতরে ছিল গোলাপের সুগন্ধ।  
প্রেম যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে ।তার  কোনো দিনক্ষণ থাকে না। বয়স থাকে না ।মনোজের জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছিল  প্রথম যৌবনের সুরভী লেগেছিল, তার মনের কোণে কোন এক বনমালী বাঁশ রী বেজেছিল ।সে মনে মনে প্রত্যাশা করত অভিসার যেতে। তার মানস প্রত্যাশিত সেই প্রেমিকা ছিলো জুইদিদি।
আজকে এসব কথা ভাবতেও খারাপ লাগে কিন্তু কিছু করার ছিল না তার প্রথম প্রেম , তাকে অস্বীকার করবে কি করে? মৌউল ফুলের নেশার মত টান তো।
প্রেমের বোধহয় একটা অবাধ্য ভাব আছে। কারোর জন্য কোন কিছু নিয়ে প্রতীক্ষা করলে বা অনেক আয়োজন নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করলে সে আসে না। তার দর্শন পাওয়া দায়। প্রেম কখনো দিনক্ষণ দেখে আসেনা ,তা শুধু অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে আর যখন আসে তার সেই আবেগ ত্রিভুবনে জুড়ে বসে।
জুই দিদিকে নিয়ে বেশি ভাবলেই তার ভেতরে একটা শিহরণ লাগতো ,সে রাত্রে তার চোখে ঘুম আসত না। জুঁই দিদিকে নীল শাড়িতে খুব সুন্দর মানাত ,যেন একটা নীল পরী নেমে এসেছে কিন্তু একটা দুঃখের বিষয় এত সুন্দর রূপ তার প্রকাশ নেই। মনোজ সেই দিদিকে নিয়েই কত বর্ষার সন্ধ্যা কত জ্যোৎস্নাময় রাত্রি ভেবে গেছে কিন্তু সব সময়  অধরাই থেকে গেছে।
মনোজের শুধু মনে হতো একটি সুকোমল নারীর হৃদয়ে এত সম্ভার রক্ষিত আছে অথচ তার প্রিয়তমের আসন খানা জনশূন্য অন্ধকারে হাহাকার করত। যদি  কাঁচা রূপের সাজের আবরণে আস্তে আস্তে আরো অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়, তার কথা বলার ভঙ্গি ,তার সাজসজ্জা, এমনকি বেনিবন্ধেও  অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায় তাহলে হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেম রাশি একজনের স্মরণেই নিবেদিত হতো, তাহলে কি ভালোই না হত। কত নির্জন রাত্রে মনোজের মনে এভাবে জুঁই দিদি নাড়া দিয়ে যেত। আর মনোজকে উতলা করে দিত।
মনোজ মনে মনে ভাবে এই সৌন্দর্যের একটা  মোহিনীশক্তি আছে । যার বসে মনোজ পড়েছে সেই সুন্দর্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে বারবার তাই মনোজ হতাশ হয়ে যেত তার হৃদয় মরুভূমি নয় সবসময় যেন নতুন রসের উদ্ভব হত।
একসময় এই মোহিনী রূপেই জুঁই দিদি মনোজের মনেও এক  ম্লানগোধূলির আলো তে পরিণত হয়েছিল, যেদিন মনোজ তার কল্পনার প্রথম প্রেমিকা  অন্য কারোর হতে যাচ্ছে ,সেই মুহূর্তে তার কাছে পৃথিবীর রং বদলে গিয়েছিল।

পিন্টু যখন এসে বিয়ের কার্ড খানা মনোজদের বাড়িতে এসে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন মনোজের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছিল, তার মনের ভেতরের সদ্য পাপড়ি মেলা প্রস্ফুটিত ফুল যেন ঝরে পড়তে শুরু করেছিলো। মনে মনে তাকে নিয়ে সাজানো নতুন বাড়ির গোলাপি পর্দা গুলো ক্রমশ অনেকদিনের রং চটা ধুলোর আস্তরণে  পরিণত হয়েছিল।
তার হৃদয় বিকল হয়ে গেছিল সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে চলে এসেছিল যেন মনে হয়েছিল তার চোখের সামনে তার সেই কল্পিত জুই দিদি তার মানসপ্রতিমা যেন নীল জর্জেটের আঁচল খানা মেলে দিয়ে একটা অন্তরাল সৃষ্টি করেছিল দুই দেশেই মোহনীয় উদ্ধত রূপ আর মনোজ দেখতে পেল না।
মনোজ সাহসে বুক বেঁধে আর ভেতরে ত্যাগের মহিমায় উন্নীত হয়ে পরেরদিনই হোস্টেলে চলে গেছিল।
যে মনোজকে হস্টেলে পাঠানোর জন্য বাবা-মা হিমশিম খাচ্ছিল সেই মনোজ নিজের থেকেই হোস্টেলে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে দেখে বাবা-মা একটু অবাক হয়ে গেছিল মাত জিজ্ঞেস করেই ফেলল কি ব্যাপার আজকে তোকে হোস্টেলে যেতে হবে জুয়েল বিয়ে আছে দুদিন থেকে যান তারপরে যাবি।
মনোজ নিরুত্তর থেকে ছিল ছেলের চাউনিতে একটা ভাবলেশহীন প্রতিমূর্তি ধরা পড়েছিল মনোজের মা তখন শিউরে উঠেছিল মনোজকে আর ঘাটাতে সাহস পায়নি মনের ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল
মনোজ তার প্রেমের সকল বাতায়নগুলি রুদ্ধ করে ফেলেছিল সেখানে আর প্রেমের সৌন্দর্য লোক প্রবেশ করতে পারবে না তারপর বহু দিন এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেরিয়ে ছিল কিন্তু কাউকে প্রকাশ করতে পারিনি হয়তো মনের মত এরকম সকলেরই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে যা সব সময় সকলের কাছে শেয়ার করা যায় না।
এসব ভাবছে এমন সময় রেখা এসে বলল" কি ব্যাপার জানালায় দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?""
"কই কিছু নাতো। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?"
"আরে পার্থর মা ,মানে মাসিমা ।'সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে গেছে তাই দেখতে গেছিলাম।
"এ বাবা কখন?"
"সন্ধ্যেবেলায়।"
আর দরজাটাকে হাট করে খুলে রেখেছো যে দেখো তোমার পেছনে কারা কারা বসে আছে।
ও বাবা তুতু, মিলি ,পাইলট সবাই। টু বুঝতে পারেনি দেখো।
তুমি কি এই জগতে ছিলে , অন্য কোন জগতে ছিলে ,কে জানে।'

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৩




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১৯৩

উন্মত্ত খেলা

মমতা রায়চৌধুরী



আজ ছুটির দিন এইমাত্র সূর্য অস্ত গেল । পশ্চিম দিক জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মনোজ সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে আর সন্ধ্যারানীর লজ্জা বনত রক্তিম মায়াটুকু দেখার জন্য উৎসুক  । কিছুক্ষণ আগেও রেখা মনোজের পাশে ছিল রেখা আর আকাশের এই অস্থিয়মান সূর্য। দু'জনকেই   যেন অস্পষ্ট মনে হচ্ছে ।সমস্ত রং যেন আকাশের চোখ  থেকে মুছে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা বিবর্ণ চেহারা এত আকাশের। তবুও অস্পষ্ট বেড়াজাল অতিক্রম করে মনোজের মনে স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে আসে কিছু অজানা তথ্য ।সেদিনও এভাবেই তারা দুজন পাশাপাশি বসেছিল । শুধু পাত্রী পাল্টে গেছে জায়গা পাল্টে গেছে, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।সেদিন কারো  মুখে কোন কথা ছিল না। শুধু পরস্পরের সান্নিধ্য আর অন্ধকার রাত্রিতে তারার চাকচিক্য যেন মনে হচ্ছে রঙের খেলা চলছে আকাশের বুকে ।যখন এই রঙের খেলা চলে তখন তো অপূর্ব লাগে। তখন মনোজের হৃদয় আকাশে শুধু তিথি সবই ভালো লাগে।
মনোজের চোখ যখন তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে নিমিলেষ নেত্রে। তখনও মনোজ চোখের ভাষা বোঝেনি । তাছাড়া কখনো বুঝে উঠতে পারেও নি ।তিথি যেন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখনো মনে হতো সন্ধ্যারাতে ধূসর ছায়ার মতো, কখনো বা পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মত উজ্জ্বল ,কখনো ভোরের শিশির এর উপর সূর্যের কিরণ পরলে ,যেরকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় ,সেরকম।  কখনো মনে হতো নদীর কালো জলের মতো ।আসলে তিথির গহন মনের হদিশ কোনদিনও পায় নি ।একতরফাই তিথিকে ভালোবেসেছিল জানে না । কিন্তু শেষ সময় তিথির আবেগ দেখে মনোজের কখনো মনে হয়নি একতরফাই ভালোবেসেছে মনোজ। তারপরে আর কখনো মনে হয়নি যদি তাই হতো তাহলে ইতিহাস হয়ে যেত না আজ তিথি ইতিহাস।তবে হয়তো  সেটা ছিল তার বয়সের দোষ ।এ কাঁচা বয়স তখন তার ভেতরের তারুণ্যের রক্ত টগবগ করে
 ফুটছে ।হয়তো সে জন্যেই তার উষ্ণতার পারদ চলেছে ।সেই কারণে হয়তো মনোজের সান্নিধ্য তার ভাল লেগেছে ।আজ দীর্ঘদিন পরে এসে  যখন আবার  সে ভালবাসার দাবি নিয়ে এসে হাজির হয় । মনোজ অস্বীকার করে ,এটাই তো স্বাভাবিক কারণ যখন তাকে চেয়েছিলো সে ,তখন তার ভালবাসাকে উপেক্ষা করে পাড়ি দিয়েছিল বিদেশে । মনোজ মনে মনে একটা ছোট্ট সুখের ভালোবাসার নীড় মনের কোনে অজান্তেই রচনা করেছিল। অথচ সেটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার করে দিয়ে চলে গেছে।।তবে কেনই বা আজকে হঠাৎ করে এই সময় আজ আবার তিথির কথা মনে পড়ছে । আজ তিথি তার কাছে অতীত  আর রেখা তার কাছে বর্তমান ।অতীত আর বর্তমানের মাঝে  দাঁড়িয়ে মনোজ ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে  ।ভবিষ্যত  অবশ্যই হওয়া উচিত রেখাকে নিয়ে। রেখাই তার জীবন সঙ্গিনী। রেখার মতো মেয়ে হয় না। উজ্জ্বল ঝকঝকে একটি মেয়ে। কত গুণ ওর। তারপরও মাঝে মাঝে রেখার প্রতি এমন আচরণ করে ফেলে যার জন্য রেখাও ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এসব কথা ভাবছে হঠাৎ করেই দোলা দিয়ে যায় তার কাঁচা বয়সের কিছু ভুল। কাঁচা বয়স কলেজে পড়া অবস্থায় সেই সময় মনের ভেতরে যেন একটা তীব্র তৃষ্ণা কাজ করত ।সবসময় মনেপ্রাণে চাই তো তিথিকে স্পর্শ করতে , তিথির সান্নিধ্য পেতে । নাকি তখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ জন্মায়, হয় তো সে তার জীবনে এসেছিল বলে শুধু তিথির প্রতিই তার মোহ জন্মেছিল। যাইহোক কি আর হবে সেই নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। তবুও মনে পড়েএকদিন  অযাচিতভাবে এসে গেছিল সেই মুহূর্ত। সে দিনটা ছিল এরকমই সন্ধ্যের সময় সূর্য অস্ত যায় যায় একটা দারুন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য তিথি
দের বাড়িতে। সেদিন আরও বন্ধুবান্ধবের আসার কথা ছিল। ওরা আস তে  অনেকটা দেরি করেছিল। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে জানলাগুলোকে দড়াম দড়াম করে বাজনা বাজাচ্ছিল। তিথি  তখন গেছিল চা করতে আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম জানলার কাছে জানালাটা বন্ধ করতে ভাল লাগল না। কেমন যেন একটা উন্মত্ততা কাজ করছিল নিজের ভেতরে, ওটাই যেন ভাল লাগছিল  বাইরের প্রকৃতির খেলা আর নিজের ভেতরের খেলাসেদিন যেন সব একাকার হয়ে যাবে মনে হয়েছিল ।ঠিক সেই সময় তিথি এসে চায়ের কাপটা নামিয়ে যখন বলল 
"কি করছো ?জানলাটাকে বন্ধ করো .।তবুও জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই তিথিকে দেখছিলাম দুচোখ ভরে কি শান্ত ,স্নিগ্ধ, রূপ যেন তিথির মধ্যে কত স্নেহ-মমতা দিয়েই না সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব শিল্পী ।তিথি ছাড়া যেন তখন আর কাউকে অর্থাৎকোন নারী তার কাছে এত সুন্দর বলে মনে হয়নি ।দরজা বন্ধ। তিথি জানালা বন্ধ করতে গেছে ।তখন আমি বলেছিলাম "কি দরকার জানালাটা খোলা থাক না ।দেখছো ,না বাইরে কি সুন্দর ঝড় উঠেছে।"
  তিথি কিছুটা মনোজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল "ঝড় উঠেছে বলেই তো বন্ধ
 করছি । জানলা বন্ধ করতে যাবে ঠিক সেই সময়  তিথির হাত দুটো টেনে এনে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল । তিথিরও যেন কিছুটা মনে হচ্ছিল নিজেকে পিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ  করে ফেলতে চায় মনোজের বুকে। তার সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর আমার ভেতরের  শিরাগুলো যেন বিদীর্ণ করে দিয়ে রক্তের স্রোত ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বিপুল একটা মুহূর্ত যেন তখন কাজ করছিল। তিথির গায়ের গন্ধ তখন সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করে উঠেছিল । তিথির এত সুন্দর সৌন্দর্য প্রজাপতির ডানার মতো যেন
 যেন দুটি গাল ,গোলাপের পাপড়ির মত সুন্দর দুটো উষ্ণ ঠোঁট, চারুকন্ঠ ছিল অনেক নমনীয় যেন মনে হচ্ছিল রক্তকরবী। আর ছিল স্নিগ্ধতা এ ভরা দুটি বক্ষ। ভেতরে যে তখন কি উত্তেজনা কি সর্বনাশা সেই সুখ পরস্পর পরস্পরের কাছে আসা। হয়তো সেদিন বিপ্লব ঘটে যেত যদি না বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ টা আসতো 
 আজ নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সে কথাগুলো রেখার কাছে অকপটে স্বীকার করতেও পারে না একদিন তাকে স্বীকার করতেই হবে নাহলে গ্লানি তাকে কুরে কুরে খাবে কিন্তু কি করে বলবে তার ভাষা কোথায় ?আজকে সেইসব ভাবছে বসে বসে। হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় এসে রেখা ।
"এই নাও তোমার কফি নাও ।
কি এত ভাবছো বল তো ?জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আর কতগুলো সিগারেট খাবে বলো তো ।"
মনোজ বলল" না না বেশি সিগারেট খাই নি ।"
রেখা বলল "কী বলবো ,।বলার তো কিছু নেই। যা ভালো বোঝো করো '।
ওমা দুজনের মধ্যে এই রকম একটু কথা চালাচালি হচ্ছে ।তার মধ্যে তুতু ঢুকে কিউ কিউ আওয়াজ করছে ।
কে জানে? কী হলোতোর ?আবার কি হয়েছে ?"

রেখা তুতুকে আদর করে বললো "শুয়ে পড়ো শুয়ে পড়ো।"
তুতু কি সুন্দর শুয়ে পড়ল।

মনোজের তখনও ঘোর কাটেনি আবার চলে গেছে স্মৃতির অ্যালবামে।
তিথি যখন মনোজকে বলছে "কেউ এসে গেছে সিঁড়িতে তখন হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
মনোজ বলল " আজ বড্ড অশান্ত আমি। তুমিও কি অশান্ত নও।,"
তিথি বলেছিল "আমি শীর্ণ নদীর জল ,শুধুমাত্র একটুখানি ভুলের মাটি ছুঁয়ে গেলাম।"
মনোজ জিজ্ঞেস করেছিল "তুমি কি তৃপ্ত? '
তিথি বলেছিল" তুমি তৃপ্ত নও?'
মনোজ বলেছিল, আজ তৃপ্ত-অতৃপ্ত বিরোধাভাস,'
তিথি বলেছিল তবুও?, এ যেন আশাতীতভাবে পেয়ে যাওয়া । "
যা চেয়ে নেয়া হয়নি, যা অর্জন করা হয়নি।
এত কৌতুহল উত্তেজনা আরও বেশি করে কাজ করে যতক্ষণ না পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়।

এ যে  অফুরন্ত সুখের আধার। হৃদয়ের অন্তস্থল উথলে ওঠে। তবুও আর একবার মনে হয়েছিল দুহাত বাড়িয়ে ওর লতায়মান দেহটিকে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে।

এ ভাবে খেলা যদি চলতে থাকতো আরো কিছুক্ষণ তাহলে সেদিন কি হতো সেটা ভগবান ই
জানতো। তিথি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তাড়াতাড়ি বাহুবন্ধনে ছাড়িয়ে একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিল। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর গেল দরজা খুলতে। আর আমার ভেতরে যে উন্মত্ত লীলা চলেছিল সেটা থমকে গেল কিছুক্ষনের জন্য । তবে বাড়িতে ফিরে এসে রাত্রে শোবার ঘরে গিয়ে শরীরটা হঠাৎ করেই আবার যেন ঝিমঝিম করে উঠলো কেন এরকম হলো কিছুই জানি না  ।তখন সমস্ত রাত শুধু তিথিকে ঘিরে স্বপ্ন এঁকে গেছি। আর ভেবেছি আবার কি তার বুকে এরকম ঝড় উঠবে ?তারা কি আবার কখনো উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠবে। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত শুধু তিথির শরীরের আতর মেখে এপাশ-ওপাশ করেছি।'
সেই আতরের গন্ধ আজও যেন নস্টালজিক হয়ে বারবার ফিরে আসে ,যেন সে এক অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় সুখ।