উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৯৭
সুমিতার জীবন
মমতা রায় চৌধুরী
এমনটা কখনো ভেবেছিল কি সুমিতা ,জীবনটা সেই কোঠীঘরের মতোই আবার হয়ে যাবে?
সেই জীবনের দগদগে ঘা শুকানোর আগেই একি হয়ে গেল। আজ মাটির ঘরে বসে বসে সেটাই ভাবছে। আজ সমস্ত মুখখানা যেন সিদ্ধ করা ডিমের মতোন ফ্যাকাশে। কি ভেবেছিল আর কি হলো ?বিয়ের দু'বছরের মধ্যেই তার জীবনের সমস্ত রস নিংড়ে ছোবড়া করে দিয়ে চলে গেছিল জীবন।
অন্য কোন মাধবি লতা বা সুমিতার খোঁজে। তাকে রেখে গেছিল অন্ধকারে। তাতে আর সুখ নেই ,স্বাদ নেই ,তার সবকিছুতেই যেন অরুচি ধরে গেছে।
হঠাৎ করেই একদিন ফাগুনের রাত ।সেই রাত তার কাছে অনেক মধুর মিষ্টি রসে টইটুম্বুর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না, তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দু'মাসের মধ্যে ফিরে আসার কথা বলে সেই যে গেছে ,তার আর কোন পাত্তা
নেই। ঠিক দুমাস পরে বনোয়ারি তার জীবনে এসেছে ।এর মধ্যে দু বছরে তার সন্তানও হয়েছে। বনোয়ারিলাল এর কাছে শোনা যায় যে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। সে এক মরদ বটে তার কো ঠী ঘরেও এরকম মরদ জোটেনি।
প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি বনোয়ারিলাল এর মতলব। সকালে বাসি উঠোনটা ঝাঁট দিচ্ছে তার আগেই মেয়েটাকে সাবু ফুটিয়ে খাইয়েছে ,এক ফোঁটা দুধও দিতে পারছে না মেয়েটির মুখে ।সেই সময়ে কাজ ধরেছে লোকের বাড়ি ,ঘর ঝাঁট দেওয়া ,বাসন মাজা ইত্যাদি ইত্যাদি। রেখার বাড়িতে সেই সূত্রেই কাজে যাওয়া। ঝাড় দিতে দিতে সে ভাবছে তার আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে মানুষটা যে সেই গেল আর কোনো খোঁজ খবর নিল না ।সে ভাবতেও পারেনি যে তার জীবনে একটা পাজি ন চ্ছার লোক
জুটেছিল ।মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে তাদের সোনালী দিনের কথা। অর্থাৎবিয়ের সীলমোহর যখন দিল কালী মন্দিরে শাঁখা ,সিঁদুর, ঢাকাই শাড়ি পরে। বুঝেছিল এই শাঁখা ,স্বামীর সিঁদুর আসলে সীলমোহর হিসেবেএকটা মেয়েমানুষ রেখেছিল। তার ঘৃণ্য জীবনে ভেবেছিল 'জীবন 'তার আশার আলো । তাকে নতুন জীবন দান করবে। হ্যাঁ নতুন জীবনই তাকে দান করেছিল। সন্তানকে নিয়ে যখন সে দিশেহারা স্বামীর খোঁজ মিলছে না ,তখন বনোয়ারিলাল এসে তাকে হঠাৎ করে হাজার খানেক টাকা ধরিয়ে দেয় বলে তার স্বামী জীবন পাঠিয়েছে সেই সূত্রেই বনোয়ারিলাল মাঝে মাঝে সুমিতার বাড়িতে আসত কিন্তু লোকটার চাহনি বুনো বুনো ছিলো ।মোটেই ভাল লাগেনি ।কেমন যেন একটা উগ্র খিদে দাও দাও করে যেন জ্বলছে ।চোখ মুখের ভেতর দিয়ে ফুটে বের হচ্ছে যেন এক্ষুনি গোগ্রাসে গিলে
ফেলবে মাঝে মাঝে মনে হত সুমিতার ।কিন্তু হাসি মুখে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে তার সাথে কথা বলতো ।সুমিতা যখন জিজ্ঞেস করত যে কবে ফিরে আসবে 'জীবন ?'তখন সে একটু তাচ্ছিল্যভরে হেসে নিতো তারপর বলতো" সময় হলেই আসবে না হলে তো আমি আছি দেখভালের জন্য।"
এর অর্থ সেদিন সুমিতা বুঝ তে পারে নি। বুঝতে পারেনি তার জীবনে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে ।অন্ধকার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
সেদিনটা বিকেল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মাটির ঘর জবজবে ভিজে গেছে। মেয়েকে খাইয়ে শুয়ে দিয়ে সে ঘরে বসে তার রঙ চটা তোবড়ানো বাক্সটা খুলে সেই জিনিস গুলো সে দেখতে দেখছিল আর জীবনের কথা ভাবছিল ।তার মধ্যে ছিল তার সেই বিয়ের ঢাকাই শাড়ি। এটা খুব সাধ করে ঢাকাই চেয়েছিল সুমিতা। এনে ও দিয়েছিল। বাক্সের ভেতর থেকে এক এক করে খুলে দেখছিল, রাখা ছিল ঝুটো মুক্তোর মালা ছিল সিটি গোল্ডের হাতের চুরি, ক'টা মাথার কাঁটা। এগুলো হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবছিল আর জীবনের মুখটাকে চিন্তা করছিল।
সেই রাত্রেই আচমকা দরজায় ঘা পড়ে। সুমিতার চমক ভাঙ্গে তার শব্দে।
ঘর থেকে জিজ্ঞেস করে 'কে?'
ঘরের এক পাশে পাটকাঠির ওপর বস্তা রাখা ছিল তার ওপর একটা কালো ছিট কাটা বিড়াল মুখ গুঁজরে ঘুমাচ্ছিল।
সেই শব্দের যেন ঘুম ভেঙে গেল।
না পাওয়াতে আবার জিজ্ঞেস করে গলা জড়িয়ে কে?"
তখন উত্তর দেয় আমি' বনোয়ারী।"
সুমিতা ভেবে পায় না এত রাত্রে কি করতে আগমন ।কথা শুনে তো মনে হচ্ছে নেশাগ্রস্ত।
কি করবে কি করবে ভাবতে না ভাবতেই আবার দরজা পেটানোর আওয়াজ।
সুমিতা দরজা খোলার সাথে সাথেই বনোয়ারি ঘরে ঢুকে পড়ে।
সুমিতা বলে 'বৃষ্টি জলের রাত্রে আপনি?'
"আমি ছাড়া আর তোমার কি খোঁজখবর রাখে তাই একটু খোঁজ নিতে আসলাম।,"
তখনও মুখ থেকে মদের গন্ধে সারা ঘর ভরে গেছে ,চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে।
কেমন কদর্য চাহনি তবুও সুমিতা বলে "আপনি চলে যান সকালে আসবেন রাত হয়ে গেছে তো?
আমার মেয়েটার বিকেল থেকে জ্বর ।"
"আজ এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি ।চলে যাওয়ার জন্য তো আসি নি সুন্দরী"।
"এসব আপনি কি বলছেন?"
"আমি ঠিকই বলছি ,।আজ রাতে আমি এখানেই থাকব।"
সুমিতা বলে "আমি কিন্তু চেঁচাব। বস্তির লোক সব জেগে উঠবে।"
"চেঁচিয়ে কি হবে?"
"বস্তির লোক দেখবে রাত্রি বেলায় এক মরদ তোমার ঘরে ঢুকেছে?"
আর তাছাড়া এতদিন ধরে খোঁজখবর রাখছি কি এমনি এমনি টাকা দিচ্ছি?"
সুমিতা যেন আকাশ থেকে পড়লো ।বলল "টাকা তো আমার স্বামী আপনার হাতে পাঠাচ্ছে।"
বনোয়ারিলালের কদর্য হাসি তে মাটির ঘর ফাটিয়ে ফেললো ।
তারপর আস্তে আস্তে সুমিতার দিকে অগ্রসর হলো সুমিতার হাতটা ধরে টানলো।
বললো "আজকে আমার তোমার সাথে সোহাগ রাত।"
সুমিতা বলল "আপনি মুখ সামলে কথা বলুন।"
বনোয়ারিলাল বলল" সতী সাবিত্রী । কো ঠ ঘরের থেকে এসেছো বড় বড় কথা ।তাই এবার আমাকে একটু রসে মজাও।
আর তোমার স্বামী তো আমার কাছে তোমাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এতদিন ধরে ভেবেছিলাম যে তুমি আপনা থেকেই আমার কাছে ধরা দেবে তা যখন হলোই না আরে সত্যটা জেনে এবার তো তোমাকে আসতেই হবে আমার কাছে।"
সুমিতা বলল" খবরদার বনওয়ারী লাল বাবু আমার দিকে এগোনোর চেষ্টা করবেন না।"
বনোয়ারিলালের ভেতরে জন্য হিংস্রতা বেড়ে উঠলো।
সুমিতার মুখটা কালো হয়ে গেল ভয়ে ,অপ্রত্যাশিত বিভীষিকার এইরূপ দেখে।
সুমিতা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
তারপর ভয় মিশ্রিত কন্ঠে সুমিতা অনুরোধ করে বনোয়ারীলাল বাবু ,আপনার টাকা আমি শোধ করে দেব কিন্তু আপনি আমার সাথে এরকম করবেন না এই অনুরোধ টা রাখুন।
বনোয়ারিলাল তখনও অর্থহীনভাবে হেসে ওঠে তারপর বলল এতক্ষণ তো হিংস্র বাঘিনীর মত কথা বলছিলে এখন হঠাৎ করে মেনি বিড়াল হয়ে গেলে কি করে?
সুমিতা দু'হাত জোর করে বলে"আপনি আমাকে ছেড়ে দিন আপনার আমি পায়ে পড়ছি।
সুমিতা দু'পা জড়িয়ে ধরে।
বনোয়ারিলাল তখন হিংস্র বাঘ বলে ওঠে আরে আরে করো কি? দুহাত দিয়ে তুলে সুনিতা কে বুকের কাছে আনার চেষ্টা করে আর বলে আমার পায়ের কাছে তোমার জায়গা না তোমার জায়গা আমার হৃদয়ে।
বনোয়ারিলাল এই কথা বলেই সুমিতাকে জোর করে বুকের কাছে চেপে রাখে তারপর তার আঙ্গুলগুলো আস্তে আস্তে পিয় থেকে ক্রমশ তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্পর্শ করতে থাকে সুমিতা অনুভব করে এ যেন বৈশাখ মাসের দুপুরের খড়ের গাদার মতন গরম গা এক্ষুনি পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।
সুমিতা জানে মুখ পোড়া মাগীচাটা পুরুষগুলো সব সময় এরকম কামুক দৃষ্টিতেই মেয়ে মানুষগুলোকে দেখে থাকে ।এ যেন এক মারাত্মক ভাদ্র মাসের কুকুরের মত সে ছটফট করছে। ছ্যাচরা,শয়তান ইতর স্বার্থপর লোককে কি করতে হয় তা সুমিতা জানো। তখন সুমিতা হয়ে গেছে রোদে শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো শক্ত ।তাই সে মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছে ,এর বিষদাঁত ভাঙতেই হবে।
দুজনার মধ্যে জোর ধস্তাধস্তি চলছে হঠাৎই বনোয়ারি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সুমিতাকে মেঝেতে ফেলে দেয় আর সুমিতার গায়ের উপর তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজের কামতৃষ্ণাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করে ।ঠিক সেই সময়ে পাটকাঠির বোঝার পাশেই ছিল একটা বটি কোনরকমে হাতরে হাতরে তার কাছে যাবার চেষ্টা করে ।তারপর পেয়েও যায় ।সে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না ।তার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে।বসিয়ে দেয় এক কোপ। সুমিতা
খেয়াল করে বনোয়ারিলাল তখন মারাত্মকভাবে জখম ,যন্ত্রণার বিকারে তার ওঠার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ তখন আরো বেড়েছে ঢোবাটাতে জল পড়াতে ব্যাংগুলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দে গান তুলেছে আর সুমিতা তখন নিজেকে বাঁচিয়ে ভাবছে যে 'জীবন 'তার নতুন জীবন দিতে চেয়েছিল, সেও তাকে এইভাবে ঠকিয়ে জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়ে গেল। কি চেয়েছিল সে জীবনে স্বামীর একটু ভালোবাসা ,দারিদ্রতা ও তার কাছে হার মানবে । কি এক টানা-পোড়েনে একি হয়ে গেল তার জীবনে।