উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৯৩
উন্মত্ত খেলা
মমতা রায়চৌধুরী
আজ ছুটির দিন এইমাত্র সূর্য অস্ত গেল । পশ্চিম দিক জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মনোজ সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে আর সন্ধ্যারানীর লজ্জা বনত রক্তিম মায়াটুকু দেখার জন্য উৎসুক । কিছুক্ষণ আগেও রেখা মনোজের পাশে ছিল রেখা আর আকাশের এই অস্থিয়মান সূর্য। দু'জনকেই যেন অস্পষ্ট মনে হচ্ছে ।সমস্ত রং যেন আকাশের চোখ থেকে মুছে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা বিবর্ণ চেহারা এত আকাশের। তবুও অস্পষ্ট বেড়াজাল অতিক্রম করে মনোজের মনে স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে আসে কিছু অজানা তথ্য ।সেদিনও এভাবেই তারা দুজন পাশাপাশি বসেছিল । শুধু পাত্রী পাল্টে গেছে জায়গা পাল্টে গেছে, পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।সেদিন কারো মুখে কোন কথা ছিল না। শুধু পরস্পরের সান্নিধ্য আর অন্ধকার রাত্রিতে তারার চাকচিক্য যেন মনে হচ্ছে রঙের খেলা চলছে আকাশের বুকে ।যখন এই রঙের খেলা চলে তখন তো অপূর্ব লাগে। তখন মনোজের হৃদয় আকাশে শুধু তিথি সবই ভালো লাগে।
মনোজের চোখ যখন তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে নিমিলেষ নেত্রে। তখনও মনোজ চোখের ভাষা বোঝেনি । তাছাড়া কখনো বুঝে উঠতে পারেও নি ।তিথি যেন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখনো মনে হতো সন্ধ্যারাতে ধূসর ছায়ার মতো, কখনো বা পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মত উজ্জ্বল ,কখনো ভোরের শিশির এর উপর সূর্যের কিরণ পরলে ,যেরকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় ,সেরকম। কখনো মনে হতো নদীর কালো জলের মতো ।আসলে তিথির গহন মনের হদিশ কোনদিনও পায় নি ।একতরফাই তিথিকে ভালোবেসেছিল জানে না । কিন্তু শেষ সময় তিথির আবেগ দেখে মনোজের কখনো মনে হয়নি একতরফাই ভালোবেসেছে মনোজ। তারপরে আর কখনো মনে হয়নি যদি তাই হতো তাহলে ইতিহাস হয়ে যেত না আজ তিথি ইতিহাস।তবে হয়তো সেটা ছিল তার বয়সের দোষ ।এ কাঁচা বয়স তখন তার ভেতরের তারুণ্যের রক্ত টগবগ করে
ফুটছে ।হয়তো সে জন্যেই তার উষ্ণতার পারদ চলেছে ।সেই কারণে হয়তো মনোজের সান্নিধ্য তার ভাল লেগেছে ।আজ দীর্ঘদিন পরে এসে যখন আবার সে ভালবাসার দাবি নিয়ে এসে হাজির হয় । মনোজ অস্বীকার করে ,এটাই তো স্বাভাবিক কারণ যখন তাকে চেয়েছিলো সে ,তখন তার ভালবাসাকে উপেক্ষা করে পাড়ি দিয়েছিল বিদেশে । মনোজ মনে মনে একটা ছোট্ট সুখের ভালোবাসার নীড় মনের কোনে অজান্তেই রচনা করেছিল। অথচ সেটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার করে দিয়ে চলে গেছে।।তবে কেনই বা আজকে হঠাৎ করে এই সময় আজ আবার তিথির কথা মনে পড়ছে । আজ তিথি তার কাছে অতীত আর রেখা তার কাছে বর্তমান ।অতীত আর বর্তমানের মাঝে দাঁড়িয়ে মনোজ ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ।ভবিষ্যত অবশ্যই হওয়া উচিত রেখাকে নিয়ে। রেখাই তার জীবন সঙ্গিনী। রেখার মতো মেয়ে হয় না। উজ্জ্বল ঝকঝকে একটি মেয়ে। কত গুণ ওর। তারপরও মাঝে মাঝে রেখার প্রতি এমন আচরণ করে ফেলে যার জন্য রেখাও ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এসব কথা ভাবছে হঠাৎ করেই দোলা দিয়ে যায় তার কাঁচা বয়সের কিছু ভুল। কাঁচা বয়স কলেজে পড়া অবস্থায় সেই সময় মনের ভেতরে যেন একটা তীব্র তৃষ্ণা কাজ করত ।সবসময় মনেপ্রাণে চাই তো তিথিকে স্পর্শ করতে , তিথির সান্নিধ্য পেতে । নাকি তখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ জন্মায়, হয় তো সে তার জীবনে এসেছিল বলে শুধু তিথির প্রতিই তার মোহ জন্মেছিল। যাইহোক কি আর হবে সেই নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। তবুও মনে পড়েএকদিন অযাচিতভাবে এসে গেছিল সেই মুহূর্ত। সে দিনটা ছিল এরকমই সন্ধ্যের সময় সূর্য অস্ত যায় যায় একটা দারুন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য তিথি
দের বাড়িতে। সেদিন আরও বন্ধুবান্ধবের আসার কথা ছিল। ওরা আস তে অনেকটা দেরি করেছিল। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে জানলাগুলোকে দড়াম দড়াম করে বাজনা বাজাচ্ছিল। তিথি তখন গেছিল চা করতে আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম জানলার কাছে জানালাটা বন্ধ করতে ভাল লাগল না। কেমন যেন একটা উন্মত্ততা কাজ করছিল নিজের ভেতরে, ওটাই যেন ভাল লাগছিল বাইরের প্রকৃতির খেলা আর নিজের ভেতরের খেলাসেদিন যেন সব একাকার হয়ে যাবে মনে হয়েছিল ।ঠিক সেই সময় তিথি এসে চায়ের কাপটা নামিয়ে যখন বলল
"কি করছো ?জানলাটাকে বন্ধ করো .।তবুও জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই তিথিকে দেখছিলাম দুচোখ ভরে কি শান্ত ,স্নিগ্ধ, রূপ যেন তিথির মধ্যে কত স্নেহ-মমতা দিয়েই না সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব শিল্পী ।তিথি ছাড়া যেন তখন আর কাউকে অর্থাৎকোন নারী তার কাছে এত সুন্দর বলে মনে হয়নি ।দরজা বন্ধ। তিথি জানালা বন্ধ করতে গেছে ।তখন আমি বলেছিলাম "কি দরকার জানালাটা খোলা থাক না ।দেখছো ,না বাইরে কি সুন্দর ঝড় উঠেছে।"
তিথি কিছুটা মনোজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল "ঝড় উঠেছে বলেই তো বন্ধ
করছি । জানলা বন্ধ করতে যাবে ঠিক সেই সময় তিথির হাত দুটো টেনে এনে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল । তিথিরও যেন কিছুটা মনে হচ্ছিল নিজেকে পিষে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলতে চায় মনোজের বুকে। তার সারা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর আমার ভেতরের শিরাগুলো যেন বিদীর্ণ করে দিয়ে রক্তের স্রোত ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বিপুল একটা মুহূর্ত যেন তখন কাজ করছিল। তিথির গায়ের গন্ধ তখন সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করে উঠেছিল । তিথির এত সুন্দর সৌন্দর্য প্রজাপতির ডানার মতো যেন
যেন দুটি গাল ,গোলাপের পাপড়ির মত সুন্দর দুটো উষ্ণ ঠোঁট, চারুকন্ঠ ছিল অনেক নমনীয় যেন মনে হচ্ছিল রক্তকরবী। আর ছিল স্নিগ্ধতা এ ভরা দুটি বক্ষ। ভেতরে যে তখন কি উত্তেজনা কি সর্বনাশা সেই সুখ পরস্পর পরস্পরের কাছে আসা। হয়তো সেদিন বিপ্লব ঘটে যেত যদি না বাইরে কলিং বেলের আওয়াজ টা আসতো
আজ নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সে কথাগুলো রেখার কাছে অকপটে স্বীকার করতেও পারে না একদিন তাকে স্বীকার করতেই হবে নাহলে গ্লানি তাকে কুরে কুরে খাবে কিন্তু কি করে বলবে তার ভাষা কোথায় ?আজকে সেইসব ভাবছে বসে বসে। হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় এসে রেখা ।
"এই নাও তোমার কফি নাও ।
কি এত ভাবছো বল তো ?জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আর কতগুলো সিগারেট খাবে বলো তো ।"
মনোজ বলল" না না বেশি সিগারেট খাই নি ।"
রেখা বলল "কী বলবো ,।বলার তো কিছু নেই। যা ভালো বোঝো করো '।
ওমা দুজনের মধ্যে এই রকম একটু কথা চালাচালি হচ্ছে ।তার মধ্যে তুতু ঢুকে কিউ কিউ আওয়াজ করছে ।
কে জানে? কী হলোতোর ?আবার কি হয়েছে ?"
রেখা তুতুকে আদর করে বললো "শুয়ে পড়ো শুয়ে পড়ো।"
তুতু কি সুন্দর শুয়ে পড়ল।
মনোজের তখনও ঘোর কাটেনি আবার চলে গেছে স্মৃতির অ্যালবামে।
তিথি যখন মনোজকে বলছে "কেউ এসে গেছে সিঁড়িতে তখন হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
মনোজ বলল " আজ বড্ড অশান্ত আমি। তুমিও কি অশান্ত নও।,"
তিথি বলেছিল "আমি শীর্ণ নদীর জল ,শুধুমাত্র একটুখানি ভুলের মাটি ছুঁয়ে গেলাম।"
মনোজ জিজ্ঞেস করেছিল "তুমি কি তৃপ্ত? '
তিথি বলেছিল" তুমি তৃপ্ত নও?'
মনোজ বলেছিল, আজ তৃপ্ত-অতৃপ্ত বিরোধাভাস,'
তিথি বলেছিল তবুও?, এ যেন আশাতীতভাবে পেয়ে যাওয়া । "
যা চেয়ে নেয়া হয়নি, যা অর্জন করা হয়নি।
এত কৌতুহল উত্তেজনা আরও বেশি করে কাজ করে যতক্ষণ না পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়।
এ যে অফুরন্ত সুখের আধার। হৃদয়ের অন্তস্থল উথলে ওঠে। তবুও আর একবার মনে হয়েছিল দুহাত বাড়িয়ে ওর লতায়মান দেহটিকে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে।
এ ভাবে খেলা যদি চলতে থাকতো আরো কিছুক্ষণ তাহলে সেদিন কি হতো সেটা ভগবান ই
জানতো। তিথি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত তাড়াতাড়ি বাহুবন্ধনে ছাড়িয়ে একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিল। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর গেল দরজা খুলতে। আর আমার ভেতরে যে উন্মত্ত লীলা চলেছিল সেটা থমকে গেল কিছুক্ষনের জন্য । তবে বাড়িতে ফিরে এসে রাত্রে শোবার ঘরে গিয়ে শরীরটা হঠাৎ করেই আবার যেন ঝিমঝিম করে উঠলো কেন এরকম হলো কিছুই জানি না ।তখন সমস্ত রাত শুধু তিথিকে ঘিরে স্বপ্ন এঁকে গেছি। আর ভেবেছি আবার কি তার বুকে এরকম ঝড় উঠবে ?তারা কি আবার কখনো উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠবে। এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত শুধু তিথির শরীরের আতর মেখে এপাশ-ওপাশ করেছি।'
সেই আতরের গন্ধ আজও যেন নস্টালজিক হয়ে বারবার ফিরে আসে ,যেন সে এক অভূতপূর্ব অনির্বচনীয় সুখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much