২৫ জুলাই ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস উপন্যাস টানাপোড়েন ১৯৪




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১৯৪

মনোজের মৌউল নেশা

মমতা রায়চৌধুরী


মনোজ আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল প্রায় রাত্রি নটার পরে।  ক্লান্ত শ্রান্ত মন নিয়ে যখন সে তার কলাপসিপল গেট খুলে ঘরে ঢুকলো তখন মনে হল সে বেশি বড্ড ক্লান্ত হয়ে 
পড়েছে ।তাড়াতাড়ি কোনরকমে আলোটা জ্বাললো । জোরালো আলো আরও বেশি ক্লান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে , তাই মৃদু আলো জ্বাললো।ওদিকে পুবের জানালার শার্সি দেয়া ছিল তার ভেতরে প্রচুর চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের 
মধ্যে ,ঘরের প্রায় সবকিছুই আবছা দেখা 
যাচ্ছে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না দেখতে lনিজের প্যান্ট, শার্টটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে রাখল তারপর এক এক করে ঘরের জানলাগুলো
 খুলে মনে মনে ভাবছে  "কি ব্যাপার আজকের জানলা গুলো বন্ধ? রেখা কি এখনো বাড়ি ফেরেনি ?কি হতে পারে? কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই সোফায় গিয়ে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিলো।
"এইসময় রেখা থাকলে, এক কাপ কফি হলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত ।আজকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন ?মনে মনে ভাবছে  তারপর চোখটা বুজে আসলো। এরমধ্যে দেখা গেল তুতু এসে মনোজের পাশটাতে বসে" কিউ কিউ" আওয়াজ করছে ।মনোজ চোখ বন্ধ করেই বললো " কি ব্যাপার ,তোর আবার কি হলো ?তোর মালকিন কোথায় গেল ,কিছু বলে গেছে ?'
তারপরও দেখা গেল কিউ ,কিউ আওয়াজ করে যাচ্ছে  তখন মনোজ আবার উঠলো ,উঠে দেখল সামনেই ফ্লাক্স রাখা রয়েছে  মনোজ এতক্ষণে খেয়াল করে। ফ্লাক্স এর ঢাকা খুলে
খুলে দেখল' সত্যিই কফি রাখা আছে ।'
"উফ এইজন্যেই রেখা কে এত ভালো লাগে কিন্তু সত্যিই কি এত ভালো লাগে ?"
ভাবতে ভাবতে তু তুর  কাছে গেল  ।
দেখা গেল ও আবার দরজার কাছে যাচ্ছে, বুঝল তুতু বাইরে বেরোবে ।
মনোজ আবার গেটটা খুলে দিল । গেটটা
  বন্ধ না করে সোফায় এসে বসলো আর মনে মনে ভাবল একটু পরেই তো আবার তুতু
 ঢুকবে  কাজেই গেট বন্ধ করে লাভ নেই । সামনেই কাপ রাখা ছিল তাতে কফি ঢেলে খেল। কফি খেতে ই মাথাটা যেন ছেড়ে গেল ,ক্লান্তি দূর হয়ে গেল ।এবার রিমোট নিয়ে নাড়াচাড়া করল টিভিতে সেই একই নিউজ শুনতে আর ভালো লাগছে না ।সেই ভোটের তরজা।'
তার চেয়ে মনোজ সিগারেট হাতে নিয়ে জানলার কাছে গেল তারপর লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো ,ধরিয়ে চাঁদের আলোর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে লাগলো। মনটা যেন আজ কেমন কেমন সিগারেট পাশে এক সুন্দরী নারী।
মনোজের মন ক্যানভাসে নাড়া দিয়ে গেল আরো কিছু তুলির আচড়  মনে পড়ে গেল মনোজ যখন গ্রামের বাড়িতে ছিল সেই সময় প্রতিবেশী এক দিদি তাকে খুবই স্নেহ করত কিন্তু দিদিকে দিদি হিসেবে ভাবতেই পারতো না ।মনে মনে তাকে নিয়ে কত কিছুই কল্পনা করেছিল কিশোর মনে। সেই অলিখিত মনে দোলা দিয়ে গিয়েছিল প্রথম  দিদি নারী ।তার জীবন তখন ভোরের সদ্যফোটা আলোর মত ছড়িয়ে পড়তে চাইছিল চারিদিক। শীতের ভোরের কুয়াশা যখন দূর্বা ঘাসের উপর পড়ে তার ওপর যদি রোদের ছটা পরে তা যেমন চিকচিক করতে থাকে ,এক অপরূপ মুক্তার মত আলোয় ভরে যায় চারিদিক । ঠিক জুঁই দিদিকে দেখে মনোজের মনপ্রাণ হিন্দলিত হত ।এভাবেই মনাকাশে চলতো মেঘের আনাগোনা ।কিন্তু কোথাও দ্বিধা কোথাও যেন একটা লজ্জা, বোধের জগতে কাজ করছিল। ভালোবাসার প্রকাশ করতে পারেনি একটা অনাবিল সর্বদা তার ভেতরে কাজ করেছে কাউকে শেয়ার করতে পারেনি কারন সেটা সমাজের কাছে সেখা নিজে অসম বয়স এ ভালোবাসা কখনো মর্যাদা পাবে
 না  মনোজের থেকে বয়সে তিন বছরের বড় তার সমবয়সী পিন্টুর দিদি । পিন্টুর সঙ্গে একসঙ্গে খেলাধুলা করত ,পিন্টুদের বাড়ি প্রায়শই যেত, পরে বুঝতে পেরেছিল তার কিসের এত টান ওই বাড়ির প্রতি। আসলে দিদির ওই সৌন্দর্য সেই বয়সেই তার মনে দাগ কেটে গেছিল অপরূপ কাঁচা রুপের সাজ , মনোজের মনের ভিতরে জুই দিদির  মাধুর্যএর ছটা সর্বদা ঘুরপাক খেত। তাই কারণে-অকারণে পিন্টু দের বাড়িতে হাজির হতো মনোজ। জুই দিদির অপরূপ সৌন্দর্য। সুন্দর ফর্সা দেহ খানি কোকড়ানো চুল, পটলচেরা চোখ সেই চোখের দৃষ্টি যেন অনেক গভীরে পৌঁছে যেত মনোজ। সাঁতার কাটতো ।নিটল বক্ষের ভেতরে ছিল গোলাপের সুগন্ধ।  
প্রেম যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে ।তার  কোনো দিনক্ষণ থাকে না। বয়স থাকে না ।মনোজের জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছিল  প্রথম যৌবনের সুরভী লেগেছিল, তার মনের কোণে কোন এক বনমালী বাঁশ রী বেজেছিল ।সে মনে মনে প্রত্যাশা করত অভিসার যেতে। তার মানস প্রত্যাশিত সেই প্রেমিকা ছিলো জুইদিদি।
আজকে এসব কথা ভাবতেও খারাপ লাগে কিন্তু কিছু করার ছিল না তার প্রথম প্রেম , তাকে অস্বীকার করবে কি করে? মৌউল ফুলের নেশার মত টান তো।
প্রেমের বোধহয় একটা অবাধ্য ভাব আছে। কারোর জন্য কোন কিছু নিয়ে প্রতীক্ষা করলে বা অনেক আয়োজন নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করলে সে আসে না। তার দর্শন পাওয়া দায়। প্রেম কখনো দিনক্ষণ দেখে আসেনা ,তা শুধু অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে আর যখন আসে তার সেই আবেগ ত্রিভুবনে জুড়ে বসে।
জুই দিদিকে নিয়ে বেশি ভাবলেই তার ভেতরে একটা শিহরণ লাগতো ,সে রাত্রে তার চোখে ঘুম আসত না। জুঁই দিদিকে নীল শাড়িতে খুব সুন্দর মানাত ,যেন একটা নীল পরী নেমে এসেছে কিন্তু একটা দুঃখের বিষয় এত সুন্দর রূপ তার প্রকাশ নেই। মনোজ সেই দিদিকে নিয়েই কত বর্ষার সন্ধ্যা কত জ্যোৎস্নাময় রাত্রি ভেবে গেছে কিন্তু সব সময়  অধরাই থেকে গেছে।
মনোজের শুধু মনে হতো একটি সুকোমল নারীর হৃদয়ে এত সম্ভার রক্ষিত আছে অথচ তার প্রিয়তমের আসন খানা জনশূন্য অন্ধকারে হাহাকার করত। যদি  কাঁচা রূপের সাজের আবরণে আস্তে আস্তে আরো অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায়, তার কথা বলার ভঙ্গি ,তার সাজসজ্জা, এমনকি বেনিবন্ধেও  অভিজ্ঞ সুরুচির পরিচয় পাওয়া যায় তাহলে হৃদয়ের সমস্ত অপ্রার্থিত প্রেম রাশি একজনের স্মরণেই নিবেদিত হতো, তাহলে কি ভালোই না হত। কত নির্জন রাত্রে মনোজের মনে এভাবে জুঁই দিদি নাড়া দিয়ে যেত। আর মনোজকে উতলা করে দিত।
মনোজ মনে মনে ভাবে এই সৌন্দর্যের একটা  মোহিনীশক্তি আছে । যার বসে মনোজ পড়েছে সেই সুন্দর্যকে উপলব্ধি করতে না পেরে বারবার তাই মনোজ হতাশ হয়ে যেত তার হৃদয় মরুভূমি নয় সবসময় যেন নতুন রসের উদ্ভব হত।
একসময় এই মোহিনী রূপেই জুঁই দিদি মনোজের মনেও এক  ম্লানগোধূলির আলো তে পরিণত হয়েছিল, যেদিন মনোজ তার কল্পনার প্রথম প্রেমিকা  অন্য কারোর হতে যাচ্ছে ,সেই মুহূর্তে তার কাছে পৃথিবীর রং বদলে গিয়েছিল।

পিন্টু যখন এসে বিয়ের কার্ড খানা মনোজদের বাড়িতে এসে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন মনোজের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছিল, তার মনের ভেতরের সদ্য পাপড়ি মেলা প্রস্ফুটিত ফুল যেন ঝরে পড়তে শুরু করেছিলো। মনে মনে তাকে নিয়ে সাজানো নতুন বাড়ির গোলাপি পর্দা গুলো ক্রমশ অনেকদিনের রং চটা ধুলোর আস্তরণে  পরিণত হয়েছিল।
তার হৃদয় বিকল হয়ে গেছিল সে দ্রুতপদে নিজের ঘরে চলে এসেছিল যেন মনে হয়েছিল তার চোখের সামনে তার সেই কল্পিত জুই দিদি তার মানসপ্রতিমা যেন নীল জর্জেটের আঁচল খানা মেলে দিয়ে একটা অন্তরাল সৃষ্টি করেছিল দুই দেশেই মোহনীয় উদ্ধত রূপ আর মনোজ দেখতে পেল না।
মনোজ সাহসে বুক বেঁধে আর ভেতরে ত্যাগের মহিমায় উন্নীত হয়ে পরেরদিনই হোস্টেলে চলে গেছিল।
যে মনোজকে হস্টেলে পাঠানোর জন্য বাবা-মা হিমশিম খাচ্ছিল সেই মনোজ নিজের থেকেই হোস্টেলে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে দেখে বাবা-মা একটু অবাক হয়ে গেছিল মাত জিজ্ঞেস করেই ফেলল কি ব্যাপার আজকে তোকে হোস্টেলে যেতে হবে জুয়েল বিয়ে আছে দুদিন থেকে যান তারপরে যাবি।
মনোজ নিরুত্তর থেকে ছিল ছেলের চাউনিতে একটা ভাবলেশহীন প্রতিমূর্তি ধরা পড়েছিল মনোজের মা তখন শিউরে উঠেছিল মনোজকে আর ঘাটাতে সাহস পায়নি মনের ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল
মনোজ তার প্রেমের সকল বাতায়নগুলি রুদ্ধ করে ফেলেছিল সেখানে আর প্রেমের সৌন্দর্য লোক প্রবেশ করতে পারবে না তারপর বহু দিন এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেরিয়ে ছিল কিন্তু কাউকে প্রকাশ করতে পারিনি হয়তো মনের মত এরকম সকলেরই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে যা সব সময় সকলের কাছে শেয়ার করা যায় না।
এসব ভাবছে এমন সময় রেখা এসে বলল" কি ব্যাপার জানালায় দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?""
"কই কিছু নাতো। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?"
"আরে পার্থর মা ,মানে মাসিমা ।'সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকে গেছে তাই দেখতে গেছিলাম।
"এ বাবা কখন?"
"সন্ধ্যেবেলায়।"
আর দরজাটাকে হাট করে খুলে রেখেছো যে দেখো তোমার পেছনে কারা কারা বসে আছে।
ও বাবা তুতু, মিলি ,পাইলট সবাই। টু বুঝতে পারেনি দেখো।
তুমি কি এই জগতে ছিলে , অন্য কোন জগতে ছিলে ,কে জানে।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much