উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৯৫
অভিনয়
মমতা রায় চৌধুরী
নারী যেন নদীর মত আপন বেগে প্রবাহিত হতে চায় কিন্তু তার গতি রুদ্ধ করে দেয়া হয় ।একদিকে যদি ভরাট হয়, অন্যদিকে ভাঙ্গন ।তাই দুই কুলকে সযত্নে রক্ষা করে চলতে হয়
নারীকে ,আর সংসার প্রবেশ করলে তো কথাই নেই ।একদিকে সংসার অন্যদিকে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই। এই দুটো দিক সযত্নে যখন ব্যালেন্স করে রাখা যায় বা চলা যায় তাহলে সেই ক্ষেত্রে সেই নারী সংসারে তত বেশি প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি, সুনাম। মাধুরী বরাবর এটা ব্যালেন্স করে চলেছে। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তা নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে বসেছে ,কখনো স্বামীর মন রক্ষা করা ,সেখানে তার অভিনয়টা খুব পাকাপোক্তভাবে করতে হয় ।কখনো বা সন্তানদের ক্ষেত্রে কখনো বা শাশুড়ির সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত্রে তার নিজের শাশুড়ি নেই । এখন সবই পিসি শাশুড়িদের সঙ্গে।
এই তো শিখার বিয়ের পর থেকে মেজো পিসি শাশুড়ি রয়েছেন ,তার আবার শরীর খারাপ একটুতেই অভিমান। সব দিকে মাধুকে নজর রাখতে হয় ,বিরক্ত হলেও সে বিরক্তিভাব প্রকাশ থাকে না ।সব সময় হাসিমুখে চলে, সর মাধুর্যে একটা আলাদা চমক আছে।
এইতো গত পরশুদিন শিখা ফোন করেছিল বলেছিল বৌদি ভাই এসো না কদিন এখানে বেরিয়ে যাও। বাড়ি ছেড়ে তো নড়ার কোন অবসর তুমি পাও না।".
মাধুরী হেসে বলেছিল 'যাব বৈকি ।"
শিখা উৎফুল্ল হয়ে বললো ' কবে আসছো
বলো ?বলো ,বলো?"
"এইতো মেজ পিসিমা রয়েছেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন ।"
শিখা হতাশ হয়ে বলে "তারপর?''
মাধু বলল " হ্যাঁ তার পরই তো।
রেখে যাই বল কার ভরসায়।"
"বলে আচ্ছা ,বৌদি সব দায়িত্ব কি শুধু তুমিই নিয়ে রেখেছো ?তোমার নিজস্বতা বলে কিছু
নেই ।এখন আমি বড় হয়েছি to আমার বিয়ে দিয়েছ। এবার আমি যেটা বলবো তোমাকে সেটাই শুনতে হবে।"
"হ্যাঁ জানি তো ।এরপর আমাদের বয়স হয়ে যাবে তোরাই তো আমাদেরকে সবকিছু বুঝাবি, শাসন করবি। তোরা ছাড়া কে আছে বল?"
এই কথা বলে এড়িয়ে যাবার মতলব না? বাহরে কোথায় গেলাম বল?'
"তবে না না তো কি বলো?'
"বাববা পিসিমা জানতে পারলে খাপ্পা হয়ে যাবে রে?"
বলার আগে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল 'পিসিশাশুড়ি আবার শুনতে পেলেন কিনা?''
শিখা বলল "তুমি আবার এ কথাগুলো বলছে আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নাও।
মাধু মনে মনে ভাবল সে আর বলতে ।সে তো দেখে নিয়েছে শিখা কি করে মাধুর মনের কথা জানে কে জানে?"
কি হলো বৌদি চুপ করে আছো যে?
পিসি কবে যাবে বল তো ?আমার বিয়ের আগে এসেছে, এখনো পড়ে আছে।"
"আমি কি করে বলি বল ?তাদের বাপের,! বাড়ি আসতেই পারেন।"
"বৌদি এতকিছু সহ্য করো অন্য কেউ বলে না কবে মুখের উপর বলে দিতো।"
কি করব বলো? সবকিছুই তো মেনে নিতে হবে
আর কত মানাবে বলতো? "
"দাদারা আর ফোন করে নি পিসির ব্যাপারে?"
'কই।এখন তোর দাদার কাছে করেছে কিনা জানিনা?'
'ও মাধু ও মাধু চা টা পাবো নাকি গো?'
'কে পিসির গলা না?'
'হ্যাঁ রে ,বলতে না বলতেই।'
শিখা বলল 'যেন বোমা বর্ষণ হচ্ছে।'
মাধু একটু শিহরিত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সাড়ে চারটে বাজে সর্বনাশ।"
শিখা বলল-হঠাত সর্বনাশ করে উঠলো যে?
"বাবা এই টাইমে যদি চা না পান ,তাহলে হার্টের ট্রাবল দেয় নাকি ওনার খুব।"
"বলছো কি বৌদি ভাই"? শিখা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। বাববা যাই হোক তোমার মুখ থেকে তবু এই কথাটা বেরোলো।'
"এবার আমি ফোনটা রাখছি বুঝেছিস, পরে কথা বলব।
"কেন রানুদি আসেনি ।রানুদিকে বলো না আজ চা করে দিতে?"
"রানু ঘর ঝাঁট দিচ্ছে।"
রানু "একটু চায়ের জলটা বসা তো?
পিসি শাশুড়ি উপর থেকে সব লক্ষ্য রাখলো আর মনের ভেতরে গজ গজ করতে লাগলেন তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে বসলেন।
এমনি তুই ভালো আছিস তো? কল্যাণের খবর কি?"
শিখা একটু চুপ করে থেকে বলল' চলছে ।'
"সামার ভাকেশন পড়েনি ?কদিনের জন্য একটু বেরিয়ে যা।'
'আর ব'লো না তো, আজ এই সেমিনার ,কাল ওই সেমিনার করে বেড়াচ্ছে ।'
"আর আমার ননদিনীকে সময় দিচ্ছে না তাই তো?"
শিখা চুপ করে থেকে বলেন আমার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বৌদি ভাই?
রানু চা করে এনে মাধু কে এক কাপ দিয়ে বললো" বৌদি এই নাও চা "
মাধু শিখা কে বলল "এই দেখ, রানু চা করে এনেছে । তোর চা কোথায়? আর পিসিমা চা দিয়েছিস?
রানু বলল 'হ্যাঁ দিয়েছি।
কার সাথে কথা বলছো গো, দিদিভাই? আমাকে একটু দাও না কথা বলি।
মাধু বলল "এই শিখা ,এই নে, রানু কথা বলবে তোর সাথে?''
আরে কেমন আছিস রানু?
আছি দিদি তুমি ভালো আছো কবে আসবে?
ভালো আছি আমি গেলে তো তোর বাসন বাড়বে।
দিদি কোনদিন আমি বলেছি !যতদিন এই বাড়িতে কাজে লেগেছি তোমরা আসলে বাসন বাড়বে,?
"না রে পাগলী ,আমি এমনি বললাম আসলে ম্যাক্সিমাম কাজের লোক না ,এই আমার বাড়িতেই দেখ না দু একজন লোক আসলেই আগে জিজ্ঞেস করবে কদিন থাকবে !বল, খারাপ লাগে না ?এর মধ্যে ভদ্রতা নেই রে বাবা ।আমি এমনি বলেছি মনে কিছু করিস না ।"
একগাল হেসে বলল 'না গো দিদি ,আমি কখনো তোমাদেরকে না পর ভাবতে পারি না ।আসলে এরকম ভালোবাসা আমি আর কোন পরিবারে পাই নি।"
"ঠিক আছে শোন, আমি এরপরে গেলে তোর একটা ভালো কানের দুল আর হারের সেট নিয়ে যাচ্ছি কেমন ?তোকে খুব মানাবে দেখিস আর বৌদি ভাইয়ের যেন কষ্ট না হয় দেখিস কিন্তু ,।রানু , বৌদি ভাই কিন্তু কখনো বলবে না নিজের থেকে একটু করে দিস।"
হ্যাঁগো ,বৌদি ভাই তো কথাই শোনে না ।দেখবো আমি আসার আগে কত কাজ করে
নিয়েছে ।আমি মাঝে মাঝে রেগে যাই জানো
তো ? রেগে গিয়ে বলি' আমাকে রাখার কি দরকার ?তুমি তো নিজেই করতে পারো।"
"আমাদের বৌদি ভাই বুঝলি রানু ,সবার দুঃখ নিজে ভাগ করে নিতে জানে আচ্ছা শোন, যাই বলুক তুই কিন্তু কামাই করিস না ।বাবা না না আমি এগুলো আমার নিজেরই ভালো লাগে না অন্য বাড়িতে কামাই করলে তোমাদের বাড়িতে আমি কামাই করব না কখনো হয়তো দেরি হতে পারে?
তারপর বৌদি ভাইয়ের দিকে তাকে বললো" বল বৌদি ভাই ,আমি কামাই করি?"
তুই মেলা বকেছিস তোকে আর বকতে হবে
না ।যা দিয়ে এবার ভাল করে বাসন টাসন মেজে নে । আবার তো বাড়ি যাবি ?ঠিক আছে ।না রে কামাই করে না ।করলে ও বলে যায় । বাববা আগের যে কাজে ছিল যা ভুগিয়েছে ।সত্যি কথা রানুর মত মেয়ে পেয়েছি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। ও খুবই ভালো মেয়ে।"
কথাটা শুনে খুব রানু খুশি হলো ।তারপর হাসতে হাসতে নিজের কাজ করতে গেল।
"ফোন করাটা কমেছে বৌদি ভাই ?"
"ওইটাই তো রোগ।যেদিন ফোন নিয়ে আসবে কাজ করার আগে ফোনে গল্প,।
" কার সাথে কথা বলে, সেই হাঁদু?
ছেলেটি কি করে গো বৌদি ভাই?"
"জানি না বাবা ,রানুই জানে। রানুর কাছে ওই ছেলেই সর্বেসর্বা ওর ব্যাপারে কিছু বলা যাবে
না ।ও বাবা এ যে তোকে বলছি আবার শুনে ফেললে তো একেবারে মুখ হাঁড়ি করে ফেলবে।'
"ঠিক আছে, রাখছি রে সন্ধে দেব কেমন? ভালো থাকিস।"
ফোনটা কেটে দিয়ে মাধু দেখছে, রানু চলে যাচ্ছে "কি রে রানু ,আজকে তুই আমাকে না বলেই চলে যাচ্ছিস? কি ব্যাপার?"
"এমনি তুমি ফোনে কথা বলছো তো তাই?"
মাধু বুঝল নিশ্চয়ই হাদুর ব্যাপারটা বলেছি শুনে নিয়েছে।
"বুঝেছি তুই আমার উপর রাগ করেছিস, তোকে চা করতে হয়েছে বলে?"
বাববা এত রাগ। একটু চা করতে গিয়ে, তুই তো চা করে খাওয়াস তো। তোর হাতে চা কত ভালো?"
এ নিয়ে মুখ ভার করি নি বৌদিভাই ।আমি কখনো চা করতে গিয়ে এরকম করেছি?'
"তাহলে এত গোসা ক্যান,? তোমার মুখে অমাবস্যা লেগেছে?ও বাবা তোর চোখে জল।"
মাধু রানুকে কাছে টেনে বললো' আমি কি এমন কথা বলেছি রে। যার জন্য তুই কষ্ট পেয়েছিস?"
"কি করব বলো আমি তো হাদুকে ভালোবাসি।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালোবাসা অপরাধ নাক
রে ?ভালবেসেছিস বেশ করেছিস ।তুই ওকেই ভালোবাসবি। হাদুর মতো ছেলে হয় নাকি? তোকে কতো ভালবাসে?
একদিন আমার কাছে হাদু কে নিয়ে আসবি তো?"
রানু খুব খুশি হয়ে বলল" তুমি দেখবে
বৌদিভাই ?তুমি দেখবে ?ঠিক আছে নিয়ে আসব।"
"আমি তো এমনি শিখার আছে ইয়ার্কি
মারছিলাম ।একটা ক্ষেপি মেয়ে। রানুকে কাছে টেনে আর একটু আদর করে দিলো।"
রানু খুশি হয়ে বাড়ী চলে গেল।
এরপর মাধু গেল পিসিমার কাছে ।তার এখন ওষুধ খাওয়ার টাইম ।সন্ধ্যের নাস্তার আগে ওষুধ আছে।
মাধু ঘরে ঢোকার আগে বলল" পিসিমা, পিসিমা ঘুমিয়ে গেলে ন নাকি পিসিমা? আপনার ওষুধ খাবার আছে খেয়ে নিন ।না হলে আবার সেই সন্ধ্যেবেলার নাস্তা খেতে পারবেন না । উঠুন,
উঠুন।শুয়ে আছেন ?কি ব্যাপার শরীর খারাপ?"
"একি চা খাননি কেন?"
"ইচ্ছে হয়নি তাই?"
"ওমা সেকি কথা !আপনার ওই টাইমে চা না খেলে শরীর খারাপ করে মাথা ছাড়ে না। আচ্ছা খান নিকেনো?"
"আজ সুরো অফিস থেকে আসলে একটু ফোন করতে ব'লো তো ,আমার ছেলের কাছে।"
"সে কি হঠাৎ ফোন? মন খারাপ করছে সবার জন্য?"
"না মা কে আর কতদিন এখানে ফেলে রাখবে
বলো ?নিজের বাড়িঘরেও তো যেতে হবে নাকি?"
মাধু জানে কিভাবে পেট থেকে কথা বের করে নিতে হয়। তার মানে শিখার সাথে যখন পিসি মাকে নিয়ে কথা বলছিল, তখন কিছু একটা শুনে নিয়েছেন। তাই এত গোসা।'
"ঠিক আছে পিসিমা, সব কথা হবে আরো ক'দিন থেকে যান। আপনি না থাকলে কি আমাদের ভালো লাগে বলুন? কেমন বটবৃক্ষের মতো আছেন আমরা তার ছায়ায় নিশ্চিন্তে কাটাচ্ছি।
"আমি না থাকলে তোমাদের খারাপ লাগবে?"
"১০০বার লাগ বে।"
"কি বলছ বৌমা তাহলে যে শিখার সাথে বলছিলে..।
এবার পথে এসো চাঁদু মাধু মনে মনে বলল।তারপর কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলল মাধু " ওতো শিখাকে একটু রাগানোর জন্য বলছিলাম ।আপনার সাথে খুব আড়ি আছে না?*
"ও তাই ,?রাগ করো না মাধু ।আমি তোমাকে কতো কথা শোনালাম। মাধুকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় আশীর্বাদ করে বললেন "তোমার মত লক্ষ্মীমন্তবউ এ বাড়িতে এসেছ বলেই ,এই সংসার টা এখনো সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলছ।
ভগবান তোমাদের কল্যান করুক।'
আসলে এই সংসারটাই হচ্ছে একটা নাট্যশালা তাই এই রঙ্গমঞ্চে যে যত বেশি ভালো অভিনয় করতে পারবে ,তার তত বেশি প্রতিষ্ঠা ,প্রতিপত্তি সুনাম-সুখ্যাতি ।সংসারে এই অভিনয়ের যথেষ্ট দরকার রয়েছে ।মাধু যেমন এখানে অভিনয় করেছে ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে একটা মমতাময়ী নারী সত্বেও আছে। সে সে যেন তার বিশাল পক্ষপুটের আড়ালে সযত্নে আশ্রয় দিয়েছে সকলকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much