ধারাবাহিক শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত"
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ১১)
শামীমা আহমেদ
বিকেলে ছাদে চা নাস্তার আয়োজন করে শিহাবের ভাবী সুমাইয়া, শিহাব ও বাচ্চাদের নিয়ে ছাদে চলে এলো। ছাদে ম্যাট বিছিয়ে দিল বাচ্চাদের জন্য। আরাফের খেলনা আর আরাফকে নিয়ে সুনায়রা ও আরুশ খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সুমাইয়া খুব ভাল করেই জানে এখানে এলে শিহাব তার অতীত নিয়ে মুষড়ে পরে।তাই খানিকটা হালকা করতে ছাদে চলে আসা।কিন্তু এতে শিহাব যেন আরো বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো । রিশতিনার স্মৃতি তাকে ভীষণভাবে তাড়া করে ফিরে। শিহাবের জীবনে রিশতিনা এসেছিল ক্ষণিকের অতিথি হয়ে।
সুমাইয়া শিহাবকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো । শিহাব চিন্তামগ্ন হয়ে কাপটা হাতে নিলো। শিহাবের একে একে সবকিছু মনে পড়তে লাগল।
শিহাবদের বাড়ির কয়েকটি বাড়ির আগেই, ধরতে গেলে গলির মোড়ের প্রথম বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়িটাই রিশতিনাদের।আর তার মুখোমুখি চমৎকার একটা কনফেকশনারী ছিল।এখন সেখানে একটি সুপার শপ হয়েছে।বাড়ির খুব কাছে হওয়াতে সুমাইয়ার জন্য খুব সুবিধা হয়েছে। শিহাব এখন গলিটা পেরুতে গেলেই ওখানে কেমন যেন থমকে যায়। সেখানে দাঁড়ালে রিশতিনার ঘরের সাথের বারান্দাটা একেবারে সরাসরি দেখা যেতো।
রিশতিনা মাঝে মাঝেই হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে বারান্দায় এসে ইয়ার ফোনে গান শুনতো।কখনোবা হাতে থাকতো পাঠ্যবই।বুঝাই যেতো আজ অথবা কাল এক্সাম।বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তো। রিশতিনা ছিল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ব্যারিস্টার বাবার আদরের মেয়ে। রিশতিনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল তার মা, রিশতিনাকে কখনোই একা চলার সুযোগ দেননি।বাবার কড়া নির্দেশে রিশতিনাকে মা সর্বক্ষণ ঘিরে থাকতেন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করতো রিশতিনা।চালচলন আর পোশাকআশাকে এই এলাকায় সবার চেয়ে সহজেই আলাদা করা যেতো । রিশতিনা তখন ও লেভেলের ছাত্রী।সদ্য কৈশোরে পড়া মেয়েটির মায়াবী মুখটায় শিহাবের চোখ আটকে যায়।প্রতিদিন সেই কনফেকশনারীর সামনে বাইক নিয়ে সাথে কিছু বন্ধুদের নিয়ে চলতো শিহাবের চা পানের উৎসব।রিশতিনাকে এক নজর দেখার জন্য শিহাবের উৎসুক চোখ মরিয়া হয়ে থাকতো।কিন্তু মেয়েদের উত্যক্ত করা শিহাবের রুচিতে নেই।
আর পড়াশুনায় সিরিয়াস রিশতিনার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই।কিন্তু শিহাবতো রিশতিনাকে কল্পনায় ভেবে চললো। কিন্তু তাকে তা জানানোর জন্য মোটেই কোনরকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়নি।রিশতিনা যখন বারান্দায় আসে শুধু সেই দৃশ্যটুকু দেখার জন্য দিন রাত ঝড় বৃষ্টি গরম শীত কিছুই তাকে টলাতে পারেনি।
পড়াশুনায় ভীষণ খামখেয়ালিপানার শিহাব কখনোই তেমন করে সিরিয়াস হয়নি। তখন বি কমে জগন্নাথে নামকাওয়াস্তে ভর্তি হয়ে থাকা।ক্লাসে একেবারেই নিয়মিত নয়। বিদেশ থেকে বাবার টাকা,নিজেদের বাড়ি থেকে আয়,বড় ভাইয়ের এত বড় চাকুরী,মায়ের আদর আহলাদের বড় হওয়া শিহাব বখাটে না হলেও খুব যে সুন্দর করে জীবন গড়ছে সেটাও নয়।
রিশতিনা মায়ের সাথে গাড়িতে করে স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেলে দারোয়ান দরজা লাগিয়ে দেয়ার আগের সময়টুকু বাড়িটির ভেতরে যতটুকু দেখা যায়,এলাকার মানুষের তা উঁকি দিয়ে একনজর দেখার ইচ্ছা থাকে।ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ি বলে কথা! ভীষণ সুন্দর বাড়িটির ভিতরে। চমৎকার ফুলের বাগান, মাঝে একটা পানির ফোয়ারা, বাগানের চারপাশে পানি ছড়িয়ে দিচ্ছে! কতইনা বাহারী ফুল! মাঝে মাঝে কয়েকটা পাথরের মৎসকন্যার মূর্তি দাঁড়িয়ে। রাতের বেলা যখন বাগানের নিয়ন বাতিগুলো জ্বলে উঠে মনে হয় যেন একটা স্বপ্নপুরী!একজন মালীর নিরলস যত্নে এমন সবুজ ঘাস আর রঙিন ফুলের বাগান দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।কিন্তু সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ।
শিহাবের জীবনে ইশারায় ইঙ্গিতে অনেকেই ভালবাসার কথা জানিয়েছে,কত মেয়ের প্রেমের প্রস্তাব বা একটু সাথে চলার জন্য, বিকেলে একটু চায়ের আড্ডার জন্য , এমন কতইনা অনুরোধ উপেক্ষা করেছে।ক্লাসে গেলে দিনে জুনিয়রদের কাছ থেকে কমপক্ষে চার পাঁচটা প্রেম নিবেদন মোকাবেলা করতে হতো।কিন্তু কেন যেন শিহাবের মনে বারবার রিশতিনার মুখটিই ভেসে উঠতো! যাদের জীবনে চারপাশে হাজারো নারীমুখ ঘিরে থাকে তারা কিন্তু শুধুমাত্র একটা মুখের জন্যই তৃষ্ণার্ত থাকে। শিহাবও যেন দিনে দিনে রিশতিনার ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো।
এভাবে দু'বছর চলে যায়। শিহাব মাস্টার্সে ভর্তি হলো। রিশতিনা এ লেভেল শেষ করলো। এরই মাঝে খুবই দ্রুত অনেককিছু ঘটে গেলো। রিশতিনার প্রতি শিহাবের দূর্বলতা সেটা রিশতিনার চোখ এড়ায়নি। আর শিহাব চোখ পড়ার মতই একটা ছেলে। এলাকায় ভদ্র ছেলে হিসেবে তার একটা সুনামও আছে।সানগ্লাস পরা এমন শুভ্রতায় নায়কোচিত চেহারার প্রতি তো নজরের তীর এমনিতেই বিঁধে।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করা ছেলেমেয়েরা বরাবরই ভীষণ আউটস্পোকেন আর স্মার্ট হয়।ওদেরকে নিজের কথা নিজে বলার মত সাহসী করেই গড়ে তোলা হয়।রিশতিনাও তেমনি একদিন বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিলো। একদিন ওদের বাড়ির দারোয়ানকে কনফেকশনারীর সামনে চায়ের দোকানটিতে পাঠিয়ে শিহাবের মোবাইল নাম্বারটা লিখে দিতে বলে। শিহাব অত্যাশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন! আর বন্ধুদেরও সেকি ঠাট্টা তামাশা!
এরপর দুজনার প্রেমকাহানী এগিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে। শিহাব এমনিতে উপরে উপরে চাপা স্বভাবের হলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ রোমান্টিক আর আবেগী একটা ছেলে আর রিশতিনা, বাবা মায়ের কড়া শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শিহাবের কাছে একটু যেন স্বস্তি খুঁজে ফিরেছিল।
শিহাবের ভাবী সবই টের পাচ্ছিল বা বলা যায় তার চোখ কিছুই এড়ায়নি। আর শিহাব আর রিশতিনার ভরসাস্থল ছিল সুমাইয়া ভাবী।কিন্তু ভাবী এ সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে ভীষণ আতংকিত হয়ে উঠেন। রিশতিনার ব্যারিস্টার বাবার ক্ষমতা আর কড়া মেজাজের কথা এলাকায় কারো অজানা নয়। রিশতিনার বিয়ের কথা চলছিল ওর বাবার ছাত্র এক ব্যারিস্টারের সাথে। বিয়ে পর লন্ডনে গিয়ে রিশতিনাও ব্যারিস্টারী পড়বে, সেভাবেই ওর বাবা সব কিছু গুছাচ্ছিলেন। আর সেই বিয়ে এড়াতে, রিশতিনার প্রবল আগ্রহ আর চাপে শিহাবকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হলো। ওরা নিজেরাই বিয়ে করে এলো কাজী অফিস থেকে। এলাকায় তখন একটা থমথমে ভাব।কী যে ভয়ে আর আতংকে দিন কেটেছে শিহাব আর রিশতিনার ! বিয়ের পরে যেখানে সবাই হাসি আনন্দে দিনকাটায় সেখানে সারাক্ষণই ওদের ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছে কখন বাবা তার লোকবাহিনী পাঠিয়ে মেয়েক..
চলবে....