ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭৩)
শামীমা আহমেদ
শায়লার কলটি রিশতিনা রিসিভ না করেই মোবাইলটা নামিয়ে রাখলো।রিশতিনা বুঝে নিলো মায়া নামক এই মেয়েটি তাহলে এখন শিহাবের হৃদয় জুড়ে।সারাক্ষণ তাই তার ভাবনায়ই শিহাব ডুবে থাকছে।এই মেয়েটির জন্যই এতদিন পর তাকে কাছে পেয়েও কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ নেই, তার জন্যই এত টান!মনকে ঘুরিয়ে নিয়ে পরক্ষণেই রিশতিনা ভাবলো,থাকতেই পারে, অমন মায়াভরা মুখটায় যে কোন পুরুষই আটকে যাবে।রিশতিনা ভেতরে কষ্ট অনুভব করলেও নিজেই যেন নিজের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে নিলো। রিশতিনা বুঝে নিলো,চাকরি পাওয়া যেমন একটা সোনার হরিণ পাওয়া,আজকাল মন পাওয়াও তেমন আর একবার যদি স্বেচ্ছায় তুমি অবস্থান ছেড়ে যাও এক পলকেই তা অন্য কারো জন্য বরাদ্দ হয়ে যায়।আজকাল মনের নাগাল পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে গেছে। সব কিছু বুঝে নিলো সে। ধীর পায়ে ডাইনিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলো।
শিহাব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেই তার মোবাইলটা চেক করে নিলো।সম্ভবত সে ওয়াশরুম থেকে রিং শুনেছে। শিহাব দেখলো শায়লার কল। সে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো।রাত সাড়ে এগারোটা বাজছে।আজ সারাদিন শায়লার সাথে কোন কথা হয়নি। শায়লা নিশ্চয়ই খুব চিন্তিত হয়ে আছে।খাবার খেয়ে কল ব্যাক করতে হবে।
খেতে এসো,রিশতিনার ডাকে শিহাব নিজের মাঝে ফিরে এলো।রিশতিনার কথা সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। শিহাব মুখ তুলে তাকাতেই রিশতিনার চোখে চোখ পড়লো। শিহাব নিজেকে একেবারেই আড়াল না করে চোখে মুখের দৃঢ় অভিব্যক্তিতে শায়লার অবস্থানটা বুঝিয়ে দিলো। ডাইনিং টেবিলে শিহাব বসে রিশতিনাকেও প্লেট এগিয়ে দিলো। খুব নীরবেই দুজনের খাওয়া পর্ব চলছিল। শিহাব এর পরের পর্বটির ব্যাপারে ভেবে নিচ্ছিল এবং নিজেই একটা সিদ্ধান্তে এলো। দুজনে খাওয়া শেষ করে রিশতিনা শিহাবের নির্দেশনা বা শিহাবের আহবানের অপেক্ষায় ডাইনিংয়ের চেয়ারেই বসে রইল।
শিহাব বেশ অনেকটা সময় চুপচাপ থেকে
সে নিজেই নীরবতা ভাঙল। শিহাব রিশতিনার দিকে না তাকিয়েই বললো, রিশতিনা তুমি আমাকে না জানিয়ে এখানে চলে এসেছো। জানিনা আমার বাসার ঠিকানা কিভাবে পেয়েছো।তোমার এভাবে চলে আসাতে আমার পারিপাশ্বিকে যারা থাকছে তারা আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা পেলো। যদিও তুমি নিজের পূর্ণ পরিচয় দিয়ে আমাদের জীবনের ঘটে যাওয়া সবকিছু জানিয়ে আমাকে দোষমুক্ত রেখে নিজের ভুলটা স্বীকার করেই আমার ফ্ল্যাটে প্রবেশ নিয়েছো, তবে রিশতিনা তুমি হয়তো বুঝতে পারোনি সব পরিচয়ের মূল্য সবসময়
একই মূল্যমানে নাও থাকতে পারে।অনেক পরিচয়ের রঙ সময়ে ফিকে হয়ে আসতে পারে,চাইকি একসময় তা বিবর্ণও হয়ে যায়।
তোমাকে আমি আমাদের বাসায় সেদিন তা বুঝিয়েছি, বুঝাতে চেষ্টা করেছি।
রিশতিনা শিহাবের কথাগুলো শুনছিলো। রিশতিনার একটা বিশ্বাস ছিল এতটা কাছে এলে শিহাব তাকে ফেরাবে না।কিন্তু সে বুঝে নিলো শিহাবের মনে তার জন্য আর এতটুকু ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। রিশতিনার এখানে আর এক মূহুর্তো থাকতে ইচ্ছা করছে না।মন চাইছে বেরিয়ে যেতে।কিন্তু রোমেল ভাইয়ার কথা মনে হতেই সে নিজেকে সংযত করল্য।কিছুতেই মাথা গরম করা যাবে না। দুজনার মাঝে এতদিনের দূরত্ব তা এক রাতেই ঘুচে যাবে না।
শিহাব রিশতিনাকে বললো, তুমি আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ো।আমি ভীষণ ক্লান্ত আমি ড্রইং রুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ছি।
অবশ্য শায়লাকে কল দিতে হবে।আমার কথা বলতে হবে।সারাদিন কথা হয়নি। ও আমার জন্য চিন্তায় আছে। আশা করি এ নিয়ে কোন ধরনের সিন ক্রিয়েট করবে না,এ কথা বলেই শিহাব তার সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার আর একটা বালিশ নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।যাবার সময় বললো শুধু,
বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
রিশতিনা অসহায়ের মত বিছানার কোনায় বসে রইল।এতটা অপমানই কি তার জন্য পাওনা ছিল? রিশতিনা নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলো। এখন মনে হচ্ছে শিহাবের কথাই ঠিক, তার এখানে এভাবে আসা উচিত হয়নি। আগে রোমেল ভাইয়াকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেয়া উচিত ছিল। শিহাবের মনে আজ অন্য নারীর বাস।বলতে গেলে সে রিশতিনাকে একেবারেই ভুলে গেছে।ভুলে গেছে? নাকি অভিমানে এমনটি করছে।রিশতিনার মনে এখনো যেন একটা ক্ষীণ আশা উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো,আর একটিবার অন্য কোন উপায়ে সে শিহাবের মান ভাঙতে চেষ্টা করবে। আর য়া কিভাবে করা যায়,আজ রাতের মাঝেই তা খুঁজে বের করতে হবে। রিশতিনা ঘরের বাতি নিভিয়ে শিহাবের বিছানার খুব অল্প জায়গা নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
শিহাব ড্রইং রুমের সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলো। এখন এক কাপ চা খাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল।কিন্তু রিশতিনার সাথে সে আর কথা আগাতে চাইলো না। শায়লা অপেক্ষায় আছে, কল দিতে হবে।
শায়লা যেন শিহাবের কলের অপেক্ষায় ছিলো।একটা রিং হতেই সে রিসিভ করলো।
ও-প্রান্তে খুবই উৎকন্ঠা নিয়ে শায়লা শিহাব সুস্থ আছে কিনা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলো। সারাদিন শিহাব শায়লার সাথে একেবারের যোগাযোগে ছিল না। শিহাব শায়লাকে আস্বস্ত করলো,সে ভালো আছে।আজ গাজীপুরে গিয়েছিল তাই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।শায়লার মাঝেও নোমান সাহেবের চলে আসার দিন এগিয়ে আসায় উৎকন্ঠা বাড়ছে।সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।শিহাব তাকে খুব সহজ সমাধান করে দিলো,তুমি আমার কাছে চলে আসবে। ব্যস! এটাই আমার সমাধান। তুমি যাকে ভালোবাস তার সাথেই থাকবে। আর যাকে ভালোবাসোনা,তাকে ফিরিয়ে দিবে। যতই আকুতি অনুরোধ বা অধিকার নিয়েই এসে দাঁড়াক না কেন। শিহাবের কথায় শায়লা ভরসা পেলেও তার নিজের পরিবারের জন্য বিষয়টি কেমন হবে। মা কি এত বড় একটা ধাক্কা সইতে পারবে ? যদি কিছু একটা হয়ে যায় ? রাহাত কি মানুষের কাছে ছোট হয়ে যাবে না ? নায়লার শ্বশুরবাড়ি নিশ্চয়ই নায়লাকে কথা শোনাবে। শিহাব পুরুষ মানুষ। তাদের কোনদিন বদনামের ভয় নেই।যত কলংক শুধু নারীর জন্যই।শায়লা শিহাবকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নিজের মা ভাই বোনকে নিয়ে যে পরিবারটি তিল তিল করে গড়ে তুলেছে আজ তারই কারণে লজ্জিত হবে।
শায়লা দুইদিকের নানান ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠলো। নোমান সাহেবের আসতে আর মাত্র তিনদিন বাকী।যা হউক,সুস্থির ভাবে ভেবে শায়লাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।আজ আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে বললো,
শিহাব তুমি ক্লান্ত ঘুমিয়ে পড়ো।আমিও ঘুমাবো।যদিও সে আজ কদিন হলো ঘুমাতে পারছে না।
শিহাবের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিল। সেও শায়লার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লো।
পাশের রুম থেকে রিশতিনা, শিহাব আর শায়লার কথোপকথন সবটাই বুঝতে পারলো। ওদের মাঝে বাধা হয়ে সে থাকতে চায় না।তবুও ভেবে নিলো, সে কাল শেষবারের মত শিহাবকে তার দিকে ফেরাতে চেষ্টা করবে।নয়তো ইংল্যান্ডের টিকেট করাই আছে। যদিও তার মা চলে গেছে,যদিও শিহাবের জন্য মায়ের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছিল, কিন্তু শিহাব ফিরিয়ে দিলে মা ছাড়া আর কোন নিরাপদ আশ্রয় কি আর আছে এই পৃথিবীতে?
চলবে...