২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস ১১৪ পর্ব




উপন্যাস

 টানাপোড়েন ১১৪
বি ব্লক এর ২৩ নম্বর
মমতা রায় চৌধুরী



সারারাত ছটফট করেছে রেখা ।কি যে ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করেছে ফোনটা আসার পর থেকে ।কে হতে পারে ?কে হতে পারে? এই ভাবনা বার বার মোচড় দিয়ে উঠেছে তার হৃদআকাশে । একবার এপাশ, একবার ও পাশ করেছে। একটু অবাক হল আবার মনোজ আজও এ ঘরে শুতে আসে নি। অথচ আগে বলতো রেখার পাশে না শুলে নাকি ওর ঘুমই আসে না। 
চুলের গন্ধে ওকে নাকি আলাদা একটা মাদকতা এনে দিত। এসব অতীত রেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।একটা সময় পর বোধহয়  এরকমই
 হয়  ।দাম্পত্য জীবনের একঘেয়েমি দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। রেখার  ও মনোজের জীবনে তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসলো ।এর কারণ অবশ্যই আছে, তাদের মাঝে সেতুবন্ধন ঠিকঠাক হয়নি ।আজ যদি ওদের মাঝে এক নতুন অতিথি র আগমন হতো, তাহলে কি সব কিছু অন্যরকম হতো। নাকি তিথি এখনো মনোজের মন জুড়ে আছে ।কিছুটা সময় হয় তো রেখার সঙ্গে মোহাবিষ্ট হয়ে জড়িয়ে ছিল ।এজন্যই হয়তো তখন তিথি ছিল নিষ্ক্রিয় । আজ রেখা নিষ্ক্রিয় হতে  চলেছে ।এমনিতেও রেখাকে পছন্দ করে না শাশুড়ি, ননদ ।মনোজের একরাশ ভালোবাসা সবকিছু ভুলে গেছিল কিন্তু আজ যদি ও  মুখ ফিরিয়ে নেয় ,তাহলে রেখার ভালোবাসার স্বপ্নগুলো কিভাবে পূর্ণতা পাবে?
তবে কি সে বড় ভুল করেছে ?তার জীবনে বসন্ত এসে তার দোরগোড়ায় কড়া নেড়েছে বারবার । স্বপ্নীল এসেছিল জায়গাটা নিতে  সে জায়গায় তাকে বসালেই কি তার জীবনে অন্য পূর্ণতা পেত?
আজ ভীষণভাবে স্বপ্নীলের কথা মনে হচ্ছে।
হঠাৎই রেখা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ,জানলার কাছে পর্দা সরিয়ে ভালো করে পাল্লা খুলে  দেখতে থাকে । নিচের দিকে তাকিয়ে ঝিমঝিম করে উঠে মাথাটা। অবলম্বনহীন একটা শূন্যতা যেন রেখার চারপাশে দুহাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করতে 
থাকে ।জানলা দিয়ে বাতাস ছুটে আসছে। অবলম্বনহীন দীর্ঘ শূন্যতা তার নেমে আসছে সারা শরীরে। কিভাবে অতিক্রম করবে ?অনেকক্ষণ চেয়ে রইল নিচের দিকে ।ভুল হয়ে গেছে।   প্রায় পোকার মত মানুষ হাঁটছে, মর্নিং ওয়াক করছে।  গাড়ি যাচ্ছে।
এর মধ্যেই বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ আসলো। এত সকালে বাথরুমে কে মনোজ ই 
হবে ।হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে রেখাও উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। রেখার আজকাল শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। ভাবছে একবার ডাক্তার দেখাবে কিনা? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল রেখার যদি লেখার রসদ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় ,তাই ডায়েরি নিয়ে বসল গিয়ে ব্যালকনিতে।
হ্যাঁ তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলো ।  আলোর মনটা ছিল কল্পনাপ্রবন। কল্পনায় সে হারিয়ে যেত দূর থেকে বহুদূর। তার নায়িকার মধ্যে রয়েছে একাকীত্ব, তার স্বামী তাকে ভালোবাসে না, তার মেয়ে তাকে ভালোবাসে
 না ,তার ছেলে তাকে ভালোবাসে না, সংসারে কেউ তাকে চায় না ।তার সেই দু:খের কথা ভেবেই  ভেবেই সে  সুখ পেত।
তাঁর উপন্যাসের আলো ছিল রক্ষণশীল পরিবারের বধূ। ও বাড়ীর কাঁটাতার পেরিয়ে মনের হদিশ পাওয়া খুবই দুষ্কর ব্যাপার। তবুও যেন পবিত্র কোন এক রন্ধ্র পথে  ঢুকে পড়েছিল। আলোর দুর্বলতাগুলো যেন সে জেনে নিতে পেরেছিল। এই দুর্বলতাকে  না সরিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আলো বোধহয় এ রকমই কিছু চেয়েছিল ।কোন একটা অঘটন ,একটু পতন। তবুও,একটু  সামান্য অপরাধবোধে জীবনটাকে যেন উজ্জ্বল করে দিয়ে যায়।
এই অব্দি লেখার পর রেখা একটু আঁতকে উঠলো একি আলো, আলো ক্রমশ রেখার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ যেন মনে হচ্ছে দুটি ভিন্ন আত্মা।
এবার লেখা থামিয়ে রেখা ভাবল এবার প্রাতঃক্রিয়া সেরে  ফেলে গোপালের ভোগ চাপাতে হবে। চা করতে হবে। কাজের মাসি একটু পরেই চলে আসবে। মিলি,তুলিদের খাবার দিতে হবে।
কালকে রাত্রিতে খেয়াল করেছে পাইলট একটু  খেয়েছে ।আশা করা যায় আজ থেকে পাইলট খাবার ধরবে। ওদের তো শুনেছি আজকে ভ্যাকসিন করতে আসার কথা, যে দুটো বাচ্চা সুস্থ আছে তাদের জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে বাথরুমে চলে যায় রেখা।তারপর ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে গোপালের ভোগ নিবেদন করে। 
, চায়ের জলটা বসিয়ে  পেপারে মনোযোগ দেয়। অনেকদিন পর পেপারটা পরছে । সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে ।অলস বৃষ্টির দিনে আজকে স্কুলে যাবে না এমনিতেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সেজন্য স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। পেপারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে একটা ছবি নজরে আসে। আরে ,এ তো স্বপ্নিলের ছবি ।ভুল দেখছে না তো? ছবিটা আরেকটু চোখের সামনে নিয়ে আসলো । চশমাটা পরে নিল  হ্যাঁ ঠিক দেখছে।
ভালো করে পরল পড়ে দেখল স্বপ্নীলের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে বইমেলায়। স্বপ্নীলের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়েছিল। তখনো মাঝেমাঝেই কবিতা আওরাত এতো ভালো লাগতো ওর 
কন্ঠে।রেখা মোহাছন্নের  মতো তাকিয়ে
 থাকতো ।কবিতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাকিয়ে থাকত রেখা।
মনে পড়ে স্টেশনে আসার পর গরম এক কাপ চা না খেলে যেন সারা সকালটাই
যেন তখন মাঠে মারা যেত।
আর স্টেশনের রত্নাদির চা না খেলে তো জীবনটাই যেন বৃথা। একদিন  স্বপ্নীল বলল ' চা খাবে?'
 দোকানটার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো ওই দোকানের চা খুব ভালো।
রেখা বলল' হ্যাঁ ,চা তো খাবোই। রত্নাদির তাহলে তো কথাই নেই। রত্নাদির চা ঠিক আছে। আজ তুমি কিন্তু আমার 
অতিথি ।আমি তোমাকে চা 
খাওয়াবো ।স্বপ্নীল একগাল হেসে 
নিল। তারপর বলল' বেশ তাই হবে।'
তড়িঘড়িরেখা বলল 'রত্নাদি তোমার স্পেশাল চা খাওয়াও। দু কাপ দিও।'
রত্নাদি হেসে বলল' রিম্পাদি এসেছে?'
রেখা ঘাড় নেড়ে বলল আসেনি।
রত্নাদি বলে তাহলে দুকাপ চা।
স্বপ্নীল নিজেকে দেখিয়ে এগিয়ে এসে বলল' 'এই যে আমি অধম এখানে পড়ে আছি ,আমার জন্য।
রত্নাদি অত্যন্ত আহ্লাদিতো ভাবে  বলল' আরে আমার কবি
 ভাই ।তোমাকে চা না খাওয়ালে হবে ,তোমার কবিতার লাইন শুনবো কি করে?'
রেখা খুব অবাক হয়ে যায় রত্নাদি স্বপ্নীলকে চেনে? অনেক কিছুই জানে মনে হয়।
স্বপ্নীল ও রেখা একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে বসল।
ইতিমধ্যে রত্নাদি স্পেশাল চা করে এনে দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে বলল' তোমাকে কবি ভাই বললো ,তাহলে তোমার লেখা এরাও পড়েছে?'
স্বপ্নীল মুচকি মুচকি হাসে আর বলে 'আমার কাছ থেকে শুনেছে।আবার অন্য কোনভাবে উপরে থাকতে পারে সেটা আমার জানা নেই।'
কত সুন্দর মুহূর্ত গুলো কেটেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আরে, রান্নাঘরে তো
চায়ের জল বসানো 
আছে ।এতক্ষণ পর মনে পড়ল রেখার।
তড়িঘড়ি করে রেখা রান্নাঘরে গেল ,গিয়ে দেখল চায়ের জল কমে এক কাপের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। কি আর করবে অগত্যা আর একটু জল দিয়ে দিল । এবার চা করে নিয়ে এককাপ মনোজের ঘরে দিতে গেল।
চা নিয়ে গিয়ে রেখা দেখল মনোজ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রেখা ডাকলো না ।চা নিয়ে চলে আসলো। এরমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ জয় গনেশ জয় গনেশ জয় গনেশ দেবা।'
রেখা ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখে মাসি এসেছে 
কাজে ।রেখা বলল' তুমি আজকে আরো তাড়াতাড়ি আসলে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে না আসলেই পারতে   
মাসি।'
মাসি এক গাল হেসে বলল 'তোমাকে বলে যায়নি তো। তাই?
রেখা বলল 'তা বুঝেছি, এই বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপ হবে মাসি। আর তোমাকে বলা থাকলো এরকম বৃষ্টি হলে তুমি সেদিন কাজে এসো না।
বলতে বলতেই রেখা চায়ের কাপটা মাসীর দিকে এগিয়ে ধরে।
চা খেতে খেতে মাসী বললো আজকে তুমি স্কুলে যাবে না?
রেখা আস্তে আস্তে বলল 'আজকে আমি ডুব দিলাম'।
'তা বেশ করেছো'। এর মধ্যেই আবার কলিং বেলের আওয়াজ 'জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা '। রেখা অবাক হয়ে গেল ।বলল'আবার কে আসলো?
একটু বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলল, খুলেই ভূত দেখার মত দেখল" একি পার্থ?'
পার্থ বলল' হ্যাঁ বৌদি, মনোজদা রেডি তো?'
 রেখা অবাক হয়ে বলল 'রেডী মানে? কোথায় যাবে?'
' সে কি আপনাকে বলে নি।,


"আমাকে বলেছিল তো কলকাতায় যাবে।'
রেখা বললো' কে জানে ।কলকাতায় যাবে তো এখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে ।আমাকে তো কিছু বলেনি। এসো ,ভেতরে এসো পার্থ ।কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?'
বৃষ্টির অলস দিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সারাদিন ধরে মনের ভেতরে পিয়ানোর সুর এর মত বারবার বেজে উঠেছে স্বপ্নীলের কথা। কতবার স্বপ্নের ঘোরে স্বপ্নীল আর রেখা এক হয়েছে ,পাশাপাশি চলেছে, তাদের এই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে । স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে দেখে সে পড়ে আছে কল্যাণীর 'বি' ব্লকের ২৩ নম্বর বাড়িতে। এখানে আছেএখন একরাশ বিরক্তি ,ভালবাসাহীন, অবলম্বনহীন শূন্যতা।'

মমতা রায়চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১১৩





উপন্যাস 



টানাপোড়েন ১১৩
স্বপ্নের জগত 
মমতা রায়চৌধুরী

ফোনটা বেশ কয়েকবার রিং হবার পরে ফোনটা ধরল রেখা। রিম্পা দি বলল'কোথায় থাকিস' জিনিয়াস'? রেখাকে উত্তর দেবার আগেই বলল শোন তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে তবে যেটুকু বলার আগে সেটুকু বলি ,সেটা হল তোর লেখা গল্প পড়ে অন্য একজন সম্পাদক তোর ঠিকানা চাইছিল । তোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় লেখা পাঠানোর জন্য। 
আসলে প্রথম লেখাটা তো আমার ঠিকানা থেকেই পাঠানো হয়েছিল ওই জন্য বোধহয় আমাকেই ফোনটা করেছেন।আমি কিন্তু হ্যাঁ বলে দিয়েছি। তুই কিন্তু না করতে পারবি না?
'সে তো বুঝতে পারলাম কিন্তু তুমি আমার নামটা হঠাৎ করে জিনিয়াস রাখলে কবে থেকে?'
'বা,বা তোকে জিনিয়াস না বলে উপায় আছে। তাই এই নামটা আমি খুব খুঁজে বুদ্ধি খাটিয়ে 
পেলাম ।তোর সঙ্গে এখন এটা খুব যায় ।একগাল হেসে রিম্পা দি বলল।
রেখার হাসিতে যেন জোছনা ঝরে পড়ে যত কালিমা সব ধুয়েমুছে চলে যায় কোথায়।
'তা বেশ বেশ জিনিয়াস নাম নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আরেকটা নাম হল সে তো ভালো কথা। তবে নামকরণটা সার্থক হবে  কিনা সেটা একবার ভেবে দেখতে পারতে? শেষ পর্যন্ত দেখো কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন এর মত না হয়। রেখা ও প্রাণ খুলে হেসে নিল।
'হ্যাঁ হয়েছে আমি যা নাম রেখেছি দেখবি সার্থকতা লাভ করবে? এবার কাজের কথায় আসি। জানিস আমরা একটা পিকনিক করছি আর তুইও আছিস । না করবি না কিন্তু? মনোজকেও বলবো। একটা গেট টুগেদার এর মত হবে।'
'সে তো যেতে ইচ্ছে করছে। কতদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়না। মনে হচ্ছে যেন একটা যুগ। কত কথা বলার আছে জানো?এক আকাশ মন নিয়ে বিছিয়ে রেখেছি থরে থরে সাজানো অনুভূতি। শুধু তোমার সঙ্গে সেগুলো শেয়ার করবো  আর অনুভূতির অনুরণনে গা ভাসিয়ে শুধুই উপলব্ধি উপলব্ধি।'
'তা হলে না করিস না ।কিন্তু কিন্তু করবি না কিন্তু?'
একটু উদাস ভাবে বলল তবুও একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে গো। আমার বেবিগুলো তো
 অসুস্থ ।তারমধ্যে দুটো একটু ঠিকঠাক এর মধ্যে আছে ,কিন্তু আমার পাইলট সোনা ও ঠিক না হলে যেতে পারবো না।'
'সে কিরে আবার পাইলটের শরীর খারাপ?'
'তবে আর কি বলছি তোমায়। কি  যে টেনশনে  আছি ,ওষুধ দেয়া হয়েছে কিন্তু খাবার একদমই খাচ্ছে না ।ওর চেহারাটা না ভেঙে গেছে। দেখে না চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। বেচারা কাছে  গেলে যেরকম হতো অর্থাৎ আগে যেরকম ভাবে আদর করত ,ওঠার ক্ষমতা ওর নেই তবে কিন্তু তাকায় করুণভাবে।'
'শোন চিন্তা করিস না রেখা বুঝলি ?ঠিক হয়ে যাবে ।দুজনা যখন ঠিক হয়েছে, ও ঠিক হয়ে
 যাবে ।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডেটটা তো কাছে পিঠে। তাহলে তোর জন্য ডেটটা তোর সুবিধামতো  ঠিক করতে হবে ।বাকিদের সঙ্গে কথা বলে দেখি।'
'শুধু শুধু আমার জন্য ডেট চেঞ্জ করবে রিম্পা দি কতজনার সঙ্গে তুমি সেট করেছ , দেখো এখন ওদের কোন অসুবিধা হবে নাতো?'
'সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছিস, এই জন্য তো তোর নাম জিনিয়াস দিয়েছি। তবে মনে হয় না কেউ আপত্তি করবে ।তবুও একবার কথা বলে দেখতে হবে বুঝেছিস? আমি চেষ্টা করবো অবশ্যই।
আর শোন স্কুলে যাবি তো কাল?'
কেন বলতো ?কিছু দরকার আছে? যাবো ভেবেছি তো এখন স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। অন্য রকম পরিবেশ হয়ে গেছে না ।তবে ওই যে  বড়দি সামনে সরস্বতী পুজো আছে, দেয়াল পত্রিকা স্কুলের সামনে সাজানোর এসব দায়িত্ব পড়েছে আবার?'
'কেন রে এত যে জায়গা নিয়ে ঝগড়া করল ওকে দিয়ে দিক বড়দি।'
রেখা একগাল হেসে বলে ,তা যা বলেছ ।বড়দি ছাড়তে রাজি হবে  নাকি।  সবই ঘেঁটে ঘ করে দেবে।'
খুব মিস করবো রিম্পা দি তোমাকে  জানো তো, এই কাজগুলো তুমি আমি মিলে করতাম। একদমই ভালো লাগছে না। সবথেকে বড় ব্যাপার স্টাফ রুমে গেলেই ওইপাশে চেয়ারটা
 ফাঁকা ।মন-প্রাণ কেমন হু করে ওঠে ।জানো মনে হয় যেন কত দূরে চলে গেছো তুমি ।তোমাকে স্পর্শ করতে পারবো না ।প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবো না ।তখনই চোখ ফেটে জল আসে।'

', বুঝি , বুঝি, সবই বুঝি ।কিন্তু কি করব
 বল ?পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় কখন নিয়ে যায় কেউ কি আর বলতে পারে? আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেল  দেখ ও এরপর পড়াশোনার চাপ আছে ।তাছাড়া তোর দাদাও অফিসে চলে যাবে কে মেয়েটা কে সামলাবে আমি যদি কাছে  না যেতাম ।তোকেও বলছি' উৎস শ্রী' নাম লেখা কি দরকার ওখানে পড়ে থাকার? এরপর বয়স হবে শরীরে ক্ষমতা কমে যাবে তখন কি করবি 
বল ?তাছাড়া তুই এখন লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত সময় দিতে পারবি ?আর বড়দি তো যখন তখন তোকে ডেকে নেন। তোকে কি লোকাল টিচার ভাবেন নাকি বলতো?'
রেখা একমনে কথাগুলো শুনতে থাকে তারপর বলে হ্যাঁ সেটাই ভাবছি আবার অন্যদিকে একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। কি যে হবে কাছে আসলে সেটাও বুঝতে পারছিনা । রিম্পা দি অত্যন্ত উৎসুক ভাবে বলল কেন রে কি হয়েছে?'
' আর বোলো না শাশুড়ি মা তো এখন এখানে এসে থাকবেন  । গাছ থেকে পড়ে গেলে যেমন ঝটকা লাগে তারপর কিছু ভেবে ওঠার আগেই যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, ঠিক তেমনি  রিম্পা দি রেখার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারলো। তাই অবাক হয়ে বললো ওরে বাপরে দেখ তুই এবার বারুদ নিয়ে খেলা করবি।'
'তা যা বলেছ আমি কিছু বুঝতে পারছিনা?
 কি করবো ?মনোজ অবশ্য বলেছে 'তোমার ডিসিশনটা জানাও ।
'আমি কি জানাতে পারি বল? তার মা তার বাড়িতে আসবেন ।আমি কি বলব,  আসবেন
না ।এটা কি কখনো আমার কাম্য ।সেটা তো আমি পারবো না। রিম্পা দি অতি আশ্চর্য হয়ে বলল 'কেনই বা পারবি না বল না ?অন্যভাবে নিস না। দেখ সবকিছু নিয়ে গেছে মেয়ের 
পরামর্শে ।সব নিয়ে চলে গেছে ওখানে থাকবে বলে। তোকে তো সহ্যই করতে পারেন না। এখন হঠাৎ করে আবার এখানে এসে থাকার কথা ভাবছেন কেন? আবার কি মতলব ?'
রেখা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো 'জানিনা আমি কিছু জানিনা গো ?কি হবে সারাক্ষণ এক মানসিক যন্ত্রণা দেবার জন্য থাকবে । অন্যদিকে স্কুলের পরিবেশটাও দিনকে দিন কেমন হয়ে
 যাচ্ছে ।
' এবার ঘরেতে এসে এক দন্ড শান্তি পাবি না। কি হবে রেখা তোর বুঝতে পারছিনা ।'
'আমিও বুঝতে পারছি না।'
মা মা মা আ আ আ..
রেখা ফোনেতে এই রিম্পাদির মেয়ের গলা শুনতে পেলো। 
' ওই দেখ। হ্যাঁরে, তোর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওদের দরকার পড়ে কেন বলতো?আমি দেখেছি এটা খেয়াল করে ।বিশ্বাস কর যখনই তোর সাথে কথা বলবো তখনই এইরকম। আবার শুনতে পেল ওমা মা ওমা আ আ আ… রিম্পা দি এবার বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,' কি হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছিস কেন?'
'পাশের বাড়ির আন্টি এসেছেন নিচে বসে আছেন তাই তোমাকে ডাকছি?'
'ও বাবা। ওই দেখ, সেই পিকনিকের কথা বলছিলাম পাশের বাড়ির বন্দনাদি । উনিও স্কুল টিচার ।একসঙ্গে পিকনিক করবে বলে ,তার তো তর সইছে না রে ।আচ্ছা ,এখন ফোনটা রাখি কেমন ?পরে কথা বলবো।  বাচ্চাগুলো কেমন থাকে, আমাকে একটু জানাস ।ভালো 
থাকিস ।অত টেনশন করিস না ।সময় সবকিছু ঠিক করে দেবে।'
রিম্পা দি ফোনটা কাটার পর রেখার মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল ।উফ ,কতদিন পর রিম্পা দি সঙ্গে কথা বলে একটু খানি যেন হালকা মনে 
হচ্ছে ।কিন্তু ফোনটা ছাড়ার পরে মনে হল যেন আবার  একযুগ পর দেখা হবে, কথা হবে ।খুবই খারাপ লাগছে ।এদিকে বাইরে ভালই বৃষ্টি হচ্ছে হিমেল হাওয়া বইছে ,জানলাগুলো আওয়াজ তুলেছে।রেখা ফোনটা রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় চোখেমুখে দু চার ফোঁটা ছাট এসে ভিজিয়ে দিল। আজ বৃষ্টির ঘ্রাণ রেখার ভালো লাগছে ।
এই অনুভূতিটা এসেছিল কয়েক বছর 
আগে ।স্বপ্নের মতোই যেন এসেছিল জীবনে। রেখার থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোট ।মনে পড়ে সেই দিনটার কথা ।স্কুল থেকে ফিরছে ,বাইপাশে দাঁড়িয়ে, ক্লাস থেকে বের হতে দেরী হওয়াতে ট্রেন পায়নি। ট্রেন মিস করাতে, যত গন্ডগোল ।স্বপ্নরা এসে ভিড় করেছিল। সেদিন একসঙ্গেই স্টেট গাড়িতে উঠেছিল দূরপাল্লার গাড়ি ।সিটে বসেছে পাশে এক ভদ্রলোক, কাছে একটা স্টপেজে নেমে যাওয়াতে ,তার পাশেই বসে পড়ে দরদর করে ঘাম পড়ছিল , পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘামটা মুছে নিলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুমাল বের করতে গিয়ে রেখার হাতের সাথে স্পর্শ হয়ে যায় ।তখনই একটা কি অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়েছিল রেখার দিকে। রেখাও তাকিয়েছিল রেখার তাকানোতে কি ছিল সেটা তো রেখা বলতে পারবে না। তবে ওর চাহনিতে একটা মাদকতা ছিল ',মহুয়া' ফুলের নেশা যেন। ক্লান্ত ,শ্রান্ত ,মন সেই নেশায় বুঁদ হয়ে চলে যেতে চেয়েছিল অনেক অনেক দূর 'মহুয়ার দেশে।' আর ঠিক তখনই বৃষ্টি। জানলা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছিল রেখার চোখেমুখে  একটু একটু করে সরে এসেছিল স্বপ্নীলের পাশে। স্বপ্নীল জানালাটা বন্ধ করতে চাইছিল কারণ রেখা চেষ্টা করেও জানালাটা বন্ধ করতে পারছিল না। স্বপ্নীল জানলাটা যখন বন্ধ করতে যায় স্বপ্নিলের মুখটা অনেকটা রেখার কাঁধের কাছে। স্বপ্নিলের দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল ঘনঘন। কি অনুভূতি 
জানিনা ।শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছিল ।তারপর জানলা বন্ধ করতে গিয়ে স্বপ্নীলও কিছুটা ভিজে যায় ।এতটাই টাইট ছিল জানলাটা। তারপর রেখা আর স্বপ্নীল  মিলে দুজনে  হাত লাগিয়ে জানলাটা টানে। যখন দুজনে মিলে জানলাটা টানছিল দুজন দুজনের হাতের স্পর্শ আর শরীরের গন্ধ একটা পাগল পাগল উত্তেজনা, যেন রক্তে নাচন শুরু হয়ে গেছে  তারপর স্বপ্নীল বলল অনেকটাই ভিজে গেছেন আপনি  মুছে নিন। রেখা মোহাবিষ্ট এর মতো তাকিয়েছিল । ব্যাগ হাতরে হাতরে রুমাল বার করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু রুমালটা খুঁজে পাচ্ছিল না ।স্বপ্নীল আর একটা রুমাল বের করে রেখাকে দেয়, বলে এটা দিয়ে মুছে নিন ।'
রেখা প্রথমে রুমালটা নিতে চাইছিল না। 
' রুমালটা তো কোন দোষ করেনি ।এটা ফ্রেশ রুমাল নিন্ না। তাছাড়া রুমালটা তো আপনাকে আমি দিয়ে দিচ্ছি না ।অ্যাতো হেসিটেট্ ফিল করছেন কেন?'
রেখা রুমালটা নিতে চাইছিলো না তবুও কিভাবে যেন হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল আস্তে আস্তে। স্বপ্নীল রুমালটা দিলে, মুছতে থাকে। কপালের জল তখন পড়ছে কয়েকটা বুকের ভাঁজের কাছে এসে পড়ল । চোখ দুটো ভিজে গেছে।
 স্বপ্নীল আবেগ ভরা দৃষ্টিতে দেখছিল, তারপর চোখ নামিয়ে নিল । হঠাৎই অবিন্যস্ত আঁচলটা ঠিক করে নিল রেখা।তারপর রুমালটা স্বপ্নীলকে দিয়ে দিল।
প্রথম পরিচয় কিভাবে যে হয়েছিল ,জানা যায় না এই ভাবেই শুরু হয়েছিল তাদের পথ চলা কিন্তু সেই পথ চলতে গিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁতকে উঠেছিল রেখা । কোন বাধা ছিল না স্বপ্নীলের।  ব্যাচেলর ছেলে সে মনেপ্রাণে চাইছিল রেখাকে এইভাবে কয়েক বছর কেটে গেছে ধীরে ধীরে যখন জানা যায় স্বপ্নিল একটি বেসরকারি ব্যাংকে ভালো পোস্টে আছে  পোস্টিং হয়েছে তার ইদানিং এখানেই  রেখার কাছ থেকে  স্কুল ঠিকানাটা জানতে পারল এবং বাড়ির ঠিকানাটা ও কায়দা করে জেনে নিয়েছিল ।
 এভাবেই মাঝেমাঝেই ওদের দেখা হতে লাগল এবং কেমন যেন একটা নেশার মতো হয়ে গেছিল স্বপ্নীল ট্রেনে যাতায়াত করে না। ওরতো দূরপাল্লার গাড়ি সুবিধা ।তবে অকারণেই এরপর দেখা যেত রেখার ট্রেন ফেল হয়ে যেত। স্বপ্নীল ও মাঝে মাঝে ট্রেনে যাতায়াত করতো।যেন অপেক্ষায় থাকত রেখা আসবে ।
কি জানি হয়তো তাই মনে হয়েছে। এভাবেই পথ চলা শুরু হয়েছিল ।দুটো ভালোলাগা মন ।যেখানে বয়স একটা সংখ্যা মাত্র ।এই প্রথম এই কথাটা  স্বপ্নীলের মুখে শুনতে পেয়ে রেখা অত্যন্ত খুশি হয়েছিল ।প্রথম ভালোবাসার প্রস্তাব জানিয়েছিল স্বপ্নীল।কিন্তু রেখা সাড়া দিতে পারেনি ।রেখা বলেছিল সে যে অবস্থাতে আছে তাকে ভালোবাসা যায় না ।ভালবাসার পূর্ণতা সে কোনদিনও পাবে না ।স্বপ্নীল তাকে বলেছিল ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে জানলে স্বপ্নীল স্বপ্ন দেখায় না ,বাস্তবে তার প্রয়োগ করে দেখাবে। স্বপ্নীল মনেপ্রাণে চেয়েছিল রেখাকে।'
কিন্তু রেখার শুধু মনে হতো কি করে হবে? একটা অসম বয়সের সঙ্গে কখনো ভালোবাসা
 হয় ?তাছাড়া সে তো বিবাহিতা। রেখা সাড়া দিতে পারেনি।'
স্বপ্নীল পাগলের মত হয়ে গেছিল রেখার জন্য। একদিন হাতে হাত রেখে স্বপ্নিল বলেছিল এক মুঠো আকাশ আমাকে হতে দাও ,দেখো তোমার জীবনে বৃষ্টি দিয়ে সব জীর্ণতাকে ধুয়ে মুছে, আবার নতুন করে সাজিয়ে দেবো তোমায়?
এক মায়াবী রাতে তুমি হবে আমার গল্পের উপাখ্যান  । শুধু তাই নয় আমি তোমার জন্য সমুদ্র হতে পারি ।তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাব দূর বহুদূরে ।রেখা স্বপ্নীলকে বলেছিল 
থামতে । দুইকানে আঙ্গুল দিয়েছিলো 
রেখা। এগুলো শোনা  তার পাপ, সে কিছুতেই পারবেনা তার ডাকে সাড়া দিতে। সেদিন রেখার  দু চোখ ভিজে উঠেছিল ।তখন তার বাড়িতে চলছিল চরম অশান্তি ।মনোজের মা, দিদি যেভাবে মেন্টালি টর্চার শুরু করেছিল রেখার
 প্রতি  মনোজের কিছুই করার ক্ষমতা ছিল
 না ।রেখা একটা আলাদা জগৎ খুঁজে পাবার চেষ্টা করছিল । স্বপ্নীলের ভেতরে সেটা পেয়েছিল কিন্তু রেখা সাড়া দিতে পারল না ।এভাবেই রয়ে গেল তাদের অলিখিত উপাখ্যান ।
আজ হঠাৎ এইসব মনে হচ্ছে কেন?
ইতিমধ্যেই রেখার ফোন বেজে ওঠে একবার ফোন বেজে কেটে যায় ।আবার ফোনটা বেজে 
ওঠে  রেখা তখনো জানলার কাছে দাঁড়িয়ে হিমেল হাওয়ায় আর বৃষ্টি স্নাত হয়ে সে ডানায় ভর করে উড়ে যেতে চাইছিল দূর বহুদূরে  তার ভাবনায় ছন্দপতন ঘটায় ফোনের রিং। রেখা জানলাটা কোনরকমে বন্ধ করে এসে ফোনটা ধরে বলে হ্যালো'
বৃষ্টি হচ্ছে? সেই বৃষ্টি যাতে গন্ধ আছে মিষ্টি মধুর?
রেখা বলল কে ?কে বলছেন আপনি?'
অপরপ্রান্ত থেকে বলল আমি তোমার অনেক কাছের ।তুমি চিনতে পারছ না আমায়? স্বপ্নে তুমি আমাকে দেখতে পাও না? বলেই ফোনটা কেটে যায়..।

কবি শহিদ মিয়া বাহার এর কবিতা




ওফেলিয়া গঙ্গা নিতল
শহিদ মিয়া বাহার

ওফেলিয়া হাতে, বল্লরী রাতে বেঁধেছ বাধন 
হ‍্যামলেট নই তবু অকারণ
মৌ- শিহরণ, জলে-আলোড়ন 
পরিযায়ী চোখে চেয়ে চেয়ে দেখি
 বসন্ত -ছায়ার বয়লার দহন। 

আকাশ-কুঞ্জে কার
 চারু চারু মুখে তার শালবন সঙ্গীত দোলে
বাতাসের পলে পলে, ভৈরবী রাগ তুলে 
বেজে উঠে বিকেলের একতারা মন
হায় উচাটন---
নর্তকী চুলে চুলে 
হাওয়ায় হাওয়ায় দোলে
মৌতালী চোখের চৈতালী বন।

কঙ্কন হাতে, নির্ঝর রাতে  বাজাও তোমার ভায়োলিন সুর
কতদূর-- আর কতদূর---
আকাশ মেঘের সীমানা তাহার ?
আঁধার যাহার 
আরন‍্যক পথে, হেটে যেতে যেতে
বন্ধ কপাট খুলে, মন্দিরা চোখ তুলে 
কত তারে দেখাবো,কত তারে শেখাবো
মেগাবাইট মনের সমুদ্র অতল, 
আমি বার বার বহুবার 
ছেঁকে ছেঁকে ছুঁয়েছি 
 তাহার গঙ্গা মোহনা নিতল ।

মনি জামান এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৩





ধারাবাহিক উপন্যাস


সেদিন গোধূলি সন্ধ্যা ছিল
১৩ তম পর্ব 
মনি জামান

সন্ধ্যার একটু আগে গাড়ি জিকুদের বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো,সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।শুধু সাংবাদিক ফিরোজ নিজ বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো,জিকু ডাকলো ফিরোজকে কোথায় যাচ্ছিস তুই,ফিরোজ বলল,আমার অনেক কাজ আছে জিকু এখন যায় কালকে এসে কথা বলবো বলেই ফিরোজ হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির পথে।
আজ ফিরোজের কেন জানি আসমার কথা বার বার মনে পড়ছে মোমেনা বেগমের অহঙ্কারী মনোভাব ফিরোজকে কেন জানি খুব ভাবাচ্ছে,প্রশ্ন জাগছে মনে আসমা মেয়েটা ভাল থাকবেতো?আবার এটাও ভাবছে ফিরোজ আসমাকে নিয়ে ভাবনা তার বোধহয় ঠিক হচ্ছেনা কারণ আসমা পরস্ত্রী।
সকাল হলো আসমার মা বাবা এসেছে জামাইয়ের বাড়ি নাতি ছেলে দেখতে,কিন্তু বেয়াইন মোমেনা বেগম একবারও ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো না এমন কি তাদের বসতেও বললো না।আসমা তার মা ও বাবাকে ডেকে ঘরে নিয়ে বসালো,নয়নকে এনে মায়ের কোলে দিয়ে বলল,মা তোমার নাতি,জিকু এসে শশুর শাশুড়িকে দেখে খুব খুশি হলো তারপর শশুর শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো মা এবং আব্বা আপনারা কেমন আছেন,শশুর শাশুড়ি বলল,ভালো আছি বাবা তুমি কেমন আছো,জিকু বলল,ভালো আছি আমরা। 
জিকুর শশুর শাশুড়ি খুব খুশি হলো জামাই জিকুর অমায়িক ব্যবহারে,আসমা মা বাবার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো তারপর মা বাবাকে খেতে দিলো খাওয়া শেষে আসমার মা বাবা নাতি ছেলেকে খুব কষ্টে যোগাড় করা আংটিটা পরিয়ে দিয়ে জামাই ও বেয়াইন মোমেনা বেগমকে বললো,বেয়াইন আমরা বাড়ি যাচ্ছি আপনি যাবেন,কিন্তু মোমেনা বেগম মুখটা ঘুরিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো।
জিকু শশুর শাশুড়িকে থাকার জন্য খুব অনুরোধ করলো কিন্তু শশুর শাশুড়ি বলল,বাবা আজ যাই সময় করে আবার একদিন আসবো বলেই আসমাকে ডেকে বলল মা জিকুর দিকে খেয়াল রেখো।
জিকুর শশুর শাশুড়ি চলে যাবার পর
মোমেনা বেগম ছেলে জিকুকে ডাকলো, ডেকে বলল,আমাদের পারিবারিক সব ব্যবসা এখন থেকে জিকু তোমাকে দেখতে হবে,এবং তোমাকে কোম্পানির চাকরি ছেড়ে বাড়ি থেকে সকল জমি জায়গা সব দেখা শুনা করতে হবে।
জিকু কিছু বললো না শুধু সম্মতি দিয়ে রূমে চলে গেলো,রূমে এসে স্ত্রী আসমাকে ডেকে জিকু মায়ের প্রস্তাবটা আসমাকে জানালো,আসমা স্বামীর হাতটি ধরে বলল প্লীজ জিকু তুমি মায়ের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিও না প্রস্তাবটা রাখো না হলে মা খুব কষ্ট পাবে,কত আশা করে হয়তো আমাদের এনেছে। জিকু বলল ঠিক আছে আমি মেনে নিলাম কিন্তু তুমি আমার পাশে থেকে সাহার্য করবে।
জিকু পরের দিন কুমিল্লার উদ্দশ্য রওনা হলো অফিসে গিয়ে দরখাস্ত দিয়ে আসলো চাকরি ছাড়ার,বাড়ি ফিরে কিছুদিন বিশ্রামে কাটালো তারপর পরিবারের ব্যবসা এবং জমি জায়গা দেখাশুনার দায়িত্ব হাতে নিয়ে দেখাশোনা শুরু করলো,এর ভিতর এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো।
মোমেনা বেগম আসমার উপর আস্তে আস্তে নির্যাতন শুরু করলো শারীরিক এবং মানুষিক ভাবে,বাড়ির সব থালাবাটি ধুয়া মাঝা থেকে শুরু করে ঘর দোর সব মুছা এবং উঠোন ঝাড়ু দেওয়া পর্যন্ত সব আসমার উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বাড়ির কাজের মেয়েকে বিদায় করে দিয়েছে মোমেনা বেগম।
এখন থেকে আসমার উপর সব দায়িত্ব, আসমা শাশুড়ি মোমেনা বেগমকে খুশি করার জন্য সব একমনে মেনে নিলো একটু বৌমা স্বীকৃতি পাবার আশায়,ক্রমশ কাজের চাপে আসমার আস্তে আস্তে শরীর খারাপ হতে শুরু করলো,জিকু বাসায় এসে প্রায় জিজ্ঞেস করে আসমাকে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা,মা কেমন ব্যবহার করছে ইত্যাদি,আসমা হাসি মুখে জিকুকে বলল না কোন সমস্যা হচ্ছেনা আর সমস্যা হবে কেন,শাশুড়ি মোমেনা বেগমের প্রসংশা করে বলল মা এখন সংসারের দায়িত্ব সব আমার কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছে।
জিকু আসমার মুখে সব শুনে খুশি হলো এবং মনে মনে ভাবলো মা তাহলে আস্তে আস্তে পুত্র বধু আসমাকে মেনে নিয়েছে।
কিন্তু জিকু তার মা মোমেনা বেগমের ঘৃণ্য দুরঅভিসন্ধি ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেলোনা, এমন কি নয়নকে আসমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করলো শাশুড়ি মোমেনা বেগম,আসমার কাছে ছেলে নয়নকে এক প্রকার দেইনা সব সময় মোমেনা বেগম নিজের কাছে রাখে।
নয়নও প্রায় মায়ের সংস্পর্শ না পেয়ে এই এক বছরে মাকে প্রায় ভুলেই গেছে,সময় বয়ে চললো দুই বছর হয়ে গেলো জিকু কিছু জিজ্ঞেস করলে আসমা জিকুর কাছে সব লুকায়,কিন্তু নিভৃতে একা একা বসে কাঁদে কি চেয়েছিল আর কি পেতে শুরু করেছে সে।
দিন দিন আসমা মোমেনা বেগমের চক্ষু শুলে পরিণত হতে থাকলো কিন্তু ছেলে জিকুর ভয়ে প্রকাশ্য কিছু বলতো না মোমেনা বেগম,কৌশল অবলম্বন করে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ালো।
এদিকে সকাল হলো জিকু আসমাকে বলল খেতে নাস্তা হয়ে থাকলে দাও আমি বেরুবো,আজ মালের চালান আসবে দোকানে,আমাকে সকাল সকাল যেতে হবে।আসমা সকালের নাস্তা আনতে রান্নাঘরে গেলো,হঠাৎ জিকুর একটা চিৎকার শুনতে পেলো,আমাকে ধরো।আসমা চিৎকার শুনা মাত্র ছুটে এসে যা দেখলো জিকু বুকটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে,আসমার হৃদয়ে হঠাৎ একটা ভয়ের সঞ্চার হলো আসমা জিকুকে জড়িয়ে ধরে বলল,কি হয়েছে সোনা বলেই আসমা চেঁচিয়ে কেঁদে শাশুড়ি মোমেনা বেগমকে ডাকলো।
জিকুর মা মোমেনা বেগম সহ বাড়ির অনন্যরা সবাই ছুটে এলো,মোমেনা বেগম ডাক্তারকে ফোন করলো,আসমা জিকুকে ডাক দিয়ে বললো কি হচ্ছে তোমার আমাকে একটু বলো প্লীজ জিকুর ঠোঁট দুটো শুধু বিড় বিড় করে নড়লো,কিন্তু কিছু বলতে পারলো না তারপর আসমার হাতে এলিয়ে পড়লো।
ডাক্তার এলো জিকুর হাত ধরে পরীক্ষা করে জানালো জিকুর মৃত্যু হয়েছে,শুনে
আসমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তার ভালবাসার শেষ অবলম্বন এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছে,তার শেষ আশ্রয় টুকুও সৃষ্টি কর্তা আজ কেড়ে নিয়েছে,আসমা যে রাজকুমারের স্বপ্ন দেখেছিলো সেই রাজকুমার আজ তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলো পরপারে,নয়ম এতিম হয়ে গেলো আসমা বিধবা হলো জিকু হয়তো আসমার হৃদয়ে এখন থেকে হয়তো স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে চিরকাল।


চলবে....

কবি সৈয়দ আহম্মদ আশেকী




প্রথম প্রেমের শিরোনাম
সৈয়দ আহম্মদ আশেকী

বিরহের একেকটি সময়
 কতো মহাকাল দীর্ঘ হয়
সে টুকুন
বিরহানলে প্রজ্জ্বলিত প্রেমিক জানে।
সুখ সময়ের সজ্ঞা খুবই ছোট্র হয়,
আঁভা ও সুবাস ছড়ায়ে যে ফুল ফোঁটে;
কালো ভ্রমর ও রঙিন প্রজাপতির
ডানার কম্পনে মাতুয়ারা করে কানন।
ফুলের কোমল পাঁপড়িগুলো মনলোভা হারালে
একদিন সুখ-মোহের গুঞ্জন ভাঙে,
 আনন্দের মন্থন ফুরায়ে যায়।

আমার কাননে তুমি মৌসুমী 
ফাগুণ হয়ে এসেছিলে।
অনিন্দ ভালোবাসার পরশে পরশে
মৃদু-মৃদঙ্গে ছুঁয়েছিলে পাঁপড়িদ্বয়,
এতো ভাবাবেগ! এতো মায়া-ব্যাকুলতায়
আমার হৃদয় কমলে জাগালে চৈতন্য।
কম্পন উঠেছিলো প্রতিটি লোমকূপে,
দেহের আপাদমস্তক আরশিনগরে,
মাইকোকন্ড্রিয়ার উষ্ণাঞ্চলে প্রাণানুভুতির
কেতনে পুলকে পুলকে দোল উঠে।
ভালোবাসার জন্য বহমান স্রোতধারায়
স্নায়ূর প্রতিটি কোষে বিদ্যুতায়িত হয়,
স্বর্গানুভুতির বিভোরে সুখের মলাটে আমি শিরোনামে লিখে দিলাম তোমার নাম।

সময় গড়িয়ে যায় দিবস-যামির প্রহরে প্রহরে,
কতকাল কতদিন চলে গেলো তুমিহীনা
সে টুকুন আমি টের পাই ক্ষণে ক্ষণে,
জীবনের অনেকটা পথ পার হয়েও
হৃদয়ের একাকীত্বে আজও খুঁজি তোমাকে।
পঁটে আঁকা ছবিটা শুধুই তোমার,
তোমাকে কি করে ভুলবো বলো?
তুমি ভালোবেসেছিলে বলে
আমার অস্তিত্বে তুমি কবিতা হয়ে গেছো,
বুকের প্রকোষ্টে বিরহের তপ্তানল জ্বালায়ে
আমাকে পোড়ায়ে পোড়ায়ে অতীতের
ভালোবাসাগুলোর সময় জাগিয়ে দাও।
প্রতিটি শব্দের কোঠরে কোঠরে 
বিরহ তোষানলে হৃদয় পোড়ায়ে
আজও তোমার অস্তিত্ব টের পাই।

শিরোনামে মলাটের ভেতর খুঁজি তোমায়
প্রথম প্রেমের শিরোনাম 
কখনও বদলানো যায় না ।

শামীমা আহমেদ  এর ধারাবাহিক উপন্যাস পার্ব ৬৩





শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৬৩)
শামীমা আহমেদ 

সন্ধ্যার চা পর্ব শেষ করে গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে শায়লা নিজের ঘরে চলে এলো।নানান রকম খবরে কেমন যেন  মন বিষন্ন করা অনুভবে বিছানায় বসলো। ভাবনায় দুই বিপরীতমুখী মনের চলন! সারাদিন যেমন একটা অনন্য সুখের আবেশে ভেসেছিল এখন যেন ঠিক ততটাই  বেদনার সাগরে ভেসে চলা।সে জানে না এই ভেসে যাওয়া তাকে কতদূর নিবে।প্রতিটা মূহুর্তে শিহাবের অনুভুতি অনুভব তাকে আবেগী করে তুলছে আবার নোমান সাহেবের পিছুটান আশংকা হয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কেন জীবন আজ দুই দিকে দাঁড় করালো।নোমান সাহেব কেন এতদিন নীরব রইলেন?কেনইবা শায়লাকে আপন করে নেয়ার কোন আগ্রহই দেখাননি? শায়লাতো বয়সের ব্যবধানকে তুচ্ছ করেছিল।ভেবে ছিল মনটাই আসল। যদি তার সাথে মনের বন্ধন হয়ে যায় তবে আর বয়স কোন বাধা হবে না। তবে শায়লাকে নোমান সাহেবের বিয়ে করার প্রকৃত কারন যখন সে জেনেছে তখন তার প্রতি একরাশ ঘৃনাই জন্মেছে।মিথ্যে দিয়ে ঢেকেছে তার উদ্দেশ্য। দুজনার জীবনের শুরুটাই যদি এমন হয় তবে সেখানে আর কোন বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে না। বিয়ের পর তিনটি রাত তাদের একসাথে কাটলেও নোমান সাহেব কোন কিছুতেই এগিয়ে আসেননি। শায়লা বিছানার এক কোনায় একপাশ হয়ে নানান ভাবনায় থেকেছে।অজানা অচেনা ভিনদেশী মানুষ কোন অধিকার খাটায় নি বলে শায়লা তাকে বেশ ভদ্রলোকই ভেবেছিল।কিন্তু এখন মনে বারবার প্রশ্নটা  উঁকি দেয়,এটা কি তার নিছক ভদ্রতা ছিল, নাকি ছিল একধরনের উপেক্ষা? ফাইভ স্টার হোটেল রুমে শায়লার বতেমন করে বাসর সাজানো হয়নি,বিয়েতে  আর দশটি মেয়ের যেমন হয়।সেই যে তার শায়লাকে আপন করে না নেওয়া সেটা যেন বিশাল এক শূন্যতা হয়ে রইল।আর আচমকাই একটু একট করে, কেমন করে  শিহাব তার ভাবনায় জায়গা করে নিলো!দুজনেই যেন বঞ্চিতের দুঃখ ব্যথায় দুজনের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে।দুজনার শূন্য জায়গাটা পূরন করার আকুলতায় কাছে এসেছে। শায়লার চোখের কোনে পানি এসে জমলো।তার জীবনটা কেন সবসময় এমনি অপ্রাপ্তি দিয়ে ভরা? এমনি নীরব প্রশ্নে বুকের ভেতরটা অভিমানী হয়ে কেঁদে উঠলো।  নানান ভাবনার গভীরতায় ডুবে শায়লা গুটিসুটি হয়ে কখন যেন ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো।

রাহাত টিভির ক্রিকেট  খেলায় একেবারে ডুবে রইল।ছুটির দিনটি আজ  ঘরেই কাটালো রাহাত। চোখ টিভি স্ক্রিনে আটকে থাকলেও মনের ভেতর অনেক কিছুরই হিসেব চলছে।মাথার ভেতরে অনেককিছুর গণনার হিসেব চলছে।নোমান সাহেব আসতে আর দধদিন বাকী।তাইতো শায়লার বিষয়টি নিয়ে সে গভীরভাবে ভাবছে। শায়লার মুখের দিকে তাকালে রাহাতের মনটা কেঁদে উঠে।কতদিন আর আপুর এই একার জীবন চলবে? যদিও নোমান সাহেব আসতে চাইছেন।কিন্তু তা বেশ দেরি হয়ে গেলো। নব বিবাহিতদের মাঝে দেড় বছরের দূরত্ব সেতো অনেক। দুজনার মাঝে বয়স আর ভাষার ব্যবধান তাদের একেবারেই কাছে টানেনি।তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দেয়া ঠিক হয়নি।কিন্তু কী আর করা তখন? এক বোনের ভালোর জন্য আরেক বোনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
রুহি খালাকেও উপেক্ষা করা যায়নি।আমাদের পরিবারে তার একটা বিরাট অবদান। এখন এই সিচুয়েশনে   তাকেও ম্যানেজ করতে হবে।আবার নোমান সাহেব নিজের স্ত্রীকে কাছে নেয়ার অধিকারের কাছে তো আর শিহাব ভাইয়ার আবেগ দাঁড়াতে পারবে না। যেখানে কাগজে কলমে আইনে সে শায়লার স্বামী। কিন্তু এদিকে শায়লাও পুরোপুরি শিহাবের দিকে মন নিয়ে গেছে। দুজনাকে মানায়ও বেশ!
তবে এখানে শায়লার চেয়ে নোমান সাহেবের দোষটাই বেশী। তার উচিত ছিল আপুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা আর তাকে কাছে নেয়ার প্রসেসটা দ্রুত করা।চাইলে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় একা থাকা যায় কিন্তু কারো সাথে জীবন বাঁধলে তখন দূরত্বটা চরম এক হতাশা আর অস্থিরতায় ভরে উঠে। মনের সাথে শরীরেরও এক তীব্র চাওয়া হিংস্র হয়ে উঠে।স্বামীদের দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন দেশে থাকা স্ত্রীরা জানে জীবনের  কতটা  সুন্দর সময় একাকীত্বে কাটছে।তখন অন্য কোন হাতছানি এলে নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।মানুষের দেহ আর মনের চাওয়া যে সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এটা আমাদের সমাজের মুরুব্বিরা বুঝতে চায় না।
রাহাত ভাবলো,কাল একটু সময় করে শিহাব ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে।রাহাত টিভিতে  খেলার চ্যানেল বদলে অন্য চ্যানেলে থামতে হলো।সংবাদ চলছে।সংবাদ পাঠিকাকে রাহাতের খুব ভাল লাগলো।চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে।রাহাত ভাবলো,বাঙালি মেয়েদের শাড়িতে অনন্য অপূর্ব রূপসী লাগে! 
রাতের খাবারের সময় হয়ে এলে রাহাত শায়লাকে ডেকে তুললো।এমন অসময়ে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলাম? এইভেবে শায়লা দ্রুতই বিছানা ছাড়লো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে নীরবে নিঃশব্দে ভাইবোন খেয়ে নিলো। শায়লার ভাবনায় কপালের ভাঁজ রাহাতের দৃষ্টি এড়ায়নি। রাহাত নিজেও কোনপথে কিভাবে এগুবে তা নিয়েও ভাবনায় ডুবে থাকে।সুনশান নীরবতায় বাড়িটাকে যেন মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে।মা থাকলে তবুও কিছু কথা চলে।
রাহাত খাবার শেষ করে শায়লাকে সব গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করলো। রাহাত বুঝেছে আপুর জন্য এখন নিত্যদিনের কাজকরায় দিনদিন অনাগ্রহই আসবে।
আপু রাত জেগোনা,ঘুমিয়ে যেও।
বলে রাহাত নিজের ঘরে চলে গেলো।শায়লা নিজের ঘরে ঢুকলো।শিহাবের কথা মনে পড়ছে।সেকি রাতের খাবার খেয়েছে? নাকি নাখেয়েই ঘুমিয়ে গেলো? একটা কল দিয়ে জানাতো  যায়!ভাবতেই মোবাইল স্ক্রিন আলোকিত হয়ে উঠলো। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো, নোমান সাহেবের কল!  শায়লা বুঝতে পারছে না এখন কি করবে? এখনতো কোন অজুহাতে কল না ধরে থাকা যাবে না।
শায়লা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে কল রিসিভ করলো।হ্যালো বলতেই,পৃথিবীর ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো,হাই,শাআলা,,দিস ইজ নোমান ফ্রম কানাডা।হাউ আর ইউ? গুড ইভনিং,, 
কে যেন শায়লার কন্ঠ রোধ করে রাখলো।অপ্রান্ত থেকে বারবার একই প্রশ্নের শায়লার  অস্ফুট স্বরে একটা কথাই বেরিয়ে এলো,আই এম ফাইন,,থ্যাংকিউ।নোমান সাহেবের আজ যেন কথার খই ফুটেছে! একটানা কথা বলেই চলেছে।শায়লার অনিচ্ছতে কানে মোবাইলটা আটকে আছে যেন!

শিহাব রাতের বেশ অনেকটা সময় বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলো।আজ আর ঘরের দিকে মন টানছে না।মন চাইছে সারারাত এই বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতে।শায়লার অনুভব নিয়ে চোখে এক ঘোর লাগা  রঙিন 
স্বপ্নভেলায় ভাসছে সে।তার মন খুব করে শায়লার উপস্থিতি চাইছে।মনে হচ্ছে এখুনি কল করে শায়লাকে চলে আসতে বলি। আজ সারাটাদিন শায়লার চোখের প্রতিটি চাহনী তার বুকে যেন তীর হয়ে বিঁধছে।সুখানুভুতির তীব্রতায় আনমনে ভাবনায় কখন এভাবে সময় হয়ে গেলো, একেবারে টেরই পেলো না শিহাব।  একটি একটি করে পুরো এক প্যাকেট বেনসন শেষ হয়েছে।নিশ্চয়ই শায়লা থাকলে শত বারনে থামিয়ে দিত এই ধোয়া টেনে যাওয়ায়।নিশ্চয়ই বলতো সন্ধ্যে হয়েছে ঘরে আসো,এমন ভর সন্ধ্যায় বাইরে থাকতে হয়না।এমনি করে মিষ্টি  শাসনে কতদিন হল কেউ বারন করে না। শিহাববের ভাবনায় বারবার লিফটে সেই শায়লার স্পর্শ  শায়লার নিজেকে  একেবারে সঁপে দেয়া ক্ষণ গুলো যেন শিহাবকে বিদুৎ চমকে আবেশিত করছে।শিহাব ক্রমশ অধীর হয়ে উঠছে।শায়লাকে একান্তে পাওয়ার আবেগে একাকীত্বটা অসহনীয় হয়ে উঠছে। কেবলি বলতে ইচ্ছে করছে, শায়লা তুমি এক্ষুণি চলে আসো,এসে দেখো আমি কেমন একা  একা বসে শুধু তোমাকেই ভেবে চলেছি।হাতের কাছে মোবাইলটা। তবুও ইচ্ছে করছে না কল করতে, ইচ্ছে করছে না কথা বলতে, অনুভবের এই উন্মাদনায় শিহাব পুরোপুরি ডুবে আছে।চাইছে না কথার অনুরননে তার ছেদ ঘটাক। মাঝে মাঝে নিঝুম নিশ্চুপ নিরালা পরিবেশ হাজার কথার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠে। আজ আকাশে প্রচুর তারার মেলা।শিহাব বারান্দায়  আলো নিভিয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে বসা।ধীরে ধীরে সে সন্ধ্যার আকাশ থেকে রাতের এই ঘন কালো আঁধারের আকাশ দেখছে। তারার ঝিকিমিকিতে শিহাবের মন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। নিজেকে আজ একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষ ভাবছে। দুঃখ যতই আঘাত হানুক একটু সুখ ছোঁয়ার তার চেয়ে অনেক ক্ষমতা। শায়লাকে খুঁজে পাওয়া তার  আপন হওয়া এমনি করে তার জীবনের সাথে শায়লার মিশে যাওয়া শিহাবের  পিছনের সব দুঃখকে ভুলিয়ে দিয়েছে। শিহাবের যেন আর দেরী সইছে না, শায়লাকে কবে নিজের ঘরে তুলে আনবে।সব কিছুর দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সে শুধুই শায়লাকে দেখে সময় কাটাবে। কত কত দিন যে এই নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে। দিন শেষে শূন্য হৃদয়ে,ফাঁকা এই ঘরটার লক খুলে ঢুকেছে। অসহনীয় সেই ক্ষণগুলো।আর ভাল লাগছে না কিছুই।কবে শায়লার সান্নিধ্য পাবে, কাটবে মধুময় সময়।শিহাব বুঝতে পারছে কেমন করে শায়লা তাকে এতটা বিভোর করে রাখে।
ইচ্ছে করছে এখুনি বাইকটা নিয়ে পিছনে শায়লাকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়ি অজানার উদ্দেশ্য।  ছুটে চলি মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে দূর থেকে দূরে। 
বেশ অনেক রাত হলো।শিহাব মোবাইল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। রাত সাড়ে বারোটা!  কিভাবে এতটা সময় পেরিয়ে গেলো।শায়লার সাথে কথা বলার জন্য মনটা বেচায়েন হয়ে উঠলো!  তার ফোন কলের অপেক্ষায় নিশ্চয়িই অভিমানী মুখ নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। শিহাব বিছানায় আধশোয়া হয়ে শায়লাকে মেসেঞ্জারে কল দিতেই ফোন স্ক্রিনে দেখা গেল, সি ইজ বিজি উইথ এনাদার কল! 
শিহাব বুঝতে পারলো না, এত রাতে শায়লা কোন কল নিয়ে বিজি হলো? তবে কি কানাডার কল এটেন্ড করছে সে? 
শিহাবের ভেতরটা ওলোট পালোট হয়ে গেলো।


চলবে.....