উপন্যাস
টানাপোড়েন ১১৪
বি ব্লক এর ২৩ নম্বর
মমতা রায় চৌধুরী
সারারাত ছটফট করেছে রেখা ।কি যে ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করেছে ফোনটা আসার পর থেকে ।কে হতে পারে ?কে হতে পারে? এই ভাবনা বার বার মোচড় দিয়ে উঠেছে তার হৃদআকাশে । একবার এপাশ, একবার ও পাশ করেছে। একটু অবাক হল আবার মনোজ আজও এ ঘরে শুতে আসে নি। অথচ আগে বলতো রেখার পাশে না শুলে নাকি ওর ঘুমই আসে না।
চুলের গন্ধে ওকে নাকি আলাদা একটা মাদকতা এনে দিত। এসব অতীত রেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।একটা সময় পর বোধহয় এরকমই
হয় ।দাম্পত্য জীবনের একঘেয়েমি দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। রেখার ও মনোজের জীবনে তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসলো ।এর কারণ অবশ্যই আছে, তাদের মাঝে সেতুবন্ধন ঠিকঠাক হয়নি ।আজ যদি ওদের মাঝে এক নতুন অতিথি র আগমন হতো, তাহলে কি সব কিছু অন্যরকম হতো। নাকি তিথি এখনো মনোজের মন জুড়ে আছে ।কিছুটা সময় হয় তো রেখার সঙ্গে মোহাবিষ্ট হয়ে জড়িয়ে ছিল ।এজন্যই হয়তো তখন তিথি ছিল নিষ্ক্রিয় । আজ রেখা নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে ।এমনিতেও রেখাকে পছন্দ করে না শাশুড়ি, ননদ ।মনোজের একরাশ ভালোবাসা সবকিছু ভুলে গেছিল কিন্তু আজ যদি ও মুখ ফিরিয়ে নেয় ,তাহলে রেখার ভালোবাসার স্বপ্নগুলো কিভাবে পূর্ণতা পাবে?
তবে কি সে বড় ভুল করেছে ?তার জীবনে বসন্ত এসে তার দোরগোড়ায় কড়া নেড়েছে বারবার । স্বপ্নীল এসেছিল জায়গাটা নিতে সে জায়গায় তাকে বসালেই কি তার জীবনে অন্য পূর্ণতা পেত?
আজ ভীষণভাবে স্বপ্নীলের কথা মনে হচ্ছে।
হঠাৎই রেখা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ,জানলার কাছে পর্দা সরিয়ে ভালো করে পাল্লা খুলে দেখতে থাকে । নিচের দিকে তাকিয়ে ঝিমঝিম করে উঠে মাথাটা। অবলম্বনহীন একটা শূন্যতা যেন রেখার চারপাশে দুহাত বাড়িয়ে আকর্ষণ করতে
থাকে ।জানলা দিয়ে বাতাস ছুটে আসছে। অবলম্বনহীন দীর্ঘ শূন্যতা তার নেমে আসছে সারা শরীরে। কিভাবে অতিক্রম করবে ?অনেকক্ষণ চেয়ে রইল নিচের দিকে ।ভুল হয়ে গেছে। প্রায় পোকার মত মানুষ হাঁটছে, মর্নিং ওয়াক করছে। গাড়ি যাচ্ছে।
এর মধ্যেই বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ আসলো। এত সকালে বাথরুমে কে মনোজ ই
হবে ।হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে রেখাও উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। রেখার আজকাল শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। ভাবছে একবার ডাক্তার দেখাবে কিনা? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল রেখার যদি লেখার রসদ কিছু খুঁজে পাওয়া যায় ,তাই ডায়েরি নিয়ে বসল গিয়ে ব্যালকনিতে।
হ্যাঁ তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলো । আলোর মনটা ছিল কল্পনাপ্রবন। কল্পনায় সে হারিয়ে যেত দূর থেকে বহুদূর। তার নায়িকার মধ্যে রয়েছে একাকীত্ব, তার স্বামী তাকে ভালোবাসে না, তার মেয়ে তাকে ভালোবাসে
না ,তার ছেলে তাকে ভালোবাসে না, সংসারে কেউ তাকে চায় না ।তার সেই দু:খের কথা ভেবেই ভেবেই সে সুখ পেত।
তাঁর উপন্যাসের আলো ছিল রক্ষণশীল পরিবারের বধূ। ও বাড়ীর কাঁটাতার পেরিয়ে মনের হদিশ পাওয়া খুবই দুষ্কর ব্যাপার। তবুও যেন পবিত্র কোন এক রন্ধ্র পথে ঢুকে পড়েছিল। আলোর দুর্বলতাগুলো যেন সে জেনে নিতে পেরেছিল। এই দুর্বলতাকে না সরিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আলো বোধহয় এ রকমই কিছু চেয়েছিল ।কোন একটা অঘটন ,একটু পতন। তবুও,একটু সামান্য অপরাধবোধে জীবনটাকে যেন উজ্জ্বল করে দিয়ে যায়।
এই অব্দি লেখার পর রেখা একটু আঁতকে উঠলো একি আলো, আলো ক্রমশ রেখার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। এ যেন মনে হচ্ছে দুটি ভিন্ন আত্মা।
এবার লেখা থামিয়ে রেখা ভাবল এবার প্রাতঃক্রিয়া সেরে ফেলে গোপালের ভোগ চাপাতে হবে। চা করতে হবে। কাজের মাসি একটু পরেই চলে আসবে। মিলি,তুলিদের খাবার দিতে হবে।
কালকে রাত্রিতে খেয়াল করেছে পাইলট একটু খেয়েছে ।আশা করা যায় আজ থেকে পাইলট খাবার ধরবে। ওদের তো শুনেছি আজকে ভ্যাকসিন করতে আসার কথা, যে দুটো বাচ্চা সুস্থ আছে তাদের জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে বাথরুমে চলে যায় রেখা।তারপর ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে গোপালের ভোগ নিবেদন করে।
, চায়ের জলটা বসিয়ে পেপারে মনোযোগ দেয়। অনেকদিন পর পেপারটা পরছে । সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে ।অলস বৃষ্টির দিনে আজকে স্কুলে যাবে না এমনিতেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সেজন্য স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। পেপারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ করে একটা ছবি নজরে আসে। আরে ,এ তো স্বপ্নিলের ছবি ।ভুল দেখছে না তো? ছবিটা আরেকটু চোখের সামনে নিয়ে আসলো । চশমাটা পরে নিল হ্যাঁ ঠিক দেখছে।
ভালো করে পরল পড়ে দেখল স্বপ্নীলের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে বইমেলায়। স্বপ্নীলের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়েছিল। তখনো মাঝেমাঝেই কবিতা আওরাত এতো ভালো লাগতো ওর
কন্ঠে।রেখা মোহাছন্নের মতো তাকিয়ে
থাকতো ।কবিতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাকিয়ে থাকত রেখা।
মনে পড়ে স্টেশনে আসার পর গরম এক কাপ চা না খেলে যেন সারা সকালটাই
যেন তখন মাঠে মারা যেত।
আর স্টেশনের রত্নাদির চা না খেলে তো জীবনটাই যেন বৃথা। একদিন স্বপ্নীল বলল ' চা খাবে?'
দোকানটার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো ওই দোকানের চা খুব ভালো।
রেখা বলল' হ্যাঁ ,চা তো খাবোই। রত্নাদির তাহলে তো কথাই নেই। রত্নাদির চা ঠিক আছে। আজ তুমি কিন্তু আমার
অতিথি ।আমি তোমাকে চা
খাওয়াবো ।স্বপ্নীল একগাল হেসে
নিল। তারপর বলল' বেশ তাই হবে।'
তড়িঘড়িরেখা বলল 'রত্নাদি তোমার স্পেশাল চা খাওয়াও। দু কাপ দিও।'
রত্নাদি হেসে বলল' রিম্পাদি এসেছে?'
রেখা ঘাড় নেড়ে বলল আসেনি।
রত্নাদি বলে তাহলে দুকাপ চা।
স্বপ্নীল নিজেকে দেখিয়ে এগিয়ে এসে বলল' 'এই যে আমি অধম এখানে পড়ে আছি ,আমার জন্য।
রত্নাদি অত্যন্ত আহ্লাদিতো ভাবে বলল' আরে আমার কবি
ভাই ।তোমাকে চা না খাওয়ালে হবে ,তোমার কবিতার লাইন শুনবো কি করে?'
রেখা খুব অবাক হয়ে যায় রত্নাদি স্বপ্নীলকে চেনে? অনেক কিছুই জানে মনে হয়।
স্বপ্নীল ও রেখা একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে বসল।
ইতিমধ্যে রত্নাদি স্পেশাল চা করে এনে দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে বলল' তোমাকে কবি ভাই বললো ,তাহলে তোমার লেখা এরাও পড়েছে?'
স্বপ্নীল মুচকি মুচকি হাসে আর বলে 'আমার কাছ থেকে শুনেছে।আবার অন্য কোনভাবে উপরে থাকতে পারে সেটা আমার জানা নেই।'
কত সুন্দর মুহূর্ত গুলো কেটেছে।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আরে, রান্নাঘরে তো
চায়ের জল বসানো
আছে ।এতক্ষণ পর মনে পড়ল রেখার।
তড়িঘড়ি করে রেখা রান্নাঘরে গেল ,গিয়ে দেখল চায়ের জল কমে এক কাপের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। কি আর করবে অগত্যা আর একটু জল দিয়ে দিল । এবার চা করে নিয়ে এককাপ মনোজের ঘরে দিতে গেল।
চা নিয়ে গিয়ে রেখা দেখল মনোজ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। রেখা ডাকলো না ।চা নিয়ে চলে আসলো। এরমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ জয় গনেশ জয় গনেশ জয় গনেশ দেবা।'
রেখা ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখে মাসি এসেছে
কাজে ।রেখা বলল' তুমি আজকে আরো তাড়াতাড়ি আসলে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে না আসলেই পারতে
মাসি।'
মাসি এক গাল হেসে বলল 'তোমাকে বলে যায়নি তো। তাই?
রেখা বলল 'তা বুঝেছি, এই বৃষ্টিতে ভিজলে শরীর খারাপ হবে মাসি। আর তোমাকে বলা থাকলো এরকম বৃষ্টি হলে তুমি সেদিন কাজে এসো না।
বলতে বলতেই রেখা চায়ের কাপটা মাসীর দিকে এগিয়ে ধরে।
চা খেতে খেতে মাসী বললো আজকে তুমি স্কুলে যাবে না?
রেখা আস্তে আস্তে বলল 'আজকে আমি ডুব দিলাম'।
'তা বেশ করেছো'। এর মধ্যেই আবার কলিং বেলের আওয়াজ 'জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা '। রেখা অবাক হয়ে গেল ।বলল'আবার কে আসলো?
একটু বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলল, খুলেই ভূত দেখার মত দেখল" একি পার্থ?'
পার্থ বলল' হ্যাঁ বৌদি, মনোজদা রেডি তো?'
রেখা অবাক হয়ে বলল 'রেডী মানে? কোথায় যাবে?'
' সে কি আপনাকে বলে নি।,
"আমাকে বলেছিল তো কলকাতায় যাবে।'
রেখা বললো' কে জানে ।কলকাতায় যাবে তো এখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে ।আমাকে তো কিছু বলেনি। এসো ,ভেতরে এসো পার্থ ।কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?'
বৃষ্টির অলস দিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সারাদিন ধরে মনের ভেতরে পিয়ানোর সুর এর মত বারবার বেজে উঠেছে স্বপ্নীলের কথা। কতবার স্বপ্নের ঘোরে স্বপ্নীল আর রেখা এক হয়েছে ,পাশাপাশি চলেছে, তাদের এই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছে । স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে দেখে সে পড়ে আছে কল্যাণীর 'বি' ব্লকের ২৩ নম্বর বাড়িতে। এখানে আছেএখন একরাশ বিরক্তি ,ভালবাসাহীন, অবলম্বনহীন শূন্যতা।'