একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (৩৩)
অজানা আতঙ্ক
আজ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। সকলে ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করবে ,যাতে গৃহে সুখ-সমৃদ্ধি শান্তি বজায় থাকে । রেখা গতকাল স্কুল থেকে ফেরার সময় একটু বৃষ্টিতে ভিজেছিল। মনে হচ্ছে গা টা সকাল থেকেই একটু ম্যাচ ম্যাচ করছে ,মাথা যন্ত্রণা করছে, জ্বর জ্বর ভাব। এসব উপেক্ষা করে লক্ষ্মী পূজার জোগাড়ে মেতে উঠেছে ।সকাল থেকে কাজ গুছিয়ে নিয়ে ,স্নান করে মা লক্ষ্মীর ভোগ রান্না করে ,তারপর পুজোয় বসেছে ।এর মধ্যে একবারও মনোজ কোন খোঁজ খবর নেয় নি। সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তা 'যেন একলা আকাশ থমকে গেছে কোন এক....।' পুজোর জোগাড় করছে বটে ,কিন্তু মনোজের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে ।আজকাল ঘনঘন মনোজের ফোন আসে। যদিও কোনো কালে রেখা ফোনের ব্যাপারে কৌতুহলী হয় নি ।তবে আজকে একটা কথাতে রেখার মনে খটকা লেগেছে ।কি হতে পারে?
মনোজ কেন ওই কথাটি বলল 'এখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
'ভাবতে ভাবতে কাজে ভুল হচ্ছে। ওদিকে সকালের সব কাজ গোছানোর পর সুমিতা এসেছে। কিন্তু তাকে কিছু বলার প্রবৃত্তি রেখার আজকে হয় নি ।কি বলবে ?পুটু চলে যাবার পর থেকেই এই মেয়েটি কাজে এত দেরি করে আসে ।আবার কোনদিন আসলোই না। কামাইও প্রচুর। এই জন্য রোজ রোজ কথা বলতে ভালো লাগে না ।আজকে তো ইচ্ছেই করছে না। বাসন গুলো ছিল ,সেগুলো মেজে দিয়ে চলে গেছে। যাবার সময় বলল ' বৌদি বৌদি বৌদি।'
রেখা ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল 'চিৎকার করছো কেন?'
সুমিতা বলল 'কালকে আমাকে মাইনের টাকাটা দিয়ে দেবে?,'
রেখা বলল ' এখনো তো মাস শেষ হয়নি?'
সুমিতা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল 'আমার খুব দরকার তাই..?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে। নিয়ে নিও। সবকিছুই ঠিক আছে সুমিতা। তুমি কাজে কেন এতো লেটে আসো ?আবার যেদিন আসো না ,সেদিন বলেও যাও না। এতে যে আমাকে কত অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় ,সেটা যদি তুমি একটু বুঝতে?'
সুমিতা শুধু পায়ের উপর পা ঘষে যেতে লাগল আর চুপ করে থাকলো।
কালকের দিনটা সুমিতা যে কাজে আসবে ,রেখা নিশ্চিত হয়ে গেল। কারণ কালকে ও টাকা নেবে।
ওদিকে কে যেন মনোজ মনোজ করে ডাকছে। তার আগে কলিং বেল বাজল। কিন্তু মনোজ কী করছে?
কোনো সাড়া শব্দ নেই ভাবতে ভাবতে দরজা খুলল।
রেখা দরজা খুলেই দেখে 'সৌম্যকান্তি শুভ্র বস্ত্র পুরোহিত মশাই।'
পুরোহিত মশাই বললেন 'কখন থেকে কলিং বেল বাজাচ্ছি বৌমা'। কারোর কোন সাড়াশব্দ নেই। মনোজ কোথায়?
রেখা একগাল হেসে বলল 'ক্ষমা করবেন। আসুন ভেতরে আসুন। ও কাজ করছে বোধহয় ভেতরে।'
পুরোহিত মশাই বললেন ,'আজ লক্ষ্মীপুজো কত জায়গায় পুজো আছে জানো, একটুও সময় এদিক ওদিক হলে চলে না।'
রেখা মনে মনে ভাবল যতবারই যেকোনো পুজোতেই আসুন না কেন একই কথা?যদিও কোজাগরীতে পুজের সংখ্যাটা একটু বেশি থাকে।
পুরোহিত মশাই বললেন ' সব জোগাড় আছে তো মা?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ।
পুরোহিত মশাই বললেন 'জানি তোমার বাড়িতে পুজো করতে এসে আমাকে কিছু জোগাড় যন্ত্র করতে হয় না তুমি সব গুছিয়ে রাখো ।তবু একবার জিজ্ঞেস করলাম। তোমরা স্বামী-স্ত্রী লক্ষীনারায়ন।' এরপর শুরু করলেন পুজো।
এরইমধ্যে রেখা ভাবতে লাগলো আরতি করার সময় হোমের সময় মনোজ থাকে পাশে। সত্যিই খুব সুন্দর দু'জনে মিলে পূজা করে। এবারটা যে কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। পুজো করতে বসেও মনে শান্তি নেই। একটু পরে আরতী শুরু হবে মনোজ কী আসবে? না কি ডাকতে যেতে হবে? বলতে বলতেই শঙ্খ বাজাতে শুরু করলো, উলু ধ্বনি দিল।
রেখা আবার ভাবছে 'মনোজ এর জন্য একটা নতুন পাজামা -পাঞ্জাবী বের করে রেখেছে। স্নান করে এসে ওটা পরবে তো?'
পুরোহিত মশাই বললেন 'মনোজকে ডাকো, বৌমা ।আরতী শুরু হবে ।নইলে তো আবার রাগ করবে।,'
রেখা বলল 'হ্যাঁ যাই ।ডেকে আনছি।'
ওদিকে জানলা দিয়ে চৈতির মা ডাকছে ও দিদি, ও দিদি ,পুরোহিত মশাই এসে গেছেন গো?
রেখা জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে বলল ,' হ্যাঁ।
চৈতির মা বলল 'দিদি একটু পুরোহিত মশাইকে বলবেন তো ,এরপরে যেন আমাদের বাড়ির পুজোটা করে দেন।'
রেখা শুধু ঘাড় নাড়ল আর বলল ,'দিদি প্রসাদ নিও,আমাদের বাড়িতে এসে।'
চৈতির মা হেসে বলল 'আজ সবার বাড়িতে পুজো আপনারাও আসবেন আমার বাড়িতে।'
অন্যদিকে পুরোহিত মশাই ডাকছেন 'বৌমা ,বৌমা দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
রেখা গলা বাড়িয়ে বলল 'হ্যাঁ ,যাই কাকাবাবু।'
চৈতির মা বলল 'না, না ,দিদি। বেশি কথা বলব না। যান ওদিকে দেরি হয়ে যাবে।'
রেখাও বললো 'হ্যাঁ, দিদি ।বলেই চলে গেল।
মনোজকে খোঁজ করতে গিয়ে দেখে, ঘর অন্ধকার ।ড্রইং রুমে বসে ফোনে কথা বলছে।'
রেখা বলল 'তুমি আরতী করতে আসবে তো?'
মনোজ না তাকিয়ে ঘাড়টা নাড়লো।
রেখা বলল আরতি শুরু হয়ে গেছে একটু তাড়াতাড়ি এসো ।ওদিকে পুরোহিত কাকা তাড়া দিচ্ছেন ।এরপর হোম আছে।-বলেই রেখা চলে গেল পুজোর ঘরে। যেন কুকুর তাড়া করেছে।
রেখা লক্ষ্মী পূজার দিন খুব সুন্দর করে সাজে গয়নাগাটিতে ।পায়ে নুপুর পরে। নুপুরের আওয়াজে সারা বাড়ি যেন নেচে ওঠে।নুপুরটা মনোজের জন্য ই পরে।
অথচ একবারও আজকে মনোজ বলল না ,নুপুর পরে গয়নাগাটিতে তোমাকে কত সুন্দর লাগছে। মনোজ প্রতিবার এই কথাটা রেখাকে বলে ।আজ কি করে ভুলল। পুজোর ঘরে গিয়ে বসে বসে ভাবছে।
পুরোহিত মশাই বললেন 'মনোজ আসলো না? আর কতক্ষন ওয়েট করবো বৌমা ?এবার তাহলে হোম শুরু করে দেব?'
রেখা বলল 'আসলে শরীরটা একটু খারাপ তো?'
পুরোহিত মশাই বললেন 'ও তাই বুঝি ।এই জন্যই আজকে মনোজ পুজোর ঘরে নেই ।আমি ভাবলাম কী জানি ,আবার কি হলো। ডাক্তার দেখিয়েছো তো।
তাহলে ওকে না ডাকলেও হয়। ও রেস্ট নিক বুঝলে বৌমা?'
রেখা শুধু ঘাড় নাড়ল।
এরমধ্যে হোমের জোগাড় করে ,হোম শুরু হয়ে গেল। রেখা করজোড়ে ঠাকুরকে ডাকতে লাগল 'ঠাকুর সবাইকে ভালো রেখো। আর তার জীবনে সবকিছু ঠিক করে দাও ।মনোজের মনে যদি কোন কষ্ট থাকে ।সেগুলো দূর করে দাও । সুখ শান্তিতে ভরিয়ে তোলো ।ভালো রেখো।'
হঠাৎই মনোজ পুজোর ঘরে প্রবেশ করে। রেখার তখনও দু চোখে জল। প্রণাম করে উঠতেই মানোজকে দেখতে পেয়ে, চোখে আবার আনন্দাশ্রু বেয়ে পরে।
পুরোহিত মশাই বললেন 'বাবা মনোজ শরীর ঠিক আছে তো ?এসো ,এসো বাবা ।বসো।'
হোম অর্ধেক হতেই একটা ফোন আসে, মনোজ বেরিয়ে যেতে চায় ।
তখন রেখা বলে 'হোম শেষ না করে উঠতে নেই ।তুমি তো জানো?'
অগত্যা মনোজ বসলো। ফোনটা বেজেই যেতে লাগলো।
রেখা বলল ' ফোনটা একটু সাইলেন্ট করে দাও।
রেখা লক্ষ্য করলো মনোজ সেই নতুন পাজামা -পাঞ্জাবীটা পরে নি ।পুরোনোটাই পরেছে ।চোখে মুখে যেন একটা বিষন্ন দুশ্চিন্তা।
পুজো শেষ হয়ে গেল পুরোহিত মশাই একে একে তার সমস্ত জিনিস ঝোলায় পুরে নিতে লাগলেন। বরাবরই ভালো ভালো মিষ্টি ,নাড়ু যা থাকে ,সব ই তুলে নেন দু-একটা রেখে ।বড় বড় গোটা গোটা ফলগুলো তুলে নেন। তারপর দক্ষিণা।
যাবার সময় প্রতিবার বলেন ' পরেরবার দক্ষিণা আরেকটু বাড়িও মা।'
একটু পরেই বাড়িতে পার্থ (পাশের বাড়ির), তার পাশের বাড়ির সকলেই প্রসাদ নিতে চলে আসে। রেখা
সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করে। চৈতিদের বাড়িতে প্রসাদ পাঠিয়ে দেয়। সুমিতার জন্য আলাদা করে প্রসাদ ফ্রিজে ঢুকিয়ে দেয়।
এরই মাঝে পার্থ জিজ্ঞেস করেছিল 'বৌদি ,মনোজদা কোথায় গেল? দেখতে পাচ্ছি না। আজকে আমিও বেশিক্ষণ বসবো না ,আমার একটু তাড়া আছে, বৌদি।
রেখা বলল 'কাজে ব্যস্ত আছে তো?'মনে মনে ভাবল কতজনকে বলবে এই একই কথা? আর ভাবলো ভালোই হলো পার্থ বেশিক্ষণ বসবে না।না হলে হাজার প্রশ্ন উঠে আসত।
সবাই চলে যাবার পর রেখা মনোজের ঘরে প্রসাদ নিয়ে গেল ।তখনো মনোজ ফোনে কথা বলে যাচ্ছে রেখার একটু অদ্ভুত লাগছে । কি এমন আর্জেন্ট কথা আছে ,সব সময় ফোনে এরকমটা তো আগে কখনো হয় নি।
মনোজ রেখাকে দেখে একটু চমকে উঠলো। ইশারায় বলল-'প্রসাদটা রেখে যেতে।'
রেখা প্রসাদের থালাটা নামিয়ে রেখে ,এবার নিজে প্রসাদ খেয়ে ,জল খেয়ে নিল ।প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। এই জন্য মনোজ কী করছে ,না করছে রেখার সেসব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ।শরীর নিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে আবার মিলিদের খেতে দিতে হবে ।কাজেই ঐসব দিকে রেখার থাকলে হবে না। অনেকক্ষণ থেকেই মিলি চেঁচাচ্ছে খাবার জন্য। বাচ্চা হবার পর ওর খাবারের চাহিদা বেড়েছে। এবার রেখা মিলিদের খেতে দিতে চলে গেল। ভাবলো আর নয় এবার একটু রেস্ট নেবে ।পুজোর বাসনগুলো কালকে তো সুমিতা আসবে ,ওই মেজে নেবে।
রেখার নিজের ঘরে রেস্ট নিতে যাবার সময় মনোজের হটটক শুনতে পেল। 'আমি তো বারবার বলছি ,আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরেও জোর করলে তো হবে না ।এখন অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে। সেটা তোমাকে বুঝতে হবে।'
রেখা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবছে 'সব ঠিক আছে। 'তোমাকে বুঝতে হবে ?'তুমি' বলতে কাকে বোঝাতে চাইছে?'রেখা ভাবছে, এবার রেখা পাগল হয়ে যাবে ।রেখার জীবনে নূতন কোনো ঝড় আসতে চলেছে কিনা? নতুন করে সেই ঝড় সত্যিই সে সামলে উঠতে পারবে তো? বারবার তার গা শিউরে উঠতে লাগলো অজানা অচেনা আতঙ্কে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন" ৩৩ক্রমশ