টানাপোড়েন (২৩)
ক্রাইসিস
তৃপ্তি বেশ কয়েক দিন ধরে ভাবছে শেখরকে রাধার কাজে না আসার ব্যাপারে বলবে।কিন্তু শেখর সব সময় এড়িয়ে যায় ব'লে ,বলি বলি করে বলা হয় না।তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।তাছাড়া অফিসে যায় বলে শেখরের নজরে আসে নি বোধহয়।আজ ছুটির দিন অনেকটাই সময় ওর হাতে।ভাবছে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কথাটা তুলবে ।
হঠাৎ শেখর রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলে ' খাবার রেডি?' 'অনেক দিন পর শেখরকে এই মুডে দেখে তৃপ্তির ভালো লাগলো।মনে পড়ে গেলো প্রথম বৌ হয়ে যখন এ বাড়িতে আসে ,তখন প্রায় ই কোনো না কোন অজুহাতে রান্নাঘরে আসতো,শুধু মাত্র তৃপ্তিকে দেখার জন্য।আসলে যৌথানপরিবার তো সেজন্যই।এক পলক একটু দেখা।সারাদিন অফিস করে একেবারে রাত্রিবেলায় দেখা।এখন যৌথাপারিবারও ভেঙে গেছে।একক পরিবারে থেকে ও আগের মত আকর্ষণ অনুভব করে না। পুরোনো দিনে ফিরে যায় তৃপ্তি।
আবার শেখর বলে 'তৃপ্তি ব্রেকফাস্ট রেডি?'
তৃপ্তি চমকে ওঠে ,একটু লজ্জা পেয়ে বলে ''হ্যাঁ।,তুমি খাবার টেবিলে বসো।'
শেখর বলে 'আজ কি রাধা আসবে না বলে গেছে,,?'
তৃপ্তির কাছে মেঘ না চাইতে জল।তৃপ্তি ব্রেকফাস্ট দিতে দিতে বলল ' ও তো আজ কদিন ধরেই আসছে না।'
শেখর অবাক ও বাঘ্রভাবে বলল ' তুমি এ ক'দিন নিজে কাজ করেছো,আমাকে বলো নি কেন?'
তৃপ্তি হেসে বলল 'আসলে,তোমার অফিসে এত চাপ,তাই আর বলি নি।'
শেখর বলে 'তাতে কি?তুমিও তো আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট।'
তৃপ্তির বুকটা হঠাৎ ছাৎকরে উঠলো।আর অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
শেখর বলল 'তোমার কষ্ট হলে ,আমার কষ্ট লাগে না?ঠিক আছে। আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি।ফিরে এসে খবর নেব।টেনশন নিও না ।'
তৃপ্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
শেখর আবার বলে 'সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকো না।'
তৃপ্তি অবাক হয়ে যাচ্ছে।কোনো স্বপ্ন নয় তো?তাই একবার নিজের শরীরে চিমটি কাটল।না তো এটা একেবারে বাস্তব।
শেখর আবার বলল 'আসছি।'
তৃপ্তি একটু হাসলো।
তৃপ্তি ভাবছে আজ সকাল থেকে কি যে হচ্ছে?তৃপ্তি সৌরভের ব্যাপারটা নিয়ে দোটানায় পড়ল।
শুধুমাত্র সন্তান না হওয়ার জন্য শেখরকে ছেড়ে যাবে?হঠাৎ সৌরভ আসতেই কি জীবন অন্যদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে?এরকম সাতপাঁচ ভাবছে, এমন সময় ফোন বেজে উঠল,নুতন কলার টিউন' ডোন্ট ক্রাই বেবি,ডোন্ট ক্রাই ।আই অ্যম দিস কামিন...
আমি আসছি।'।তৃপ্তির কাছে পরিচিত এই গান।অনেক দিন পর বাজছে।এটা যে শেখরের কল ,সে জানে ।
পুরনো সুখস্মৃতি বড্ড নাড়া দেয়।
তৃপ্তি খুশি মনে ফোনটা রিসিভ করে বলে 'হ্যালো'।
শেখর বলে 'নিউজ দেখেছ?'
তৃপ্তি অবাক হয়ে বলে 'না তো?কেন কি হয়েছে?'
শেখর একটু উত্তেজিত হয়ে বলে 'তোমার রাধার খবর পেয়ে যাবে?'
তৃপ্তি বলে 'কোন চ্যানেল?'
শেখর বলে 'কলকাতা লোকাল নিউজ?'
তাড়াতাড়ি তৃপ্তি রিমোট টিপে নিউজ চ্যানেল খোলে।অবাক কাণ্ড বারবার দেখাচ্ছে '১০ দিনের দুধের কন্যা সন্তানকে মহালায়ের পুণ্য তিথিতে গঙ্গায় বিসর্জন দিলেন,এক মা।দেবী পক্ষের আগমনে , দেবশিশু র বিসর্জন।
তৃপ্তি অবাক হয়ে যায়,রাধা এই কাজ করেছে?অথচ লাস্ট বার যখন ও প্রেগন্যান্ট ',।
তখন সে বলেছিল, 'রাধা ঘরে তো সন্তানের অভাব নেই,তা সত্ত্বেও আবার কি দরকার ছিল?.'
তাতে সেদিন রাধা তৃপ্তির মাতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।খুব খারাপ লেগেছিল।মনের ওপর ঝড় বয়ে গেছে।ঝড় আবার আজ উঠলো।মা হয়ে কি করে সন্তানকে,বিসর্জন দেয়?আর ভাবতে পারছে না। সত্যি সত্যি তৃপ্তির হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। একটা সন্তানের জন্য একটা পরিবার ভেঙে যায়, ভালোবাসার মানুষ দূরে চলে যায় ।একটা সন্তান না থাকার জন্য পরিবার সমাজের কাছ থেকে কত রকম কটুক্তি শুনতে হয়।
রাধা কেন এরকম কাজ করলো ।ভেবেই পাচ্ছে না তৃপ্তি।
রাধা তো বলেছিল 'স্বামীকে বেঁধে রাখার জন্যই এই সন্তানের ভীষণ দরকার।'
তাহলে সেই দরকারটা এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। নাকি ভেতরে ভেতরে রাধা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল।
কোন ক্রাইসিস বোধ থেকে এরকম কাজ করেছে ।যাই হোক না কেন তৃপ্তি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ।মা হয়ে রাক্ষসীর মত কাজ। কন্যা সন্তান হয়েছে বলেই কি এই কাজ করল? রাধার ভিতর কোন্ ক্রাইসিস কাজ করছিল ?তৃপ্তি ভেবেই পাচ্ছে না।
এরইমধ্যে শেখরের আবার ফোন 'রাধাকে থানায় নিয়ে গেছে।'
তৃপ্তি বলল 'কেন যে রাধা এরকম কাজ করলো?'
শেখর বলল এই নিয়ে আবার ভাবতে বসো না।'
দেখি অন্য কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। রাখছি।
তৃপ্তির আজকের সোনালি মধুর মুহূর্তে একরাশ মন খারাপ করা অন্ধকার গ্রাস করল।