একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা নিয়ে কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন " চলবে...
টানাপোড়েন (৫৫)
সমানুভূতি
'আ.আ.আ. মেরে ফেলল'-পাশের বুলু জেঠিমাদের বাড়ি থেকে চিৎকারটা আসছে। রেখা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। হন্তদন্ত হয়ে ছাদ থেকে নেমে এসে ডাকতে শুরু করলো, 'কাকিমা, কাকিমা ও কাকিমা?'
কাকিমা রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বলল 'কি হল রে ননী।'
রেখা বলল 'তুমি এখনো রান্নাঘরে?'
কাকিমা বললেন 'আর বলিস না সাড়ে তিনটে বাজে। এখনো তো লক্ষী আসলো না?'
রেখা বলল'তাই বলে তুমি এখন বাসন মাজতে বসবে?'
কাকিমা বললেন'না মেজে উপায় আছে? সকাল হোলেই তো বাসনের দরকার হবে।'
রেখা বলল ' তাহলে তুমি আমাকে বলতে পারতে?'
কাকিমা বললেন'না ননী ,তোরা শ্বশুর বাড়িতে কত কাজ করিস। বাপের বাড়িতে এসে একটু রেস্ট নিবি না।'
রেখা বলল 'যদি মেয়েরা বড় হয়ে মায়েদের কাজেই না লাগে ,তাহলে কি ভালো দেখায়?'
কাকিমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে চিবুক ধরে আদর করে বললেন 'লক্ষী মেয়ে কত সুন্দর ভাবনা। বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।'
রেখা বলল ' কাকিমা ,আমি না তোমার মধ্যে আমার মায়ের গন্ধ পাচ্ছি।'
দু চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগলো।
কাকিমা ওর চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললেন ' ভাবনা কিসের মা ।আমরা তো এখনো বেঁচে আছি।'
রেখা বলল 'কাকিমা, যখন বাড়িতে একা থাকি তখন খুব মায়ের কথা মনে হয়। অনেক অনেক দেখতে ইচ্ছে করে মা কে। মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে।'
কাকিমা বললেন 'সে তো করবেই মা ।তোমার জন্মদাত্রী ।তার জন্য তো তোমার কষ্ট হবেই।'
কাকু ঘর থেকে বললেন 'তোমাদের রান্না খাওয়া দাওয়া হলো। এবার তো ননীকে নিয়ে বেরোবে একটু।'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ বেরোবো। আর বোলো না একটু দেরি হয়ে গেল। লক্ষ্মী কাজে আসে নি।'
কাকু উদগ্রীব হয়ে বললেন ' লক্ষী কামাই বেশি করে না ।করলেও তোমাকে বলে যায়। আজকে তাহলে কি কিছু হল?'
কাকিমা বললেন 'কে জানে আমিও তো সেটাই ভাবছি।'
রেখা বলল 'কাকিমা তোমাকে যে কথাটা বলার জন্য ছুটে এসেছিলাম ।'
কাকিমা বললেন ' কি কথা রে?'
রেখা বলল 'বলছি তুমি কোন চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেয়েছো ?'
কাকিমা বললেন'হইচইয়ের আওয়াজ একটা কানে আসলো বটে কিন্তু আমি অতটা আমল দিই নি জানিস ননী ?তখন আমার রান্নাঘরেই ধ্যান ছিল।'
'রেখা বলল 'ওই আওয়াজটার কথাই বলছি ।আমি তো ছাদে ছিলাম ।স্পষ্ট আসছিল আওয়াজটা।'
কাকিমা বললেন 'তোর কি মনে হয় কোন দিক থেকে আসছিল আওয়াজটা।'
রেখা বলল 'বুলু জেঠিমাদের বাড়ি থেকে।'
কাকিমা বললেন 'কি রকম আওয়াজ বল তো?'
রেখা বললো 'মনে হচ্ছিল যেন অসহায় ভাবে কোন আর্তনাদ।'
কাকিমা বললেন 'সে কিরে?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,কাকিমা'।
কাকিমা বললেন 'ড্যাম সিওর গাধাটা ঠিক দিদিকে..?'
রেখা বলল 'কে গো কাকিমা? কার কথা বলছো?'
কাকিমা বললেন ' আজ যদি ওরা দিদিকে কেউ কিছু করেছে ,আমার হাত থেকে ওরা পার পাবে না। এটা দিনকে দিন আর সহ্য করা যাচ্ছে না।'
রেখা বলল 'কেন কাকিমা ওরা কি করে বুলু জেঠিমাকে?'
কাকিমা বললেন 'ভেবেছিলাম কথাটা তোকে বলব না ।কষ্ট পাবি।এখন দেখি বলতেই হচ্ছে।'
রেখা বললো 'কি কথা?'
কাকিমা বললেন ' সে অনেক কথা মা।বুলুদি, উনি মানসিক ভারসাম্য হারান নি। অনেক মেন্টাল টর্চার করা হয়েছে রে।'
রেখা বলল "সেকি কথা কাকিমা?'
কাকিমা বললেন 'এই ছোট ছেলে আর ছোট ছেলের বউটা যে কি ধুরন্ধর ,কি বলবো তোকে?'
রেখা বলল 'তাই?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ ,রে মা ।আমার তো মনে হয় নীলাঞ্জন এর সঙ্গে ওরা এমন কিছু করেছে ,যার জন্য নীলাঞ্জন বাড়িতে আসে না।'
রেখা বললেন 'কেন এরকম করেছে?'
কাকিমা বলছেন ' সবই সম্পত্তি বুঝেছিস?'
দাদা মারা গেলেন এইসব চিন্তা করতে করতে।
এখন বুলুদিকে এরা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে।'
কাকিমা বললেন 'আচ্ছা, চল মা ।তোকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি ,।জেঠিমাকে দেখবি বলছিলি?'
রেখা বললো 'চলো কাকিমা।'
কাকিমা কাকুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ' কি গো একটু খেয়াল রেখো ।আমি দরজা লক করে দিয়ে যাচ্ছি ।তোমার কাছে একটা চাবি আছে না ,ওটা রেখো তোমার কাছে। একটু ননীকে নিয়ে ঘুরে আসি।'
কাকু বললেন' 'সেই ভালো।'
কাকিমা বললেন ' চল রে ননী'।
গেট লক করে বেরোতে যাচ্ছেন ,ঠিক সেসময় ভোলা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল 'ছোট বৌদি ছোট বৌদি?'
কাকিমা পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেন' ভোলা।
কাকিমা বললেন 'কিরে ভোলা এত হাঁফাচ্ছিস কেন ?কি হয়েছে?'
ভোলা বলল 'বুলু বৌদিদের বাড়ি থেকে প্রচন্ড আওয়াজ আসছে ।কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না ।মনে হচ্ছে বুলু বৌদিকে মারছে।'
রেখা তো একে বারে অবাক হয়ে গেল।
কাকিমা একটু রেগে গিয়ে বললেন 'চল তো দেখি ?ওদের কিছু না বলে বলে ,ওদের বড্ডো বাড় বেড়েছে।'
কাকিমা দ্রুতবেগে হাঁটতে লাগলেন সঙ্গে ভোলা এবং রেখা ও।
কাকিমা গেটের কাছে গিয়ে থমকে গেল ।গেট লক করা। বাধ্য হয়ে তখন কাকিমা লালের উদ্দেশ্যে চেঁচাতে লাগলেন।
কাকিমা ঊর্ধ্বস্বরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন 'লাল ,লাল গেট খোল।'
এতক্ষণ চিৎকার-চেঁচামেচিতে গেটের কাছে লোক জড়ো হয়ে গেছে।
ঘরের থেকে আওয়াজ আসলো 'কাকিমা, মা আজকে বড্ড বাড়াবাড়ি করছে ।তাই গেট খুলছি না।'
কাকিমা বললেন 'ঠিক আছে। দরজা খোলো আমরা ভিতরে ঢুকবো'।
অলরেডি গেটের সামনে প্রচুর লোকের ভিড় জমে গেছে।
পরী এসে গেট খুলে দিল। কাকিমা দ্রুতগতিতে ভেতরে ঢুকলেন।
কাকিমা ভেতরে ঢুকেই লালকে বললেন'কি হয়েছে এত চিৎকার করছে কেন বুলু দি।'
বুলু জেঠিমা ভয়ে ভয়ে কাকিমার পেছনে এসে দাঁড়ান।
লাল (লালমোহন) বলল 'রোজ রোজই পাগলামি দেখতে আর ভাল লাগছে না।'
কাকিমা বললেন 'বুলুদি তো এরকম ছিল না। তোমরা দিদিকে এরকম অবস্থায় এনেছো। এখন বলছ রোজ রোজ পাগলামি?'
লালের হাতে একটা লাঠি ছিল । কাকিমা লালের হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে বললেন 'এবার তোমার পিঠে পড়বে লাঠি।'
বুলু জেঠিমা হাততালি দিয়ে বললেন 'বেশ হবে। বেশ হবে।'
রেখার চোখে যেন ঝিলিক খেলে গেল।
মীনাক্ষী কাকিমা বললেন'ভালো করে তোমার মায়ের টিটমেন্ট করাও আর একটা কথা শুনে রাখ ।এরপর যদি আবার কখনো এই দিদির গায়ে হাত তুলতে দেখি বা শুনি ।তাহলে কিন্তু আমরা আইনের দ্বারস্থ হবো।"
প্রতিবেশিদের সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন ' কি আপনারা সবাই সাক্ষী দেবেন তো?'
সকলে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন 'হ্যাঁ ,হ্যাঁ ,দেবো দেবো।'
মীনাক্ষী কাকিমা বললেন ' আগে গ্রামে শাসন ছিল ।মুরুব্বীরা ছিলেন গ্রামে বিচার হতো ।এখন সে সব উঠে যাচ্ছে বলে ,আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সব ভুলে যাচ্ছে ।তাই যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না'।
মাঝখান থেকে লাল এর বউ পরী বলে উঠলো 'এটা তো আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। আপনারা এর ভিতরে ঢুকছেন কেন?'
মীনাক্ষী কাকিমা বললেন 'ঢোকার দরকার হতো না ,পরিবারের মধ্যেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ রাখলে। হঠাৎ হঠাৎ এত চিৎকার করছেন দিদি কি কারণে ?সেগুলো প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরও দেখা উচিত?
আর প্রতিবেশী হিসেবে সেই কাজটাই করার চেষ্টা করছি।'
অন্যান্য প্রতিবেশীরা বললেন 'একদম ঠিক। একদম ঠিক । না হলে সব অনাচার বেড়ে যাবে।'
মীনাক্ষী কাকিমা আরো বললেন ' শোনো লাল। তোমার দাদা নীলকে সব ব্যাপারে জানিয়েছ তো ,নাকি সে ধোঁয়াশার মধ্যেই আছে?'
লাল চুপ করে রইলো।
কাকিমার এই মারমুখীমূর্তি একদিকে যেমন মরিয়া অন্যদিকে মারিয়া ও বটে -এই মহামারী রূপ রেখার চোখে প্রথম।
যেন কাকিমার মধ্যে সেই দুর্গতিনাশিনী দুর্গা মায়ের মূর্তি প্রত্যক্ষ করল।
কাকিমা তো ভালই কিন্তু কাকিমার ভেতরে প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতি ,সমানুভূতি -এটা দেখে রেখার গর্বে বুক ভরে উঠলো আর ভাবল সে এই পরিবারে মেয়ে। এঁদের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছে করলো। রেখার মনে বারবার সেই গানটি অনুরণিত হতে লাগল' দুর্গে ,দুর্গে ,দুর্গতিনাশিনী ।মহিষাসুরমর্দিনী...?'