একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা নিয়ে কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন " চলবে...
টানাপোড়েন (৫৪)
মনজানলা
বৃষ্টিটা কমাতে একটু হাঁফ ছেড়ে যেন রেখা বাঁচল। অথচ এই বৃষ্টির জন্য এক সময় আকুলি- বিকুলি করতো। এখনো মাঝে মাঝে মন আনচান করে।অনেকদিন পর গ্রামে এসে এই বৃষ্টি যেন সবকিছু মেচাকার করে দিচ্ছে। মনে পড়ে একবার বৃষ্টির সময় ঘোষদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর পাশাপাশি দুই বোনের পুজো হত মানে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পূজোর সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতীর ও বন্দনা হ'ত । ছেলে মেয়েদের ভিড় জমত। এ রকমই একবার সরস্বতী পূজার অঞ্জলি দিতে ঘোষ বাড়িতে গেছিলো রেখা।সেখানে অন্যান্য ছেলেদের মতো নীলুও গেছিল। নীলু তো যাবেই ,যেখানে রেখা গেছে।
বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎই বৃষ্টি ।বড় আমগাছটার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল দু'জনা। সেদিন যেন মনে হচ্ছিল বৃষ্টিটা না থামলেই ভালো হয়।
নীলু বলেছিল ' হ্যাঁ ,রে ।তুই তো ভিজে গেছিস? তোর ঠান্ডা লেগে যাবে। এক কাজ কর তুই আমার শার্ট টা নে।'
রেখা বলল'কেন তাহলে তো তুমি ভিজে যাবে?'
নীলু বলেছিল'আমরা পুরুষ মানুষ আমাদের ঠান্ডা সহ্য হয়। আর তোর তো আবার ঠান্ডার ধাত আছে?'
দু'দিন পরে স্কুলে যেতে পারবি না।'
রেখা বলল 'স্কুলে যেতে পারব না, তাতে তোমার কি?'
নীলু বলল ' তার মানে?'
রেখা বলল 'তার মানে আবার কি ?আমি বাড়িতে রেস্ট নেবো।'
নীলু বলল ' তোর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলো কে করবে শুনি?'
রেখা বলল 'সে তোমাকে অত ভাবতে হবে না।'
নীলু বলল 'না ,আমি ভাববো না ।তো কে ভাবতে শুনি ?আমি তোর ভালো বন্ধু হই না?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,তা ঠিকই বলেছ?
নীল বলল "আমি যেটা বলছি তোর ভালোর জন্যই বলছি। তোকে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে।'
রেখা বলল 'আর তুমি?'
নীল বলল'আমাকেও বড় হতে হবে। পড়াশোনাতে নিজেকে সব সময় নিয়োজিত করতে হবে। কিন্তু একটা সমস্যা আমার হয়?'
রীতা বলল 'কী?'
নীল বলল 'তোকে দেখার'
এমন সময় আরও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল, সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোতে রেখা ভয় পেয়ে গেল। আর ভয়েতে নীলুদাকে জড়িয়ে ধরল। নীলুও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলো।
নীলু বলেছিল' ননী তুই ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাস না ।আমি আছি তো?
রেখা ও যেন পরম একটা আশ্রয় পেয়েছিল নীলুর বুকে।
একটু যখন বৃষ্টি কমতে শুরু করল ।তখন নীলু বলল 'চল বাড়ি চল।'
রেখা বলল 'আজকে বাড়িতে গেলে মা বকবে?'
নীলু বলল ' কেন রে?'
রেখা বলল 'অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তো?'
নীলু বলল 'বকবে না ছাই, আমি যাবো তোর সাথে কাকিমাকে গিয়ে ...।'রেখা নীলুর কথা শেষ করতে না
দিয়েই বলল ' তোমার সাহস কতদূর আছে ,আমার জানা আছে ।মায়ের সামনে গিয়ে তোতলাতে থাকো।'
নীলু বলল ' হ্যাঁ রে ।কাকিমাকে দেখলে ভয় লাগে।'
রেখা বলল ' আমার মা কি বাঘ? না ভাল্লুক? যে তোমার ভয় লাগে ।খেয়ে ফেলবে?'
নীলু বললো ' না ,কাকিমার ভেতরে এমন একটা জিনিস আছে,কি আছে ,জানি না ।কাকিমার সামনে কথা বলতে সাহস হয় না। সামনে গেলেই কেমন সবকিছু গুলিয়ে যায়।'
রেখা বলল 'ওরে আমার বীরপুরুষ রে ,অনেক হয়েছে ।যাই ,আমি বাড়িতে গিয়ে বকাটা শুনি।'
নীলু বলল ' চল ,চল, চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।'
সেদিন বাড়িতে পৌঁছানোর পর রেখাকে অনেক বকুনি খেতে হয়েছে।
বাড়িতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রেখার মা বললেন 'এতক্ষণ কোথায় ছিলে?'
রেখা বলল 'ঘোষ জেঠুদের বাড়ি।'
রেখার মা বললেন 'তাহলে ভিজলে কি করে?'
রেখা বলল 'এই তো আসার সময় বৃষ্টিটা পেলাম।'
রেখার মা বললেন 'বৃষ্টির মধ্যে আসলে কেন ঘোষ দাদাদের বাড়ি থাকতে ?আমরা গিয়ে নিয়ে আসতাম।'
রেখা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।
রেখার মা আরো বললেন 'এখন বড় হচ্ছো ।যেখানে সেখানে একা একা যাবে না। দরকার হলে আমরা তোমাকে নিয়ে যাব।'
রেখার মা বললেন 'পার্বতী দি কিছু পাঠায় নি প্রসাদ?'
রেখা জানে এখানে মিথ্যে কথা বলা যাবে না ।আদতে পার্বতী জেঠিমা প্রসাদ নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন ।কিন্তু আমি ভুলে গেছি।'
রেখার মা বলল " কিরে উত্তর দিচ্ছিস না?'
রেখা বলল ' নিয়ে আসতে বলেছিলেন কিন্তু আমি তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে চলে এসেছি।'
রেখার মা বললেন ' হ্যাঁ, সে তো ঠিকই ।যেগুলো কাজের মধ্যে পড়ে ,সেগুলো তুমি ভুলে যাও। আর যেগুলো অকাজ সেগুলো করে ঘুরে বেড়াও।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,সত্যি বলছি।'
রেখার মা বললেন 'ওরে ,আমার সত্যিবাদী যুধিষ্ঠির '।
রেখা যখন রুমের দিকে যাচ্ছে তখন ওর মা বললেন 'শোন ।বলছি এবার আলপনাটা কেমন হয়েছে রে?'
রেখাও খুব গদগদ ভাবে এসে মাকে বললো' খুব সুন্দর হয়েছে মা।'
রেখার মা বললেন 'প্রায় ২০০ বছরের পুরানো পুজো,।দুর্গাপূজা যেমন হয় তেমনি আবার এই দুই বোনের পুজো হয় সাড়ম্বরের সাথে।'
রেখা বলল' ও মা দুটো ঘট বাঁধা হয় কেন?'
রেখার মা বলল ' দুটো পুজো ,তো দুটো ঘট হবে না?'
রেখার মা বললেন 'ভোগ খেয়েছিস তো?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ মা।'
রেখার মা বলল 'কি কি ভোগ দিয়েছেন রে?'
রেখা বললো ' ওই তো মা ।প্রতিবার যা দেয়া হয় ফলমূল ,লুচি ,সুজি সবকিছুই।'
রেখার মা বলল 'হ্যাঁ রে। বিদেশ থেকে ঝুমুরা এসেছে?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ।মনে হয় ।প্রচুর লোকজন তো?'
রেখার মা বলল ' 'ঠিক আছে। যাও গিয়ে আগে চেঞ্জ করো।
ঠান্ডা লেগে যাবে।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ মা।'
আজ সবই স্মৃতি।
আবার সেই ছাদে উঠে চারিদিকটা দেখতে লাগলো ।ওই তো আমবাগান দেখা যাচ্ছে।
রেখা ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে গ্রামটা একটু দেখে নিচ্ছে। এমন সময় কাকিমা এসে বললেন
''কি করছিস ননী?'
রেখা বলল 'আচ্ছা কাকিমা। ঘোষজেঠুদের আগের মতো সাড়ম্বরে পূজা হয় ,ওই দুই বোনের পুজো'?
কাকিমা বললেন 'আগের মত আশেপাশের গ্রামের মানুষদের আর সেরকম নেমন্তন্ন করা হয় না ,আর্থিক অসঙ্গতির জন্য।'
রেখা বলল 'ও তাই বুঝি?'
কাকিমা বললেন 'আগে যে খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ানো হতো এখন সেটা দাঁড়িয়েছে শুধু প্রসাদ বিতরণে।'
রেখা বলল 'আচ্ছা কাকিমা এখনো কি গো জেঠুদের সেই পুকুরেই প্রতিমা বিসর্জন হয়?'
কাকিমা বললেন ' তোর সব মনে আছে? হ্যাঁ এখনো সেই পুকুরেই হয়।'
কাকিমা বললেন 'চল ,চল, ননী ।খেয়ে নিবি।
বিকেলে তো বেরোবো তোকে নিয়ে?'
রেখা বেরোনোর আনন্দে বললো 'চলো ,চলো 'কাকিমা।
রেখার মন এখন শ্রাবণ মাসের ভরা নদী ।টুইটুম্বুর করছে স্মৃতির ভান্ডার। মন জানলায় বারবার উঁকি দিচ্ছে।
তাই পুরনো স্মৃতিকে আরেকবার ঝালাই করে নিতে চাইছে।
রেখা বলল 'কাকিমা বুলু জেঠিমার আর খবর পেলে।'
কাকিমা বললেন 'না রে , ভোলা এসে তো কিছু খবর দেয় নি।,'
রেখা বলল' ও'।
কাকিমা বললেন'বেশ ,চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো।'
রেখা বলল ' আচ্ছা কাকিমা ,নীলুদা কি একদমই আসে না?'
কাকিমা বললেন "এখন কেন আসে না সেটাই বুঝতে পারি না। ওদের কিছু একটা হয়েছে ভাইয়ে-ভাইয়ের।'
কাকিমা কথাটা বলেই নিচে চলে গেল খাবার বাড়তে সঙ্গে রেখা কেউ বলে গেল তাড়াতাড়ি নামতে।
রেখা শুধু মনে মনে ভাবছে আর কি কোনদিনই নীলু দার সঙ্গে দেখা হবে না?
রেখার আরো ভাবছে 'নীলুদার সেই কথাগুলো কোথায় গেল? একবারও কি আমার কথা মনে পড়ে? নাকি বিদেশে গিয়ে মেমসাহেব দেখে সবকিছুই ভুলে গেছে। অথচ রেখা কেন ভুলতে পারে না। রেখার আজ যেন 'পল পল দিল কে পাস তুম রেহতি হো', আঁচড় কাটছে হৃদয়ের ক্যানভাসে।