উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৫৩
অনুভবে কাছাকাছি
মমতা রায় চৌধুরী
২৯.৩.২২ রাত্রি ২২.৩৯
মনোজ রেখাকে নিয়ে দ্রুত গাড়ি ছুটিয়ে চলেছে কখনো ভালো ,কখনো খারাপ রাস্তা দিয়ে। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। মনোজ বললো, 'তুমি ভালো করে আমাকে ধরে থেকো ,আমি কিন্তু স্পিডে গাড়ি চালাব।'
রেখা ভাবলো' আজ কি সুন্দর দুজনে একসঙ্গে এটা অনুভব করতেই একটা আলাদা শিহরণ জেগে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে।'
এক সময় গাড়ি ব্যস্ত রাস্তায় এসে পড়ে রাস্তার গাড়ি চলাচলের আওয়াজ, গাড়ির হর্ন লোকজনের কোলাহল সবের মধ্যে এসে পড়ে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে আকাশে চাপ চাপ কালো মেঘ দেখে যেন মনে হচ্ছে , সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মনোজ বলল 'বৃষ্টি হবে কিনা কে জানে?'
রেখা বলল 'তাই তো এখনো তো পৌঁছাতে সময় লাগবে।'
"আমি টানার চেষ্টা করছি।'
'না না তাই বলে অত দ্রুত গাড়ি না চালানোই ভালো।,'
মনোজ বলল" রায়দার হোটেলে 'দাঁড়াবো?
রেখা বলল' কেন?'
'চা টা, স্ন্যাক্স খেয়ে নাও।'
'তা মন্দ হয় না ।চায়ের নেশা চেপেছে।'কিন্তু..?
মনোজ বললো' আবার কিন্তু কিসের?'
রেখা বলল 'বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।'
'চা খেতে আর কত সময় লাগবে ? চলো তো।'
'ঠিক আছে চলো।'
মনোজ বলল 'চা না খেয়ে কফি খাই'
রেখা সম্মতি জানালো।
মনোজ কফি অর্ডার করল সঙ্গে পনির পকোড়া আর স্যাকা পাপড় ।
রেখা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল'রায়দার হোটেলে চা টা কিন্তু দারুন।'
মনোজ হেসে বলল' দারুন তাই না? আর তুমি বলছিলে থাক খেতে হবে না।'
'হ্যাঁ বলেছি , দেখো পনির পকোড়াটাও কি ভালো বানিয়েছে গো?'
'রাত্রি-এর জন্য কিছু নিয়ে যাব কি?'
'কি নেবে বল তো?'
'কালকে তো আবার রিম্পাদিদের ওখানে যেতে হবে। সংবর্ধনা আছে?'
'তাহলে তুমি কালকে স্কুলে যেতে পারছ না?'
'কি করি বলতো?'
'না, না ছুটি নিয়ে নাও। উনারা আয়োজন করেছেন এটা তো তোমার একটা সম্মান প্রাপ্তি না?'
'আমিও সেটাই ভাবছি।'
'ওই জন্যই বলছি খাবারটা নিয়ে যাই ।ফ্রিজে রেখে দেবে। কালকে ওটাই গরম করে খেয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। আর এত রাত্তিরে ফিরে তোমার আর কালকে সকালে উঠে রান্না করার সেই ধৈর্য থাকবে?'
' তা অবশ্য ঠিকই বলেছ? এমনিতেও খুব টায়ার্ড লাগছে।'
'মিলিদের রান্নাটা মাসিকে বললেই করে নেবে।'
'একদমই তাই। কিন্তু কি নেবে বলো তো?'
'ঠিক আছে তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও আমি যা ভালো বুঝছি সেটা নিচ্ছি।'
'ঠিক আছে তাহলে ওদের অর্ডারটা দিয়ে দিই বুঝেছ ?লেট করলে হবে না এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো নয়।'
'ওয়েটার।'
'বলুন স্যার।'
'বলছি আমাদের একটা প্যাকিং লাগবে।'
'অর্ডারটা দিন।'
রেখা বলল 'পনিরের কিছু আইটেম নাও না। 'পনিরটা ভালো লাগলো আমার।
'ঠিক আছে। ও ভাই পনির রেজালা হবে?'
'হ্যাঁ হবে।'
'পনির রেজালা প্যাক হবে আর তন্দুরি চিকেন।'
'যথারীতি টাকা পেমেন্ট করে মনোজ রেখাকে বাইকে চাপিয়ে স্টাট দিল ।দ্রুত গতিতে ছুটলো বাইক।
মনোজ গান ধরল'আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই তুমি তাই গো….।'
রেখা অনুভব করছে কতদিন পর মনোজ আবার আগের মুডে ফিরে এসেছে এক সঙ্গে কতদিন এইভাবে কাছাকাছি বসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে যাওয়া হয়নি। মাঝে যে সময়গুলো কেটেছে অনেকটা তিক্ততা, সম্পর্কের অবনতি আর আজ যেন অনেকটাই সেখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলছে । এ যেন সত্যিই মাঝে মাঝে স্বামী-স্ত্রীর একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা উচিত।
রেখা ভাবতে থাকে মাঝে মাঝে কেন এরকম হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কে জানে ?অথচ রেখা নিজের দোষটাই খুঁজে পায় না ।মাঝে মাঝে আত্মসমালোচনা করেছে নিজেকে নিয়ে কি করলে ভালো হয় কিন্তু খুঁজে পায় নি কিছু।
এসব ভাবতে ভাবতেই'গাড়ি এবার নিজের চেনা ডেরায় পৌঁছে গেল।
গাড়ি গেটের কাছে থামতেই চির পরিচিত অরোকেরিয়া গাছ আনন্দে অভিবাদন জানা'লো তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল পুরো ব্যাটেলিয়ান ।লেজ নেড়ে নেড়ে রেখা আর মনোজকে তারাও অভিবাদন জানালো। শুধু তাই নয়। সঙ্গে তারা ভালোবাসার বার্তাটা ছড়িয়ে দিচ্ছিল সারা শরীরে।
কিছুটা অভিমান ও কাজ করেছে তাদের কিন্তু সেই অভিমান বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি তাদের চির পরিচিত মালিক মালকিন কে দেখে।
ওদের চেঁচানোর আওয়াজ শুনে মাসি গেট খুলে বাইরে আসলো। রেখা তখনও ওদেরকে আদর করে যাচ্ছে। মাসি দরজাটা খুলেই এই দৃশ্য দেখে বললো 'ওই জন্যেই এত আওয়াজ করছে। এতক্ষণে বুঝলুম।'
'তোমরা এসে গেছো বৌমা?'
'ওদের খেতে দিয়েছে মাসি?'
'হ্যাঁ দিয়েছি গো।'
'তাহলে কি আমি চলে যাব?'
'তুমি চলে যাবে? যদি মনে হয় থাকতে পারো, অসুবিধে নেই মাসি।'
'না গো বউটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে একা থাকবে
তো ,চলেই যাই।'
'কিন্তু মাসি কালকেও কিন্তু তোমাকে একটু থাকতে হবে?'
'কালকে আবার কি আছে?'
'খারাপ লাগছে তোমায় বারবার বলতে ।বাড়ি ছেড়ে তোমাকে এসে থাকতে হচ্ছে।'
'আরে আমাকে তুমি এরকম ভাবো বৌমা ।আমার অসুবিধে থাকলে তো আমি বলে দেবই যে আমি আজকে পারব না ।কি করব একটু যদি কারোর উপকার হয়।'
'কালকে আমার একটা সংবর্ধনার অনুষ্ঠান আছে ওখানে যেতে হবে । আজকেই খবরটা পেলাম।'
'ঠিক আছে তাই হবে।'
'তবে তুমি চলে যাবার আগে তুমি খাবার বানিয়েছো তো তাহলে নিয়ে যাও খাবার।'
'ঠিক আছে।'
রেখা একগাল হেসে মাসিকে বিদায় জানাল।
রেখা মাসি কে বলল 'কালকে এসে কিন্তু মিলিদের খাবার বানাবে তুমি। আর নিজের খাবারটাও।'
'মাসি মাথা নেড়ে চলে গেল।'
এবার মনোজ কলাপ সিপ ল গেট লাগিয়ে
দিল ।দরজা বন্ধ করল । তারপর হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসলো ', আজ অনেকটা জার্নি হল গো।'
'হ্যাঁ তোমার খুব কষ্ট হল।'
', তা ঠিক। তবে ভালোও লেগেছে।'
কথাটা বলেই রেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো মুচকি মুচকি হেসে।।
রেখা বলল তুমি হাসছো কেন এরকম?
এমনি?
'তুমি এমনি হাসার মানুষ, পাগল তো নও?'
'আজ আমরা দুজনে অনুভবে কাছাকাছি, পাশাপাশি ,মনে মনে টানাটানি।'
'আচ্ছা নাও উঠো ,ফ্রেশ হয়ে নাও ।তারপর খাবার খেয়ে একেবারে ঘুম দেব।:
'তুমি আগে ফ্রেশ হও।'
'হ্যাঁ আমি আগে যাচ্ছি তোমাকে বলে গেলাম। তোমার তো আবার বসে বসেও ঘুম হয়।'
রেখা কথাগুলো বলে দিয়েই বাথরুমে চলে গেল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে রেখা বলতে লাগলো 'তোমার জন্য দুটো রুটি করব, না তিনটে,?'
কোন উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করে
'কি গো কথা বলছো না?'
সাড়া না পেয়ে রেখা কাছে এসে দেখে মনোজ
ভোস ভোস করে নাক ডাকছে।
রেখা কাছে এসে বলল 'এই তো তোমার ঘুম?'
মনোজ বললো কোথায় ঘুমিয়েছি,। ।তুমি শুধু আমাকে ঘুমোতেই দেখো।'
'বেশ তুমি ঘুমোচ্ছ না ।এবার তুমি ফ্রেশ হও গিয়ে খাবার দেবো।'
মনোজ আরমোরা কেটে বললো 'হ্যাঁ যাই।'
রেখা এর মধ্যে দুটো রুটি করে ফেলল।
তারপর ফয়েলের প্যাকেট খুলতে যাবে তখন মনোজকে বলল 'এখন কি খাবে ?পনির খাবে ,না চিকেন খাবে?'
মনোজ বাথরুমে গান ধরেছে' সখি ভাবনা কাহারে বলে সখি যাতনা কাহারে বলে, তোমরা যে বলো দিবস রজনী..।'
রেখা তখন দরজার কাছে গিয়ে নক করে বলল "কি গো শুনতে পাচ্ছ?'
মনোজ বললো 'কি?'
"আজ চিকেন খাবে ,না পনির?'
মনোজ বললো 'পনির ,পনির।'
"নাও তাড়াতাড়ি বের হও আর গান করতে হবে না'।
রেখার কথাটা শেষ না হতেই মনোজ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।'
মনোজ বলল'তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো? যাও গিয়ে তাড়াতাড়ি খাবারটা বার করো.।'
'হ্যাঁ যাই।'
মনোজের খাবারটা দিয়ে রেখা খেতে বসতে যাবে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।
রেখা বলল 'দেখলে একটু শান্তিতে বসার উপায় নেই।'
মনোজ বললো ' যাও আগে ফোনটা ধরে নাও না হলে বেজেই যাবে।'
'ঠিক বলেছ।'
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল' হ্যালো।'
'বলছি ম্যাডাম। বসন্তের সংখ্যাতে আপনার কবিতা বেরিয়েছে।খুব সাড়া পাচ্ছি।'
রেখা বলল'অসংখ্য ধন্যবাদ।'
"আর বলছি ম্যাডাম আজকের লেখাটা কি পাবো?"
"চেষ্টা করছি?"
"Ok ম্যাম।'
রেখা এটা জানতো যে আজকেও লেখা পাঠাতে হবে তাই গতকালকেই লেখাটা লিখে রেখেছে।
ফোনটা রেখে রেখা খেতে বসতে যাচ্ছে ঠিক তখনই আবার ফোনের আর্ত না দ।
মনোজ বলল' এত রাত্রে আবার কে ফোন করলো দেখো'।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
হ্যাঁ রে ফিরেছিস?'
'ও রিম্পাদি হ্যাঁ ফিরেছি।'
'অনেক রাত হলো বেশি কথা বলবো না কালকে কিন্তু আসছিস? আর শোন আমার এখানে খাওয়া দাওয়া করবি?'
'আবার কেন তোমার ওখানে ঝামেলা করবো বলো তো,?'
'ঝামেলা কিসের রে ?আমি যা বললাম সেটা শুনবি। ঠিক আছে রাখছি।'
মনোজ বললো 'ভালই তো হলো।'
রেখা বলল' ভালো তো হলোই।' কিন্তু ওদিকে কাকিমা কাকুকে তো খবর দেয়া হলো না একবার ফোন করবে?'
'এত রাত্রে?'
'হোক রাত নাহলে চিন্তা করবে করে দাও।'
'ওকে।'
ঘরে ঢুকে রেখা মোটামুটি কালকে কি বলবে একটা খসড়া লিখে ফেলল।'
মনোজ লেখার উপর চকিতে শেষবারের মতো একটা সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। যেন মনে হলো ইর্ষুক নজর কেড়েছে আজ রেখার সৌভাগ্যফলক।