ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৯)
শামীমা আহমেদ
শায়লাদের বাসার অতিথিরা রাহাতের এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে আসার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে । শায়লা মায়ের পাশে একেবারে নীরব হয়ে বসে আছে । চারদিকে সকলের সব আয়োজন যেন হঠাৎ করে থমকে গেলো ! রাহাত ও বুবলী ঘরে ঢোকা মাত্রই সবাই তাদের ছেঁকে ধরলো। সবাই প্রকৃত অবস্থাটা রাহাতের মুখ থেকে জানতে চাচ্ছে। একের পর এক প্রশ্নে রাহাত জর্জরিত হলো।যার সারমর্মে একটা কথাই দাঁড়ায়।জামাইকি অন্য কোনদিন আসবে না একেবারে আসবেই না ? সবার প্রশ্নের মুখে রাহাত একেবারে নিরুত্তর হয়ে রইল।
শায়লা আপুকে সে কিভাবে মুখ দেখাবে এই ভেবে ভেতরে ভেতরে সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। শায়লার মনে চাওয়ার বিরুদ্ধে এতদিন রাহাত সব করছিলো।
রাহাত সবাইকে শান্ত করতে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলো।রাহাতের পাশে বুবলীও বসলো। মুরব্বিরা রাহাতকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলো। কেমন করে কি হলো সবাই তা জানতে চাইছে।রাহাত সবাইকে বিনীতভাবে সব উত্তর দিচ্ছে। সবাই কোন আশার কথা শুনতে চাইছে।আজ না হয় অন্য কোন দিন অন্য কোন তারিখে আসার সম্ভাবনা আছে কিনা ? রাহাত তেমন কিছুই বলতে পারলো না। এরপর সবাই এই বিয়ের উদ্যোক্তা রুহি খালাকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। কানাডায় ফোন করে রুহি খালা যেন নোমান সাহেবের সাথে কথা বলে সব জেনে নেয়,কেউ কেউ তেমন পরামর্শ দিচ্ছে। এর মাঝে কেউ একজন বলে উঠলো, রুহি খালা বেশ কয়েকবার কানাডায় ফোন করেছে কিন্তু নোমান সাহেব কল রিসিভ করেননি। এমন কথায় আত্মীয়স্বজনেরা আর কোন আশাই দেখতে পেলো না।সবাই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। রাহাত কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এত বিশাল আয়োজন নিমেষেই মিথ্যে হয়ে গেলো ! এমন লজ্জা আর অপমান নিয়ে আত্মীয়দের কাছে তার ছোট হতে হলো। রাহাতের মোবাইলে একে একে নানানদিক থেকে ফোন আসতে লাগলো।ডেকোরেটরের লোক,ছাদে স্টেজ সাজানো, বাসর ঘর সাজানো, রাতে বেলা সারাবাড়ি লাইটিং করা। যদিও বাড়ির মেইন গেট জামাইয়ের প্রবেশের জন্য গতকালই সাজানো হয়েছে। আশেপাশে প্রতিবেশী, পথচারীরা জেনে গেছে আজ এই বাড়িতে একটা বিয়ের আয়োজন আছে। সকলেই উৎসুক হয়ে বাড়ির ভেতরে তাকিয়েছে । কিন্তু এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় সবই অর্থহীন হয়ে গেলো। গত কয়েকদিনে নোমান সাহেবের সাথে রাহাতের কয়েকবার কথা হয়েছে। সবসময়ই তিনি দেশে আসার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। ফ্লাইট নম্বর,সময়, সব জানিয়েছে। কিন্তু আজ কেন এলোনা রাহাতের কাছে তা স্পষ্ট নয়। এমন সাজানো বিয়ের গেট দিয়ে এখন আত্মীয়স্বজনেতা বেরিয়ে গেলে পাড়ার লোকজন হাসাহাসি করবে। চিরকাল মানুষ আঙুল তুলে বলবে, এই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে। জামাই বিদেশে থেকে আসেনি। মেয়েটাকে ধোঁকা দিয়েছে । উফ! রাহাত আর কিছু ভাবতে পারছে না। পরক্ষণেই রাহাত ভাবলো, না,এ হতে দেয়া যাবে না।আর এতে মা ভীষণ আহত হবেন।এত বড় শোক মা সইতে পারবে না। এমনিতেই আপু আর শিহাব ভাইয়াকে নিয়ে নানান ঝামেলা সয়েছে।এখন এই বয়সে এত বড় ধাক্কা মা নিতে পারবে না। রাহাত ভাবলো,এখন শায়লা আপুই একমাত্র ভরসা যদি সে সবকিছুকে সহজভাবে নিতে পারে। তাহলে আত্মীয়স্বজনকে এখন যেতে দেয়া যাবে না। রাহাত মনের ভেতরে আশার দীপ জ্বালিয়ে রাখলো। যদিই হঠাৎ করে নোমান সাহেব আসার কোন তারিখ জানায় ! সে ভাবলো, আর চারপাশের মানুষকে সব কিছু স্বাভাবিক বুঝাতে বাড়িতে বিয়ের সকল প্রস্তুতি চালু রাখবে। আত্মীয়দের এভাবে খালিমুখে যেতে দেয়া যাবে না। রাহাত বাড়ি লাইটিং,রান্নার ডেকোরেটর, ছাদের স্টেজ সাজানো, শায়লার ফুলের গহনা, বাসর ঘর সাজানোর জন্য সব লোকদের কল করে তারা যেন এসে কাজ শুরু করে তা জানিয়ে দিলেন।অতিথিরা রাহাতের কর্মকান্ডে বেশ অবাক হলো ! রাহাত সবার উদ্দেশ্য জানিয়ে দিলেন কেউ বিয়ে বাড়ি থেকে খালিমুখে যাবেন না। বিয়ের রান্না হবে,বাড়ি লাইটিং হবে, স্টেজ হবে, আপনারা সবাই থাকুন।কেউ যাবেন না।
রাহাতের এমন সিদ্ধান্তে বুবলী ভীষণ অবাক হয়ে গেলো ! সে রাহাতের কথাগুলোকে পাগলের প্রলাপ ধরে নিলো। সবকিছু শুনে বুবলীর হঠাৎ শায়লার কথা মনে পড়তেই সে দ্রুত শায়লার কাছে গেলো।শায়লা মায়ের পাশে বসে জানালায় উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুবলী শায়লার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শায়লা তার দিকে তাকালো। বুবলী ভীষণ চমকে গেলো ! শায়লার চোখ দুটো জলে ভরে ছলছল করছে।মূহুর্তেই শায়লা বুবলীর বুকে মুখ লুকিয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো।বুবলী বুঝতে পারছে না এ কান্না কি নোমান ভাইয়া না আসাতে অপমানে নাকি শিহাব ভাইয়াকে না পাওয়ার বেদনাতে। বুবলী শায়লাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে। বুবলীর সব রাগ গিয়ে পড়ছে রাহাতের উপর।অল্প থাকতেই এই সমস্যাটার সমাধান করা উচিত ছিল। দুইটি অতৃপ্ত হৃদয় দুই দিকে কেঁদে যাচ্ছে আরেকদিকে একজন অচেনা মানুষের কাছে শায়লা আপু অপমানিত হচ্ছে। বুবলী ভাবছে, শায়লা আপু যদি আগে থেকে তাকে কিছু জানাতো তবে সে রাহাতকে এ ব্যাপারে চাপ দিয়ে আদায় করে নিতো। তবে কি এখন সে শিহাব ভাইয়ার সাথে কথা বলবে ?
বুবলী শায়লাকে কথাটা বলতেই শায়লা তাতে অসম্মতি প্রকাশ করলো। আজ নোমান সাহেব আসেনি বলে তোমরা শিহাবের খোঁজ করছো ? কিন্তু কেন ? শিহাবের কী কোন আত্মসম্মান নেই।তোমরা নোমান সাহেবের এমন আচরণের বদলে শিহাবকে ভাবছো? ছিঃ বুবলী কেমন করে এ কথা আমি শিহাবকে জানাবো ? সারাজীবন এই কথা আমার শুনতে হবে। আমি তো শুধুই ভালোবেসে শিহাবকে পেতে চেয়েছি,কারো আসবার বা না আসবার বদলে নয়। বুবলী শায়লার কথার সবটাই বুঝতে পারলো আর শিহাবের প্রতি শায়লার ভালোবাসার গভীরতাটা টের পেলো। বিছানায় শুয়ে মা শায়লা আর বুবলীর সব কথাই শুনলো।নির্বাক মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কেন বারবার আমার এই মেয়েটা কেবল কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে ? যেন বিধাতার কাছে মায়ের নিঃশব্দে জানতে চাওয়া।
শায়লা তার নিয়তির বারবার এই খেলায় আজ নালিশ জানাতেও ভুলে গেছে।সেতো নোমান সাহেবের স্ত্রী হয়েই তার সামনে যেতে চেয়েছিল যদিও তার মন পুরোটায় শিহাবের কাছে সঁপে দেয়া ছিল। হয়তো নোমান সাহেবের কাছে সে সব খুলে বলতো।
বুবলী ও শায়লাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে শায়লার মোবাইল বেজে উঠলো ! দুজনেরই চোখ গেলো মোবাইল স্ক্রিনে। অত্যাশ্চর্য একটা কিছু ঘটে গেছে এমন অভিব্যক্তিতে দুজন ভাষা হারিয়ে ফেললো। শায়লার মোবাইল স্ক্রিনে ইংরেজিতে ভেসে উঠেছে মিঃ নোমান এর নাম! বুবলী শায়লাকে কলটি ধরার জন্য তাড়া দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শায়লা তাতে অনীহা দেখাচ্ছে। বুবলী তাকে বারবার বুঝাতে চাচ্ছে কলটা ধরা জরুরি। নিশ্চয়ই উনি কিছু বলতে চাইছেন। শায়লা কলটি ধরে, হ্যালো বলেই তা জোরপূর্বক বুবলীর হাতে গুঁজে দিলো। শায়লার একেবারেই কথা বলার ইচ্ছে নেই যেন ! ওপ্রান্তে নোমান সাহেব শায়লা শায়লা করেই যাচ্ছে। শায়লার কন্ঠে হ্যালো শুনে আশ্বস্ত হলেও মোবাইল এখন বুবলীর কানে লেগে আছে। নোমান সাহেব ওপ্রান্তে শায়লার কাছে শুধু সরি সরি বলে যাচ্ছে। শায়লা তোমাকে আমার অনেককিছু বলার আছে। আমি কেন আসিনি তা তোমাকে জানাতে চাই।যদিও রুহি চাচী আমায় অনেক কল দিয়েছেন তবুও আমি কল ধরিনি, তাকে কিছু বলিনি।আমি তোমাকে সব কিছু খুলে বলতে চাই, শায়লা।
এ প্রান্তে বুবলী একেবারে চুপ।করে নোমান সাহেবের সব কথা শুনে যাচ্ছে। যা কানাডায় বসে নোমান সাহেব একেবারেই বুঝতে পারছে না।
শায়লা তোমাকে আমার সব কথা বলা হয়নি। এটা অবশ্য আমারই দোষ। আমি বলিনি তুমিও কিছু জানতে চাওনি আমার সম্পর্কে। বরাবরই তুমি আমার সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। কেন এমন ছিলে তা আমি বুঝতে পারিনি।
শায়লা আজ কি আমি তোমাকে আমার সবকিছু জানাতে পারি ? যদিও আমি দেশে না আসাতে তোমরা আমার প্রতি ভীষণ রেগে আছো। বাট আই এম আনডান। প্লিজ ফরগিভ মি।
গতকাল সকালে সাডেনলি আমার দুই বাচ্চার মা আমার এক্স ওয়াইফ পামেলা তার সন্তানদের কাছে ফিরে এসেছে। তার ভুলের জন্য অনেক কান্না করেছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তার বয় ফ্রেন্ড তার সাথে চিট করেছে । সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে ।সে আমার কাছে আবার ফিরে এসেছে । শায়লা তুমি বিলিভ করবে না বাচ্চাদুটো ওদের মাকে ফিরে পেয়ে কতটা আনন্দিত! ওরা ওদের মাকে এক ঘন্টা শুধু চুমুই দিয়েছে।মাকে আঁকড়ে ধরেছে।পামেলাও অঝোর ধারায় কেঁদেছে।মা সন্তানের এই বন্ধনতো আমি ভাঙতে পারি না। ওরা আবার মায়ের বুক ফিরে পাক এটাই আমার চাওয়া।যদিও এতে তোমাকে অনেক কষ্ট দেয়া হয়। কিন্তু সন্তান পিতামাতাহারা হলে কতটা কষ্টে তাদের জীবন কাটায় তা আমি জানি। তুমি আমার সবটা জানো না।আমি সেই তিন বছর বয়সে বাবা মাকে হারিয়েছি।এরপর তোমার রুহি খালার হাজবেন্ড আমার দূর সম্পর্কের চাচা তার কাছে কিছু দিন থাকি।এরপর একটি এনজিওর মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি আমাকে দত্তক নেয়। বুবলী সব শুনছে আর সে অবিরল ধারায় কেঁদেই যাচ্ছে।ওপ্রান্তে নোমান সাহেব বলেই যাচ্ছেন।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল এবার তোমার কাছে এসে নিজের সবটা খুলে জানাবো। তোমরা বাঙালি মেয়েরা স্বামী সন্তান সংসারের জন্য নিজেদের জীবনে সব কিছু ছাড়তে পারো। তোমার মাঝে সেই রূপটি আমি দেখেছি কিন্তু আজ যখন পামেলা তার সন্তানদের কাছে ফিরে এলো আমি দেখলাম সব মায়েদের একই রূপ। শায়লা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি বাঙালি লাইফ স্টাইল নিজের মাঝে নিতে পারিনি। অনেক ছোট বেলায় এই দেশের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। তবে তোমাকে দেখে আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সবটা জানবো।আমার সন্তানদের মা নীল নয়না আর গোল্ডের কার্লি হেয়ারের পামেলা একজন আমেরিকান মেয়ে। ও কাজের জন্য কানাডায় আসে। খুব অল্প দিনের পরিচয়ে আমরা বিয়ে করি। আমি তার নীল চোখের প্রেমে পড়ে যাই, তাকে খুব ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু ওরা তোমাদের বাঙালি মেয়েদের মত নয়। ওরা একজনের সাথে প্রয়োজন ফুরালে আরেকজন নতুন বয় ফ্রেন্ডের সাথে চলে যায়। কিন্তু আজ যখন সে ফিরে এসেছে আমি নিশ্চিত সে আর কোনদিন আমায় ফেলে যাবে না। শায়লা তুমি আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমার জীবনের অনেক সুন্দর সময়কে নষ্ট করেছি।
আজ আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। তোমার উপর আমার সব অধিকার তুলে নিলাম। সুন্দর মনের কাউকে পেলে তাকে বিয়ে করে নিও।নিশ্চয়ই সেও তোমাকে অনেক অনেক ভালবাসবে।
বুবলী নীরব শ্রোতা হয়ে সবকিছু শুনছিল। ওপ্রান্ত থেকে কল কেটে যাওয়ায় বুবলী মোবাইল নামিয়ে রাখলো। নোমান সাহেবের শেষ কথাগুলোতে বুবলী ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে গেলো। তবে পরক্ষণেই তার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেলো ! শায়লা কিছুই বুঝতে পারছে না নোমান সাহেব কী এমন বললো যে বুবলী খুশিতে ডগমগ হয়ে রাহাতের কাছে ছুটলো !
রাহাত ভাইয়া এক্ষুনি শিহাব ভাইয়ার সাথে শায়লা আপুর বিয়ের ব্যবস্থা করো। নোমান সাহেব আর দেশে আসবেন না।
রাহাত সবকিছু শুনে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে রইল। বুবলীর কাছে সবটা শুনে সে একে একে ডেকোরেটর,লাইটিং, স্টেজ সাজানো আর বাসর ঘর সাজানোর লোকজনকে কল করতে লাগলো! আনন্দ উচ্ছাসে রাহাত হতবিহ্বল হয়ে গেলো!
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much