ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯০)
শামীমা আহমেদ
শিহাব হাসপাতালের নীচ থেকে এসে তিনতলায় আরাফের কেবিনের সামনের সোফায় বসে রইল।সারাদিনের ছুটোছুটিতে তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে । মনের ভেতর শায়লাকে নিয়ে চলমান অস্বস্তি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সাথে ছোট্ট আরাফের এমন অবস্থায় শিহাব ভীষণ চিন্তিত হয়ে যাচ্ছে। এখন আরাফ ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু যখন জাগবে তখন তাকে শান্ত রাখতে হবে। শিহাবের আরাফকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভেতরে রুবিনা আছে। শিহাব নিজেকে ভেতরে যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করলো। রুবিনা শিহাবকে চাইলেও শিহাবের এতে কিছু করার নেই। যদিও রুবিনার সাথে দেখা হওয়ার অনেক পরে শায়লার পরিচয়।কিন্তু একটু একটু করে শায়লা যেন কিভাবে শিহাবের মনে জায়গা করে নিলো। যদি রুবিনা এভাবে তার মনে জায়গা করে নিতো তবে হয়তো রুবিনাই আজ সবচেয়ে কাছের মানুষ হতো। অবশ্য সেটা সম্ভব নয়।রুবিনাদের আর্থিক অবস্থান অনেক উপরে। রুবিনার বাবা একজন শিল্পপতি। তাদের সাথে মধ্যবিত্ত শিহাবের কোনদিনই মানায় না। যদিও কিছুদিন প্রায়ই রুবিনা শিহাবকে কল করত্য, কথা বলতে চাইতো। কিন্তু শিহাব কখনোই তা গ্রহন করেনি। আজ রুবিনার জীবনে এমনটা ঘটে যাওয়াতে এতটা কাছে আসতে চাইছে। তবে মেয়েটি যে আরাফকে অনেক ভালোবাসে সেটা স্পষ্ট। আরাফকে খুব করে জড়িয়ে ধরে রাখছিল। যদিও তার চোখের ভাষায় শিহাবের থেকে কিছু শুনতে চাইছিল। দূর্ভাগ্যের স্বীকার মেয়েটি শিহাবকে আপন করে পেতে চাইছে। যদিও তার বসবা ইচ্ছে করলে মধ্যবিত্ত পরিবারের যেকোন ছেলেকে কিনে নিতে পারে।শিহাব সোফায় বসে আছে।হাসপাতালের নার্স আর অন্য কেবিনের মানুষের চলাচলে শিহাবের প্রতি সবারই দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিল।শিহাবকে দেখার জন্য অকারণেই তাদের চলাচল বেড়ে গেছে। শিহাব তা বুঝতে পেরে সানগ্লাস পরে বসে রইল শিহাবের এই এক সমস্যা কোথাও একা স্থির হয়ে থাকা মানেই মানুষের নজরে পড়া।বিশেষ করে মহিলাদের ঘুরাঘুরি বেড়ে যায়। শিহাব চুপচাপ বসে রইল। তবে তা আর সম্ভব না হওয়াতে হাতে মোবাইল নিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া চলছিল। শায়লার খবর জানা হচ্ছে না অনেকক্ষন। শিহাবের ইচ্ছে করছিল শায়লাকে একটা মেসেজ পাঠাতে। কিন্তু শায়লা এখন কি অবস্থায় আছে।বাড়িতে লোকজন। বিদেশি মেহমান চলে এসেছে।নিশ্চয়ই সবাই খুব দ্রুতই চাইবে শায়লা যেন তার স্বামীর কাছে যায়।তারা দুজনে একান্তে সময় কাটাক।না, শিহাব আর ভাবতে পারছে না। এতটা কাছে এসেও দুজন আজ কতটা দূরত্বে চলে যাচ্ছে। তার জীবনে বারবার কেন এমন হচ্ছে ? কত মেয়েরাই তো তাকে ভালোবাসতে চেয়েছে, কাছে পেতে চেয়েছে সেতো কখনো তাদের চাওয়া নিয়ে মিথ্যে কোন আশ্বাস বা আনন্দ ফূর্তি করে বেড়ায়নি। সে সবসময়ই মেয়েদের সম্মানের চোখে দেখেছে। মোবাইলে হঠাৎ কল এলো। অফিস এসিস্ট্যান্ট কবিরের ফোন। শিহাব রিসিভ করতে জানালো সোবহান আর মামুন সাহেব চেক বুঝে নিয়েছেন।তারা আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাইছেন। শিহাব কবিরকে বললো সোবহান সাহেবকে ফোন দিতে। সোবহান সাহেব ভীষণ কৃতজ্ঞচিত্তে শিহাব সাহেবকে ধন্যবাদ জানালো। শিহাবের সাথে একসাথে পরবর্তীতে আরো কাজ করবার ইচ্ছা জানালো। শিহাব জানালো, তার কোম্পানির একটা গুড উইল আছে। আমরা লেনদেন এর ব্যাপারে ভীষণ পরিষ্কার। কোন ঘুটচাল আমাদের নেই। মানুষকে ঘুরানো আমাদের প্রিন্সিপাল এ নেই। সোবাহান সাহেব ভীষণভাবে বিনীত হয়ে গেলো শিহাবের প্রতি। শিহাব কথা সংক্ষিপ্ত করে তাদের বিদায় জানালো। শিহাবের কিছুই ভালো লাগছে না। কখন আরাফ জাগবে। আরাফ তাকে বাবা বলে ডাকবে। কতদিন হলো ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করা হয় না। ছোট্ট ছেলেটা মায়ের আদর পায়না। শিহাবের মনটা ব্যথায় ভরে উঠলো। শিহাবের ইচ্ছে ছিল শায়লাকে সে আরাফের মা করে আনবে। শায়লা আরাফকে খুবই আপন করে নিয়েছিল। আজ সবই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। শিহাবের মন রাহাতের প্রতি অভিমানে ভরে উঠলো। রাহাতের প্রতি সে অনেক ভরসা রেখেছিল।রাহাত তাকে কথা দিয়েছিল শায়লা যেন তার সাথে একসাথে জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু রাহাত মাঝপথে এসে নিজেকে বদলে ফেলে। রাহাত এমনটি করবে জানলে সে রাহাতের অপেক্ষায় থাকতো না। শায়লা আর তার চাওয়া তাদের কোনদিন আলাদা করতে পারতো না।কিন্তু রাহাত এখসবে ডাবল গেম খেলেছে।তাকে ভরসা দিয়েও শায়লাকে কানাডা পাঠানোর সব আয়োজনই করেছে। রাহাতের এমন কর্মকান্ডে শিহাবের মনটা একেবারেই ভেঙে গেছে। সে চাইলে শায়লাকে যেকোন সময়ই তার বাসায় নিয়ে যেতে পারতো। তাতে শায়লার কোন আপত্তি থাকতো না। কিন্তু শিহাব চেয়েছিল সম্মাঞ্জনকভাবে শায়লাকে তার কাছে আনা। যেন তাদের পরিবারের কোন অসম্মান না হয়। তবে আজ সকালে শিহাব রাহাতকে স্পষ্ট করেই বলে এসেছে। যদি তারা শায়লার সুখ চায় তবে যেন তাকে কানাডায় যেতে না দেয়। শিহাবের কিছুই আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চয়ই শায়লাকে এতক্ষণে তার স্বামীর সাথে কথা বলতে বাধ্য করা হয়েছে। হঠাৎ নার্স এসে জানতে চাইলো,আপনি কি কেবিন তিনশ চাররের বেবী আরাফের এটেন্ডেট ? শিহাব জানালো হ্যা।আমি আরাফের বাবা। তাহলে ভেতরে আসুন।আরাফের স্যালাইন এখন শেষ হবে। আর একটু পরেই আরাফের সেন্স ফিরে আসবে। ভেতরে রোগীর কাছে কে আছে ? ওর মা ? আপনিও ভেতরে আসুন। আরাফ জাগলে তখন মা বাবাকে দেখলে সে শান্ত থাকবে। রুবিনাকে নার্সের আরাফের মা ভাবাতে শিহাব একটু বাধা দিয়ে বলতে চাইলেও সে আবার তা ফিরিয়ে নিলো। নার্সের কাছে সবটা বলার কোন প্রয়োজন নেই। আর রুবিনা যেভাবে আরাফকে ঘিরে আছে তাতে তাকে যে কেউই আরাফের মা ভাবতে পারে। শিহাব নার্সের সাথে কেবিনের ভেতরে গেলো। নার্স আরাফের স্যালাইনের শেষটুকু পাস হওয়ার অপেক্ষায় কেবিনে দাঁড়িয়ে রইল।মমধ্যবয়সী নার্স টুকটাক প্রশ্ন করে আরাফের কিভাবে দূর্ঘটনা হলো,দূর্ঘটনার পর কি করলেন রুবিনাকে আরাফের মা ভেবে তা জানতে চাইলে শিহাব আর রুবিনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।বাবা হয়েও সে আরাফের কাছে ছিল না আর রুবিনাও কাছে থাকার প্রশ্ন আসে না।দুজনার অভিব্যক্তিকে নার্স একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো। সে সরাসরিই জানতে চাইলো, তাহলে শিশুটি কার কাছে থাকে ? তবে কি আপনারা সেপারেশনে আছেন ? মুরুব্বী গোছের মানুষের এই এক সমস্যা। তারা কিছু বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না।তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সব কিছু হিসেব করে। শিহাব আর রুবিনা এত প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর রইল। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় ট্রেতে করে দুইকাপ রঙ চা আর লেক্সাস বিস্কুটের প্যাকেট রেখে গেলো। শিহাব নার্সের উপস্থিতিতে রুবিনাকে চা অফার করতে পারছে না। নার্স হয়তো তাদের সম্পর্ক কিছুটা আঁচ করতে পারছে। তারা স্বামী স্ত্রী হলে এতটা নীরব থাকতো না। নিশ্চয়ই কথোপকথন অন্য রকম হতো। নার্স স্যালাইন শেষ করে নিডল খুলে ফেললো।জানিয়ে গেলো, আর দশ পনের মিনিটের মধ্যেই আরাফ জেগে উঠবে। আপনারা ওর কাছে থাকুন। ও জেগে মা বাবাকে কাছে চাইবে। আপনারা শিশুটির কাছ থেকে একেবারেই দূরে থাকবে না।নার্স তার দ্বায়িত্ব সেড়ে সন্দেহজনক মন নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই শিহাব রুবিনাকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো। আপনার অনেকক্ষন কিছু খাওয়া হয়নি,প্লিজ বিস্কিট দিয়ে চা খেয়ে নিন। শিহাব বেশ বিনীতভাবেই রুবিনাকে কথাগুলো বললো। শিহাব চায়ের ট্রে এগিয়ে ফিলো।রুবিনা চায়ের কাপ নিয়ে পাশে রাখলো। শিহাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে শিহাবকেও আরেক কাপ চা নিতে বলে বিস্কিটের প্যাকেট খুলে শিহাবকে বিস্কিট নিতে অনুরোধ করলো। শিহাব হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে রুবিনকে ধন্যবাদ জানালো। দুজনেই কেবিনে নিঃশব্দে চা খেতে লাগলো। ওরা আরাফের জেগে উঠার অপেক্ষায়। শিহাব ভাবলো,রুবিনা তার সন্তানের জন্য এতটা করছে তার সাথে অন্তত একটু কথা বলা উচিত। তাছাড়া উনি নাকি প্রায়ই আরাফকে সময় দেয়। শিহাবতো সেটুকুও দিতে পারে না। তাই শিহাব হালকা আলাপচারিতায় রুবিনার কুশলাদি জানতে চাইলো।রুবিনা তাতে ভীষণ আপ্লুত হয়ে গেলো। শিহাবের কথা বলায় রুবিনার মুঝের সেয় দুঃখভাবটা নিমেষেই কেটে গেলো। তার চোখে মুখে বিজলী খেলে গেলো! সে শিহাবকে জানালো, আমি ভালো আছি। যদিও তার ভালো থাকাটা একেবারেই সত্য নয়।
আপনি কেমন আছেন ? আপনিতো উত্তরায় থাকেন তাইনা ? রুবিনা ইঙ্গিতে কিছু একটা জানতে চাইলো। শিহাব কি একাই উত্তরা থাকে না সাথে অন্য কেউ থাকছে ?
শিহাব রুবিনার প্রশ্নের খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো। যেখানে হ্যা বা না কিছুই বুঝালো না।শিহাব বললো, এইতো আছি আরকি।শিহাব প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো , আপনিতো অনেকক্ষন হয় এখানে এসেছেন নিশ্চয়ই বাসার সবাই আপনাকে খোঁজ করবে।
রুবিনা খুবই বিষন্ন মুখ করে বললো, বাসায় অতি আপন বলে কেউ নেই যে আমার খোঁজ করবে। আমি আরাফের সাথেই আছি সেটা ওরা জানে। রুবিনার এমন উত্তরে শিহাবের খুবই মায়া হলো। শিহাব খেয়াল করলো, রুবিনা গোলাপী রঙের একটা শাড়ি পরেছে।যার আভা তার চোখেমুখে ছড়িয়ে গেছে।
দরজার নক করার শব্দে শিহাব উঠতেই নার্স রুমে ঢুকলো। আরাফ একটু একটু করে চোখ খুলছে। শিহাব দ্রুত আরাফের বেডের কাছে এলো। রুবিনা আরাফের দিকে আরো ঝুঁকে গেলো।যেন আরাফ চোখ মেলেই তাকে দেখতে পায়। আরাফ সম্পূর্ণ চোখ মেলে শিহাবকে দেখতে পেয়েই আব্বু বলে ডেকে উঠলো। শিহাব আরাফের হাত ধরে কপালে চুমু খেলো। রুবিনা আরাফের হাত তার গালে বুলাতে লাগলো।আরাফ এবার রুবিনার দিকে তাকিয়েই বললো, রুবি আন্টি,তুমি কখন এসেছোভ ? আমি তোমার সাথে খেলা করবো। আরাফ শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, আম্মু কোথায় আম্মু,দাদু, আরুশ ভাইয়া,,সবাই কোথায় ? নার্স ওদের পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। তার সন্দেহের মেঘ কিছুটা কাটলেও আরাফের প্রকৃত মা কে তা বুঝতে চাইছে।আরাফ তার চাচী সুমাইয়াকে মা বলে ডাকছে তাকে দ্রখতে চাইছে। শিহাব আরাফের পাশে বসে ওর মাথা নিজের বুকের কাছে টেনে নিলো।
আরাফ বলে উঠলো, বাবা আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।মা আমাকে বাসায় নিয়ে যায়নি। আমি তাই পড়ে গেলাম। আরাফ তার দূর্ঘটনার আগের সবকিছু মনে করতে পারছে দেখে নার্স নিশ্চিন্ত হলো। আর সে বুঝে গেলো কেবিনে থাকা দুজন নারী পুরুষ আসলে স্বামী স্ত্রী নয়। যেন বিরাট একটা কিছু জয় করে ফেলেছে এমন আনন্দে সে বেরিয়ে গেলো।আরাফ শুধু বলেই যাচ্ছে মা কোথায় ? মা কোথায় ?
শিহাব বাসায় খবরটি জানানোর জন্য তার মাকে কল করলো। এরপর সুমাইয়াকে কল করে আরাফ তার
মাকে অর্থাৎ সুমাইয়াকে দেখতে চাইছে জানাতেই,ওপ্রান্ত থেকে সুমাইয়া জানালো, কেন রুবিনা ওখানে আছে না ? তুমি আরাফকে বলে দাও, এখন থেকেই এই আন্টিই তোমার মা।
ভাবীর এমন দুষ্টুমি শিহাব সহজভাবে নিতে পারলো না।কিন্তু যেহেতু সে ভাবী, দেবরের সাথে একটু ফান সে করতেই পারে। শিহাব কিছুক্ষণ নীরব থেকে কল এন্ড করলো। সে মুখ ঘুরাতেই দেখলো, রুবিনা তার দিকে তাকিয়ে আছে। শিহাব আরাফের দিকে মনযোগী হয়ে তার সাথে কথা চালিয়ে গেলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much