ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮১)
শামীমা আহমেদ
রিশতিনা সারাটা সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা কাটিয়ে এখন রাত প্রায় আটটা বাজতে চললো। সে সারাদিন ঘরে একা একাই সময় কাটালো।মাঝে কাজের বুয়া এলেও খুব একটা কথা বলা হয়নি।তবে বুয়ার মনের ভেতর অনেক কথা, যা সে বলতে চায় কিন্তু রিশতিনা সেদিকে একেবারেই কোন আগ্রহ দেখায়নি। একরকম দম ফাপড় করা অবস্থায় সে কাজ সারলো।বুয়াকে বিদায় দিয়ে রিশতিনা আবার একা হয়ে গেলো।
দুপুরের দিকে ইংল্যান্ড থেকে রিশতিনার মা কল দিয়েছিল।তিনি খুব কান্নাকাটি করলেন। তিনি বলেই চললো,শিহাবের পরিবারের সাথে তোর কোনদিনই মিলবে না মা। তোর এই বিয়ে নিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা নানান কথা বলছে। রিশতিনা যেন শিহাবের কাছ থেকে চলে আসে বারংবার তিনি সে কথাই বলে যাচ্ছিল।রিশতিনা ভেবে দেখলো আজও মা শিহাবকে আপন করতে পারেনি। আজো মেয়ের মন, মেয়ের সংসার তার কাছে কোন বিবেচনায় আসে না।অথচ তারই মেয়ে শিহাবের এতটুকু মনযোগ পাওয়ার আশায় সবকিছু পিছু ফেলে এসেছে। শিহাবকে আপন করে পেতে দিনরাত কেঁদে যাচ্ছে। রিশতিনা ভাবলো পৃথিবী সৃষ্টির লগ্ন থেকেই মনে হয় এই ধনী গরীব আর ভালবাসার প্রশ্নে পিতামাতা আর সন্তানের মাঝে দ্বন্দ চলে আসছে।
রিশতিনা সারাদিন এ ঘর ওঘর বারান্দা কিচেন করে সময় কাটিয়েছে। আর এতেই যেন সে শিহাবের স্পর্শ খুঁজে নিয়েছে। শিহাবের রেখে যাওয়া ভেজা টাওয়েল,শিহাবের ছেড়ে যাওয়া পোষাক, কফি মগ,চায়ের কাপ,বিছানা, বালিশ, শিহাবের ছুঁয়ে যাওয়া বেসিনের কল,শেভিং ব্রাশ,রেজর, শিহাবের ঘুমিয়ে থাকা এলোমেলো সোফার গদি,শিহাবের এস্ট্রে,লাইটার, কয়েকটি শলাকার বেন্সনের প্যাকেট, টিভি রিমোট, দরজার হাতল, রিশতিনা সবই ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিহাবের স্পর্শ অনুভব করেছে। শিহাবের ব্যবহৃত সুগন্ধির আবেশ সারাটিদিন ঘরময় সুবাস ছড়িয়েছে। রিশতিনা যেন স্বেচ্ছায় শিহাবের ফ্ল্যাটে বন্দীত্ব বরণ করেছে। যদিও সকালের পরপর কাজিন রোমেল ভাইয়ার সাথে তার কথা হয়েছে।গতরাত থেকে ঘটে যাওয়া সব কিছু সে রোমেলকে জানিয়েছে। শিহাবের সাথে দেখা হওয়ার পর কি কথা হয়েছে বা শিহাব তাকে কিভাবে গ্রহন করেছে তার সবই জানিয়েছে। রাতে এক ডাইনিংএ খাবার খাওয়া,আলাদা রুমে ঘুমানো,অফিসে যাওয়ার আগে কি বলে গেছে রিশতিনা রোমেলকে সবই জানিয়েছে। শিহাবের খুবই কাছের বন্ধু রোমেল। রিশতিনাকে রোমেল ভাইয়ার শুধু একটাই নির্দেশনা, রিশতিনা, আমার বন্ধুটা খুবই ভালো মনের একজন মানুষ। তাকে ফিরে পেতে হলে তোমাকে আরো অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অবশ্য রিশতিনার তাতে এক বিন্দুও আপত্তি নেই। সে যে করেই হউক শিহাবের মনে আবার তার জন্য ভালবাসা জাগিয়ে তুলবে। যদিও শিহাব সারাদিন একটা ফোন কল করেও তার কোন খোঁজ নেয়নি। রিশতিনার ফোন নাম্বার আছেই কিনা সেটাও রিশতিনা নিশ্চিত নয়। সে নিজেও শিহাবকে কল করে বিরক্ত করেনি।সারাদিন গান শুনে টিভি দেখে আর নিজের সাথে আনা কিছু ফ্যাশন ম্যাগাজিন দেখে সময় কাটিয়েছে। ফ্রিজে যথেষ্ট খাবার জমা আছে।কিন্তু রিশতিনা ঐসব বাঙালি খাবারে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। সেসব রান্না করাতো দূরের কথা। সে কফি আর সাথে কুকিজ খেয়েই দুপুর পার করেছে।রাতের জন্য অনলাইনের অর্ডার করে একটা পিজা আনিয়ে রেখেছে। রাতে শিহাব ফিরলে দুজনে একসাথে খাবে।
কিন্তু শিহাব কখন ফিরবে বা সাধারণত কখন ফেরে তা কেয়ারটেকার বিল্লালের কাছে রিশতিনা জানতে চেয়েছিল।বিল্লাল ঠিক গুছিয়ে সময়টা বলতে পারেনি। তাই শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
শায়লা মায়ের স্ট্রোকের খবর জেনে কান্নায় ভেঙে পড়লো। শিহাব মেসেজ পড়ে সবটা বুঝে নিলো। দুজনার আজ রাতের সকল পরিকল্পনা ভুলে গিয়ে শিহাব শায়লাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতে চাইলো।ওরা দ্রুতই লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালো।
শিহাব বাইকে শায়লাকে নিয়ে দ্রুতই চলে এলো। শায়লাদের বাসার সামনে এম্বুলেন্স দাঁড়ানো। শায়লা অবিরল ধারায় কেঁদেই যাচ্ছে। শিহাব তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালো, আমি একটু দূরে আড়ালে বাইক নিয়ে অপেক্ষায় আছি।তুমি ভেতরে গিয়ে আমাকে ফোনে জানাবে তোমার আম্মা কেমন আছেন।কোন হসপিটালে নিতে হলে আমাকে জানাবে।যেহেতু রাহাত এখনো ফিরেনি,অবশ্যই আমাকে জানাতে দ্বিধা করবে না। শায়লা শিহাবের বাইক থেকে নেমে গেলো। সে পিছনে শিহাবের দিকে আর না তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে দৌড়ে বাসায় ঢুকে গেলো। শিহাব বাসা থেকে একটু দূরে একটা এপার্টমেন্টের পাশে বাইক নিয়ে অপেক্ষায় রইল।
দোতালার দরজা খোলাই ছিল। শায়লা বাসায় ঢুকে সরাসরি মায়ের ঘরে গেলো।বাসায় ডাক্তার ডাকা হয়েছে। তিনি মায়ের পালস, প্রেসার চেক করছেন। যখন খারাপ লেগেছে তখনকার ডিটেইল জানতে চাচ্ছেন। শায়লা মায়ের বিছানার কাছে দাঁড়ালো। মা শায়লাকে দেখে কেঁদে উঠলেন।ভীষণ আবেগী হয়ে উঠলেন। বিছানার উপরে রুহি খালা মায়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।আর বলে যাচ্ছেন, এইতো আপনার শায়লা চলে এসেছে। আপনি আর কান্নাকাটি করবেন না।
শায়লা ডাক্তারের মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছে।ডাক্তার সব কিছু শুনে জানালেন, একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে।তবে এখন বিপদমুক্ত। তার সাথে আপনারা স্বাভাবিক আচরণ করুন। কোন ব্যাপারে যেন উত্তেজিত না হন।বয়স হয়েছে, ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।রাতে অবশ্যই তার সাথে কেউ থাকবেন।ওয়াশরুমে যেন একা না যায়।
মাকে কি হাসপাতালে এডমিশন করাতে হবে ? শায়লা জানতে চাইল।ডাক্তার জানালেন,না, আজ এডমিশন লাগবে না।
তবে খুবই খেয়াল রাখতে হবে।
মা বারবার শায়লার হাতটা ধরতে চাইছে। কিন্তু শায়লা নিজেকে ফ্রি রাখতে চাইছে। শিহাবকে কল করে সব জানাতে হবে। শিহাব বাইরে অপেক্ষায় আছে। রুহি খালা মাকে দেখার পাশাপাশি শায়লার গতিবিধিও খেয়াল রাখছে। ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।ড্রইং রুমে খালু বসে ছিলেন।শায়লা তা একেবারেই খেয়াল করেন নি।তিনি ডাক্তারের সাথে বেরিয়ে গেলেন। তবে কি আমরা এম্বুলেন্স ছেড়ে দিতে পারি ? ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে খালু নিচে নামলেন।
শায়লা বারান্দায় গিয়ে শিহাবকে কল করে সব জানালো। এখনো রাহাত ফিরেনি।মা একা।খুব কাঁদছেন। ডাক্তার রাতে পাশে থাকতে বলেছেন।বলেছেন, ঝুঁকি এখনো আছে। এবার শিহাব জানতে চাইলো,তবে কি তুমি আসবে না শায়লা ? আমি একা চলে যাবো ? তোমাকে রেখে আমি যেতে চাইনা। শায়লা তাকে আশ্বস্ত করলো, রাতের মধ্যে মা সুস্থ হলে,আমি খুব সকালেই তোমার কাছে চলে আসবো। তুমি জেগে থেকো।
শিহাবের মনটা একেবারে ভেঙে গেলো।তবুও মায়ের শরীরটাই এখন বেশি ইম্পর্টেন্ট।
শিহাব বাইক নিজের বাসার দিকে তাক করে স্টার্ট দিলো। বারবার তার জীবনে বাধা এসে দাঁড়ায়। তার চাওয়া পাওয়ার কি কোন মিল হবে না। শত অনিচ্ছা সত্বেও এখন রিশতিনার মুখোমুখি হতে হবে। না চাইলেও তার সাথে একই ঘরে রাত কাটাতে হবে। আর শায়লা,মায়ের পাশে বসে শিহাবের জন্য কেবল না পাওয়ার আকুতিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
শায়লা সারারাত দুই চোখের পাতা এক করেনি।সারাক্ষণ মায়ের খেয়াল রেখেছে।রাহাত কয়েকবার মায়ের ঘরে এলেও শায়লার সাথে খুব একটা কথা হয়নি। শায়লার মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে কানাডা থেকে নোমান সাহেব শায়লাকে বারবার কল দিচ্ছিলেন। তিনি ফ্লাইটে উঠে গেছেন। এখন ট্রানজিটে দুবাই এয়ারপোর্টে আছেন।কাল দুপুর নাগাদ বাংলাদেশে পৌঁছে যাবেন। শায়লা যেন তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যায়।সে বারবার শায়লাকে অনুরোধ করছে।শায়লা যেন লাল শাড়ি পরা থাকে। সে যেন প্লেন থেকে নেমেই শায়লাকে চিনে নিতে পারে। শায়লা সবকিছু শুনছিল আর তার দুই চোখ থেকে অবিরল ধারায় পানি নেমে আসছিল।
শিহাব তার ভাঙা মন নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়ালো। কলিং বেল দিতেই রিশতিনা দরজা খুলে দিলো। সে হাত বাড়িয়ে শিহাবের হাত থেকে হেলমেট আর বাইকের চাবি নিতে চাইলেও শিহাব তাকে এড়িয়ে তা ড্রইং রুমের টেবিলে রাখলো। রিশতিনা শিহাবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।সে বেশ বুঝতে পারলো, শিহাবের মনটা ভালো নেই। চোখে মুখে কেমন যেন একটা কষ্টের ছাপ। শিহাব তার বেড রুমে গিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে কাপড় না বদলে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
রিশতিনা তার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো, কোন কারণে তোমার কি মন খারাপ শিহাব ? আমি তোমার জন্য এক কাপ কফি করে আনি ? যদিও রিশতিনার সাথে তার একেবারেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু এখন এক কাপ কফি হলে অন্তত মনের ক্লান্তিটা যেতো। তবে শিহাব নীরবই রইল। শিহাবের কোন বাধা না আসাতে রিশতিনা কফি বানাতে কিচেনে চলে গেলো।
সে খুব দ্রুতই কফি মেকারে দুই কাপ কফি বানিয়ে পিরিচে কয়েকটি কুকিজ নিয়ে ট্রে সাজিয়ে আনলো। খাটের পাশের সাইড টেবিলে রেখে সে বিছানায় শিহাবের পাশে বসলো।প্রচন্ড ক্লান্তিতে শিহাব চোখ বন্ধ করে অতল ভাবনায় ডুবে রইল। রিশতিনা শিহাবের হাতে হাত রাখতেই সে চমকে চোখ খুললো! দেখলো, রিশতিনা তার চোখে চোখ রেখে তাকে ঘেঁষে বসে আছে। শিহাব হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে সে দেখলো রিশতিনা বেশ শক্ত হাতেই তাকে ধরেছে।শিহাব চট করে উঠে বসতেই রিশতিনা শিহাবকে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শিহাব কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। রিশতিনা আরো কাছে এগিয়ে এসে শিহাবের মুখটিকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। শিহাব সবকিছুতে একেবারেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রিশতিনা কিছুতেই শিহাবকে আলগা হতে দিচ্ছে না। শিহাব তার শত অনিচ্ছাই রিশতিনার বাহুডোরে আটকে গেলো। রিশতিনার কোন দিকেই খেয়াল নেই।সে চোখ বন্ধ করে তার বহু যুগের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছিল যেন। রিশতিনা ধীরে ধীরে শিহাবকে আবেশিত করে দিতেই শিহাব নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। সে নিজেও বেশ শক্ত হাতে রিশতিনাকে নিজের সাথে আটকে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত রিশতিনার মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণহীন করে দিলো। সে রিশতিনার মাঝে শায়লাকে খুঁজে নিতে চাইছে।শিহাব জীবনের প্রতি ভীষণ এক অভিমান নিয়ে শায়লাকে না পাওয়ার অতৃপ্তি যেন রিশতিনার মাঝে খুঁজে নিতে চাইছে।
সাইড টেবিলে রাখা দুই কাপ কফির ধোঁয়া মিলিয়ে গিয়ে কখন যে ঠান্ডা জল হয়ে গেছে,দুজনের কেউই তা টের পায়নি।
চলবে.....