একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন পর্ব ২৮
মন আনচান করা স্বর্ণালী সন্ধ্যা
শিখার সপ্তমীর সকালটা এবার অন্যরকম। শরতের শুভ্র কাশফুল ,শিউলির সুঘ্রান আর শিশিরস্নাত সকালবেলা কি অসাধারণ লাগলো। তাই মানুষ বটে বারবার ভেসে ওঠে,গ্রামের পুজো মন্ডপ সত্যিই অন্যরকম ।সকলে কি সুন্দর আপন করে নেয় ।শিখা তো পুরো অচেনা কিন্তু গ্রামের মানুষগুলো মাধুর ননদ জেনেই সকলে হাসি ঠাট্টা ,মজা শুরু করে দিল। আর বললো সপ্তমীরতে দুপুরের খাওয়া -দাওয়া ,সন্ধ্যেবেলায় আড্ডা ,ধুনুচি নাচ ,আমাদের নতুন অতিথিরাও কিন্তু এতে অংশগ্রহণ করবে। গ্রামের একজন দাদা (আশুদা )ভীষণ ভালো মানুষ। বেঁটে- খাটো ,কালো কিন্তু তার ব্যবহার তার গায়ের রংকে হার মানিয়ে সকলের কাছে প্রিয় করে তুলেছে।
আশুদা এসে বলল 'তুমি এসো। এদিকে এসো একটু। তোমরা তো কলকাতার মেয়ে অনেক কিছু আমাদের ভুল ত্রুটি থাকতে পারে ।সেজন্য তোমরা আমাদের ক্ষমা করে দিও ।আর শোনো আমাদের অষ্টমীতে কুমারী পুজো হয় ।বাচ্চাদের সাজানোর দায়িত্বটা তোমাকে দিলাম। '
পাশে কল্যান ছিল, বলল ' হ্যাঁ ঠিক ব্যক্তির কাছেই দায়িত্বটা দেয়া হলো ।আপনারা নিশ্চিত থাকুন"।
আশুদা বলল 'আপনিও বাদ যাবেন না ।আপনাকেও দায়িত্ব নিতে হবে। আপনাকে কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় ধুনুচি নাচেতে অংশগ্রহণ করতে হবে।'
কল্যানদা বলল' আমি ওসব পারি নাকি?'
শিখা তখন বলল 'সঠিক ব্যক্তিকেই আপনারা নির্বাচন করেছেন।'
কল্যান একটু মুচকি হেসে শিখার দিকে তাকালো। আর মনে মনে ভাবল তখনকার খোঁচাটা এখন নিজেরই লাগলো।
কল্যান বলল 'দেখি পারি কিনা?'
বৌদি এসে বলল .'পারবে না মানে।কল্যাণ ভালো ধুনুচি নাচে। আমি শুনেছি। তবে দেখার সৌভাগ্য হয় নি ।আজকে সেই মনের আশা পূর্ণ করব।'
শিখা মনে মনে ভাবল ও তার মানে একটু ওয়েট বাড়ানো হচ্ছিল ।ঠিক আছে।
সবাই যে যার মত হাসি ঠাট্টাতে মগ্ন। শিখার বৌদি শিখা আর কল্যাণকে লক্ষ্য করছিল। শিখাকে সত্যিই যেন গ্রামেতে একটু অন্যরকম লাগছে। একটু খুশি খুশি লাগছে ।সেই উদাসী বাউল মনটা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারছে ।ওর দাদাকে ধাক্কা দিয়ে বললো 'দেখ শিখা আর কল্যান কিরকম পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে ।
শিখার দাদা বললো 'ভালোই তো খারাপ কি?'
হঠাৎ শিখা পুজো মণ্ডপ ছেড়ে বাড়ির ভেতরের দিকে গেল ।
মাধু বলল 'কিরে কোথায় যাচ্ছিস?'
শিখা বলল 'একটু আসছি বৌদি।'
কল্যান যেন ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
একটু পর কল্যাণ বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
মাধু বলল ' তোমার আবার কি হলো ?'
কল্যান বলল 'আমিও একটু আসছি বৌদি।'
শিখা চোখে মুখে জল দিয়ে ড্রইং রুমে এসে দেখে কল্যান বসু বসে। শিখা যেন ভূত দেখার মত দেখল।
কল্যান নিজে যেচে পড়ে ও জিজ্ঞেস করল 'আপনি উঠে আসলেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে?'
শিখা বলল 'একটু দরকার ছিল।'
কল্যান বলল ' ভাবলাম কোন কারনে রাগ হয়েছে কিনা?'
শিখা বলল-'কেন? কার প্রতি রাগ হবে?'
কল্যান বলল ' আমি গেস করেছিলাম।
ঠিক আছে ।তাহলে চলুন পুজো মণ্ডপে।
শিখা বলল 'না, এখন যাব না। আপনি যান।'
কল্যান বলল ' এখানে নতুন আমিও তাই, নতুন বন্ধু দুজন একসঙ্গে না থাকলে ভালো লাগে বলুন তো?'
শিখা বলে' কেন ,এটা তো আপনার দিদি জামাইবাবুর বাড়ি।আপনি নতুন কেন ?আপনি আসেন নি এর আগে? কল্যান বলল 'অনেক আগে একবার এসেছিলাম ।দীর্ঘদিন পর আসলাম।
কল্যান বল ল 'চলুন না।'
আপনি আমাকে এত জোরাজুরি করছেন কেন।
কল্যান বলল একটা সত্যি কথা বলবো? আপনি থাকলে ভালো লাগবে।'
শিখার কথাগুলো শুনে গা শিউরে উঠলো। এ কথা তো এর আগেও শুনেছে । কিন্তু অন্য রকম অনুভুতি হচ্ছে কেন?
কল্যাণ বলল 'কিছু বলছেন না?'
আপনাকে কিন্তু লং লালচে স্কার্টে দারুন লাগছে।
থ্যাঙ্ক ইউ।(শিখা বলল)
কল্যাণ বলল 'দাঁড়িয়ে কেনো?বসুন না?'
শিখা বলল 'আপনি চলে আসলেন যে, পুজো মণ্ডপে যান। '
কল্যাণ বলল 'এখন ভালো লাগছে না পূজা মন্ডবে যেতে।'
শিখা বলে ' তাহলে আপনি বসুন। বই পড়ুন ।আমি আসি।'
কল্যান বললো ,'আরে, যাই মানে?আমি তো .. এরই মাঝে এসে মাধু বলল 'কিরে শিখা ,তোদের সবাই মণ্ডপে খোঁজ করছে, চলো। '।
কল্যাণ ভাবল ভাগ্যিস বৌদি চলে এসেছে ।কথাটা কি করে বলতাম যে,পুজোমণ্ডপে যাব। হ্যাঁ, এই তো যাই।'
এখন দুপুরের খাওয়া-দাওয়া পর্ব। চল না আশুদা তোমাদের দেবে?'কল্যান বলল 'কেন বৌদি আমরা কি করেছি?'পরিবেশনের দায়িত্ব পড়বে চলো।'
কল্যান হো করে হেসে উঠলো।মাধু বলল ' এখানে সপ্তমীর দিন খিচুড়ি ,আলুরদম ,একটা চচ্চড়ি ৫ রকমের ভাজা,চাটনি,পায়েস হয়।'
আশুদা কল্যাণের হাতে ধরিয়ে দিলো খিচুড়ির বালতি আর শিখার হাতে ধরিয়ে দিলো ,৫ রকমের ভাজা পাত্র।
খাওয়া দাওয়া মিটতে মিটতে ৫টা বেজে গেলো ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যেবেলার পুজো আরোতি। ধুনুচি নাচ। মহিলাদের লাখ বাজানোর প্রতিযোগিতা।')
সবাই ফ্রেশ হয়ে পুজোমণ্ডপে হাজির ধুনুচি নাচ আর শাখ বাজানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ।
মাধু বলল 'খুব সুন্দর ধুনুচি নাচে কল্যা।, মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি তে দারুন লাগছিল কল্যাণকে।:
শিখা দিব্যেন্দুর সঙ্গে সপ্তমীর দিন শুধু প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে কিন্তু একটি পুজোমণ্ডপে থেকেও যে এতটা আনন্দ করা যায় ,ঠিক গ্রামীণ ঘরোয়া পরিবেশে না আসলে কল্পনা ও করা যেত না ।বারবার মনে মনে বৌদি ভাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাল। তারপর চলে পুজোর মন্ডপে গানের আড্ডা। শিখাকে প্রথমে গানের জন্য অনুরোধ করলো ।
মাধু বলল ' শিখা তো ভালো গান করে ।আজকে না করে কোনো ছাড় নেই ।করতেই হবে।
শিখা গান ধরে 'এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়। একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু ...?
সবাই আপ্লুত হয়ে গেল ।কল্যান মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল শিখার দিকে। শিখার চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে গেল । 'এ যেন চোখে চোখে কথা নয় গো বন্ধু ।আগুনে আগুনে কথা।'
মাধু বলল 'অনেক হয়েছে এবার সভা ভঙ্গ ।কালকে আবার সকাল বেলায় অষ্টমীর অঞ্জলি আছে। সুতরাং আজকে আর নয় ।এবার খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে যে যার মতো শয়নে'।
রাত্রিতে একবার কিসের টানে ড্রইংরুমে শিখা আসে এবং দেখে কল্যান দাঁড়িয়ে জানলার কাছে ।যেন শিখার জন্য ই অপেক্ষা করছিল ।
কল্যান বলল ' অপূর্ব !অপূর্ব !আপনার কন্ঠ বাঁচিয়ে রাখুন ।আপনি তো শিল্পী মানুষ ।অনেক কিছু দিতে পারবেন ।
শিখা বলল 'আগে করত এখন তো ছেড়েই দিয়েছে ।'।
কল্যান বলল 'ছেড়েছেন কেন ?শিল্পীসত্তা যদি চলে যায় ,তার নিজস্বতা কি থাকে? আপনি গান করবেন ।আপনার গানের গলা খুব সুন্দর । '
শিখা 'থ্যাঙ্কস জানায়।'
কল্যান বলল ' অষ্টমীর অঞ্জলি আছে ।দেখা হবে কাল মণ্ডপে ।'
শিখা বলল "কেন শুধু মণ্ডপে দেখা হবে কেন আর কি দেখা হবে না বলে শুধু হাসলো।'
উদাসী বাউল এর চোখে তাকালো শিখার দিকে এবং মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল।
শিখা রাত্রিতে শুতে গিয়ে কল্যাণের কথাগুলো ভাবছিল ।সত্যিই তো ,দিব্যেন্দু কখনো এভাবে জোর করে নি গানের জন্য। কথাগুলো যেন একটা মনের ভেতরে অসম্ভব টান অনুভব করছিল ।কখন সকালটা হবে ?কোন কিছুর জন্য একটা প্রত্যাশা মনের ভেতরে রয়েছে। মনে হল যেন আজকের রাত্রি সত্যি সুন্দর। বৌদি হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে বলল 'শিখা এখনো ঘুমাস নি ?কালকে কিন্তু অঞ্জলি আছে ।সকাল সকাল উঠতে হবে ।বুঝতে পারছিস তো বাড়িতে প্রচুর লোক বাথরুম পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে ।ঘুমিয়ে পড়।
ওদিকে কল্যাণের মনের মধ্যে সব সময় যেন মনে হচ্ছে একটা অস্থিরতা ভাব ।কোন কিছুকে দেখবার জন্য বারবার মনটা আনচান করছে। আগে কখনো তো এরকম অনুভব হয় নি।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"২৮ক্রমশ