উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৪৪
পাল তুলেছে খুশির হাওয়া
মমতা রায় চৌধুরী
মনোজ চোখ বুঝে আছে কিন্তু মন বোঝেনি। আজকে অফিস যেতে ভালো লাগছে না। সকাল থেকেই মেজাজটা কেমন খাটটা হয়ে গেছে। রেখার উপর অকারনে চিৎকার ,চেঁচামেচি করলো। সারাদিন এর রেশ থেকে যাবে। রেখার হিম শীতল উত্তরটা অনেকটা ট্রেনে অন্যমনস্ক যাত্রী বসে থাকলে হঠাৎ করে হুইসেল বেজে গেলে যেরকম হয়, ঠিক সে রকম জোরে ধাক্কা দেয়ার মত।
এদিকে সুরোদের বাড়িতে সত্যিই যাওয়ার দরকার যা ক্ষেপে আছে রেখা। সত্যিই তো, ওর তো কোন দোষ ছিল না।। আমার যে মাথাটা কেন মাঝে মাঝে এরকম হয় নিজেই বুঝে উঠতে পারছি না। এক্ষুনি স্কুলে বেরিয়ে যাবে ।একবার বলব গিয়ে।
রেখা তখন স্কুলের জন্য রেডি হচ্ছে ।
মনোজ দরজায় নক করল। রেখা শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে আড় চোখে তাকিয়ে দেখল মনোজ কিছু বলল না। তারপর পিনাপটা ঠিকঠাক করে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে চুলটা আচড়ে ক্লেচার লাগিয়ে নিল, সিঁদুর পরে নিল।
তখন ও মনোজ দাঁড়িয়ে দরজার কাছে ।মনোজ একটু হালকা কেশে নিল মনোজের অস্তিত্বটাকে বোঝানোর জন্য ।
রেখা সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করছে।
মনোজ খেয়াল করল রেখা মোটামুটি রেডি হয়ে গেছে ।এখন ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরোনোর চিন্তা ঠিক তখনই মনোজ বলল' রেখা সকালে তোমার সঙ্গে ওই রকম ব্যবহার করাটা আমার ঠিক হয়নি। তার জন্য সরি।'
রেখা কোন সাড়া দিচ্ছে না। এবার রেখা ব্যাগে র চেনটা বন্ধ করে চশমাটা পরে নিল। এবার বেরোতে যাবে দরজা আগলে দাঁড়ালো
মনোজ । হচ্ছেটা কি ?কি হল? তুমি সাড়া দিচ্ছ না ?
তখনও রেখা কিছু বলছে না।
মনোজ বলল' তুমি উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না ।
'তখন রেখা বলল 'আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি। তুমি বলেছ আমি শুনে নিলাম। তুমি সরি বললে আমি শুনে নিলাম'।
তুমি কিছু বলবে না?
' কি বলবো বলব? আমার কথা তুমি শোনো ?না বোঝো বোঝার চেষ্টা করো?
ঠিক আছে সরো বেরোতে হবে, স্কুলে যেতে না হলে দেরি হয়ে যাবে ট্রেন পাব না।'
'আজকে তোমার স্কুলে যাওয়া হবে না বলে হাত দুটো ধরল রেখার।'
'কি করছো তুমি? আমি রেডি হয়ে গেছি স্কুলে যাব না তাই কখনো হয় নাকি?'
কোন কাজ বাকি আছে কি?'
'তোমার সঙ্গে আমার কতগুলো কথা আছে।'
রেখা মনে মনে ভাবলে এই জন্যই মনে হচ্ছে রেখার ঘরে এসেছে।
'কি কথা?'
'আগে বলো রাগ করোনি?'
'আজকাল আমার না কোন কিছুতে কিছু এসে যায় না ।আমি জানি রাগ করে তো কোন লাভ নেই। কার ওপর রাগ করবো বলো তো? যে রাগের গুরুত্ব বোঝেনা ।মান অভিমানের গুরুত্ব বোঝেনা ।তার সঙ্গে ?আমি এই বেশ ভালো আছি জানো তো?'
মনোজ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
'ঠিক আছে তুমি এবারকার মত আমাকে ক্ষমা করে দাও।'
'আমি তো তোমার প্রতি রাগই করি নি। ক্ষমা করার প্রশ্নটা কোথা থেকে আসছে?'
Ok
তাহলে এস এখানে বসো। হাত দুটো ধরে রেখাকে সোফাতে বসালো। মনোজও তার পাশে বসলো।
তারপর রেখাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আসলো।
রেখা যেন কেমন হয়ে গেল ।সবকিছু যেন ভুলে গেল ।ও যেন একটা নিশ্চিত আশ্রয় খুঁজছিল নিজের ভেতরের যে ক্লান্তি কষ্ট সেগুলোকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দেবার জন্য।
মনোজ বলল' রাগ কমেছে?'
রেখা মনে মনে ভাবছে আসলে মেয়েরা এরকমই স্বামীর একটু ভালোবাসা আদর পেলে সবকিছু গলে যায়।
রেখা বলল 'দরজা খোলা আছে।'
'আমি কি পর নারীর সঙ্গে পরকীয়া করছি নাকি?
'আমার নিজের বউয়ের সাথে প্রেম করছি।'
'বাপরে বীরপুরুষ?'
'ওই দেখো মা?'
বলতেই মনো জ রেখাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে দিল।
রেখা খিল খিল করে হেসে উঠলো
'ও তুমি আমার সাথে দুষ্টু দুষ্টু করলে?'
এইবার রেখা কে পুরো জাপটে ধরে মনোজের ঠোটটা স্পর্শ করালো রেখার ঠোঁটে। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে লাগলো ।রেখা ও যেন কেমন পাগলের মতো হয়ে যেতে লাগলো।
এরকম চলেছে কতক্ষণ নিজেদের হিসেব নেই তারপর হঠাৎ শান্ত স্নিগ্ধতায় ভরে গিয়ে রেখা বলল' সত্যিই আজকে স্কুলে যাওয়া হলো না। তুমি যে কি করো না মাঝে মাঝে।'
'আমি কি করেছি গো?'
মনোজের বুকে দুই চার দুমদুম করে কিল দিয়ে বলল 'আমি জানি না।'
"এবার জরুরী কথা শোনো?"
"স্কুলে যখন যাওয়া হলই না, বলো শুনি?'
মনোজের কাঁধে মাথা রেখে বলল।
'বলছি সুরোদের বাড়িতে যেতে হবে তো নাকি?'
রেখা বললো 'এই যা ,হ্যাঁ, কবে যেন?
' আরে কালকে বিয়ে তো?'
'কবে যেতে চাইছ?'
'আজকে যাবে?'
রেখা বলল' কিন্তু বাচ্চা গুলো?'
'সে আমি চৈতির মা কে বা সেন্টুদাকে বলে
দেব ।
'আর মাসি আসবে তো?'
'মাসিকে তাহলে ফোন করতে হবে?'
এক্ষুনি ফোন করে কনফার্ম হয়ে নাও।'
রেখা বলল ''ok
রেখা সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালো ।রিং হতে না হতেই মাসির বৌমা ফোন ধরল।
বলল "হ্যালো'।
'বলছি মাসির শরীর কেমন আছে গো?'
'আগের থেকে ভালো আছে।'
'বলছি কালকে কাজে আসতে পারবে কিনা একটু বলতে পারবে?'
মাসির বৌমা ,মাসিকে ফোনটা দিল তারপর বলল "তোমার শরীর কেমন?'
ওই আছি।
'কি হয়েছে বৌমা?'
"ও বৌমা।'
ফোন করেছি কাজে আসতে পারবে কিনা…?
"তুমি কি বলছ কালকে আসতে পারবে?'
দেখি?
'ও মাসি দেখি বললে হবে না। কালকে থাকবো না ।তুমি আসলে আমার খুব উপকার হয়। বাচ্চা গুলোর ভাতগুলো করে দিতে পারতে। ওরা কি খাবে না হলে বলো সারাদিন?'
'ঠিক আছে যাবো।'
'তোমাকে ডাক্তার কি বলেছেন?'
'পেশার লো ছিল বৌমা?
আর কি কি যেন বলল?
"যাক ওষুধ দিয়েছেন তো?'
"হ্যাঁ ,বৌমা দিয়েছে।"
'আচ্ছা মাসি তুমি রেস্ট নাও
তাহলে ।কালকে এসো ।আসলে আমার খুব সুবিধে হয়। আসলে ওরই বন্ধুর বোনের বিয়ে তো যেতে হবে। আজকেই বেরোবো। আজকে আমি রান্নাবান্না করে রেখেই যাবো। কালকে বিয়ে বাড়ি আছে।'
'কালকে তোমরা ফিরতে পারবে?'
'ধরে রাখো ফিরতে পারবো না।'
'আচ্ছা ঠিক আছে বৌমা, চিন্তা করো
না। তোমার যে দুদিন মনে হয় তুমি কাটাও । বাচ্চা গুলোকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি খাইয়ে দাইয়ে ঠিকই দেবো।'
'তুমি তো জানো কোথায় কি থাকে ওদের মাংস রাখা থাকবে তুমি ভাত মাংস ওদের করে দিও আর তুমি তোমার খাবারগুলো করে নিও এখান থেকে। পারলে থেকে যেয়ো।'
'আমি থাকবো !তোমার শাশুড়ি মা…?
শাশুড়ি মায়েদের ও তো নেমন্তন্ন ।গেলে ভালো, যদি না যায় তাতে কি হয়েছে তোমার তো থাকার ঘর আলাদা আছে মাসি। তোমার অসুবিধা কি তোমাদের ছেলে সব বলে দিয়ে যাবে মাকে ।তোমার কোন অসুবিধা হবে না।।
'আচ্ছা বৌমা।'
মনোজ আনন্দে উল্লাসে বলে' উঠলো হুর রে.রে ।
'ঠিক আছে শান্তি এবার।'
মনোজ হাত দুটো নিয়ে নিজের গালে আলতো করে স্পর্শ করছে ।
তারপর বলল 'বুকে হাত দিয়ে দেখো শান্তি।'
'দেখো কতদিন আমাদের যাওয়া হয় না কোথাও চলো একটু মজা করেই আসি নাকি?
'যাও দেখো মা দিদিরা যাবে কিনা বল ওদের।'
'তুমি গুছিয়ে নাও তাহলে আজকে আমরা সন্ধ্যার ট্রেনটা ধরছি।'
Ok
'সন্ধ্যার ট্রেন ধরবে কেন তার আগেই চল না? "
"হ্যাঁ তার আগে বলে চলে যাব ।দেখি এবার মা দিদিরা কি আবার বলে?'
'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী…।'গান গাইতে গাইতে মনোজ চলে গেল রেখার শাশুড়ি মায়ের ঘরে।
রেখা সব গোছ-গাছ করে নিতে থাকলো।
ওয়ারড্রব টা খুলে শাড়ি সিলেট করতে থাকলো কোনটা পড়বে ।মনোজের ব্লেজার টা নিয়ে নিল ওর ব্লেজারের কালারটা হচ্ছে পিংক ।তাহলে রেখা কি ভাইলেট কালারের ওপালাটা পরবে নাকি চাঁদনী বেনারসি টা পড়বে? রেখা
এই ভাবছে।
'অন্যদিকে মনোজ তার মাকে বললো মা তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে নাও ।দিদি গোছগাছ করে নাও। বিয়ে বাড়িতে যাব।'
মা দিদি দুজনে সমস্বরে বলে উঠল 'কার বিয়েতে?'
'কেন সেদিন বলল না? সুরোর বোনের বিয়ে, শিখা ।তুমি ভুলে গেলে?'
মনোজের মা মেয়ের দিকে তাকালো।
মনামী বলল 'কিন্তু আমি কি করে যাই ভাই ?আমি তো ভালো শাড়িই আনি নি।'
'শাড়ির সমস্যা হলে তুই রেখার শাড়ি পরবি?'
'রেখার শাড়ি পড়বো?'বলেই কেমন একটু বাঁকা হাসি হাসলো।
"কেন না পড়ার কি আছে?"
', না না আমি ওর শাড়ি পরবো না।'
"তাহলে কি করবি যাবি না তো?'
'না আমি যাব না।।"
মনোজের মায়ের যাবার ইচ্ছে ছিল মেয়ের না যাওয়ার জন্য বলল "তাহলে আমি কি করে যাব বল?'
তোমার না যাবার কি আছে মা?
দিদি বাড়ি থাকবে।'
'নারে ও একা থাকবে। থাক, তোরাই ঘুরে আয় আমরা দুজন বাড়ি থাকি।'
'দেখো যেটা ভালো বোঝো ।আমি আর কি বলবো।'
মনামী বলল'কুকুরের বাচ্চা ওদেরকে কে খেতে দেবে?'
'প্রথমে দিদি তোকে একটা কথা বলি কুকুর বলে সম্বোধন করিস না। ওদেরকে কিন্তু আমরা কন্যাস্নেহে লালন পালন করছি। ওদের তো নাম আছে। নাম বললেই তো যথেষ্ট।'
মনামী একটু ভেঞ্চি কেটে বলল' বাববা এত গায়ে লাগছে কুকুরকে কুকুর বলবো না?'
কুকুরকে কুকুর বলবি না কেন কিন্তু যেখানে আমরা ওদের নাম রেখেছি ওই নামে ডাকলে কি অসুবিধা আছে
দিদি ?সব সময় এত নেগেটিভ কথা বলিস কেন?'
'ওই নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না সে ব্যবস্থা আমরা করেই যাব। মাসি
থাকবে ।মাসি রান্নাবান্না করবে খাওয়াবে দাওয়াবে।'
মনামী বলল 'ও আচ্ছা'।
আর একটা কথা বলি মা দিদি তোমাদের দুজনকেই। মাসির সঙ্গে কিন্তু খিট খিট করবে না ।মাসি কিন্তু খুবই ভালো মনের মানুষ। দেখো কোন ঝগড়া টগরা বাঁধিয়ে দিও না।'
মনামী বলল 'কেন রে ভাই ,আমরা কি ঝগড়া করি?'
'আমি সে কথা বলছি না।'
'কথায় কথা বাড়বে তোদেরকে যেটুকু বলার ছিল বললাম।'
'মাসিও কিন্তু এখানেই খাবে।'।
'ও মা মাসির রান্না কে করবে রে ভাই?'
এটা তোদের করতে হবে না তোদেরটা তোরা রান্না করে খাস ।মাসিকে বলা আছে মাসি নিজে করে নেবে।'
মনোযের মা আর দিদি দুজনেই পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
মনোজ কথাগুলো বলেই ঘরে গেল সব জিনিস গোছগাছ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখতে ।
কেমন যেন একটা উন্মত্ত ফূর্তি কাজ করছে ।প্রচন্ড একটা সেলিব্রেশন করার মোক্ষম উপায় পেয়েছে ।সেই সেলিব্রেশনটা হবে শিখার বিয়েকে উপলক্ষ করে ।অনেকদিন পর রেখা আর মনোজ যেন আবার পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি হতে চলেছে। এই ভাবেই বোধহয় মানুষের জীবনে কোন পালা পার্বণকে কেন্দ্র করে একত্রিত হবার একটা প্রচেষ্টা চলে ।কত ঝড় বয়ে গেছে ওদের দুজনের মধ্যে । আজ যেন প্রবল ভাবে ভালোলাগার জোর নাড়া দিতে লাগলো। এত দিনের যে তীব্র বিষ ফুল ঝরে পড়েছিল মনোজের হৃদয়ে আজকে সেই গন্ধটাকা ক্রমশ অসহ্য মনে হচ্ছে। সেই বিষ ফুলের ছেয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে তার গন্ধটা কে নাকে রুমাল চাপা দেবার মত একটা প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতেই কি সেই গন্ধ বিলুপ্ত হবে? এইসব ভাবনায় যেতে চায় না মনোজ আজ হৃদয়ে খুশির পাল
তুলেছে তাই হারিয়ে যেতে চায় অনেক দূরে।।।