৩০ মার্চ ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৮০




ধারাবাহিক উপন্যাস 


শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮০)
শামীমা আহমেদ 

শায়লা এবার উঠতে হবে,চলো। দুপুরের খাবারের সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।সাড়ে তিনটা বাজতে চলেছে।চলো,কোথাও কিছু খেয়ে নেই। শিহাব শায়লাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেও শায়লা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। শিহাবের কথায় স্বাভাবিকে এলো। অস্ফুট স্বরে বললো,হ্যাঁ, চলো, তবে খাওয়ার জন্য অন্য কোথাও নয়।এখানে কিছু খাবারের দোকান আছে, সেখানে বসে কিছু খেয়ে নেই। শিহাব একমত হলো।দুজনেই উঠে দাঁড়ালো।শিহাব চোখের ভাষায় যেন শায়লাকে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর তাতে শায়লার অকপটে উত্তর,তুমি ভেবোনা। আজ আর আমি বাসায় ফিরছিনা। জীবন আজ থেকে অন্যরকম হবে।
দুজনে এখানেই একটা রেস্টুরেন্টে বিফ বার্গার আর কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলো। শিহাব শায়লাকে নিয়ে ভাবছে। এখন কি তবে শায়লাকে অফিসে নিয়ে যাবে নাকি ওর নিজের ফ্ল্যাটে  রেখে আসবে?কিন্তু বাসায় শায়লা একা একা কি করবে ? শিহাবের আজ অফিসে বেশ কিছু জরুরী কাজ আছে।অফিস থেকে বেরুতে  রাত হয়ে যাবে।এতক্ষন শায়লাকে অফিসে বসিয়ে রাখাও খুব একটা ভালো দেখাবে না। কি করা যায় ? ভাবতেই শায়লা শিহাবের মুখভঙ্গি যেন পড়ে নিলো।শিহাব কি নিয়ে চিন্তিত জানতে চাইলো। 
তুমি কি আমাকে নিয়ে বিব্রত বোধ করছো শিহাব ? 
একেবারেই না, তুমি আমার সাথে চলো, আমরা একসাথেই থাকবো। কাজ শেষ করে একসাথেই বাসায় ফিরবো।
কথাটা বলেই শিহাবের মন আনন্দে নেচে উঠলো!  শায়লাকে আজ সে আপন করে পেতে যাচ্ছে। শিহাবের সেই রবীন্দ্র সংগীতটির কথা মনে পড়ছে... ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি,ওগো নন্দিনী। 
শায়লা হাত বাড়িয়ে দিলো। শিহাব হাত এগিয়ে শায়লাকে ধরলো। শিহাব দেখলো শায়লার হাতে তার দেয়া সেই ব্রেসলেটটা ! শিহাব খুবই পুলকিত হলো! দুজনে দ্রুত হেঁটে  বাইকের দিকে এগিয়ে গেলো। শিহাব বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, শায়লা আজ আমার বাসায় গেলে ওর জন্যতো কিছু পোশাক প্রয়োজন। কিন্তু কখন যে বেরুবো ? 
শায়লা শিহাবের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, কি ভাবছো ?
এইতো,ভাবছি তোমার জন্য কিছু পোশাক কেনা দরকার কিন্তু,,, 
শিহাবকে থামিয়ে শায়লা বললো, কোন কিছু প্রয়োজন নেই। আমি তোমার টি শার্ট আর ট্রাউজার পরে থাকবো। শিহাব যেন একটা উপায় খুঁজে পেয়ে স্বস্তি পেলো।
শিহাব বাইক স্টার্ট দিলো।শায়লা পিছনে বসতেই আর এক মূহুর্তও দেরি না, শিহাবের পংখীরাজ বাইক যেন উড়ে চললো। 
শিহাবের অফিসে ঢুকতে প্রায় পাঁচটা হয়ে গেলো। শিহাব শায়লাকে তার অফিস রুমে রাখা ঐপাশের সোফায় বসতে বললো। শায়লা শিহাবের কথামতো সোফায় চুপটি করে বসে রইল। সে বুঝতে পারছে, বাসায় এখন কি পরিস্থিতি হতে পারে। 
শায়লা এখনো বাসায় ফেরেনি। বিষয়টি রুহি খালা খুব একটা ভালো ভাবে নিচ্ছে না। সে শায়লার মাকে নানান আক্রমনাত্মক কথা শোনাচ্ছেন। আজ আর বড় বোনের মত সম্মান করে কোন কথা বলছে না। সে একেবারে হিংস্র বাঘিনীর মত ক্ষেপে আছে। সে  রাহাতকে কল করে শায়লার বাসায় না ফেরার কথা জানালো, শায়লা এখনো বাসায় ফেরেনি রাহাত। আজ ওকে একা বাইরে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি।
রাহাত ভীষণ অবাক হলো! ঘড়িতে সময় বিকেল পাঁচটা।সেই দুপুর বারোটায় বেরিয়েছে।  রাহাত শায়লাকে কল দিলো। শিহাবের অফিস রুমে সোফায় ক্লান্তিতে  শায়লার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাহাতের কলে সে জাগলো। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে রাহাতের কল দেখে কিভাবে তা মোকাবেলা করবে একটু ভেবে নিলো।
ওপ্রান্তে রাহাতের উৎকন্ঠিত জিজ্ঞাসা, 
আপু তুমি এখনো বাসায় ফেরোনি, অনেক বেলা হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় এসো।
শায়লা রাহাতকে জানালো, আজ আমি আর বাসায় ফিরে যাচ্ছিনা রাহাত। আমি শিহাবের সাথে আছি। বাকী জীবন শিহাবের সাথেই কাটিয়ে দিবো।
শায়লার এমন কথায় রাহাত ভীষণ অবাক হয়ে গেলো।সাথে মান সম্মানের কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লো। তবু্ও শায়লাকে মানাতে
সে বললো, না আপু এটাতো কথা ছিল না।তুমি কাজের জন্য বাইরে গিয়েছো। কাজ শেষ করে তোমাকে বাসায় ফিরে আসতে হবে।
না, আমি ফিরবো না। আমি শিহাবের সাথেই থাকবো। আর যদি পারো,নোমান সাহেবকে দেশে আসতে নিষেধ করে দাও।আমি তার সাথে কোথাও যাবো না।
শায়লার এমন কথা শুনে রাহাতের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এমন কথা রুহি খালা বলেছিল, সে শোনেনি। সে বুঝতে পারেনি, আপু যে এভাবে বদলে যাবে ! রাহাত তাকে যতই বাসায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছে, শায়লা ততটাই  শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যেন শিহাবের কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। রাহাত আর কোন দিক বুঝতে না পেরে কল কেটে দিলো।নিজের বোকামির খেসারত নিজেকেই দিতে হচ্ছে।
ওপাশ থেকে শিহাব সবই শুনছিল।শায়লা বেশ দৃঢ়ভাবেই রাহাতকে ফিরিয়ে দিলো।
তাহলে শায়লাকে নিয়ে তার বাসাতেই ফিরতে হবে। শিহাব জানালো, শায়লা আমার কাজ গুছাতে রাত আটটা বেজে যাবে। তুমি অপেক্ষা করতে পারবে না ? শায়লা বললো,খুব পারবো। বাসার কথা মনে হতেই বাসার  চাবির কথা মনে হলো। সে কেয়ারটেকার বিল্লালকে কল দিয়ে বাসার কথা জানতে চাইলো, বিল্লাল আমার ফ্ল্যাটের চাবি তোমার কাছে নিয়েছো ?
না ছার, ঘরে তো সেই বিদেশি ম্যাডাম। এইতো অর্ডার দিয়া পিজা নাস্তা আনাইলো।আমি উপরে গিয়া দিয়া আসলাম ।ম্যাডাম আমারে বখশিশ দিলো। আমি নিতে চাই নাই ছার,কিন্তু  জোর কইরা দিলো।
উফ! বিল্লালের মুখ যেন রেলগাড়ির মত চলছে। শিহাব তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো। 
শিহাব বুঝতে পারছে না, রিশতিনা কেনো এখনো যায়নি। সে তাকে সেই সকালেই চলে যাওয়ার কথা বলে এসেছিলো। কেন সে যায়নি ? সে কি বুঝতে পারছে না, তার সাথে আমি আর জীবন এগিয়ে নিতে চাইছি না।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটু পরে রাত হয়ে যাবে। এখন তাকে  যেতে বলা মানে অন্য বিপদ ডেকে আনা। শিহাব কি করবে তা গভীর ভাবে ভেবে  নিলো।শায়লাকে নিয়ে তবে আজ রাতে কোন হোটেলেই উঠতে হবে।কাল সকালে বন্ধু রোমেলকে ডেকে রিশতিনাকে বিদায় জানাতে হবে। 
শায়লা শিহাবের জন্য অপেক্ষায় সোফায় একেবারে ভাবলেশহীনভাবে বসে আছে।যেন সবকিছু তার শিহাবের উপরে ছেড়ে দেয়া। আজ শিহাব যেখানে নিয়ে যাবে শায়লা নির্দ্বিধায়  সেখানেই যাবে। শিহাব সোফায় এসে শায়লার পাশে বসলো। শায়লার হাত ধরে বললো, শায়লা আমার একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না, তুমি যে পুরোপুরি আমার হয়ে গেছো।
তোমাকে আপন করে পেতে যাচ্ছি। তুমি আজীবন আমার হয়েই থেকো।
শায়লা শিহাবের কাঁধে মাথা রেখে বললো, শিহাব আমি সারাজীবন শুধু দিয়েই গেছি।তুমি আমাকে আমার নিজের করে নিযের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষকে কেমন করে কাছে নিতে হয় সেটা শিখিয়েছো। শিহাব আমি তোমার মাঝেই সব নির্ভরতা খুঁজি।তোমার কাছেই সবটুকুর আবদার যাচি। তোমাতেই বিলীন হওয়ার জন্য নিজেকে উজার করে দিতে জানি। শিহাব তুমি আমায় গ্রহন করো। আমার আমিটাকে তোমার করে নাও আর তোমাকে পাওয়ার পূর্ণ সুখে আমাকে ভরিয়ে নিতে দাও।
ঠিক আছে শায়লা, তোমার চাওয়াই আমার কাছে শিরোধার্য। তবে আমার বাসায় এখনো রিশতিনা আছে।তাকে বলেছিলাম চলে যেতে কিন্তু সে এখনো আছে। আমি চাইনা তোমরা দুজন মুখোমুখি হও।এতে আরো ঝামেলা বাড়বে।তাই আমরা আজ উত্তরায় আমার এক কাজিনের হোটেলে থাকবো। যদি  তোমার কোন আপত্তি না থাকে।
শায়লার স্পষ্ট উত্তর,আপত্তির কিছু নেই। তুমি সাথে থাকলে এই পুরো পৃথিবীটাই আমার।
ঠিক আছে উঠো।গুছিয়ে নাও। চলো বের হবো।শিহাব সব গুছিয়ে কবিরকে অফিস লক করে দিতে বললো।
শায়লা আর শিহাব সবদিক ভেবে নিয়ে, সব কিছুকে উপেক্ষা করে নতুন জীবনের সন্ধানে একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে পদধাপে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। দুজনার মুখে বিজয়ীর হাসি।
হঠাৎই শায়লার মোবাইল মেজেজ রিং বেজে উঠলো। শায়লা হাতে ধরা মোবাইল মেসেজে চোখ রাখতেই ভীষণ অবাক হলো! ছোট বোন নায়লার  ম্যাসেজ।
আপু, মা বাসায় স্ট্রোক করেছে। রুহি খালা আমাকে জানালো। রাহাত ভাইয়া অফিসে।মাকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে। আমি এম্বুলেন্স কল করেছি।তুমি আমাদের মাকে বাঁচাও আপু, দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাও।
শায়লার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না!"


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much