টানাপোড়েন ৬৫
অর্থহীন জীবন
প্রথম শীতের হিমেল হাওয়া ,ভোরের শিশির সিক্ত রূপ
শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে পা দিয়ে অপূর্ব লেগেছিল রেখার। মনোজ আগের থেকে অনেক বেশি সুস্থ হয়ে গেছে। মনের কোণে যে অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে এসেছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। আজকে মনোজের টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মনোজ ও ভীষণ খুশি হয়েছে। আজ অনেকদিন পর রেখা মনোজকে হাসতে দেখল রিপোর্টটি হাতে পাবার পর। এখন ডাক্তারবাবু ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া এগুলো মেন্টেন করতে বলেছেন ।লিভারটা যাতে ড্যামেজ না হয়, সেটা দেখার জন্য, আলাদা টেস্ট দিয়েছেন। আজ রেখা তাই প্রথম শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে মেখে নিয়েছে কিন্তু সবুজ ঘাসে পা রাখতে পারে নি। শহরের সবুজ প্রাণ কোথায়?মনেপ্রাণে যে সবুজের সুঘ্রান নিয়ে এসেছিল তার নিজের বাড়ি থেকে, মনের অগোচরে তাই নেড়েচেড়ে আরো বেশি চনমনে হবার চেষ্টা করছিল।
এমন সময় পাশের বাড়ি চৈতির মার গলা শোনা গেল ।ডাকছে জানলা দিয়ে'ও দিদি ও দিদি'।
একবার ডাকার পর দ্বিতীয়বারে রেখার মনে হলো' হ্যাঁ চৈতির মা রেখাকে ডাকছে।'
রেখা জানলার পর্দা দুটো সরালো, উঁকি মারলো আর দেখার চেষ্টা করল কে, কোথা থেকে ডাকছিল?
এমন সময় চৈতির মা চৈতিদের বাড়ির জানালার পাশ থেকে বলল'ও দিদি এই দেখুন ,( আটা মাখা হাত নেড়ে)আমি রান্না ঘর থেকে বলছি।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ, বলো?'
চৈতির মা বলল 'দাদা ,এখন কেমন আছেন?'
রেখা বললো 'ভালো'।
চৈতির মা বললো 'দাদাকে দেখতে যাব কিন্তু..?
রেখা বলল' না, না ,ঠিক আছে ।ওই পরিস্থিতিতে কারোর আসাটাও ঠিক নয়।'
চৈতির মা বলল 'কিছু মনে করেন নি তো?'
রেখা বলল 'না ,দিদি মনে করব কেন?'
চৈতির মা বলল'ও দিদি' জানো আজকে না একটা ঘটনা ঘটেছে।'
রেখা মনে মনে ভাবল চৈতির মা ও যেন মনে হচ্ছে স্টার আনন্দ।সব খবর ওর কাছে পাওয়া যাবে।'
রেখা বললো 'কি হয়েছে? , কি ঘটনা?'
চৈতির মা বলল 'আরে পাশের বাড়ি( ফিসফিসিয়ে বলল) গোবিন্দ আছে না?'
রেখা বলল কি?( কানটা একটু খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো)।
চৈতির মা বলল' বলছি ওই যে নেন্দু,ভেন্দু(আঙ্গুল দিয়ে বাড়ির দিকটা নির্দেশ করল)।'
রেখা বলল'-হ্যাঁ ভেন্দুদের বাড়ি কি হয়েছে?'
চৈতির মা বলল 'ভেন্দুর বৌ সুসাইড করেছে?'
রেখা বলল-'কি বলছ?'
চৈতির মা বলল 'তবে আর বলছি কি?'
রেখা বলল 'কেন গো?'
চৈতির মা বলল' কে জানে? ওর মা তো সুচারু নয়?'
রেখা বলল'এ বউটা তো শুনেছি বিএ পাস।
ছেলেটা তো মাধ্যমিক ও পাস করতে পারে নি?'
চৈতির মা বলল' হ্যাঁ ,আগের বউটাও তো চলে গেল।'
রেখা বলল 'বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে?'
চৈতির মা এবার রেখাদের বাড়ির জানালার মুখোমুখি এসে বলল 'আমি না সকালবেলায় ওই ঘটনাটা শোনার পর একবার গিয়েছিলাম।'
রেখা বলল 'তা ,যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে ?পুলিশ এসেছিলো?'
চৈতির মা বলল' 'তখনো পুলিশ আসে নি।'
রেখা বলল 'কি অবস্থা আমাদের দেশের মেয়েদের?'
বিএ পাস মে কোথায় স্বনির্ভরশীল হবে তা নয় সুইসাইড? জীবনটা কি এতটাই সস্তা?'
চৈতির মা বলল "ঠিক বলেছেন দিদি ।ভাল লাগছিল না ,চলে যা ।যেমন আগের বৌটা চলে গেছিল।'
চৈতির মা বললো' উত্তর বঙ্গের মেয়ে।'
রেখা বললো 'আগের মেয়েটাও তো বলেছিলে উত্তরবঙ্গের?'
চৈতির মা বললো' হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছি।'
রেখা বলল' আগের বৌটা চলে গেছিল কেন?'
চৈতির মা বলল 'আগের বউটার তো শুনেছি, ওদের ওখানে নাকি একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল ।সেখানে চলে গেছে।'
রেখা বললো 'ছেলেটার কি অবস্থা বল তো দু-দুবার এরকম হলো, মন ভেঙে যাবে না?'
চৈতির মা বলল' আর ছেলেটার গুন গাইবেন না তো দিদি? ওরা মোটেই ভালো লোক নয়।'
রেখা বলল' কিন্তু ছেলেটা তো শান্তশিষ্ট, কাজেকর্মেও ভালো।'
চৈতির মা বললো 'কি জানি ছেলেটা হয় তো ভালো জানি না ।তবে মা তো সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায় আর এর ওর নামে শুধু সমালোচনা করে।'
রেখা বললো' ওমা তাই নাকি?'
চৈতির মা বললো' হ্যাঁ গো। আপনি তো বাড়ি থাকেন না। আপনার বাড়িতে ঢোকার সাহস পায় না।'
রেখা বলল 'না বাবা আমরা ঠিক আছি। এ তো গ্রামের মতো অবস্থা দেখছি। শহরে হয় নাকি?'
চৈতির মা বলল 'এটা শহর বটে কিন্তু এখানে দেখবেন,প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি কিন্তু যায়।'
এর মধ্যেই মনোজ ডাকল 'রেখা রেখা ..তারমধ্যে আওয়াজ পাওয়া গেল একটা ঝনাৎ করে কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দ ।
রেখা বলল 'হ্যাঁ, যাই। কি হলো? কি হয়েছে?'
রেখা চৈতির মায়ের দিকে হাতের ইশারা দিয়ে বলল পরে কথা হবে ।
চৈতির মাও মাথা নেড়ে বলল 'ঠিক আছে, দিদি ।পরে কথা হবে।'
রেখা এসে দেখে মনোজ পড়ে গেছে সামনে যে কাঁচের গ্লাসটা ছিল সেটা ভেঙে গেছে।
রেখা বলল 'তুমি পড়লে কি করে গো?'
মনোজ বলল' কি জানি ,হঠাৎ খাট থেকে নামতে গেলাম গ্লাসটা থেকে জলটা খাব আর কিরকম যেন হলো ।বুঝতে পারলাম না।'
রেখা মনোজকে ধরে ভালো করে বসালো, আর বলল 'তুমি তো এখনো উইক আছ।কতবার বলেছি না, কিছু প্রয়োজন হলে ,তুমি আমাকে ডাকবে।'
মনোজ বলল 'সারাক্ষণ তো তুমি আমার সেবা করেই যাচ্ছ। ভাবলাম তুমি একটু ঐ পাশে গেলে... তুমি কি চৈতির মার সাথে কথা বলছিলে?'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,গো। একটা ঘটনা ঘটেছে।'
মনোজ বলল 'ঠিক আছে। আমি ঠিক আছি ।তুমি এত ব্যস্ত হ'য়ো না।
রেখা দেখল মনোজ একটু যেন কুঁকড়ে আছে ঠান্ডাতে।
রেখা বললো 'কেন বল তো তুমি দেখছ তো শীতের হিমেল হাওয়া বইছে ,কিছু গায়ে দিচ্ছ না কেন?'
মনোজ হাসলো। তারপর বলল' ঠিক আছে দাও ।আমার চাদরটা দাও।'
রেখা চাদরটা এগিয়ে দিল এবং জড়িয়ে দিল।
মনোজ বলল' কি হয়েছে?'
রেখা বলল 'আরে ভেন্দুর বউ মারা গেছে।'
মনোজ বলল' কিভাবে?'
রেখা বলল 'সুইসাইড করেছে?'
মনোজ অবাক হয়ে বলল' কি বলছ?'
রেখা বলল' হ্যাঁ গো।'
মনোজ বললো' কে বললো তোমায়?'
রেখা বলল 'কে আবার ?আমাদের স্টার আনন্দ।'
মনোজ হেসে লুটোপুটি খেলো।
মনোজকে আজকে অনেকদিন পর হাসতে দেখে রেখা একদৃষ্টে মনোজের দিকে তাকিয়ে রইল। আর মনে মনে ভাবল মানুষটা উপর থেকে যতই নিজেকে শক্ত ভাবুক না কেন ?ভেতরে ভেতরে আসলে সে এতটাই দুর্বল আর শিশুসুলভ যে ,ওর পাশে কেউ না থাকলে ও যেন থৈ খুঁজে পায় না ।যেন অথৈ সাগরে পড়ে যায়।'
মনোজ হাত দিয়ে ঈশারা করে দেখাচ্ছে' কি হলো?'
রেখা হেসে ফেলল মাথা নেড়ে বলল 'কিচ্ছু না।'
মনোজ বলল-'অ্যাই রেখা ,বল না কি জন্য তুমি হাসছো?'
রেখা বলল ' বারে একটু হাসতেও পারবো না।'
রেখা বলল 'কিন্তু বাপের বাড়ির লোকজন আসবে তো ?পুলিশ কেস একটা হবে কি বলো?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ ,সে তো অবশ্যই। বাপের বাড়ি যদি চায় তো ওদের জেলহাজতে হয়ে যেতে পারে।'
রেখা বলল' জানো মেয়েটা নাকি বিএ পাস?'
মনোজ সন্দেহের সঙ্গে বলল' বিএ পাস মেয়ে দিয়েছে ভেন্দুর সঙ্গে ?ও তো মাধ্যমিক ও পাস করে নি?'
রেখা বলল 'বিয়ে তো বেশিদিন হয় নি ।এই ছয়-সাত মাস হবে?'
মনোজ বললো 'কি ব্যাপার বলো তো ,?একটা রহস্য রহস্য মনে হচ্ছে না ?আগের বউটাও চলে গেল।'
রেখা বলল'আগের বউটার নাকি ওদের ওখানে একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক...।'
মনোজ বলল 'তা এই বউটা চলে গেলো কেন?'
রেখা বলল 'সেটাই তো রহস্য?'
রেখা বলল 'শোনো, তোমার ডিম কলা আর লেমন জুস দিয়ে যাচ্ছি। এবার খেয়ে নেবে কিন্তু ।একদম না করতে পারবে না।'
মনোজ বলল 'রেখা এত কিছু একসাথে খেতে পারি নাকি?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে ।জুসটা তুমি পরে খাবে ।আধঘন্টা পর। 'এর মধ্যেই লিলি ,তুলি ওদের সবার আওয়াজ শোনা গেল।
মনোজ ঈশারায় দেখিয়ে বলল' ওই দেখো ওদেরও খিদে পেয়ে গেছে।'
রেখা বলল 'দেখেছ চৈতির মার সঙ্গে গল্প করতে করতে তো ,আমি ওদের খাবার দিতে ভুলে গেছি। এ বাবা কি হবে?'
রেখা বারান্দা থেকে বলতে লাগল 'দাঁড়া ,দাঁড়া ।যাচ্ছি যাচ্ছি।'
মনোজ হাসতে শুরু করল।
রেখা দুধ রুটি নিয়ে লিলি তুলিদের খাওয়াতে গেল।
রেখা মিলিকে বলল' তুই তো দুধ রুটি খাবি না ।তুই বাচ্চাদের সঙ্গে চেঁচাচ্ছিস কেন ?তোর তো এখন খাবার টাইম নয়। এই নে তুই বরং কটা বিস্কিট খা।'
মনোজ আবার ডাকতে লাগল' রেখা রেখা..আ.আ।'
রেখা ছুটে ছুটে আসলো বলল' কেন ,কী হয়েছে?'
মনোজ বলল' তোমার ফোন?'
রেখা বলল' আমার ফোন?কে করেছে?'
মনোজ বলল 'তোমার ও বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।'
রেখা বলল 'ও ,কাকিমা?'
মনোজ বললো 'ও সোনা ,ফোনটা ধরো এসে।'
রেখা এঁটো হাতটা কোনরকম সামলে নিয়ে ,বাঁ হাত দিয়ে ফোনটা ধরল । বলল 'হ্যাঁ কে?'
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বললেন 'আমি বলছি রে মা ,আমি।'
রেখা বলল'ও কাকিমা?'
কাকিমা বললেন'হ্যাঁ রে কেমন আছিস তোরা?
জামাই ঠিক আছে?'
রেখাএকটু খুশি মনে বলল' হ্যাঁ, কাকিমা ঠিক আছে এখন।'
কাকিমা বললেন 'আবার টেস্ট করিয়েছিস?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ করিয়েছি।'
কাকিমা বললেন' ভয়ের কিছু নেই তো?'
রেখা বলল 'না ,কাকিমা এবারকার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।'
কাকিমা বললেন 'যাক খুব ভালো কথা।'
এর মধ্যেই রেখার কাকা ফোনের কথাটা শুনতে পেয়ে বলল' কি হয়েছে ?কি হয়েছে ?আমাকে দাও ফোনটা।'
রেখার কাকিমা বললেন 'ওই দেখ তোর কাকু , তোর সঙ্গে কথা বলবেন।'
রেখা বলল' হ্যাঁ ,দাও ,দাও কাকুকে। ফোনটা দাও।'
রেখার কাকিমা ফোনটা রেখার কাকুর কাছে দিল।
কাকু বললেন'-কেমন আছিস রে ননী মা?'
রেখা বললো 'ভালো আছি কাকু। তুমি ঠিক করে তোমার ফিজিওথেরাপি করাচ্ছো?'
কাকু বললেন 'হ্যাঁ ,রে মা, করাচ্ছি ।আর তোর সেই চা ।ওটাও খাচ্ছি।'
রেখা হাসতে লাগল ।বলল 'যাক খুব ভালো কথা ।তাহলে তুমি গুড বয় হয়ে গেছো।'
কাকিমা বললেন 'গুড বয় না ,ছাই। শুধু বায়নাক্কা। তুই যাবার পর থেকে সমানে শুধু ননী ননী ননী। আবার কবে আসবে ননী ?এটা করত, সেটা করত, হাজারো কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে জানিস? আর খাবার ঝামেলা তো রয়েছেই।'
রেখা বলল'না ,না, না কাকু। কাকিমা যেভাবে বলছেন খেতে ,তুমি সেই ভাবেই খাও। তাড়াতাড়ি তোমাকে সুস্থ হতে হবে।'
কাকু বললেন 'আমি তো সেই ভাবেই খাই রে ।আরে না ,আমি চা টা একটু বেশি খেতে চাইছি তো, তাই তোর কাকিমা...
কথা শেষ না করতে দিয়েই রেখার কাকিমা বললেন 'ওই ওমনি নালিশ শুরু হয়ে গেল।'
রেখা বলল'ঠিক আছে ,ঠিক আছে ।তোমরা দুজনেই থামো ।তোমরা দুজনেই খুব ভালো । দুজনেই কথা শুনে চলবে, ঠিক আছে।'
কাকু বললেন 'ঠিক আছে রে, মা ।তোরা ভালো থাকিস আর জামাই পুরো সুস্থ হয়ে গেলে আবার বেড়াতে আসিস কেমন? ছিলিস মনটা আমাদের কত ভালো হয়ে গেছিল সবদিক থেকে।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ সেতো যাবোই ?'
কাকিমা বললেন' মাঝে মাঝে ফোন করিস রে মা?:
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,করব। আসলে এত ব্যস্ত ছিলাম সবসময় ফোন করে উঠতে পারি নি, জানো তো কাকিমা?'
কাকিমা বলেলেন 'আমি বুঝি রে।ঠিক আছে এখন ফোন রাখছি কেমন ?তুমি জামাইয়ের প্রতি ধ্যান দাও।'
মনোজ কথাটা শুনতে পেয়ে হাসছে রেখার দিকে তাকিয়ে।রেখা ছাড়া মনোজের জীবনটাই অর্থহীন।
্