উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮৪
মুশকিল আসান
মমতা রায় চৌধুরী
আজ শুভ বড়দিন সকাল থেকে শিখার মনটা যেন চলে গেছে সমুদ্র সৈকতের সেই ঢেউ এর কাছে, যা বারবার আবার তার কাছেই ফিরে আসে। কেন যে এই দুঃখ ,যন্ত্রণা ,কষ্টগুলো বারবার মনের ভেতরে নাড়া দিয়ে ওঠে? ভুলে তো অনেক কিছুই থাকতে চায় । অতীতকে মনে করতে চায় না। তবুও অতীতের ওপর ভিত্তি করেই বর্তমান ।তাকে অস্বীকার করে কি করে?'আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে ।এটাই তো স্বাভাবিক ।আজকের দিনটা তো সেরকমই কিছু ছিল। বিশেষ বিশেষ দিনগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসে আর ভেতরের দলা পাকানো স্বপ্নগুলো পোকার মতো নড়েচড়ে ওঠে। এতকাল যা সুখানুভূতি ছিল এখন সেগুলোই কেমন যন্ত্রণাদায়ক। ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না। কি করবে শিখা? দিব্যেন্দুর নামটা স্মরণ করতেই চায় না। ছিঃ যাকে সবথেকে বেশি আপনার মনে করেছিল। হৃদয়ের কাছাকাছি ।এমনটি করতে পারে? এজন্যই পৃথিবীর সব ছেলেগুলোর ওপর বিশ্বাস চলে গেছে। শিখা ভাবছে কখনও তো আর জানতে চাও নি ?কিসে আমার সুখ, কিসে আমার যন্ত্রণা। তোমায় ভালোবেসে শুধু পেয়েছি কাঁটার যন্ত্রণা।
পরক্ষণেই ভাবছে' কেন ওর কথা এতবার ভাবছি?
পাগল পাগল লাগছে। পার্ক স্ট্রিটে কি মজাই না করেছে? শুধু স্মৃতি।'
হঠাৎ শিখার ফোন বেজে উঠলো'
শিখা একটু কৌতুহলী আর ভাবলো 'আমার ফোন আজকের দিনে? কে? কি জন্য? ফোনটা কেটে গেল।
আবার ফোন বাজতে শুরু করলো।
ফোনের আওয়াজ শুনতে পেয়ে নিচে থেকে মাধুরী বলছে'শিখা ,শিখা ,শিখ আ.আ.আ তোর ফোন বেজে যাচ্ছে। ফোনটা ধর।'
মাধুরীর গলার আওয়াজ যেতেই 'শিখা ফোনটা ধরল।'
শিখা বলল' হ্যালো'।
ওপর প্রান্ত থেকে গানের আওয়াজ 'মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থেকো না। ঘরের দুয়ারে এসো।'
শিখা হেসে বললো 'ও কল্যাণ দা।'
কল্যাণ বলল 'মেরি ক্রিসমাস'।
শিখা বলল 'সেম টু ইউ।'
কল্যান বলল 'কী করছো এখন?'
শিখা বললো 'গল্প করছি।'
কল্যান বলল 'তাই?'
শিখা বলল 'তা হঠাৎ এত সকালে মনে পড়ল?'
কল্যান বলল 'কেন অপরাধ করে ফেললাম?'
শিখা বলল 'না ,না ।তা কেনো হবে?'
কল্যান বলল' তাহলে?'
শিখা বলল 'সকালবেলা গান ধরলেন। গান শুনে মন ভালো হয়ে যায়।'
কল্যান হেসে বলল'তোমার মত তো আর গান গাইতে পারি না।'
শিখা বলল 'তাই বুঝি দাম বাড়াচ্ছেন?'
ওদিকে মাধুরী বৌদি বলল' কে ফোন করেছে?'
মেজ পিসি বলছেন' 'তোমার ননদের কি আর ফোন করার লোকের অভাব?'
মাধুরী বলছে ' পিসিমা ঠিকই বলেছেন।বিএড এ ভর্তি হয়েছে ।সময়ে-অসময়ে অনেকেই ফোন করে কাজের কথা হয় ।ফোন করার লোকের অভাব হবে কেন?'
মেজ পিসি বললেন'আচ্ছা মাধু তোমার ননদের তো এখন বিয়ের ব্যবস্থাটা করতে পারো। এই বয়সে তো আমাদের কবে বিয়ে হয়ে গেছে।'
খুব মিষ্টি করে আর নিচু গলায় মাধুরী বলল ' না ,আমরা এখন শিখার বিয়ের কথা ভাবছি না পিসিমা ।'
শিখার কানে সব কথাগুলোই আসছে।
কল্যান বলল 'চুপ করে গেলে কেন? আমি কি কিছু ভুল বললাম?'
শিখা বলল 'না ,না। কল্যানদা ভুল কেন বলবেন?'
পিসিমা বলছেন মাধুকে' 'দেখো মাধুরী তুমি এখন এই সংসারের কর্ত্রী। আমাদের কথাগুলো হয়তো তোমার অতটা ভালো লাগছে না ।কিন্তু দেখো, সুরঞ্জন একা ইনকাম করে ।বৃষ্টিটা বড় হচ্ছে, সেদিকে একটু ভাবো ।নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথাটাও ভাবো?'
শিখা মনে মনে ভাবছে 'এই যে বিষ ঢালার জন্য সংসারে এসেছেন।'
মাধুরী বলল 'আমার মেয়ে বৃষ্টির ভবিষ্যৎটা দেখব ,শিখার ভবিষ্যৎটা দেখব না?'
পিসিমা বললেন 'তোমার কথায় ঝাঁঝ আছে। পরে তুমি কথাটা নিজের মনে ভেবে দেখো।'
মাধুরী বলল 'আমার শিখা স্বাবলম্বী হয়ে গেলে ,ওই তখন বৃষ্টিকে দেখবে ।আমাদের আর ভাবতে হবে না।'
পিসিমা বললেন 'নিজের মেয়ে নিজের মেয়েই হয় ।ননদ কখনো নিজের মেয়ে হয় না।'
কথাটা শুনে শিখার পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে রি রি করে উঠলো।
মাধু বলল' পিসিমা আপনার জলখাবারটা দিয়ে দি।'
পিসিমা বলেন' কি বানিয়েছো?'
মাধুরী বলল 'কেন আপনি যে গতকাল বললেন সকালে দালিয়া খাবেন ।সেটাই বানিয়েছি ।'
পিসিমা বলেন 'ডালিয়া বানিয়েছ?'
মাধুরী বলল 'কেন আপনি অন্য কিছু খাবেন?'
পিসিমা বললেন 'তোমাদের কি বানিয়েছো?'
মাধুরী বলল 'আজকে মুলোর পরোটা ,ক্যাপসিকামের চাটনি ,নতুন আলু মটরশুঁটি দিয়ে ডালনা মতো করেছি।'
পিসিমা বললেন' বলো নি তো আজকে মুলোর পরোটা করবে?'
মাধুরী বলল' কেন আপনি খেতেন? আসলে শীতকাল তো এখন ভ্যারাইটিজ পরোটা করি ওরা খেতে ভালোবাসে।'
পিসিমা বললেন' একটু টেস্ট করে দেখতাম?'
মাধুরী বলল' ঠিক আছে। আপনি খান না। অসুবিধা নেই তো।'
পিসিমা বললেন' তাহলে তোমার দালিয়াটা কি হবে?'
মাধুরী বলল 'ও নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না ।ও ঠিক আমরা খেয়ে নেব।'
শিখা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে জ্বালানোর একটা লিমিট আছে।'
পিসিমা বলেন' কিছু মনে করো নি তো মাধু?'
মাধুরী বলল' না ,না মনে করবো কেন?'
শিখা মনে মনে ভাবছে 'বৌদির জন্যই তো এসব কিছু হচ্ছে। এতটা বাড়াবাড়ি না করলে এরকম হতো না। সেদিন ই বললাম যে ,পিসিকে খবর দিয়ে আনতে হবে না। তা শুনলো আমার কথা।এবার নাও ঠ্যালা সামলাও।'
কল্যান বলল 'কিছু বিড়বিড় করে বললে?'
শিখা বলল 'কই না তো?'
কল্যান বলল' চুপ করে গেলে ,কথা বলছো না?'
শিখা বলল' না ,না ।বলুন না?'
কল্যান বলল 'আজকের দিনে কোথাও বেড়াতে যাও না?'
শিখা বলল 'আপনি যান না?'
কল্যান বললো 'প্রশ্নটা আমি আগে করলাম?'
শিখা বলল 'বেড়াতে যাওয়া মানে কোথায়? লোকাল ,না দূরে কোথাও?'
কল্যান বলল' না তোমারা কলকাতায় থাকো আজকের দিন তো ওখানে খুব ভালোভাবে সেলিব্রেট হয়।'
শিখা বললো 'হ্যাঁ তা হয়। গেলেই হয়। যাওয়া হয় না ।যাব কার সাথে?'
কল্যান বিড়বিড় করে বলল' বললেই পারতে?'
শিখা বলল 'কিছু বললেন?'
কল্যান বলল ' না তো। কিছু বললাম ?শুনতে পেলে?'
শিখা বলল 'শুনতে পেলে কি আর জিজ্ঞেস করতাম?'
কল্যাণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যা মেয়ে জেরার পর জেরা করবে। ভাগ্যিস শুনতে পা নি।
শিখা বললো' আপনি কি কিছু বললেন?'
কল্যান বলল 'কই না তো?'
শিখা বলল' তাহলে আপনার একটা বোধহয় রোগ আছে ।মাঝে মাঝে বিড়বিড় করেন ।কি বলেন বলুন তো বিড়বিড় করে?'
কল্যান যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো,বললো 'বিড়বিড় করি? কখন করলাম? তারপর বলল ঠিক আছে ঝগড়া ছাড়ো। গানের রেওয়াজটা করছো তো?'
শিখা বলল 'হচ্ছে রেগুলারলি করা হয় না? '
কল্যাণ বলল 'এটা কিন্তু ঠিক নয়?'
শিখা বলল' জানি ঠিক নয় ।রেগুলারলি করলে খুব ভালো হয় ।কিন্তু..?'
কল্যান বলল' কিন্তু?'
শিখা বললো 'এখন বিএড এর লেসন প্ল্যানগুলো করতে হচ্ছে তো ?খুব চাপ আছে।'
কল্যাণ বললো ' ও আচ্ছা, আচ্ছা।'
এর মধ্যে শিখা শুনতে পেল কল্যাণের ঘরে ফোনে রিং হচ্ছে,?
কল্যান বলল 'আমার একটা আর্জেন্ট ফোন এসেছে ধরি ।কিছু মনে করছো না তো?'
শিখা বলল' না আপনি ফোন এটেন্ড করুন?'
কল্যান বলল' 'ওকে।'
শিখাও মনে মনে চাইছিল ফোনটাকে ছাড়তে। নিচের পিসির কথাগুলো কানে এখনো বাজছে। ফলে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছিল না।
শিখা ফোনটা রেখে নিচে নেমে গেল।
নিচে গিয়ে ডাকছে 'বৌদিভাই ,বৌদিভাই ,বৌদিভাই।
বাথরুম থেকে আওয়াজ দিচ্ছে মাধুরী' এই আমি বাথরুমে আছি ।কিছু বলবি?'
শিখা বলল' না ,ঠিক আছে ।তুমি বেরোও তারপরে।'
মাধুরী বলল' খিদে পেয়েছে?'
পিসি কথাটা শুনতে পেয়ে বলল' কেন রে তুই নিয়ে খেতে পারিস না ।সবসময় বৌদি কে দিতে হবে কেন খাবার?'
শিখা বলল 'তুমি খাবার খাচ্ছ খাও না ।আমার ব্যাপারে তুমি এত কথা বলো কেন?'
পিসিমা বললেন 'কি বললি তুই?'
শিখা বলল' শুনতে পেয়েছো ঠিকই।'
পিসিমা বলল 'তুই হতিস আমাদের বাড়ির মেয়ে। তোর এত বেয়াদবি যদি না আমি ভেঙে দিতাম ?'
শিখা বললো 'নিজের ঘরটা আগে ভালো করে সামলাও না পিসি।'
পিসিমা বললেন' তুই এত বড় কথা বললি?'
শিখা বলল 'যেরকম প্রশ্ন ,সেরকম উত্তর পাবে।'
মাধুরী বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখছে শিখা পিসিমার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে।
মাধুরী শিখাকে বলল 'চুপ করো। বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে না।'
শিখা চুপ করে গেল আর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
মাধুরী বলল' চলে এসো। খাবে এসো।'
শিখা বলল' আমার খিদে নেই বৌদিভাই।'
মাধুরী বলল' কি তুই কোন সময় খাবার খাস আমি জানি না?'
শিখা কোন কথা বলতে পারল না ।তখনও কেঁদে যাচ্ছে।
পিসিমা বললেন 'এতে কান্নার কি আছে। যেটা সত্যি সেটাই বলেছি।'
মাধুরী একটি বিরক্তিভরে শিখাকে বলল' যা তু ই ওপরে যা। আমি খাবার পাঠাচ্ছি।'
শিখা বলল' ' আমার খিদে নেই।'
মাধুরী বলল' ঠিক আছে ।তুই ওপরে যা। যখন খিদে পাবে ।তখন খাবি।'
শিখা গটগট করে উপরে চলে গেল।
সব বুঝতে পারছে শিখার মনের কষ্টটা কিন্তু পিসিকে তো কিছু বলতে পারছে না ।
মাধুরী মনে মনে ভাবছে' শিখাকে পরে বুঝিয়ে বললেই ও সব বুঝতে পারবে।'
পিসিমা বললেন' মাধুরী আমাকে আরেকটা মুলোর পরোটা দাও তো।'
মাধুরী বলল' এই দিচ্ছি।'
মাধুরী পিসিমাকে মুলোর পরোটা আরেকটু তরকারী দিয়ে শিখার খাবারটা নিয়ে উপরে চলে গেল।
মাধুরী দেখছে 'শিখা জানলার ধরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ।'
মাধুরী আরেকটি জানলা খুলে দিল, পর্দাটা সরিয়ে দিল ।তারপর বললো 'এই জানলাটা খুলিস নি কেন?'
শিখা চুপচাপ আছে কোন কথা বলছে না।
মাধুরী বলল 'নে শিখা খেয়ে নে।'
শিখা বলল'' আমার খিদে নেই বৌদিভাই।'
মাধুরী বলল 'খিদে নেই বললেই হলো। মন খারাপ হয়ে গেছে?'
শিখা চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল মেঝেতে ঘষছে।
মাধুরী শিখাকে টেনে খাটেতে বসালো আর বলল 'পিসির কথা ধরতে যাস কেন? পিসিমার সঙ্গে কথা বলছিলি কেনো?'
শিখা বলল' কি সব কথা বলছিল?'
মাধুরী বলল 'আমি তো সব জানি। তা হলেও আমাদের বাড়িতে এসেছে। তাকে এভাবে বললে হয়?
শিখা রেগে বলল 'তুমি আর মেজোপিসির কথা ব'লো না তো বৌদি ভাই।এমনি আমার রাগেতে মাথা গরম হয়ে আছে।'
মাধুরী বলল 'তুই আমাদের কাছে কি সেটা তো আমরা জানি ।নে এবার খেয়ে নে লক্ষী মেয়ের মতো।'
শিখা বলল 'আমি খাব না।'
মাধুরী বলল' এবার কিন্তু আমি বকব। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।'
শিখার নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে মাধু একটু একটু করে মুলোর পরোটা ছিঁড়ছে আর শিখার মুখে পুরে দিতে লাগলো ।
শিখা বললো 'বৌদিভাই পিসি থাকলে আমাদের বাড়িতে একটা অশান্তি লাগিয়ে দেবে।'
মাধুরী নিজেকে দেখিয়ে বলল ' তোর চিন্তা কি আমি আছি তো।'
শিখা গলা জড়িয়ে ধরে বললো' সত্যি বৌদিভাই তুমি কত ভালো।'
মাধুরী বলল' তবে চিন্তা কি?'
শিখা একগাল হেসে বললো 'না, কোনো চিন্তা নেই। 'আমাদের মুশকিল আসান রয়ে গেছ না?'
শিখাকে খাইয়ে মাধুরী খাবার প্লেটটা নিয়ে নিচে চলে গেল আর শিখা বসে বসে তার বৌদি ভাইয়ের চলে যাওয়ার দিকটা অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল ।শিখার মনে হতে লাগলো তাঁর বৌদিভাই যেন সেই গ্রামীণ জীবনে চিরকাল নারীর সহনশীল প্রতিমূর্তি। বৌদিভাই আজকে এক পিঠ চুল ছেড়ে যখন নিচে গেল দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং লক্ষ্মী মা।
সত্যি বৌদিভাই থাকলে সবকিছুই মুশকিল-আসান হয়ে যাবে।