উপন্যাস
টানাপোড়েন ৭৬
পেটের শত্তুর
মমতা রায় চৌধুরী
সকালবেলা মরার সময় নেই, নিঃশ্বাস না নিতে পারলে ভালো হয়, এত কাজ, এত কাজ, উফ্ আর পারছি না।
আজ থেকে সুমিতার আসার কথা ছিল, আসলো না। এবার ওকে কাছ থেকে অব্যাহতি দিতেই হবে আর পারা যাচ্ছে না। হাতের কাজগুলো করতে করতে এসব ই ভাবছে ।হঠাৎ ফোন 'আমি কার, কে আমার , কী যে তার আমি হই...।'রেখা মনে মনে বলল'এ সময় আমি ফোন ধরতে পারছি না। আবার ফোন ''আমি কার,কে আমার ,কি যে তার আমি হই..।'
রেখা এক হাতে ঝাঁটা আর একহাতে ফোন ।'ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
অন্য প্রান্ত থেকে একটা সুরেলা কণ্ঠ ভেসে আসলো বললাম আমি 12 ক্লাসের ছাত্রী রিয়া বলছি
রেখা বলল' বলো?'
রিয়া বলল'আমি এ সপ্তাহে প্রজেক্ট দিতে পারব না ম্যাম ।প্লিজ পরের সপ্তাহে নিন।'
রেখার চরাম করে মাথাটা গরম হয়ে গেল ।মাথা ঠান্ডা রেখে বলল 'কেন দিতে পারবে না কেন?'
রিয়া বললো 'আমার দাদু মারা গেছে।'
রেখা বললো 'খুবই দুঃখের খবর কিন্তু প্রজেক্ট তো তোমাদের অনেক আগে দেয়া ছিল?''
রিয়া বলল' হ্যাঁ ম্যাম ।কিন্তু আমি তো গ্রুপে এড ছিলাম না ।আমি সব তথ্য জানতে পারি নি।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে কিন্তু বড়দি যদি এই সপ্তাহে নম্বর চেয়ে পাঠায় ,তাহলে তো আমার অসুবিধা হবে ।তুমি খাতাটা ঠিক দেবে তো?'
রিয়া বললো' হ্যাঁ ম্যাম ।আমি দিয়ে দেবো।'
রেখা বলল 'ok
রেখা ফোনটা কেটে মনে মনে ভাবল নম্বরটা তো বসিয়ে দিতে পারবে কিন্তু যদি খাতা না দেয় তাহলে তো অসুবিধা হবে ।এই মুহুর্তে বিশ্বাস করা ছাড়াও তো কোন উপায় নেই দেখাই যাক।'
এর জোমধ্যে আবার কলিংবেলের আওয়াজ ' জয় গনেশ, জয় গনেশ জয় গনেশ দেবা...।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রেখা দরজা খুলতে গেল
অন্য প্রান্ত থেকে গলা ভেসে এলো'বৌদি ,আমি পার্থ।
রেখা বললো "এসো ভেতরে এসো পার্থ।'
পার্থ বলল বৌদি আমি একটা দরকারে এসেছি।'
রেখা বলল' হ্যাঁ হ্যাঁ পার্থ বলো?'
পার্থ বলল 'বৌদি আজকে একটু আপনার সময় হবে?
রেখা বলল' কেন বলো তো ভাই?'
পার্থ বলল'আসলে আমি বাড়ী থাকবো না তো ওই জন্য একটু মায়ের কাছে থাকা।"
রেখা বললো 'এখনো তো বুঝতে পারছি না ভাই ।স্কুল থেকে যদি বড়দি ফোন করেন তাহলে তো আমাকে স্কুলে যেতে হবে ,না হলে আমি থাকবো।
পার্থ বলল' ও তাই?'
রেখা বলল 'কেন তুমি কি খুব দূরে যাচ্ছ?'
পার্থ বলল "আমার ফিরতে ঘন্টা দেড়েক লাগবে বৌদি।'রেখা বলল' তুমি কখন বেরোবে?'
পার্থ বলল'আমি হবিস্যিটা করে বেরোবো ভেবেছিলাম।'
রেখা বলল 'আজকে তো তোমার লাস্ট হবিস্যি না?'
পার্থ বললো 'হ্যাঁ ,বৌদি।'
রেখা বলল'ঠিক আছে এখনো দিতে বড়দি ফোন করেন নি ।হয়তো বেরোবো না।'
পার্থ বলল 'আপনি থাকলে আমি একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আপনি যেভাবে মাকে বোঝান, আর মা আপনার কথাটা ভাল শোনে।'
রেখা বলল 'রাখি দি আসেন নি?'
পার্থ বলল' কয়েকবার ফোন করেছিলাম কিন্তু কোন রেসপন্স নেই।'
রেখা বলল "রাখিদির এত রাগ কিসের তোমাদের প্রতি?'
পার্থ বলল' কি বলবো পরিবারের কথা বলুন বৌদি?'
রেখা বলল ' না' না ।আমার এই ধরনের প্রশ্ন করাটা ও ঠিক নয় ,কারণ এটা নিতান্তই তোমাদের একেবারে পারিবারিক বিষয়।'
পার্থ বলল 'এ মা না ।ছিঃ ছিঃ ছিঃ বৌদি, আপনি তো আমাদের পরিবারের ই একজন।'
রেখা বলল 'তা হলেও?'
পার্থ বলল 'না বৌদি, এমন কোনো ব্যাপার নেই।
আসলে দিদি চাইছিল সম্পত্তি আর মায়ের কিছু পারিবারিক গয়না আছে ,সে গয়নাগুলো তাকে দিতে হবে সব।'
রেখা বলল 'ও বাবা তাই নাকি?'
পার্থ বলল "হ্যাঁ বৌদি।'
রেখা বললো কিন্তু আমি তো শুনেছি তোমার দিদির অবস্থাপন্ন পরিবারে বিয়ে হয়েছে ওরাতো কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে ভাড়াই পায় অনেক।
পার্থ বলল 'হ্যাঁ বৌদি ,একদম ঠিক। তাছাড়া জামাইবাবুর নিজস্ব বিজনেস রয়েছে।'
রেখা বললো' মাসিমার কি অভিমত?
মা শুধু বলেছে 'ঠিক আছে, দেয়া হবে। আগে তোর ভাইদের সবার বিয়ে হোক।'
রেখা বলল' তাহলেও ভাইকে একবার দেখতে আসা উচিত ছিল।'
পার্থ বলল' কি বলব, বলুন?'
রেখা বললো 'ঠিক আছে পার্থ ,তুমি বাড়ি যাও কোথাও বেরোবে বলছিলে।'
পার্থ বলল 'হ্যাঁ বৌদি কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল। আমি আসছি।"
রেখা বলল' 'তুমি নিশ্চিন্তে যাও ।এদিকে টেনশন করতে হবে না।'
'পার্থ বলল ''হ্যাঁ, বৌদি।'তা আমি জানি।'
রেখা বলল "হ্যাঁ ,ভাই এসো ।তবে মাসিমা একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই যাবে তোমাদের এই পারিবারিক গন্ডগোলটা নিয়ে।
সবেমাত্র দরজাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় আবার ফোন বেজে উঠলো"আমি কার ,কে আমার, কি যে তার আমি হই।''
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
অপরপ্রান্ত থেকে বললেন 'ননী ,আমি কাকিমা বলছি।'
রেখা বলল'বলো? তোমার গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?'
কাকিমা বললেন'আমাদের কেউ শান্তিতে থাকতে দেবে না রে।'
রেখা বলল 'কেন কি হয়েছে?'
কাকিমা বললেন" সমু এসেছিল?'
রেখা বলল" হ্যাঁ ,তাতে কি হয়েছে?'
কাকিমা বললেন'সম্পত্তি ওকে লিখে দিতে হবে।"
রেখা বলল 'কেন এসব করছে।'
কাকিমা বললেন 'পেটের শত্তুর,শত্তুর।'
রেখা বলল 'ওকে কে বোঝাবে বলো তো?'
কাকিমা বললেন 'ওর সাথে বাদ বিতন্ডা হলো।''
রেখা বলল"?' কাকু কি বলল?'
কাকিমা বললেন' তোর কাকু তো যাচ্ছে তাই বলল ।আর বলল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে।'
রেখা বলল' কাকুর শরীরটা এমনি খারাপ।'
কাকিমা বললেন 'পেটের মেয়ে হয়ে বুঝলো না রে ননী ?তুই বুঝলি।'
রেখা বলল 'ও কাকিমা তোমরা মানি অর্ডার টা পেয়েছ?'
কাকিমা বললেন 'এখনো তো হাতে পা ই নি।'
রেখা বলল 'এর মধ্যেই পেয়ে যাবে দেখো।'
কাকিমা বললেন' তোকে তো আমি বারণ করেছিলাম পাঠাতে।'
রেখা বলল' এব্যাপারে একটা কথা বলবে না।'
কাকিমা বললেন 'কি বলব আর বল, যা ভালো বুঝিস কর।'
রেখা বলল 'এই তো লক্ষী মেয়ের মত কথা বলেছ।'
কাকিমা বললেন কিন্তু রোজ রোজ এই সম্পত্তি মেয়ে আর অশান্তি ভালো লাগে না মা। ভেতরে ভেতরে একটা টানাপোড়েন থেকেই যায়।
রেখা বলল ' কি আর করবে বলো?'
কাকিমা বললেন 'ঠিকই বলেছিস। পেটের শত্তূর তো
কত জ্বালা যে আছে কে জানে?'
রেখা বলল 'ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে কাকিমা ।চিন্তা করো না।'
কাকিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন 'ফোন রাখছি রে ভালো থাকিস?'
এরপর ফোন কেটে গেল রেখা ভাবতে লাগল বাপরে বাপ একের পর এক ফোন।'এরপর আবার পার্থ
দের বাড়িতে যেতে হবে।'
তবে কাকিমার কথার মধ্যে দিয়ে আজ জীবন সম্পর্কে একটা নতুন দিক উন্মোচিত হলো। সন্তান ভবিষ্যৎ জীবনের পিতা-মাতার একমাত্র অবলম্বন সেই সন্তান যখন পিতামাতাকে কুঠারাঘাত করে তখন তাদের হৃদয হয় ক্ষতবিক্ষত। সন্তানকে ঘিরে যে সোনালী স্বপ্ন লালিত হয় পিতা-মাতার মনে ।সে স্বপ্ন ধূসরতা আর যন্ত্রণায় ভরিয়ে দেয়। রেখা তাই মনে মনে ভাবে তার সন্তান হয় নি সে এক যন্ত্রনা আবার হলেও যন্ত্রনা। তবুও পিতা মাতা আশায় বুক বাঁধে সন্তানের জন্য।