উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮০
হৃদয়াকাশ
মমতা রায় চৌধুরী
রেখার চোখে শুধু জল আর জল। এ কোন নজর লাগল তার সন্তানদের প্রতি। অবজ্ঞা, অবহেলা উপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই জোটে না ওদের ।তাই রেখা ও মনোজ 'ওদেরকে একটা আলাদা জীবন দিতে তার পরিবারের সাথে লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটা উটকো ঝামেলা হয়ে গেল কোথা থেকে একটা কুকুর এসে কামড়ে দিয়ে গেল।
একটু আগে মন্টু ডাক্তার এসেছিল ভ্যাকসিন দিয়ে গেলো ।তবে হ্যাঁ ডাক্তারবাবু খুব ভালো। কি জানি কেন উনি ভ্যাকসিনের কোন টাকাই নিলেন না।
মনোজ যখন বলল 'ডাক্তার বাবু আপনাকে কত দিতে হবে?'
মন্টু ডাক্তার বললেন ' কিছু না।'
মনোজ অবাক হয়ে বলল 'সে কি ডাক্তারবাবু আপনার ভিজিট , ভ্যাকসিনের দাম নেবেন না?'
ডাক্তারবাবু বললেন 'না, না ।আপনারা যে রাস্তার কুকুরগুলোকে এত ভালবাসেন ,রোজ ওদেরকে খেতে দেন ।ওরা তো অনাদরে-অবহেলায় বড় হয়। কে এত ভালবাসে বলুন তো?
মনোজ বলল'ডাক্তারবাবু এদেরকে নিয়ে রোজ আমার পরিবারের ভেতরে অশান্তি, বাইরে রাস্তায় খেতে দিলে অশান্তি ।তবুও আমার স্ত্রী কিন্তু এগুলোকে একদমই গায়ে মাখে না।'
ডাক্তারবাবু বললেন 'ওদেরকে ভালবাসুন ।ওরা আপনাদের জন্য জীবন দিয়ে দেবে। মানুষ বেইমান। এরা নয়।'
মনোজ বলল'তবে আপনি যে কাজটা করলেন ডাক্তারবাবু এটা তো আপনার মহানুভবতার প্রকাশ।'
ডাক্তারবাবু বললেন 'দেখুন ,আমাদের পেশাটাই হচ্ছে সেবার কাজ। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের কেউ মূল্য নিতে হয়। কিন্তু আপনারা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।'
মনোজ বলল 'কিভাবে ডাক্তার বাবু?'
ডাক্তারবাবু বললেন 'এই যে আপনারা যদি ওদের জন্য এত কিছু করতে পারেন? তাহলে আমি সামান্য একটু ওদের জন্য সেবা করতে পারি না?'
মনোজ বলল' সবাই যদি এরকম হত পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো।'
ডাক্তারবাবু বললেন' পৃথিবীতে তো সবাই একরকম হবে না ,এরকম দু-চারজন মানুষই তো থাকবেন তাই না?'
মনোজ বলল' হ্যাঁ ,তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন আপনি।'
ডাক্তারবাবু বললেন 'আসুন না আমরা যে কজন ই পারি আমরা ওদের জন্য কিছু করি।'
মনোজ বলল 'একদম ডাক্তারবাবু।'
রেখা অবাক হয়ে বলল' ডাক্তারবাবু এরকম বললেন।'
অথচ এই ডাক্তারবাবুর নামে কতজন কত বাজে কথা বলেছেন। ডাক্তারবাবু হচ্ছেন চামার ,চশমখোর । ছিঃ ছিঃ। ভাবতেই কেমন কষ্ট হচ্ছে।
মনোজ বলল 'মানুষকে না সবসময় বাইরে থেকে দেখে বিচার করা যায় না। দেখ না যাকে চশমখোর ,চামার ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন লোকে ।আজ তার ভেতরটা দেখো এক মহানুভবতা ।
রেখা বললো' ঠিকই বলেছ।'
মনোজ বললো 'মিলি এখন কি করছে? ঘুমাচ্ছে?
রেখা বলল 'হ্যাঁ দেখলাম যে ঠাণ্ডায় কাঁপছে। আমি আবার কিছু ওর গায়ে চাপা দিয়ে আসলাম।'
মনোজ বললো 'দেখো জ্বর-টর যদি আসে তাহলে ওকে আবার একটু ওষুধ খাওয়াতে হবে।'
রেখা বলল "আমাদের মিলিটা দেখো কত বোঝে আমিও ওর কাছে গিয়ে বললাম 'মা তোমার শীত করছে? চোখটা মেলে তাকালো , যেই বললাম শুয়ে পড়ো ,মাথাটা একদম কাত করে দিয়ে শুয়ে পড়ল।'
মনোজ বলল 'জানো আজকে কি কান্ড করেছে?
রেখা বললো ' কি?'
মনোজ বলল 'বাচ্চারা মিলিটাকে যেই দেখতে পেয়েছে ,ওদের তো আটকে রাখা হয়েছে। লিলিটা একবার দেখি এমন চিৎকার শুরু করলো সঙ্গে পাইলট, তুলি ,ওরাও।'
রেখা বলল' লিলি যখন চেঁচায় না, একবার দেখবে গ্রীলটা ধরে চিৎকার করবে আবার একবার ভেতরে গিয়ে চিৎকার করবে।'
মনোজ বলল' এবার তুমি চিন্তা মুক্ত হয়েছ রেখা?'
রেখা বলল' হ্যাঁ । ভ্যাকসিন না হলে আমি চিন্তা মুক্ত করতে পারছিলাম না। থ্যাংকস গড।'
মনোজ বলল 'এবার কি এক কাপ ব্ল্যাক কফি পাব ম্যাডাম?
রেখা হেসে বলল 'একশোবার পাবে।'
রেখা রান্নাঘরের দিকে গেল কফি বানাতে এমন সময় ফোন আসলো। রিং হল'আমি তো সুখেই আছি..।'
রেখা রান্নাঘর থেকে কফিটা কাপে ঢালতে ঢালতে বললো 'কি ব্যাপার আজকাল তুমিও রিংটোন চেঞ্জ করছো?'
মনোজ বলল 'বাহ, তুমি করতে পারো ,আমি করতে পারি না?'
রেখা বলল 'অফকোর্স পারো।'
রেখে হাসতে হাসতে বলল' তো ফোনটা ধরো?'
এর মধ্যে ফোন কেটে গেল।
রেখা রান্নাঘর থেকে দুকাপ কফি নিয়ে এসে ডাইনিং এ টেবিলের ওপরে রাখল মনোজ পাশে সোফাতে বসেছিল। বলল 'এসো এখানে খাবে ?না তোমার কাছে গিয়ে দেবো?'
মনোজ বলল' এখানে এসো।'
রেখা বলল' ইস সসস'।
মনোজ বলল 'একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে বন্ধু। কাছে থেকো, কাছে থেকো।'
রেখা বলল' কি ব্যাপার এত রোমান্টিক?'
সত্যিই মনোজের হৃদয়াকাশ আজ প্রেমেতে ভরপুর।
মনোজ বলল 'সেই কবে থেকে আমি হেঁটে চলেছি পৃথিবীতে। অপেক্ষায় অধীর দু'চোখ কেউ রবে এ পথে ।ভাবি নি কখনো আমি ।তুমি আমার সেই তুমি। 'তোমায় দেখে চোখের পাতায় বড় সুখে সে চোখে জল ভেসে যায়। জলে ভালোবাসি আমি তোমাকে।'
রেখা বলল' ভালো গান গাইছো?
মনোজ বলল 'কেন গানটা ভালো না?'
রেখা বলল 'অফকোর্স ভালো।'
রোমান্টিকতায় যেন রসভঙ্গ হলো।
এরমধ্যে আবার ফোন বেজে উঠলো আমি তো সুখেই আছি।'
রেখা বললে 'এবার ফোনটা ধরো।'
মনোজ ফোনটা রিসিভ করে বলল ' হ্যালো।'
কিরে কি করছিস?
মনোজ বলল 'এই তো ভাই চলে যাচ্ছে।'
সুরঞ্জন বলল ' শরীর ঠিক আছে?'
মনোজ বলল' হ্যাঁ ,আগের থেকে অনেক বেটার।'
সুরঞ্জন বলল'হ্যাঁ রে, রেখা লিখছে তো নিয়মিত? অসাধারণ লেখে।'
মনোজ বললো' ও যা চাপের ভেতরে আছে, কি করছে, কে জানে?'
সুরঞ্জন বলল'-শিখা তো ওর বহুৎ বড় ফ্যান।'
মনোজ বলল' রেখাকে জানিয়ে দেবো।'
ওদিক থেকে মাধু বলল বৃষ্টিকে নিয়ে আসতে হবে ওর ছুটি হয়ে গেছে।
সুরঞ্জন মনোজ এর সাথে ফোন করে কথা বলতে বলতেই বলল হ্যাঁ এই তো যাচ্ছি। আচ্ছা, রাখি রে মনোজ। ভালো থাকিস।'
মনোজ বলল' তুইও ভালো থাকিস আর ফোন করিস মাঝে মাঝে।
সুরঞ্জন বলল ' ঠিক আছে। তুই ও মাঝে মাঝে ফোন করিস।'
এরমধ্যে রেখার ফোন বেজে উঠলো। মনোজ নিজের ফোন কলটা কেটে ,দেখছে রেখার ফোন বেজে যাচ্ছে ।রেখা ধারেপাশে কোথাও নেই। রিংটোনে গান বাজছে
'তুমি কি এমনি করে থাকবে দূরে ,আমার এ মন মানে না..।'
মনোজ বলল' রেখা ,রেখা ,তোমার ফোন বেজে যাচ্ছে।'
রেখা ছাদের থেকে শুনতে পেয়ে বলল ফোনটা ধরো আমি কম্বলটা রোদে দিতে এসেছি ।ঘরে তো একটু ও রোদ ঢোকে না।'
মনোজ ফোনটা ধরতে গিয়ে ফোনটা কেটে গেল।
আমাদের এখান থেকে নেমে এসে বলল কে ফোন করেছিল?
মনোজ বলল' খেয়াল করি নি।'
রেখা বলল' মিস কল টা দেখো না?'
মনোজ বলল' হ্যাঁ ,দেখছি।'
রেখা বলল 'পেলে ?কে করেছে?'
মনোজ বলল' তোমার কাকিমার ফোন?'
রেখা চিন্তিত ভাবে বলল' কাকিমার?'
মনোজ বললো 'ফোনটা ধরাব?'
রেখা বলল-'হ্যাঁ, ধরাও তো?'
মনোজ নম্বরটা ডায়াল করল।'রিং হয়ে গেল ' কি দিয়ে পূজিব ভগবান তোমায়...।'
মনোজ বলল 'এই নাও ফোন ধরো, রিং হচ্ছে।'
রেখা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
কাকিমা বললেন' ভালো আছিস সবাই।'
রেখা বলল'এই আছি।'
রেখার কাকিমা বললেন'ননী, একটা খারাপ খবর আছে রে?'
রেখা বলল'কি খবর?'
কাকিমা বললেন'বিপাসার জামাইবাবু মারা গেলেন।'
রেখা অবাক হয়ে ব্যাঘ্রভাবে বলল 'কিভাবে ?কবে?'
কাকিমা বললেন ' গতকাল। স্ট্রোক।'
রেখা বললো 'কি অবস্থা ভাবো ?এদিকে বিপাশার বর জেলে আছে। ভাবা যাচ্ছে না।'
কাকিমা বললেন' সত্যিই ওদের দুই বোনের কপালটা এতটাই খারাপ যে ,কি হবে? কে জানে?'
রেখা বলল' তোমরা সবাই ভালো আছে তো?'
কাকিমা বললেন 'ওই আছি ।'
রেখা বললো'মানি অর্ডার টা পেয়েছ?'
কাকিমা বললেন 'হ্যাঁ পেয়েছি।'
রেখা বলল'কাকুর ট্রিটমেন্ট করে করাও।'
কাকিমা বললেন 'তুই আমার পেটের মেয়ে নয় তবুও যা..।'
রেখা বলল' ও, তাহলে তুমি আমাকে মেয়ে বলে ভাবো না তাই তো।
কাকিমা বললেন ' না মা এসব বলতে নেই আর ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।'
ওদিকে মনোজ বলতে লাগলো মিলি একটু খেতে দাও।
রেখা বলল ' হ্যাঁ দিচ্ছি ।'
কাকিমা বললেন আমি ফোনটা রাখছি পরে কথা হবে ননী। ভালো থাকিস।'
ফোনটা কাটার পর কাকিমা ভাবতে লাগলেন হৃদয়ের টান। রেখা তার নিজের মেয়ে নয় তবুও আজ তার হৃদয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে। তার নিজের মেয়েকে নিয়ে সবসময় টানাপোড়েন।
এদিকে রেখা ভাবতে লাগলো মিলি র যদি কিছু হয়ে যেত, তাহলে রেখার হৃদয়াকাশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।