০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর' উপন্যাস পার্ব ১০০






উপন্যাস 

টানাপোড়েন১০০
রেখার ইতিকথা
মমতা রায় চৌধুরী


রেখা সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। রিম্পাদি ট্রান্সফার হয়ে যাবার পর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসা কত কথাই না  রিম্পাদির সঙ্গে বলেছে। একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এসবই ভেবে ভেবে রাত গভীর হয়, দু চোখ ক্লান্ত তবুও চোখের পাতা এক হতে চায়না। এক আকাশ বুকে আশা নিয়ে প্রহর কাটে তার।আজকাল মনোজ ও খুব বেশি একটা কথা বলে না। পুরোপুরি জীবনটা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যেতে বসেছে। বেঁচে থাকার মধ্যে আছে তার লেখা। আজকাল লেখাটাই রেখাকে প্রাণ দেয়। আরে বাবা দেবেই বা না কেন 'সিড়ি'ত্রিকার সম্পাদক রেখাকে তাড়া দিয়ে লেখা আদায় করে নেন। সত্যি লেখায় যেন একটা আলাদা অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় রেখা ।
আজকাল মনোজও বেশিরভাগ সময়টা ড্রইংরুমে কাটায়। বলে তো অফিসের চাপ বেড়েছে। রেখা চিরকালই কারোর কোন পার্সোনাল ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। মনে পড়ে যায় যখন প্রথম বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে  আসে ।রেখার শাশুড়ি মা অবশ্য প্রথম থেকেই রেখাকে পছন্দ ছিল না। শুধুমাত্র ছেলের পছন্দ বলে নাও করতে পারেন নি।  
ননদ সে তো বলেই দিয়েছিল 'কি দরকার ছিল ভাই, তোর অন্য কাস্টে বিয়ে করা? আমাদের কালচারের সঙ্গে মিলাতে পারবে?'
যদিও রেখাকে এই কথাগুলো মনোজই বলেছিল।
বিয়ের পর থেকে রেখা হাড়েহাড়ে বুঝতে পেরেছিল সত্যি অন্য কাস্টে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি।
বিয়ের পর ফুলশয্যার পরের দিন শাশুড়ি মা রেখা কে যেভাবে বলেছিল'কাজের মেয়ে মামুনকে দিয়ে
আজও মনের ক্যানভাসে রং তুলি নিয়ে আঁচড় কেটে যায়। এইতো ফুলশয্যার পরের দিন
রেখা  খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন বাড়ি কেমন যেন একটা সবসময় ভয় ভয় কাজ করছিল। এত বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি সকালে উঠতেই হবে। রেখাকে কিন্তু কেউ কিছু বলেই দেয় নি, কি করতে হবে, না করতে হবে। যেন দূরে সরিয়ে রাখার একটা প্রবণতা। কত আশা নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এসেছিল। ফুলশয্যার পরের দিনই বুঝতে পেরেছিল এই আশা আদপেও  বাস্তবায়িত হবে না। তবুও 'বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।'
রেখা ভেবেছিল' সে তো একজন শিক্ষিকা এত বড় একটা পরিবেশে সকলের সঙ্গে মানিয়ে ,স্টুডেন্টদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে স্নেহ দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে তাদেরকে মানুষ গড়ার কারিগর হতে পারে। তবে,এই সংসার টা বাদ যাবে
 কেন? 'যতই তারা দূরে ঠেলে দিক রেখা ভালোবাসা দিয়ে সকলকে মনের বন্ধনে বেঁধে রাখবে। ভালোবাসায় সব হয়। কিন্তু এই আশা আর কবে বাস্তবায়িত হবে?
বিয়ের পর থেকেই দেখে এসেছিল এ বাড়িতে কাজের মেয়ে সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বাস্তবে তার সঙ্গে কি হয়েছে? ফুলশয্যার পরের দিনই তাকে ঝাটা ধরতে হয়েছে।
আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা
'এতটা বেলা হয়ে যাওয়ার পরেও রেখা যে ঘরে থাকে মানে যে ঘরটাতে থাকতে দেয়া হয়েছে, সেই ঘরে কেউ ঝাট দিতে আসেনি বা ঘর কেউ মুছতে ও আসেনি।'
রেখা একটু অবাক হয়ে গেল নতুন বিয়ে হয়েছে । কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছে 
না ।কেমন একটু সংকোচ বোধ হচ্ছে।
এমন কি কেউ চা খাবার জন্যও  ডাকছেন  না।
মনে দ্বিধা নিয়ে রেখা  বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিজে একটা কোনরকমে ঝাটা খুঁজে পেল সেটা দিয়েই ঘরটাকে ঝাট দিল। এরমধ্যে দেখতে পেল তাদের ঘরটা বিয়ের আগে নুতন করা হয়েছে কিন্তু সেই ঘরের ভেতরে দেওয়াল আলমারিতে সিমেন্ট বালি লেপ্টে আছে। রেখা মনে মনে ভাবছে তাইতো এইগুলোতে এত নোংরা পড়ে আছে কিছুটা পরিষ্কার করে নি।
যেইনা ভাবা অমনি কাজ। একটা ন্যাকড়া জোগাড় করে  মোছামুছি করছে ঠিক সেইসময় কাজের মেয়েটি এসে বলল 'বৌদি কি করছো?'
রেখা বলল 'এইতো ভাই ঘরটা একটু ঝাট দিলাম আর এইগুলো একটু পরিষ্কার করছি।'
মামুন জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল'ও তাই?'
এরপর মামুন দ্রুত ছুটে চলে গেল নিচে।
তখনো জানে না রেখা যে নিচে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে ।রেখাকে নিয়ে সারাবাড়ি তোলপাড় হয়ে গেছে। হঠাৎই একটা কথা কানে আসলো'রেখা র শাশুড়িমা মামুন মেয়েটাকে বলছেন 'এবাড়িতে এসব চলবে না ।এবাড়িতে কিছু সংস্কার আছে। বাসি কাপড়ে কেউ ঘর ঝাট দেবে না বা অন্য কাজ করবে না।  গিয়ে বল ।'
একটু পরেই মামুন বলে মেয়েটি ছুটতে ছুটতে আসে সিঁড়ি দিয়ে। এরপর এক হাত জিভ বের করে হাঁপাতে 
থাকে।  হাঁপাতে হাঁপাতে বলে  'বৌদি তোমাকে বাসি কাপড়ে এই সমস্ত কিছু করা যাবে না।'
রেখা বলল' আমি বাসি কাপড়ে নেই 
গো। আমি কাপড় চেঞ্জ করেছি ফ্রেশ হয়ে।
তারপর রেখা বললো তুমি জানো এই ঘর এই মাসি টা কি মুছতে আসবে গো? মামুন বলল না না মনে হয় কেউ মুছতে আসবেনা জানো বৌদি।
রেখা বলল আমি কি করে জানব ভাই আমিতো বাড়িতে নতুন তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।'
মামুন আর কিছু না বলে সরাসরি নিচে চলে যায়।
 একটু পরেই রেখা খেয়াল করে তাদের পাশের ঘরটাতে ওর শাশুড়ি মা থাকে সেই ঘরটা মুছে ওই মাসি বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রেখার ঘর বা রেখার ঘরের সামনের বারান্দা কিছুই মুছলো  না।
অথচ এ বাড়িতে আসার পর শাশুরি মা কিন্তু কিছুই বলে দিলেন না    কি করতে হবে ,না করতে হবে। রেখা তো  নতুন তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে কিছুই বলেনা।
অথচ রেখা যখন নিজের ঘরে নিজে কাজ করতে যাচ্ছে তখনও খুঁত ধরে ধরে বেড়াতে লাগলেন।
যাইহোক একটু পরে আবার সেই মেয়েটি উঠে আসে এবং বলে 'বৌদি তুমি কিন্তু এখন এসব কিছু করতে ব'সো না। '
রেখা বলে' তাহলে কি ঘর এরকমই পড়ে থাকবে?'
মামুন বলে সেটাও আমি বলতে পারব না।'
রেখা স্নান করে নিজেই একা নিচে নেমে গেল।শাশুড়ি মা যে ঘরটা বসেন সেই ঘরে গিয়ে বসলো। ঘরে ঢুকতেই ননদ আর আর শাশুড়ি মা একান্তে কি কথা বলছিলেন , কে জানে? রেখাকে দেখে চুপ করে গেলেন। আর রেখার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন মনে হল রেখা কত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
এসব ভাবছে হঠাৎই রেখার ফোনে একটি ম্যাসেজ এসেছে'মনের জানালা খুলে রেখে দেখো তাকিয়ে সোনা ঝরা রোদ্দুর উঁকি মারছে তোমায় ডেকে।'সুপ্রভাত
রেখা মেসেজটা পড়ে একটু চমকে যায়' বাহ খুব সুন্দর লেখা তো ?কে পাঠালেন?'
আজকাল বেশ সুন্দর সুন্দর মেসেজ আছে সকালবেলা মনটাই ভালো হয়ে যায় রাত্রির ক্লান্তি ,অবসাদ নিশীথের মতো গভীরতা নিয়ে রেখার মনে দাগ কেটে যায় সকালের ভোরের আলোয় আবার নতুন করে খুঁজে পায় তার নতুন ঠিকানা। ভাবতে ভাবতেই মেসেজটা খোলার পর দেখছে এটা এসেছে পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে।
রেখা সত্যিই মনে মনে খুব খুশি হলো। তার মরে যাওয়া ইচ্ছে গুলোর মাঝে যেন বেঁচে ওঠার এক চিলতে রোদ্দুর।
আবার ভাবতে থাকে রেখা সেই অতীতের কথা। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বোধহয় মেয়েদের কোনদিন আপন হয় না আপন করতে চাইলেও। রেখার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বারবার প্রমাণ করে
 দেয় ।এইতো বিয়ে হয়েছে শীতকালে শ্বশুরবাড়িতে তখন গরম জলের ব্যবস্থা ছিল নিচে। শাশুড়ি মার বাথরুমে। গরম জলে যারা স্নান করবে তাদের ওখান থেকে নিয়ে ই করতে হবে। এটা জানাই ছিল না রেখার।
পরপর কদিন ঠান্ডা জলে স্নান করে ঠান্ডা লেগে যায় রেখার। কি করবে কাকে বলবে? মনোজও  তো কিছু বলছে না। মাসি শাশুড়ি রা সেই বিয়ের আগে এসেছেন তখন অব্দি রয়ে গেছে ন। এখানে ঠান্ডা লাগা দেখে শুক্লা মাসি বললেন'কি করে খা তুমি ঠান্ডা জলে স্নান করো?
রেখা কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে।
শুক্লা মাসি বলে কেন নিচের থেকে গরম জল নিয়ে আসবে? এ বাড়িতে কাজের লোক অব্দি গরম জল পায় আর তুমি বউ হওয়া সত্ত্বেও গরম জল…?
সন্ধ্যা মাসি বলে' কালকে অবশ্যই গরম জল নিয়ে আসবে কেমন?
এদিকে এমন খিদে পেয়েছে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। এ বাড়িতে নাকি নিয়ম আছে পুরুষদের সবার খাওয়া হবে তারপর মহিলাদের।
রেখা মনে মনে ভাবছিল যদি নিজের বাড়ি হত তাহলে কখন মা খাবার দিয়ে যেত। শুধু জলের বোতল থেকে জল খাচ্ছে।
এমনি করেই দিন কেটে যাচ্ছিল কিন্তু ঝামেলা বেধে গেল। পরেরদিন এত ঠান্ডা জমে যাওয়ার উপক্রম। রেখা ভাবল মাসিরা তো বলেছিল গরম জল নিয়ে আসতে। তাহলে একবার গেলে কেমন হয় নিয়েই আসা যাক।
একটা বালতি নিয়ে নিচে গেল গরম জল আনতে। মামুনকে গিয়ে বলল'কোথায় গরম জল আছে আমাকে একটু ঢেলে দাও তো?'
কথাটা শুনতে পেয়ে শাশুড়ি মা মামুনকে বললেন 'গরম জল সব সময় পাওয়া যাবে না।
এই কথা শোনার পর
রেখা গরম জল নেবার সময় মন চাইছিল না।
শ্বশুরবাড়িতে এরপরও রেখা   নতুনভাবে মেলে ধরার অবকাশ চাইছিল। সে জানে কালো মেঘ সরে গিয়ে নিশ্চিত এক মুঠো রোদ উঠবেই।

মমতা রায়চৌধুরী'র উপন্যাস পর্ব ৯৯



উপন্যাস 

টানাপোড়েন ৯৯
আত্মশুদ্ধি


মমতা রায়চৌধুরী



কতক্ষণ যে মায়ের বুকে মাথা রেখে নদী নিজেকে আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলো সে ভুলেই গিয়েছিল সে কথা। হঠাৎই ঝর্ণা মাসির ডাকে চমক ভাঙ্গে। ঝরনা মা মেয়ের এই দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেছে।
 কত ভুল বুঝাবুঝিই না হলো মা মেয়ের। ঝরনা মনে মনে চেয়েছিল এই মা-মেয়ের ঝামেলা মিটে যাক। ঝরনা  জানে এ যন্ত্রণা ।সন্তান দূরে থাকলে কি যে যন্ত্রনা ।সে প্রতি পলে পলে উপলব্ধি করতে পারে ।তারও একটা অন্য জীবন ছিল। আজ সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে চারিদিকের উদ্দাম কোলাহলের  মধ্যে শুধু নিজের হৃদয়টাকে একটা নির্জন দ্বীপ করে রেখেছে ।একলা নিশুতি রাতের মতো সেই যন্ত্রণাকে চেপে।
ঝরনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাকলো 'মামনি ,মামনি, মামনি চলো আমরা যাই। গাড়ি এসে গেছে। মিস্টার মালহোত্রা সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন।'
নদী কখন যেন একটা নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল তার মায়ের বুকে ।  চোখ লেগে গেছিল বুঝতেও পারেনি। হঠাৎই চমক ভেঙ্গে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো ঝরনার দিকে।
ঝরনা চোখের কাছে হাতটা নাড়িয়ে বলল ' কি হল মামনি, চলো আমরা যাই। কালকে তো আবার আসতে হবে তাই তো? মা তো এখন একটু ভালই আছেন চলো ।'
রুপসা ঝরনাকে বলল' চলে যাচ্ছ?'
ঝরনা রুপসার কাছে গিয়ে দুই হাত ধরে বলল 'এখন যাই বাড়িতে ওদিকটা সামলাতে হবে তাই
 না ?বাড়িটা ফাঁকা ফেলে রেখে এসেছি কালকে আবার আসব ।ঠিক আছে। তুমি কিন্তু সাবধানে বেশি টেনশন করবে না।'
নদী বলল "ঠিক আছে চলো'।
নদী যাবার সময় মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টিতে ছিল যেন কত দিনের আশা ,ভরসা, বিশ্বাসের একটা জায়গা।
রুপসা ঝরনা নদীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো।
নদী আর ঝর্ণাও রূপসাকে  হাত নাড়লো।
নদী কিন্তু বেশি কথা বলে নি মায়ের সঙ্গে ,যেটুকু বলার সেটুকুর মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে। তার অভিমান, ক্ষোভ,রাগ সমস্ত কিছুই যেন নিমেষের মধ্যে কর্পুরের মত উবে গেছে।
গাড়িতে বসে বসে নদী ভাবছে' সে যে কাজটা করেছে সেটা কি ঠিক করেছে? সে নিজেকে নিয়ে এখন আত্ম সমালোচনা করছে। কেন মিছে মিছে মায়ের সামনে এতটা রাগ করেছে। মায়ের বয়স কত হবে বড়জোর 40 -42,
বাপি মারা গেছে। কিন্তু তার মা যদি নতুন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে সেটা তো দোষের নয়। তবে কি সে অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল? বাপির জায়গাটা এতটাই সেনসিটিভ হয়তো সে জন্যেই মিস্টার মালহোত্রাকে সহ্য করতে পারে নি।
আর পরিবার পরিবেশটাও যেন সেরকমই তৈরি হয়ে গেছিল। বন্ধুবান্ধব, আশেপাশের লোকজন প্রত্যেকে যেন কেমন একটা কৌতুহলী দৃষ্টি হাসাহাসি, বিদ্রুপ তার মাকে নিয়ে । সে এসব মেনে নিতে পারে নি। বোধহয় তার নৈতিকতায় বেঁধেছিলো।
এইতো আজই হসপিটালে তার বন্ধুদের কথাতেই তাদের অদ্ভুত হাসিতে ধরা পড়ে কত কথা। আজ তো কোন কথায় নদীর গায়ে কোন জ্বালা ধরে নি বা ফোস্কা  পড়ে নি। তবে কেন মিছিমিছি সেসব কথায় নিজের মেজাজটাকে নষ্ট করেছে  । আর মাকে ঠেলে দিয়েছিল অজানার দেশে।'
 থ্যাংকস গড'
 এরকম আর কিছু হতে দিতে চায় না।
 জীবন তো একটাই। এ জীবনে উপভোগের যদি সুযোগ থাকে, মানুষের যদি তার আয়ত্তে থাকে সেটা কেন সে উপভোগ করবে না?'
হঠাৎই ঝরনা মাসি বলল ', মামনি?
নদী বলল কিছু বলছো মাসি?
ঝর্ণা বললো 'এত কি ভাবছো?'
নদী ভাবলেশহীনভাবে ঝরনার দিকে তাকিয়ে হাসল।
ঝর্ণা বললো 'বৌদি ঠিক হয়ে যাবে
দেখো ।কোন চিন্তা ক'রো না। আর তাছাড়া বৌদির বস যেভাবে বিষয়টাকে ট্রাকে ল করলেন ,সত্যিই ওনাকে ধন্যবাদ  দেয়া দরকার।'


ঝরনা কথাটা বলে নদীর প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করতে চাইছিল মুখ দেখে।
নদী ও ঘাড় নাড়লো। পরক্ষণেই গাড়িতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঝর্ণা বললো' মামনি রাতে কি খাবে?'
নদী বলল' কিছু খাব না মাসি?'
ঝর্ণা বললো 'কেন খাবে না মামনি, মায়ের কথা চিন্তা করছো?'
নদী কিছু বলল  'না?
ঝরনা নদীকে কাছে টেনে বললো' মায়ের মত কেউ হবে না ।যতই মাকে ভুল বোঝ না কেন? সন্তানের ভালো-মন্দ মায়ের থেকে আর ভালো কেউ বোঝেনা ।তুমিও যেদিন মা হবে ,তুমি সেদিন বুঝতে পারবে?'
নদী ও বলল' তুমি কি করে বুঝবে ঝরনা মাসি ।তোমার বাচ্চা আছে?'
ঝর্ণা নদীর এই কথাটায় প্রথমদিকে হকচকিয়ে যায় ।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে সন্তান থাকুক বা না থাকুক  , এটা উপলব্ধির বিষয়  ।
তারপরই হঠাৎ  ঝরনা নিজের মনে ভাবতে থাকে 'তার মা থাকলে তার বাবা কি পারতো তার সৎ মায়ের কথায় তাকে বিক্রি করে দিতে?'
একসময় লম্বা বেণী দুলিয়ে সে স্কুলে গেছে। আজ তা ইতিহাস। যাদের বর্তমান নেই, তা তো ইতিহাস হয়ে যায়।
গাড়ি এসে থামল নদীদের বাড়ির কাছে।
ড্রাইভার বলল' আপনারা নামুন।'
নদী অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে। হঠাৎ গেটের আওয়াজে নদী তাকায়  দেখছে ঝরনা মাসিকে গেট খুলে দিয়েছে ড্রাইভার। ঝরনা মাসি নেমে 
পড়ল ।এবার আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নদী নামল।
ড্রাইভার বলল' কালকে কখন যাবেন একবার স্যারকে ফোন করে 
দেবেন ।তাহলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন?'

ঝরনা নদীর দিকে তাকাল, নদী নির্বাক দৃষ্টিতে ঝরনার দিকে তাকিয়ে ।
ঝরনা ড্রাইভারকে বললো 'ঠিক আছে।'
ড্রাইভার ওকে বলে গাড়ি স্টার্ট 
করল ।গাড়ি বেরিয়ে গেল। নদী আর ঝর্ণা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসার চেষ্টা করল।
ঝরনা তাড়াতাড়ি তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গিজার চালিয়ে দিল।
তারপর ভালো করে হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে নদীকে বলল 'মামনি তুমি এখন আর ওপরে যেও 
না ।একেবারে ফ্রেস হয়ে খেয়ে ওপরে চলে যেও।
নদী বলল 'না ঝরনা মাসি, তোমার লেট হয়ে যাবে। তুমি এখানে ফ্রেশ হয়ে 
নাও ।আমি ওপরে গিয়ে গিজার চালিয়ে নিচ্ছি কেমন?
ঝর্ণা বললো 'কথাটা অবশ্য ঠিক। আমি আগে ফ্রেশ না হলে তো আমি কিছু করতেও পারবো না। ঠিক আছে, তাই হোক।
নদী নিজের রুমে চলে গেল।
ঝরনা ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল' মামনি  পাস্তা বানাবো?'
নদীর ওপর থেকে বলল' আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মাসি?'
ঝর্ণা বললো 'এভাবে বললে হবে না মামনি। তোমার প্রিয় নাস্তা আমি বানাচ্ছি পাস্তা ,ঠিক আছে?'
নদীর ওপর থেকে ঝুঁকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল' ঠিক আছে ,তাই করো।'
ঝরনা ঝটপট পাস্তার জন্য সবজিগুলো গাজর ,বিনস, ক্যাপসিকাম, টমেটো ,বাঁধাকপি সব গুছিয়ে কেটে
 ফেললো ।কাঁচা লঙ্কা ,পেঁয়াজ কুচিয়ে ফেলল ।অন্যদিকে একটা পাত্রে পরিমাণমতো পাস্তা নিয়ে তাকে জল দিয়ে ধুয়ে, ফুটন্ত জলে পাস্তাগুলো দিয়ে দিল । পাস্তা সেদ্ধ হয়ে গেলে জল ঝরিয়ে রেখে দিল। দুটো ডিম ফেটিয়ে নিল। এরপর ননস্টিক প্যানে তেল দিয়ে   ভেজে নিল ।তারপর আস্তে আস্তে  ননস্টিক প্যানে বাটার দিয়ে প্রথমে পেঁয়াজ গুলোকে হালকা করে নেড়ে চেড়ে নিল, এরপর একে একে সবজি গুলো নুন দিয়ে নেড়েচেড়ে নিল, তারপর সামান্য ভাজা ভাজা হলে, চিলি সস, সয়া সস, টমেটো সস দিয়ে দিল ।এরপর পাস্তাগুলো তার ওপর দিয়ে 
দিল ।পরিশেষে ভেজে রাখা কুচো ডিম এড করে ,রেডি করে ফেলল পাস্তা।
ঝরনা মনে মনে খুব খুশী হলো যাক শেষমেষ নদী খেতে রাজি 
হয়েছে  ।এমনিতেও ওর এগ পাস্তা খুবই প্রিয়।
ঝরনা নিচে থেকে ডাকলো "মামনি মামনি মামনি. ই.ই.ই..।'
নদী তখনও শাওয়ার এর নিচে ,কি জানি হিমশীতল রাতে আজকে কেন সে এতটাই উষ্ণ হয়ে উঠেছে। ভাল করে স্নান করছে ।মনে হচ্ছে যেন আজকে তার শুদ্ধিকরণ হচ্ছে। শাওয়ারএর জলে স্নানের সময় ঝরনার গলার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পায়নি ।সাওয়ার বন্ধ করার পর আওয়াজটা কানে গেলে, নদী চিৎকার করে বললো 'আমি বাথরুমে আছি মাসি।'
ঝর্ণা বললো ' আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফ্রেস হয়ে নিচে এসো ,তোমার পাস্তা রেডি।'
নদী ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে মায়ের দেয়া করসুলের হাউসকোটটা পরে নিচে আসলো।
নীল রঙ্গের করসুলের হাউসকোট পরে নদীকে সত্যিই একটা অন্যরকম 
লাগছিল ।ঝরনা তো দেখে অবাক  হয়ে গেছে  হাউসকোটটা কেনার পরে একদিনও নদী গায়ে তোলেনি। আজ সেই হাউসকোট-টাই পরেছে।
ঝর্ণা বললো' তোমায় কি সুন্দর লাগছে মামনি। বৌদির দেওয়া হাউসকোটে।'
নদী শুধু' হাসলো।"
বৌদির কিন্তু চয়েজ আছে। তুমি একদিনও পরো নি বলে ,বৌদি কি কষ্ট টাই না পেয়েছিল। আজকে যদি দেখতো কত খুশিই না হতো।'
নদী জিজ্ঞাসু নেত্রে বলল' তাই  মাসি ?তা এতদিন পরিনি ।আজকে তো 
পরলাম ।ঠিক আছে এসো আমরা দুজন একটা সেলফি তুলি ।মাকে ওটা পরে তুমি দেখিয়ে দিও।
ঝর্ণা বললো "বাহ রে আমার বয়েই
 গেছে ।তোমাদের মা বেটির ব্যাপার 
তোমরা বুঝে নাও। আমি তৃতীয় ব্যক্তি...।
নদী বলল' মাসি তুমি তৃতীয় ব্যক্তি কথাটা মনে রেখো কিন্তু..?
ঝরনা হেসে ফেললো।
নদী বলল' মাসি তুমি খাও। তোমার জন্য কর নি?'
ঝরনা চুপ করে আছে।
নদী বলল ' তা বললে তো হবে না  আমি এতটা পাস্তা খাব না ।তোমাকে খেতেই হবে এখান থেকে। নদী  খানিকটা পাস্তা প্লেটে করে নিয়ে ঝরনার মুখের কাছে গিয়ে বলল" হাঁ করো আগে, হা  
করো ।'
ঝর্ণা বললো' আমি খেয়ে নেব ।'
নদী বললো' না ,না ,না ,আগে আমার হাত থেকে খাও, তারপর অন্য কথা।
ঝর্ণা বললো' বাপরে আমি তোমার সঙ্গে কেন পারব !ঠিক আছে এই হা  করলাম। ঝর্ণা বললো 'দেখতো হাঙ্গর মাছের মত আমি হাঁ করেছি। গোটা মানুষ খেয়ে নিতে পারব না?"
নদী হেসে ফেললো বললো 'তুমি পারোও মাসি।"