উপন্যাস
টানাপোড়েন১০০
রেখার ইতিকথা
মমতা রায় চৌধুরী
রেখা সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। রিম্পাদি ট্রান্সফার হয়ে যাবার পর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসা কত কথাই না রিম্পাদির সঙ্গে বলেছে। একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এসবই ভেবে ভেবে রাত গভীর হয়, দু চোখ ক্লান্ত তবুও চোখের পাতা এক হতে চায়না। এক আকাশ বুকে আশা নিয়ে প্রহর কাটে তার।আজকাল মনোজ ও খুব বেশি একটা কথা বলে না। পুরোপুরি জীবনটা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যেতে বসেছে। বেঁচে থাকার মধ্যে আছে তার লেখা। আজকাল লেখাটাই রেখাকে প্রাণ দেয়। আরে বাবা দেবেই বা না কেন 'সিড়ি'ত্রিকার সম্পাদক রেখাকে তাড়া দিয়ে লেখা আদায় করে নেন। সত্যি লেখায় যেন একটা আলাদা অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় রেখা ।
আজকাল মনোজও বেশিরভাগ সময়টা ড্রইংরুমে কাটায়। বলে তো অফিসের চাপ বেড়েছে। রেখা চিরকালই কারোর কোন পার্সোনাল ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। মনে পড়ে যায় যখন প্রথম বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসে ।রেখার শাশুড়ি মা অবশ্য প্রথম থেকেই রেখাকে পছন্দ ছিল না। শুধুমাত্র ছেলের পছন্দ বলে নাও করতে পারেন নি।
ননদ সে তো বলেই দিয়েছিল 'কি দরকার ছিল ভাই, তোর অন্য কাস্টে বিয়ে করা? আমাদের কালচারের সঙ্গে মিলাতে পারবে?'
যদিও রেখাকে এই কথাগুলো মনোজই বলেছিল।
বিয়ের পর থেকে রেখা হাড়েহাড়ে বুঝতে পেরেছিল সত্যি অন্য কাস্টে বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি।
বিয়ের পর ফুলশয্যার পরের দিন শাশুড়ি মা রেখা কে যেভাবে বলেছিল'কাজের মেয়ে মামুনকে দিয়ে
আজও মনের ক্যানভাসে রং তুলি নিয়ে আঁচড় কেটে যায়। এইতো ফুলশয্যার পরের দিন
রেখা খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন বাড়ি কেমন যেন একটা সবসময় ভয় ভয় কাজ করছিল। এত বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি সকালে উঠতেই হবে। রেখাকে কিন্তু কেউ কিছু বলেই দেয় নি, কি করতে হবে, না করতে হবে। যেন দূরে সরিয়ে রাখার একটা প্রবণতা। কত আশা নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এসেছিল। ফুলশয্যার পরের দিনই বুঝতে পেরেছিল এই আশা আদপেও বাস্তবায়িত হবে না। তবুও 'বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।'
রেখা ভেবেছিল' সে তো একজন শিক্ষিকা এত বড় একটা পরিবেশে সকলের সঙ্গে মানিয়ে ,স্টুডেন্টদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে স্নেহ দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে তাদেরকে মানুষ গড়ার কারিগর হতে পারে। তবে,এই সংসার টা বাদ যাবে
কেন? 'যতই তারা দূরে ঠেলে দিক রেখা ভালোবাসা দিয়ে সকলকে মনের বন্ধনে বেঁধে রাখবে। ভালোবাসায় সব হয়। কিন্তু এই আশা আর কবে বাস্তবায়িত হবে?
বিয়ের পর থেকেই দেখে এসেছিল এ বাড়িতে কাজের মেয়ে সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বাস্তবে তার সঙ্গে কি হয়েছে? ফুলশয্যার পরের দিনই তাকে ঝাটা ধরতে হয়েছে।
আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা
'এতটা বেলা হয়ে যাওয়ার পরেও রেখা যে ঘরে থাকে মানে যে ঘরটাতে থাকতে দেয়া হয়েছে, সেই ঘরে কেউ ঝাট দিতে আসেনি বা ঘর কেউ মুছতে ও আসেনি।'
রেখা একটু অবাক হয়ে গেল নতুন বিয়ে হয়েছে । কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছে
না ।কেমন একটু সংকোচ বোধ হচ্ছে।
এমন কি কেউ চা খাবার জন্যও ডাকছেন না।
মনে দ্বিধা নিয়ে রেখা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিজে একটা কোনরকমে ঝাটা খুঁজে পেল সেটা দিয়েই ঘরটাকে ঝাট দিল। এরমধ্যে দেখতে পেল তাদের ঘরটা বিয়ের আগে নুতন করা হয়েছে কিন্তু সেই ঘরের ভেতরে দেওয়াল আলমারিতে সিমেন্ট বালি লেপ্টে আছে। রেখা মনে মনে ভাবছে তাইতো এইগুলোতে এত নোংরা পড়ে আছে কিছুটা পরিষ্কার করে নি।
যেইনা ভাবা অমনি কাজ। একটা ন্যাকড়া জোগাড় করে মোছামুছি করছে ঠিক সেইসময় কাজের মেয়েটি এসে বলল 'বৌদি কি করছো?'
রেখা বলল 'এইতো ভাই ঘরটা একটু ঝাট দিলাম আর এইগুলো একটু পরিষ্কার করছি।'
মামুন জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল'ও তাই?'
এরপর মামুন দ্রুত ছুটে চলে গেল নিচে।
তখনো জানে না রেখা যে নিচে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে ।রেখাকে নিয়ে সারাবাড়ি তোলপাড় হয়ে গেছে। হঠাৎই একটা কথা কানে আসলো'রেখা র শাশুড়িমা মামুন মেয়েটাকে বলছেন 'এবাড়িতে এসব চলবে না ।এবাড়িতে কিছু সংস্কার আছে। বাসি কাপড়ে কেউ ঘর ঝাট দেবে না বা অন্য কাজ করবে না। গিয়ে বল ।'
একটু পরেই মামুন বলে মেয়েটি ছুটতে ছুটতে আসে সিঁড়ি দিয়ে। এরপর এক হাত জিভ বের করে হাঁপাতে
থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে 'বৌদি তোমাকে বাসি কাপড়ে এই সমস্ত কিছু করা যাবে না।'
রেখা বলল' আমি বাসি কাপড়ে নেই
গো। আমি কাপড় চেঞ্জ করেছি ফ্রেশ হয়ে।
তারপর রেখা বললো তুমি জানো এই ঘর এই মাসি টা কি মুছতে আসবে গো? মামুন বলল না না মনে হয় কেউ মুছতে আসবেনা জানো বৌদি।
রেখা বলল আমি কি করে জানব ভাই আমিতো বাড়িতে নতুন তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।'
মামুন আর কিছু না বলে সরাসরি নিচে চলে যায়।
একটু পরেই রেখা খেয়াল করে তাদের পাশের ঘরটাতে ওর শাশুড়ি মা থাকে সেই ঘরটা মুছে ওই মাসি বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রেখার ঘর বা রেখার ঘরের সামনের বারান্দা কিছুই মুছলো না।
অথচ এ বাড়িতে আসার পর শাশুরি মা কিন্তু কিছুই বলে দিলেন না কি করতে হবে ,না করতে হবে। রেখা তো নতুন তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে কিছুই বলেনা।
অথচ রেখা যখন নিজের ঘরে নিজে কাজ করতে যাচ্ছে তখনও খুঁত ধরে ধরে বেড়াতে লাগলেন।
যাইহোক একটু পরে আবার সেই মেয়েটি উঠে আসে এবং বলে 'বৌদি তুমি কিন্তু এখন এসব কিছু করতে ব'সো না। '
রেখা বলে' তাহলে কি ঘর এরকমই পড়ে থাকবে?'
মামুন বলে সেটাও আমি বলতে পারব না।'
রেখা স্নান করে নিজেই একা নিচে নেমে গেল।শাশুড়ি মা যে ঘরটা বসেন সেই ঘরে গিয়ে বসলো। ঘরে ঢুকতেই ননদ আর আর শাশুড়ি মা একান্তে কি কথা বলছিলেন , কে জানে? রেখাকে দেখে চুপ করে গেলেন। আর রেখার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন মনে হল রেখা কত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
এসব ভাবছে হঠাৎই রেখার ফোনে একটি ম্যাসেজ এসেছে'মনের জানালা খুলে রেখে দেখো তাকিয়ে সোনা ঝরা রোদ্দুর উঁকি মারছে তোমায় ডেকে।'সুপ্রভাত
রেখা মেসেজটা পড়ে একটু চমকে যায়' বাহ খুব সুন্দর লেখা তো ?কে পাঠালেন?'
আজকাল বেশ সুন্দর সুন্দর মেসেজ আছে সকালবেলা মনটাই ভালো হয়ে যায় রাত্রির ক্লান্তি ,অবসাদ নিশীথের মতো গভীরতা নিয়ে রেখার মনে দাগ কেটে যায় সকালের ভোরের আলোয় আবার নতুন করে খুঁজে পায় তার নতুন ঠিকানা। ভাবতে ভাবতেই মেসেজটা খোলার পর দেখছে এটা এসেছে পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে।
রেখা সত্যিই মনে মনে খুব খুশি হলো। তার মরে যাওয়া ইচ্ছে গুলোর মাঝে যেন বেঁচে ওঠার এক চিলতে রোদ্দুর।
আবার ভাবতে থাকে রেখা সেই অতীতের কথা। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বোধহয় মেয়েদের কোনদিন আপন হয় না আপন করতে চাইলেও। রেখার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বারবার প্রমাণ করে
দেয় ।এইতো বিয়ে হয়েছে শীতকালে শ্বশুরবাড়িতে তখন গরম জলের ব্যবস্থা ছিল নিচে। শাশুড়ি মার বাথরুমে। গরম জলে যারা স্নান করবে তাদের ওখান থেকে নিয়ে ই করতে হবে। এটা জানাই ছিল না রেখার।
পরপর কদিন ঠান্ডা জলে স্নান করে ঠান্ডা লেগে যায় রেখার। কি করবে কাকে বলবে? মনোজও তো কিছু বলছে না। মাসি শাশুড়ি রা সেই বিয়ের আগে এসেছেন তখন অব্দি রয়ে গেছে ন। এখানে ঠান্ডা লাগা দেখে শুক্লা মাসি বললেন'কি করে খা তুমি ঠান্ডা জলে স্নান করো?
রেখা কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে।
শুক্লা মাসি বলে কেন নিচের থেকে গরম জল নিয়ে আসবে? এ বাড়িতে কাজের লোক অব্দি গরম জল পায় আর তুমি বউ হওয়া সত্ত্বেও গরম জল…?
সন্ধ্যা মাসি বলে' কালকে অবশ্যই গরম জল নিয়ে আসবে কেমন?
এদিকে এমন খিদে পেয়েছে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। এ বাড়িতে নাকি নিয়ম আছে পুরুষদের সবার খাওয়া হবে তারপর মহিলাদের।
রেখা মনে মনে ভাবছিল যদি নিজের বাড়ি হত তাহলে কখন মা খাবার দিয়ে যেত। শুধু জলের বোতল থেকে জল খাচ্ছে।
এমনি করেই দিন কেটে যাচ্ছিল কিন্তু ঝামেলা বেধে গেল। পরেরদিন এত ঠান্ডা জমে যাওয়ার উপক্রম। রেখা ভাবল মাসিরা তো বলেছিল গরম জল নিয়ে আসতে। তাহলে একবার গেলে কেমন হয় নিয়েই আসা যাক।
একটা বালতি নিয়ে নিচে গেল গরম জল আনতে। মামুনকে গিয়ে বলল'কোথায় গরম জল আছে আমাকে একটু ঢেলে দাও তো?'
কথাটা শুনতে পেয়ে শাশুড়ি মা মামুনকে বললেন 'গরম জল সব সময় পাওয়া যাবে না।
এই কথা শোনার পর
রেখা গরম জল নেবার সময় মন চাইছিল না।
শ্বশুরবাড়িতে এরপরও রেখা নতুনভাবে মেলে ধরার অবকাশ চাইছিল। সে জানে কালো মেঘ সরে গিয়ে নিশ্চিত এক মুঠো রোদ উঠবেই।