০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী'র উপন্যাস পর্ব ৯৯



উপন্যাস 

টানাপোড়েন ৯৯
আত্মশুদ্ধি


মমতা রায়চৌধুরী



কতক্ষণ যে মায়ের বুকে মাথা রেখে নদী নিজেকে আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলো সে ভুলেই গিয়েছিল সে কথা। হঠাৎই ঝর্ণা মাসির ডাকে চমক ভাঙ্গে। ঝরনা মা মেয়ের এই দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেছে।
 কত ভুল বুঝাবুঝিই না হলো মা মেয়ের। ঝরনা মনে মনে চেয়েছিল এই মা-মেয়ের ঝামেলা মিটে যাক। ঝরনা  জানে এ যন্ত্রণা ।সন্তান দূরে থাকলে কি যে যন্ত্রনা ।সে প্রতি পলে পলে উপলব্ধি করতে পারে ।তারও একটা অন্য জীবন ছিল। আজ সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে চারিদিকের উদ্দাম কোলাহলের  মধ্যে শুধু নিজের হৃদয়টাকে একটা নির্জন দ্বীপ করে রেখেছে ।একলা নিশুতি রাতের মতো সেই যন্ত্রণাকে চেপে।
ঝরনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাকলো 'মামনি ,মামনি, মামনি চলো আমরা যাই। গাড়ি এসে গেছে। মিস্টার মালহোত্রা সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন।'
নদী কখন যেন একটা নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল তার মায়ের বুকে ।  চোখ লেগে গেছিল বুঝতেও পারেনি। হঠাৎই চমক ভেঙ্গে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো ঝরনার দিকে।
ঝরনা চোখের কাছে হাতটা নাড়িয়ে বলল ' কি হল মামনি, চলো আমরা যাই। কালকে তো আবার আসতে হবে তাই তো? মা তো এখন একটু ভালই আছেন চলো ।'
রুপসা ঝরনাকে বলল' চলে যাচ্ছ?'
ঝরনা রুপসার কাছে গিয়ে দুই হাত ধরে বলল 'এখন যাই বাড়িতে ওদিকটা সামলাতে হবে তাই
 না ?বাড়িটা ফাঁকা ফেলে রেখে এসেছি কালকে আবার আসব ।ঠিক আছে। তুমি কিন্তু সাবধানে বেশি টেনশন করবে না।'
নদী বলল "ঠিক আছে চলো'।
নদী যাবার সময় মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টিতে ছিল যেন কত দিনের আশা ,ভরসা, বিশ্বাসের একটা জায়গা।
রুপসা ঝরনা নদীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো।
নদী আর ঝর্ণাও রূপসাকে  হাত নাড়লো।
নদী কিন্তু বেশি কথা বলে নি মায়ের সঙ্গে ,যেটুকু বলার সেটুকুর মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে। তার অভিমান, ক্ষোভ,রাগ সমস্ত কিছুই যেন নিমেষের মধ্যে কর্পুরের মত উবে গেছে।
গাড়িতে বসে বসে নদী ভাবছে' সে যে কাজটা করেছে সেটা কি ঠিক করেছে? সে নিজেকে নিয়ে এখন আত্ম সমালোচনা করছে। কেন মিছে মিছে মায়ের সামনে এতটা রাগ করেছে। মায়ের বয়স কত হবে বড়জোর 40 -42,
বাপি মারা গেছে। কিন্তু তার মা যদি নতুন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে সেটা তো দোষের নয়। তবে কি সে অনেক বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল? বাপির জায়গাটা এতটাই সেনসিটিভ হয়তো সে জন্যেই মিস্টার মালহোত্রাকে সহ্য করতে পারে নি।
আর পরিবার পরিবেশটাও যেন সেরকমই তৈরি হয়ে গেছিল। বন্ধুবান্ধব, আশেপাশের লোকজন প্রত্যেকে যেন কেমন একটা কৌতুহলী দৃষ্টি হাসাহাসি, বিদ্রুপ তার মাকে নিয়ে । সে এসব মেনে নিতে পারে নি। বোধহয় তার নৈতিকতায় বেঁধেছিলো।
এইতো আজই হসপিটালে তার বন্ধুদের কথাতেই তাদের অদ্ভুত হাসিতে ধরা পড়ে কত কথা। আজ তো কোন কথায় নদীর গায়ে কোন জ্বালা ধরে নি বা ফোস্কা  পড়ে নি। তবে কেন মিছিমিছি সেসব কথায় নিজের মেজাজটাকে নষ্ট করেছে  । আর মাকে ঠেলে দিয়েছিল অজানার দেশে।'
 থ্যাংকস গড'
 এরকম আর কিছু হতে দিতে চায় না।
 জীবন তো একটাই। এ জীবনে উপভোগের যদি সুযোগ থাকে, মানুষের যদি তার আয়ত্তে থাকে সেটা কেন সে উপভোগ করবে না?'
হঠাৎই ঝরনা মাসি বলল ', মামনি?
নদী বলল কিছু বলছো মাসি?
ঝর্ণা বললো 'এত কি ভাবছো?'
নদী ভাবলেশহীনভাবে ঝরনার দিকে তাকিয়ে হাসল।
ঝর্ণা বললো 'বৌদি ঠিক হয়ে যাবে
দেখো ।কোন চিন্তা ক'রো না। আর তাছাড়া বৌদির বস যেভাবে বিষয়টাকে ট্রাকে ল করলেন ,সত্যিই ওনাকে ধন্যবাদ  দেয়া দরকার।'


ঝরনা কথাটা বলে নদীর প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করতে চাইছিল মুখ দেখে।
নদী ও ঘাড় নাড়লো। পরক্ষণেই গাড়িতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঝর্ণা বললো' মামনি রাতে কি খাবে?'
নদী বলল' কিছু খাব না মাসি?'
ঝর্ণা বললো 'কেন খাবে না মামনি, মায়ের কথা চিন্তা করছো?'
নদী কিছু বলল  'না?
ঝরনা নদীকে কাছে টেনে বললো' মায়ের মত কেউ হবে না ।যতই মাকে ভুল বোঝ না কেন? সন্তানের ভালো-মন্দ মায়ের থেকে আর ভালো কেউ বোঝেনা ।তুমিও যেদিন মা হবে ,তুমি সেদিন বুঝতে পারবে?'
নদী ও বলল' তুমি কি করে বুঝবে ঝরনা মাসি ।তোমার বাচ্চা আছে?'
ঝর্ণা নদীর এই কথাটায় প্রথমদিকে হকচকিয়ে যায় ।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে সন্তান থাকুক বা না থাকুক  , এটা উপলব্ধির বিষয়  ।
তারপরই হঠাৎ  ঝরনা নিজের মনে ভাবতে থাকে 'তার মা থাকলে তার বাবা কি পারতো তার সৎ মায়ের কথায় তাকে বিক্রি করে দিতে?'
একসময় লম্বা বেণী দুলিয়ে সে স্কুলে গেছে। আজ তা ইতিহাস। যাদের বর্তমান নেই, তা তো ইতিহাস হয়ে যায়।
গাড়ি এসে থামল নদীদের বাড়ির কাছে।
ড্রাইভার বলল' আপনারা নামুন।'
নদী অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে। হঠাৎ গেটের আওয়াজে নদী তাকায়  দেখছে ঝরনা মাসিকে গেট খুলে দিয়েছে ড্রাইভার। ঝরনা মাসি নেমে 
পড়ল ।এবার আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নদী নামল।
ড্রাইভার বলল' কালকে কখন যাবেন একবার স্যারকে ফোন করে 
দেবেন ।তাহলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন?'

ঝরনা নদীর দিকে তাকাল, নদী নির্বাক দৃষ্টিতে ঝরনার দিকে তাকিয়ে ।
ঝরনা ড্রাইভারকে বললো 'ঠিক আছে।'
ড্রাইভার ওকে বলে গাড়ি স্টার্ট 
করল ।গাড়ি বেরিয়ে গেল। নদী আর ঝর্ণা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসার চেষ্টা করল।
ঝরনা তাড়াতাড়ি তালা খুলে ভেতরে ঢুকে গিজার চালিয়ে দিল।
তারপর ভালো করে হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে নিল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে নদীকে বলল 'মামনি তুমি এখন আর ওপরে যেও 
না ।একেবারে ফ্রেস হয়ে খেয়ে ওপরে চলে যেও।
নদী বলল 'না ঝরনা মাসি, তোমার লেট হয়ে যাবে। তুমি এখানে ফ্রেশ হয়ে 
নাও ।আমি ওপরে গিয়ে গিজার চালিয়ে নিচ্ছি কেমন?
ঝর্ণা বললো 'কথাটা অবশ্য ঠিক। আমি আগে ফ্রেশ না হলে তো আমি কিছু করতেও পারবো না। ঠিক আছে, তাই হোক।
নদী নিজের রুমে চলে গেল।
ঝরনা ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল' মামনি  পাস্তা বানাবো?'
নদীর ওপর থেকে বলল' আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মাসি?'
ঝর্ণা বললো 'এভাবে বললে হবে না মামনি। তোমার প্রিয় নাস্তা আমি বানাচ্ছি পাস্তা ,ঠিক আছে?'
নদীর ওপর থেকে ঝুঁকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল' ঠিক আছে ,তাই করো।'
ঝরনা ঝটপট পাস্তার জন্য সবজিগুলো গাজর ,বিনস, ক্যাপসিকাম, টমেটো ,বাঁধাকপি সব গুছিয়ে কেটে
 ফেললো ।কাঁচা লঙ্কা ,পেঁয়াজ কুচিয়ে ফেলল ।অন্যদিকে একটা পাত্রে পরিমাণমতো পাস্তা নিয়ে তাকে জল দিয়ে ধুয়ে, ফুটন্ত জলে পাস্তাগুলো দিয়ে দিল । পাস্তা সেদ্ধ হয়ে গেলে জল ঝরিয়ে রেখে দিল। দুটো ডিম ফেটিয়ে নিল। এরপর ননস্টিক প্যানে তেল দিয়ে   ভেজে নিল ।তারপর আস্তে আস্তে  ননস্টিক প্যানে বাটার দিয়ে প্রথমে পেঁয়াজ গুলোকে হালকা করে নেড়ে চেড়ে নিল, এরপর একে একে সবজি গুলো নুন দিয়ে নেড়েচেড়ে নিল, তারপর সামান্য ভাজা ভাজা হলে, চিলি সস, সয়া সস, টমেটো সস দিয়ে দিল ।এরপর পাস্তাগুলো তার ওপর দিয়ে 
দিল ।পরিশেষে ভেজে রাখা কুচো ডিম এড করে ,রেডি করে ফেলল পাস্তা।
ঝরনা মনে মনে খুব খুশী হলো যাক শেষমেষ নদী খেতে রাজি 
হয়েছে  ।এমনিতেও ওর এগ পাস্তা খুবই প্রিয়।
ঝরনা নিচে থেকে ডাকলো "মামনি মামনি মামনি. ই.ই.ই..।'
নদী তখনও শাওয়ার এর নিচে ,কি জানি হিমশীতল রাতে আজকে কেন সে এতটাই উষ্ণ হয়ে উঠেছে। ভাল করে স্নান করছে ।মনে হচ্ছে যেন আজকে তার শুদ্ধিকরণ হচ্ছে। শাওয়ারএর জলে স্নানের সময় ঝরনার গলার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পায়নি ।সাওয়ার বন্ধ করার পর আওয়াজটা কানে গেলে, নদী চিৎকার করে বললো 'আমি বাথরুমে আছি মাসি।'
ঝর্ণা বললো ' আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি ফ্রেস হয়ে নিচে এসো ,তোমার পাস্তা রেডি।'
নদী ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে মায়ের দেয়া করসুলের হাউসকোটটা পরে নিচে আসলো।
নীল রঙ্গের করসুলের হাউসকোট পরে নদীকে সত্যিই একটা অন্যরকম 
লাগছিল ।ঝরনা তো দেখে অবাক  হয়ে গেছে  হাউসকোটটা কেনার পরে একদিনও নদী গায়ে তোলেনি। আজ সেই হাউসকোট-টাই পরেছে।
ঝর্ণা বললো' তোমায় কি সুন্দর লাগছে মামনি। বৌদির দেওয়া হাউসকোটে।'
নদী শুধু' হাসলো।"
বৌদির কিন্তু চয়েজ আছে। তুমি একদিনও পরো নি বলে ,বৌদি কি কষ্ট টাই না পেয়েছিল। আজকে যদি দেখতো কত খুশিই না হতো।'
নদী জিজ্ঞাসু নেত্রে বলল' তাই  মাসি ?তা এতদিন পরিনি ।আজকে তো 
পরলাম ।ঠিক আছে এসো আমরা দুজন একটা সেলফি তুলি ।মাকে ওটা পরে তুমি দেখিয়ে দিও।
ঝর্ণা বললো "বাহ রে আমার বয়েই
 গেছে ।তোমাদের মা বেটির ব্যাপার 
তোমরা বুঝে নাও। আমি তৃতীয় ব্যক্তি...।
নদী বলল' মাসি তুমি তৃতীয় ব্যক্তি কথাটা মনে রেখো কিন্তু..?
ঝরনা হেসে ফেললো।
নদী বলল' মাসি তুমি খাও। তোমার জন্য কর নি?'
ঝরনা চুপ করে আছে।
নদী বলল ' তা বললে তো হবে না  আমি এতটা পাস্তা খাব না ।তোমাকে খেতেই হবে এখান থেকে। নদী  খানিকটা পাস্তা প্লেটে করে নিয়ে ঝরনার মুখের কাছে গিয়ে বলল" হাঁ করো আগে, হা  
করো ।'
ঝর্ণা বললো' আমি খেয়ে নেব ।'
নদী বললো' না ,না ,না ,আগে আমার হাত থেকে খাও, তারপর অন্য কথা।
ঝর্ণা বললো' বাপরে আমি তোমার সঙ্গে কেন পারব !ঠিক আছে এই হা  করলাম। ঝর্ণা বললো 'দেখতো হাঙ্গর মাছের মত আমি হাঁ করেছি। গোটা মানুষ খেয়ে নিতে পারব না?"
নদী হেসে ফেললো বললো 'তুমি পারোও মাসি।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much