উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮৬
স্নেহ-মায়া-মমতা
মমতা রায়চৌধুরী
অনিন্দিতার বিয়েতে যাবার আগে যে উত্তেজনা মন প্রাণকে ছুঁয়ে গেছিল। তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেল ঠিক যেন 'গঙ্গাসাগরে মৃতপ্রায় মনুয়া পাখির মতো।' অনিন্দিতা কেন যে রেখার সাথে এরকম ব্যবহার করল ?
সবাইকে জিজ্ঞেস করল একবারও রেখা কে জিজ্ঞেস করল না।
গাড়িটা আসতে আসতেএসবই ভাবছিল হঠাৎ রেখার মনে পড়ল 'এই যা মনোজ তো ফোন করেছিল ,তখন তো ধরতে পারে নি। 'হোয়াটসঅ্যাপটা খুলল দেখল 'কিছু ম্যাসেজ আছে কিনা?'
দেখল 'হ্যাঁ ,মেসেজ ঢুকেছে। মনোজ লিখেছে 'কত দূরে আছো?'
রেখা ভাবল' ফোনটা করবে? না থাক। তার থেকে মেসেজ পাঠিয়ে দি।'
রেখা টেক্সট করলো'এই তো চাকদহ পালপাড়া ক্রস করছি। তুমি খেয়েছো তো?'
রিম্পাদি বলল-'এই রেখা ,রেখা । কি রে কোনো কথা বলছিস না। মুড অফ?'
রেখা তখনো ফোনটা ঘেটে যাচ্ছে। অনুরাধাদি রিম্পাদিকে বলল'মটন কষাটা তোমাদের কেমন লেগেছে?'
রিম্পাদি বলল 'কেন বলুন তো?'
অনুরাধাদি বললেন 'এমনি জিজ্ঞেস করছি?'
রিম্পাদি আবার ঠোঁটকাটা তো বলে ফেলল' না আপনি তো এমনিতে কিছু বলেন না দিদি।নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে বা কিছু মনে জেগেছে?'
আনুরাধাদি একটু হাসলেন।
রিম্পাদি হেসে এবার একটু কায়দা করে বললো 'আমার তো ভালোই লেগেছে।'
অনুরাধাদি শুধু বললেন" অ অ।'
রিম্পাদি কায়দা করে কথাটা বের করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারল না। রিম্পাদি জানে। মটন কষাটার মটন ভাল ছিল না।'
এরমধ্যে রিম্পাদি আবার রেখাকে ধাক্কা দিয়ে বলল 'কিরে কিছু বলছিস না যে?'
রেখা বলল '' কি বলব?'
রিম্পাদি বলল 'না কিছু লিখছিলি তো ? মনোজ ফোন করেছিল?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,সে তো যাবার সময় ফোন করেছিল। আবার ফিরছি ,দেখছি মেসেজ পাঠিয়েছে।'
রিম্পাদি বলল' ও ।তা এমনি সব ঠিক আছে তো?'
রেখা বলল মনে হয় 'সব ঠিক আছে। লিখেছে যে কত দূর?'
রিম্পাদি বলল'তুই কোন উত্তর দিয়েছিস?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ,আমি লিখলাম তখন পালপাড়ায় ছিলাম সেই কথাটাই ।'
এরমধ্যে অনুরাধাদি দেখি পা নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছেন ।একটানা পা ঝুলিয়ে বসে থাকা তো?'
রেখা বলল' দিদি ,আপনি পা টা ছড়িয়ে
বসুন ।আমরা একটু এদিকে চেপে বসছি।'
রিম্পাদি ও বলল ', হ্যাঁ, দিদি। পা টা ছড়িয়ে দিন। অ্যা অ্যা অ্যা রেখা একটু সর সর সর আর একটু। ব্যস ব্যস, ঠিক আছে।'
রেখা বললো' ঠিক আছে অনুরাধাদি।"
অনুরাধাদি বললেন ' হ্যাঁ গো। উফ: কি কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু তোমাদের তো কষ্ট হবে?'
রিম্পাদি ও রেখা বলল 'আরে না ,না ।আপনি বসুন তো ঠিক করে।'
এরমধ্যে গান বাজছে'তোমারেই করেছি জীবনের ধ্রুবতারা ...।'
সবাই কিছুক্ষনের জন্যে চুপ করে গেল আর মনোযোগের সঙ্গে গানটা শুনতে লাগল।
গাড়ি ইতিমধ্যে মদনপুরের ঢুকে পড়ল।
এরমধ্যে রেখার ফোনে একটা ম্যাসেজ ঢুকলো ', খেয়ে নিয়েছি।'
রেখা মেসেজ করল' বাচ্চারা সব খেয়েছে তো?'
মনোজ লিখলো "হ্যাঁ ,সবাই খেয়েছে।'
কিন্তু রেখা জানতেও পারল না তার বাড়িতে কি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
গাড়ি যখন কল্যাণী স্টেশন হয়ে রেখার বাড়ির গেটের কাছে। গাড়ি থেকে নামল এবং রিম্পা দি অনুরাধাদিকে অনুরোধ করলো 'ভেতরে ,ভেতরে চলো সবাই।'কিন্তু রিম্পাদি অনুরাধাদি দুজনেই বললেন 'না গো অন্য দিন একদিন
আসবো ।আজ আর নয়।'
রিম্পাদি বলল 'না রে আজকে এমনি দেরি হয়ে গেছে। আমাদেরও তো ফিরতে হবে বল?'
রেখা কোন জোরজবস্তি করল না। সত্যিই তো এখনও অনেকটা পথ যাবার রয়েছে। দুজন মেয়ে মানুষ যাবেন।'
রেখা হেসে বলল 'ঠিক আছে দিদি ।তাহলে কিন্তু তোমাদের পাওনা থাকল।'
রিম্পাদি অনুরাধাদি দুজনেই হাসলেন এবং বললেন,' ঠিক আছে ।অন্য একদিন আসবো।'
রেখা বলল 'আপনারা পৌঁছে কিন্তু আমাকে একটু জানাবেন ।ফোন করতে না পারেন , অন্তত আমাদের গ্রুপে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেবেন। চিন্তায় থাকব।'
রিম্পাদি ,অনুরাধাদি ' দুজনাই বলেন ঠিক আছে।'
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। রিম্পাদি অনুরাধাদি গাড়ি থেকে হাত নাড়তে লাগলো ।রেখা ও এই দিক থেকে হাত নাড়তে লাগলো।
রেখা বাড়িতে ঢুকে কলিং বেল বাজাল ।কলিং বেলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে' জয় গনেশ ,জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।'
মনোজ এসে দরজা খুলল ।মনোজের মুখটা থমথমে। রেখা ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে রুমে ঢুকলো। টাওয়াল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করার সময় মনোজ বললো 'লিলি আর নেই।'
রেখা কথাটা শুনে ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ল। চোখে তাকিয়ে শুধু প্রশ্ন' নেই মানে?'
তখনো রেখা কল্পনা করতে পারেনি গিলি যে তাদের ছেড়ে অনেক অনেক দূর চলে গেছে যার নাগাল কোনদিনও পাবে না। কখনো ওকে ছুঁইয়ে আদর করতে পারবে না।তিন মাসও কমপ্লিট হয় নি ।এই তিন মাসের মধ্যেই কতটা রেখাকে জড়িয়ে নিয়েছিল ।ভগবান কেন এরকম করলো কে জানে?
মনোজ শুধু বলল 'কিছু করার ছিল না এক্সিডেন্ট?'
রেখা খুব উত্তেজিত ভাবে আর ভীষণ জোরে কেঁদে বলল"অ্যাক্সিডেন্ট মানে? কি করে এক্সিডেন্ট হয়?'
আর হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে " লিলি, লিলি বলে।"
মনোজ বলল'' শান্ত হও।'
রেখা বলল ' তুমি কি করছিলে?'
মনোজ বলল'আরে মিলি তো কিছু খাবার খেয়ে এসে বাচ্চাদের খাওয়াবে বলে চেঁচাতে
থাকে ।প্রতিদিনই তো গেট খুলে দেয়া হয়। ঠিক সেভাবেই খুলে দেয়া হয়েছে'।
রেখা বলে তাহলে 'এক্সিডেন্ট হয় কি করে?।
মনোজ বলল 'ওরা ঠিক মায়ের কাছে গিয়ে খাবারটা খাচ্ছিল ।ঠিক সে সময় একটা টোটো আসে আর হঠাৎই লিলি দৌড়ে রাস্তায় আসে এবং টোটোর সামনে পড়ে।'
রেখা বলল' টোটোওয়ালাকে ধরে কিছু দাওয়াই দিতে পারো নি। নিরীহ জীবগুলোকে ওরা এভাবে চাপা দেয়।'
মনোজ বলল 'টোওয়ালার এখানে কোন দোষ ছিল না ও আস্তে আস্তেই আসছিল।'
রেখা বলল 'তুমি আর টোটোওয়ালার হয়ে গুন গান গেয়ো না। আমার কিন্তু প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।'
মনোজ বলল 'টোটোর গতি বেগ কম ছিল হঠাৎ ই লিলি ছুটে এসে সামনে পড়ে।'
রেখা বললো'-তারপর?'
মনোজ বলল 'ওর গায়ে চোট-আঘাতের চিহ্ন দেখা গেল না ।তারপরেই টোটো টা সরিয়ে নিতে লিলিটা আবার ছুটে ওর মায়ের কাছে আসে।কিছুটা খাবার খায় ।তারপর ছুটে ও নিজের ঘরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় ওর রক্ত বেরোচ্ছে।
আমি তখন ওর কাছে উপস্থিত ছিলাম ।আমি আমি দেখতে পাচ্ছি একটা তরতাজা প্রাণ কি করে সবাইকে ছেড়ে চলে যায়।"
রেখা বলল-"আমার লিলি ,আমার লিলি বলে রেখা চিৎকার করে ওঠে।'
মনোজ বলল'আমি ওর মুখে জল দিলাম ।জলটা খেলো তারপর আমার দিকে তাকিয়েই মারা গেল।'
রেখা তো ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আর বলে জানো' আজ সকাল বেলায় যখন ওদের দুধ-রুটি খাওয়াতে গেছি, ওরা তো প্রতিদিনই সকলে ছুটে গেটের কাছে আসে আওয়াজ পেলে। কিন্তু খাবার থালা দেখলেই ওরা আবার এক এক করে নিজের শোবার জায়গাটায় চলে যায়।'
রেখা আরো জোরে কেঁদে ওঠে' আমার লিলি ,লিলি, লিলি বলে।'
মনোজ বলল 'কিছু করার ছিল না। নইলে কি চেষ্টা করতাম না বল?'
রেখা বলল' জানো?'আজকে লিলিকে যখন আমি ঘরে থেকে বের করতে গিয়ে বলছি সোনা বেবি তুমি ভেতরে ঢুকে কেনো? তখন কী করলো জানো?'
মনোজ উদাসী দৃষ্টিতে তখন রেখার দিকে তাকিয়ে।
রেখা বলল 'ও সুন্দর ছোট্ট বাচ্চাদের মত আদর করে শুয়ে পড়ল । যেমন ছোট বেবিরা বিছানা ছাড়তে না চাইলে ,যেরকম করে ঠিক সে রকম।'
মনোজ উৎসুক দৃষ্টিতে রেখার দিকে তাকিয়ে।
রেখা বলল' তখন আমি ওকে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে টেনে বের করে কোলে তুলে নিলাম ।ওর মুখে বার বার চুমু খেতে লাগলাম ।আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলাম। ও মুখের দিকে চুপ্টি করে তাকিয়ে থাকলো।'
মনোজ এবার উঠে বসলো আগ্রহভাবে রেখার দিকে তাকিয়ে। চোখে তখন জল ছলছল।
রেখার কন্ঠ তখন বাকরুদ্ধ তবুও বলল 'তারপর ওকে বললাম তুমি খেয়ে নাও ।তবুও সে খাবে না তখন হাতে করে করে ধরলাম ওদের মুখের কাছে তখন ওরা খেলো।'
রেখা এসব কথা বলছে আর কাঁদছে ।রেখার বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায় ।ভুলতে পারছে না ছোট ছোট কার্যকলাপকে।
রেখা আর ও বললো' যখন ওদের খাওয়ানো কমপ্লিট হলো ।তারপর জল দিয়ে দেয়া হলো ।জলের বাটিটা থেকে ওরা জল খেতে লাগলো।' আজকে একটা অভিনব কান্ড করেছে লিলি।এখন সব মনে পড়ছে।'
মনোজ এবার শুধু আস্তে করে বললো 'কি?'
রেখা বলল 'গেটে তালা চাবি দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাবো, ঠিক তখনই লিলি এসে আমার দোপাট্টা টেনে ধরল ।এবার তাকাতেই ও যেন ওর ভাষায় কিছু বোঝাতে চাইল। ওকে কোলে নেওয়া হলো। তখনো কি জানতাম লিলি এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে? সব থেকে বড় কথা কোথাও যাবার আগে সবসময় ওদেরকে একবার দেখে যাই আজকে এতটা লেট হয়ে গেছে গাড়ি এসে গেছে আর ওদেরকে দেখার টাইম হয় নি আমার।'
রেখা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল তারপরদেখল ওদের খাবার টাইম হয়ে গেছে দেখে কাঁদতে কাঁদতেই গিয়ে আবার খাবার গরম করলো। তারপর খাবার নিয়ে সরাসরি চলে গেল ওদেরকে খাওয়াতে। খাবার দিতে গিয়ে ওদের সামনে রেখা আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠলো।
আর রেখার কান্না দেখে তুলি , পাইলট চিৎকার করতে লাগল এবং রেখাকে নানাভাবে নানা দিক থেকে আদর করতে লাগল ।কখনো গালে, কখনো হাতে, কখনো মাথায়। আর গা বেয়ে বেয়ে উঠতে শুরু করল। ওরা ওদের নিজের ভাষায় 'ঘেউ ঘেউ' আওয়াজও করলো।'
রেখা তখন ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল।দু চোখে তখন জল ।'
খাবার দিয়ে এসে ঘরে প্রবেশ করতেই রেখা জিজ্ঞেস করল "তুমি খেয়েছ?'
মনোজ বলল 'আমার ওই অবস্থাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করে নি।'
রেখা বলল' তোমারও তো শরীরটা খারাপ .খাবর খাওয়া উচিত ছিল? তাহলে কি ভাত করে দেব?'
মনোজ বলল 'আমার খাবার করতে হবে না।'
রেখা বলল 'তাহলে কি খাবে?'
মনোজ বলল 'ভাইপোকে বলেছি চারটে ডালপুরি এনে দিতে।'
রেখা বলল 'সারাদিন কিছু খেলে না। এখন ডাল পুরি খাবে?'
মনোজ বলল'আমার খাবার নিয়ে আমাকে ভাবতে দাও।'
রেখা বলল'ok
কিন্তু রেখার চোখের জল তখনও কমে নি। বারবার লিলির কথা বলছে আর কাঁদছে।
আর তখনই পুরশ্রী ভবনে গান বাজছে'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে। আমি বাইব না ,আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে...।'
গানটা যেন রেখার অন্তরাত্মায় একাত্ম হয়ে
গেছে। রেখা বারবার লিলির কথা ভেবে ভেবে অস্থির হয়েছে, ডুকরে ডুকরে কেঁদে
উঠেছে ।উৎসবমুখর বিয়ে বাড়ির আনন্দ আর,আনন্দের মধ্যে যে তার লিলি না থাকার বেদনা তার ভেতরে একটা শূন্যতা সৃষ্টি করে দেবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিল । রেখা শুধু শূন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।