০৬ জানুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ /পর্ব ৪৯




শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
( পর্ব ৪৯ )
শামীমা আহমেদ 

" ছার,লাঞ্চ করবেন না? অনেক  তো বেলা হইছে। "
কবিরের কথায় শিহাব ল্যাপটপ স্ক্রীন থেকে মুখ সরালো। ছার, কিছু কি আনমু? সক্কাল থেইকা সে যে কাজে ডুবলেন আর তো একটু পানিও খাইলেন না। 
শিহাব জানতে চাইলো, কয়টা বাজছে কবির?
ছার,সোয়া দুইটা বাজে।
আচ্ছা ঐ ছেলেটা  কী চলে গেছে?
জ্বি ছার,কার সাথে যেন ফোনে কথা কইল আর দুইটার দিকে চইলা গেলো।
শিহাব একটুক্ষণ কি যেন ভেবে নিয়ে মনে মনে এই সিদ্ধান্তে এলো,নাহ! শায়লার কাছে তার সততা পাহাড়সম উচ্চতায়। সে কখনোই তার এই বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না। তক্ষুনি শায়লার মেসেজ এলো,লাঞ্চ করেছো? 
এইতো করবো।
খেয়ে নাও অনেক বেলা হলো।
---আচ্ছা,লিখেই শিহাব মোবাইল থেকে মুখ তুলতেই দেখলো,  কবির তার আদেশের অপেক্ষায় মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

কি আনমু বলেন ছার।
চাইনিজ না দেশী খাবার?
যদিও দেশী খাবারেই শিহাবের আগ্রহ বেশি তবে সেটা,ঘরে মা ভাবীর হাতের রান্না।
শিহাব কেমন যেন আনমনা হয়ে কবিরের কথাগুলোর উত্তর দিচ্ছিল।তার ভেতরে ভাবনায় অন্য কিছুর ঘুরপাক চলছে।কিছু খাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারেই নেই।
তুমি লাঞ্চ করেছো কবির? 
না ছার,আপনি না খাইলে আমি ক্যামনে খাই? 
সেকি, এত বেলা হয়ে গেছে তুমি না খেয়ে আছো,শিগগির খেয়ে নাও।আর 
আমি আমার খাবারের অর্ডার দিচ্ছি ওরা  খাবার পৌছে দিবে।কবির মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি জানিয়ে রুমের পাশেই ছোট্ট ঘরের মত জায়গাটায় তার বাসা থেকে আনা টিফিন ক্যারিয়ারটা খুলে খেতে বসলো।কবিরের বউ খুব যত্ন করে রান্না করে খাবার সাজিয়ে দেয়। কবিরও তার বউটাকে খুবই ভালোবাসে।
শিহাব ভাবলো,পৃথিবীতে ধনী গরিব  মধ্যবিত্ত দিনমজুর কিংবা রিকশাচালক সবার জীবনেই এ যেন এক অনন্য সুখ! স্ত্রীর হাতের রান্না স্বামী পরম তৃপ্তি নিয়ে খায়।আর স্বামী  অন্তঃপ্রান স্ত্রীরা জীবনের শত কষ্টের বিনিময়ে স্বামীকে স্বযত্নে খাওয়াতে ভালবাসে।
শিহাব  কাছেই একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ওদের সেট মেনু অর্ডার করলো। বিশ মিনিটের মধ্যেই ওরা খাবার পৌছে দিলো।এর মধ্যেই কবির খাওয়া শেষ করে নিলো।
শিহাবের অফিস রুমের এক কর্ণারে লাঞ্চের জন্য টেবিল চেয়ার সেট করা আছে।শিহাব সেখানে বসেই লাঞ্চ সেরে নিলো।খাবার শেষে একটু আয়েশি ভঙ্গিতে শিহাব একটা বেনসন ধরিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন হলো।ঘড়ির কাটায় তিনটা তিরিশ।নিশ্চয়ই রিশতিনা তার জন্য অপেক্ষা করে ফিরে গেছে কিংবা শিহাব যাবে না  জানতে পেরে হয়তো সেখানে আর যায়নি।
নাহ! এ হয় না।আমার অতীতকে ভুলতে হবে নয়তো সামনে এগুনো যাবে না।এবার নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে নিবো।শায়লাকে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখেছে সেটাই হবে তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।কিন্তু রিশতিনার সাথে দেখা করতে না যাওয়াটাও  শিহাব বারবার নিজের বিবেকের কাছে  হেরে যাচ্ছে।
শিহাব চোখ বন্ধ করে সেই দিনগুলির কথা ভাবছিল। যখন শত বিত্ত বৈভব পিছে ফেলে রিশতিনা তার কাছে ছুটে এসেছিলো।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।কত প্রাচুর্যেই না বড় হয়েছিল। শিহাব নিজেকে বুঝে উঠতে পারছে না। কি করবে।কারো কাছে এ বিষয়ে  পরামর্শ নেয়ার মত এমন নিরপেক্ষ কাউকে তো দেখছে না।
ব্যবসায়িক কত কিছুরইতো শিহাব ডিল করে, কত কন্ট্র‍্যাক্ট,কত ডিসিশন,কত স্টেপ, কত ফিউচার প্ল্যান,কত একশানতো তাকেই নিতে হয়।ব্যবসায়িক বন্ধুরা  তার দিকে তাকিয়ে তাকে।এ ব্যাপারে তার প্রজ্ঞা আর দূরদর্শী বন্ধুদের বিস্মিত করে।তাইতো তারা বলে,, এইসব ব্যাপারে শিহাব নাকি যথেষ্ট দক্ষ।বন্ধুরা তাই তার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে।কখনো কোন ডিসিশন তার ভুল হয়নি।কোন ব্যবসায়িক ক্ষতির সন্মুখীন তারা  হয়নি।কিন্তু নিজের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে তার এত চড়াই উৎরাই পেরুতে হচ্ছে। সহজ পথে কিছুই এগুচ্ছে না।

শিহাবের মোবাইল বেজে উঠলো।টেবিলের উপর ফোনটি ছিল।কবির আসতে আসতে রিং শেষ হয়ে গেলো।আবার কল এলো।কবির মোবাইলটা এগিয়ে দিলো।শিহাব দৃষ্টি ফেলে দেখলো বন্ধু রোমেলের কল।শিহাব কল রিসিভ করলো।ওপ্রান্ত থেকে টগবগে কন্ঠ!
দোস্ত কেমন আছো?
আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।
তুই কেমন আছিস?
ভালো,দোস্ত,তবে তুমি কেমন যেন কিছুদিন যাবৎ ঝিম মাইরা আছো।কি হইছে তোমার?
কতদিন আড্ডা নাই,ঘুরাঘুরি নাই। খাল্লি কাজ আর কাজ।বন্ধুর মিষ্টি অনুযোগ। 
 উত্তরায় ব্যবসায়িক কাজের সুবাদে রোমালের সাথে পরিচয়।খুবই খোলা মনের একজন সৎ ব্যবসায়ী। উত্তরাতেই স্থায়ী বসবাস। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের কারণে আজ ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে যাওয়া।ওর অফিস সেক্টর নয় এ।নিজে বাড়ির নিচ তলায়।
শিহাবের নীরবতায় রোমেলের ঝংকার,
দোস্ত, তোমার কি হইছে,বলা যায়? 
কই কিছু না তো?
ঠিক আছে কিছু না হইলে আজ সন্ধ্যায় দিয়াবাড়িতে চা পানের আড্ডায় চইলা আসবা।আসবা মানে আমরা একসাথে রেরুমু।
যদিও শিহাবের আজ হৈ হুল্লোড় করার মত মনের অবস্থা নেই।তবুও।বন্ধুত্বের খাতিরে তা করতে হবে।তাছাড়া ওরা খুব ভালো বন্ধু।বিশেষ করে রোমেলের মধ্যে একটা ভালো মানুষের সব গুনাগুনই আছে।
সন্ধ্যার পর দিয়াবাড়ির সেই চায়ের আড্ডায় বন্ধুরা হৈ চৈ করে একজন আরেকজনকে
নানানভাবে খোঁচাচ্ছে।বিবাহিত বন্ধুদের সবার কার সাথে কার পরকীয়া চলছে।কে কোথায় কতবার ডেটিং এ যাচ্ছে।কোন ভাবির স্বামী দেশের বাইরে আছে তার ফোন নাম্বার লেনদেন চলছে।বউকে কে কিভাবে ফাঁকি দিচ্ছে এসব যেন আজ এক সামাজিক ব্যাধিতে দাঁড়িয়েছে।তারা বুঝতে পারছে না,যখন তাদের স্ত্রীদের তারা ফাঁকি দিচ্ছে তাদের স্ত্রীরাও তখন অন্যের বগলদাবা হয়ে 
চাওয়া পাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছে।একটা অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে সন্তানরা বড় হচ্ছে।তাইতো তারাও বিপথে যাচ্ছে। নেশা আর সেক্স, আর সহজলভ্য পর্ণোগ্রাফিতে ঝুঁকছে।
শিহাব  গুটিশুটি মেরে আলো আঁধারিতে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে সিগারেট নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের তারা দেখছে।  চায়ের অর্ডার দেয়া হয়েছে।শিহাবের আজকাল সিগারেট একটু বেশিই লাগছে।কি আর করা! এতসব টেনশনে সিগারেটের সাথেই যেন সব কথা বলে চলা।
শিহাবের শায়লাকে খুব মনে পড়লো।আজ তার দিক থেকে কোন কল যায়নি শায়লার কাছে।নিশ্চয়ই শায়লা অপেক্ষায় ছিল। শিহাব শায়লার নাম্বারে কল দিলো।ফোনটা বেজেই চললো।একসময় থেমেও গেলো।পরক্ষণেই শায়লার কল ব্যাক।
শিহাব!
কেমন আছো শায়লা?
ভালো।তুমি?
ভালো। 
না,তোমার কন্ঠ কেমন যেন শোনাচ্ছে আর আশেপাশে এত হৈচৈ এর শব্দ।তুমি কি বাইরে?
হ্যাঁ শায়লা, বন্ধুদের সাথে দিয়াবাড়ি চা খেতে এসেছি।তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।একদিন তুমি আর আমি এখানে এসে চা খাবো।
ঠিক আছে। বেশি রাত করোনা।
আচ্ছা,কি করছিলে?
এইতো,তোমার দেয়া ব্রেসলেটটা দেখছিলাম।জানো শিহাব,আমি আজ অনেকবার ব্রেসলেটটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি।আর প্রতিবারই ওটা কথা বলে উঠেছে!একদম তোমার কন্ঠস্বরে!
শিহাবের ভেতরটা একবারে মোচড় দিয়ে উঠলো!কী ভীষণ গভীরতায় শায়লা যে তাকে অনুভব করে।
তা ব্রেসলেটটি কি বলে?
চুপ কেন? বলো।ব্রেসলেটটি কি বলে?
বলে, শায়লা আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
হু, ঠিকই তো বলে।আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি শায়লা।
রোমেল দুই কাপ চা নিয়ে শিহাবের দিকে এগিয়ে আসছে। শিহাব কথা সংক্ষিপ্ত করলো।ঠিক আছে শায়লা রাতে কথা হবে।রাখছি।
শিহাব হাত এগিয়ে  চায়ের কাপ নিয়ে, দুই বন্ধু চায়ে চুমুক দিলো।রোমেল যেন শিহাবের চোখের ভাষা পড়তে চাইছে।শিহাব তার চোখ আড়াল করতে চাইছে।রোমেলের আক্রমন ছুটে এলো---
কি দোস্ত,প্রেমে ট্রেমে পড়ছো নাকি?কেরম যেন আউলাভাবে থাকো আজকাল।আমাদের কোন ফোন নাই যোগাযোগ নাই।
খুবই হালকা করে শিহাব বললো,কি যে বলোনা দোস্ত। শিহাবের কথাতেই বুঝা গেলো কথার মাঝে কিছু ফাঁক আছে।
আরে দোস্ত, পুরুষ মানুষের এত্ত আবেগী হইলে চলে না।অতীত নিয়া পইরা থাকলে কি চলবো?জীবনটারে আবার নতুন কইরা সাজাও। সময়তো খুবই কম।বলাতো যায় না,
কার কখন ডাক আসে।
বন্ধুদের আড্ডায় নিজেকে খুবই প্রাণহীন করে রাখলো শিহাব।অন্যরাতো গল্পতে মেতে উঠেছে। রিশতিনার ডাকে না গিয়ে কেমন যেন একটা অপরাধ বোধের কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে।
ঘড়িতে রাত নয়টা বেজে গেলো।শিহাব বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিলো।রোমেল তার কাঁধে হাত রেখে বললো,বন্ধু কোন পরামর্শ বা  আলোচনার দরকার হইলে এই দোস্তটারে স্মরণে আইনো।আমি আছি তোমার পাশে।
শিহাবের ভেতরে অনেক কথার আকুলিবিকুলি থাকলেও বুকের ভেতরেই তা চাপা রইল।কন্ঠনালী পর্যন্ত তার অনুমতি মিললো না।শুধু চোখ দুটোতে নির্বাক দৃষ্টি আর  তার সাথে দেখা না হওয়ায় রিশতিনার অভিমানী মুখটা বারবার ভেসে উঠছে। তার মনের ভেতরও রিশতিনার প্রতি রাজ্যের প্রশ্ন জমা হয়ে আছে।


চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much