আলো
অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী নিযুক্তা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের। কারো সাথে কোন কথা বলে না। শ্রেণী শিক্ষিকা রেজিনা বেশ কিছুদিন ধরেই নজর রাখছেন। অনেক কথা বলানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একদম চুপ। একদিন ক্লাস শেষে মেয়েটিকে ডেকে অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন। আর বললেন -'আজকে কি দিয়ে ভাত খেয়ে এসে ছিলে ?মা ভালো রান্না করেছিল? মেয়েটি এই কথা শুনে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আর হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। রেজিনা আরো কাছে টেনে নেন। তখন সে বলে 'আমার মা নেই। বাড়িতে সৎ মা। ঠিকমতো খেয়ে আসতে পারি না।' তখন দিদিমণি বললেন-' মিড ডে মিল খাচ্ছ তো'? ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।ওই টুকুই আমার পেটে থাকে।। বাড়িতে গিয়ে কি করো? সমস্ত কাজ আমাকে দিয়ে করানো হয়। আমার একটা ছোট ভাই আছে ,।তাই যেটুকু মা খাবার দেন ওটুকু আমার ভাইকেই আমি দিয়ে দি। এজন্য আমি পড়া করে আসতে পারি না দিদিমণি। কিন্তু আমার ইচ্ছে হয় আমি সবকিছুতে অংশগ্রহণ করি। আমি আঁকতে খুব পছন্দ করি। রেজিনা জিজ্ঞেস করেন-
'তুমি আঁকতে পারো।' আপনি। দেখবেন? দেখি দেখি। রেজিনা অবাক হয়ে যায় ।এ তো রেজিনার ছবি। তুমি এতো ভালো আঁক। তুমি কি কারোর কাছে আঁকা শিখতে?ছোটবেলায় মা শিখিয়েছিলেন কিন্তু এখন আর আঁকার কোন জিনিস হাতের কাছে নেই আর সময়ও পাইনা। ঠিক আছে শোনো এবার স্কুলে কোন আঁকার প্রতিযোগিতা হলে তাতে তুমি দেবে। কিন্তু দিদিমণি ওদের সাথে তো আমি অত ভালো করে আঁকতে পারবো না, তুমি যা পারো তাই আঁকবে। মেয়েটি খুব উৎসাহিত হয় ।এরপর আস্তে আস্তে মেয়েটির লেখাপড়ায় মনোযোগী হয় আর ছুটি শেষে দিদিমণির সঙ্গে তার সমস্ত কথা শেয়ার করে। দেখতে দেখতে সমস্ত দেশ এক অতিমারি সংকটের মধ্যে পড়ে। ফলে স্কুল-কলেজ সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে রেজিনা নিযুক্তাকে নিয়ে ভাবতে বসে। কি খাচ্ছে মেয়েটি ,কে জানে ।এই মোচড় রোজিনাকে তিলে তিলে খায। সে আর ভাবতে পারে না। আজ যদি রেজিনার মেয়েটা বেঁচে থাকত তাহলে নিযুক্তার বয়সী হত। রেজিনার মরা গাঙে নতুন করে জোয়ার আসে।এ কদিনেই মেয়ে টি রেজিনার মনে অনেক গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তার কাছে যে ক্লাস রেজিস্টার এর খাতার কপি ছিল তা খুলে বসে। কিন্তু রেজিনা দেখে তাতে রোল নম্বর আছে কিন্তু কোন ফোন নম্বর নেই। আরেকটু নেড়েচেড়ে দেখেন ঠিকানা আছে।
রোজিনা একটু হতাশ হয় এই পরিস্থিতিতে ফোন নম্বরটা পেলে খুব ভালো হতো ।কিন্তু বাড়ি যাওয়া কি ঠিক হবে? মনের ভেতরে যে খচখচানি শুরু হয়েছে তাই সাতপাঁচ না ভেবে নিজেই স্কুটি করে তার বাড়ি পৌঁছে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন মেয়েটি বাসন মাজছে আর মা দাওয়ায় বসে ভাত খাচ্ছে। ছোট ভাই নিযুক্তার পাশে বসে আছে। নিযুক্তার জন্য কিছু বিস্কিট ,ফল ,লজেন্স নিয়ে গেছিলেন। বাড়িতে দিদিমণি আসাতে ওর সৎ মা একটু অবাক হয়ে যায় এবং নিজের সাফাই গাইতে থাকে। তার নিজের প্রচন্ড জ্বর তাই মেয়েটি নিজের থেকেই বাসন মাজছে। রেজিনার বুঝতে কিছু বাকি থাকে না। কিন্তু রেজিনা দিদিমণিকে দেখে নিযুক্তার মুখে এক অমলিন হাসি। সমস্ত অন্ধকার তার মুখ থেকে সরে যায়। সে দিদিমণিকে এসে জড়িয়ে ধরে। দিদিমণি বলেন " এ তোমার ভাই -বলেই তাকে কোলে তুলে নেন। তুমি লেখাপড়া ঠিকঠাক করছো তো? হ্যাঁ দিদিমনি। কিন্তু তোমার তো ফোন নেই ।তাই তুমি জানতেও পারছ না স্কুলের সমস্ত বিষয়।জান তো এবছর আমাদের একটা ভার্চুয়াল রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব পালিত হচ্ছে। মানে ফোনেতেই তোমাদের সমস্ত অনুষ্ঠান হবে ।তাই যে যা পারে নিজের সাধ্যমত কবিগুরুকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে। আর তুমি তো আঁকো ভালো । তাই তুমিও এতে অংশগ্রহণ করবে। দিদিমণি ,আমি কি করে ছবি পাঠাবো? ঠিক আছে তোমাদের বাড়িতে কি একটাও ফোন ..বলেই তার মায়ের দিকে তাকাল। হ্যাঁ ,আছে তো? আসলে স্কুলে দেয়া হয় নি। আমাকে দিয়ে দিন , আমি গ্রুপে এড করে দেবো। ওকে একটু একটু অনলাইনের ক্লাসগুলোতে ফোনটা দেবেন তারপরে নিয়ে নেবেন। ঠিক আছে দিদিমণি। রেজিনা এইটুকু আশ্বস্ত পেয়ে চলে যান। তারপর যথারীতি আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ তাতে তার আঁকা পাঠানো হয়। স্কুলের তরফ থেকে যে গুলোকে বাছাই করা হয় এবংএফ বি তে পোস্ট করা হয়। কিন্তু তাতে নিযুক্তার কোন ছবি সিলেক্ট হয় না। রেজিনা দিদিমণি আশাহত না হয়ে নিজের ফেসবুক একাউন্টে নিযুক্তার ছবি দিয়ে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করলেন। আর ক্যাপশন করলেন রবির আলোয় সকলেই আলোকিত হোক । আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ,ধুইয়ে দাও।'প্রথম দিন স্কুলের প্রোগ্রামের ছবি যখন এফ বি তে পোস্ট হয়। তাতে নিজের ছবি দেখতে না পেয়ে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । নিযুক্তার সৎ মা রেজিনা দিদিমণিকে ফোন করে এবং বলে তার মেয়ে আজ পাঁচদিন ধরে জ্বর, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। রেজিনা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান নিযুক্তার বাড়িতে। বাড়িতে নিযুক্তা দিদিমণিকে দেখে খুব খুশি হয় আর বলে সে আঁকতে পারে না , সে কিছুই করতে পারবে না কিন্তু রেজিনা ফেসবুকে যখন তার আঁকার ছবি দেখালেন। জ্বরের ঘোরে যেভাবে সে বক ছিল। নিজের হাতে আঁকা ছবি দেখে সে অত্যন্ত আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সে বলে আমি পারবো দিদিমণি আমিও কিছু করতে পারব তার দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে। রেজিনা বলেন, ' তুমি খুব পারবে, তুমি অনেক বড় হবে"। আমি সেরে উঠব তো দিদিমণি, বলেই দিদিমণিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। সে আসলে করোনা আক্রান্ত কিন্তু দিদিমণি নিজের দায়িত্বে নিযুক্তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেন ,তার পাশে থাকেন এবং সে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর সে বলে আপনি আমার কাছে গুরুমা আপনার আলো আমার জীবনে পড়েছে ,আমি আর অন্ধকারে থাকবো না। আমি খুব ভাল করে লেখাপড়া করব। তখন দিদিমণি বললেন ' আসলে আমাদের মনের অন্ধকার যিনি দূর করেন, আমাদের অন্তরে সর্বদা প্রজ্জ্বলিত রয়েছেন। তিনি হলেন ঈশ্বর আর আমাদের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনি পথ দেখিয়েছেন। মনে রেখো শুধু লেখাপড়া করলেই হবে না ।একজন ভালো মানুষ তৈরি হতে গেলে ন্যায়পরাযণতা, সততা, সৎ চরিত্র গঠন,গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, আর্তজনের সেবা এই সমস্ত নৈতিক গুণগুলো থাকতে হবে। তাহলেই তুমি প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। তবেই তোমার ভেতরে প্রকৃত আলোর প্রকাশ ঘটবে। সেই স্বচ্ছ আলোতেই ঘুচে যাবে সমস্ত মনের কালিমা। নিযুক্তা এত ভারী ভারী কথা বুঝতে পারলো না বটে ,তবে সে বলল আমি পারবো দিদিমণি সেই আলোকে আলোকিত হতে। রেজিনা নিযুক্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন -এ কান্না সুখের কান্না। রেজিনা জানেন বাস্তব কঠিন তাই নিজেকেও সংখ্যালঘু শিক্ষিকা বলে তাকে কম অপমানিত হতে হয়নি। কিন্তু সর্বদা আলোর দিশা দেখিয়েছেন ওই একজনই।