উপন্যাস টানাপোড়েন ৭৫
ভোরের স্বপ্ন
মমতা রায় চৌধুরী
আজকের রাতটা রেখার ভালো ঘুম হয় নি। ভেবেছিল পার্থর মা মানে মাসীমা আর মনোজ দুজনাই ভালো আছে তো মনের দিক থেকে একটু শান্তি পাবে ।আজকের রাতটা ভালো করে ঘুমাতে পারবে কিন্তু না মেয়েদের প্রজেক্ট এর চিন্তা , গল্পটা ভালো লাগবে কিনা পাঠকদের? সেই নিয়ে একটা চিন্তা ছিলো।তার দেখা ভোরের স্বপ্ন কি সফল হবে?'সে যাই হোক রেখার দুশ্চিন্তা আরও গ্রাস করল।
'কি অদ্ভুত এতবার মেসেজ করা সত্ত্বেও এই মেয়েগুলো প্রজেক্ট জমা দিল না ।আবার ফোন করা হচ্ছে তো ফোনের গলা শুনেই সুইচড অফ করে দিচ্ছে ।ভাবা যায় ?যাও বা কেউ ফোন ধরছেন বলছেন' তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ।''
রেখা এক অভিভাবককে তখন বলল 'আমরা তো ভাবতেই পারছি না ,একি রে বাবা ।কবে ,কেন বিয়ে দিলেন?এখন তো আপনাদের পড়ানোর কোনো অসুবিধে নেই ।তারপরও আপনারা মেয়ের 18 বছর হয় নি বিয়ে দিয়ে দিলেন?'
একজন ভদ্রলোক তো বলেই দিলেন '18 বছর হতে দুমাস মতো বাকি আছে । 18 বছর হয়ে যাবে। '
রেখা যখন জিজ্ঞেস করল 'আপনার বিয়ে দেবার জন্য এত তাড়া কিসের?'
ভদ্রলোক বললেন' ' দিনকাল ভালো না ।মেয়ে বড় হচ্ছে ।আশেপাশের লোকজন নানা কথা বলে ।এইজন্য ।আমরা তো সাধারন মানুষ?'
রেখা বলল 'আপনি পাড়ার লোকের কথায় কান দিলেন ?আর আমরা টিচাররা যে বলছি মেয়েকে লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভরশীল হতে দিন।'
ভদ্রলোক বললেন 'সে তো বুঝতে পারছি কিন্তু..?'
রেখা বলল 'কিন্তু, কিন্তু কি?'
ভদ্রলোক নিরুত্তর।
রেখা বলল 'আমরা জানেন কন্যাশ্রী ক্লাবে জানালে আপনার মেয়ের বিয়ে আটকে যাবে আর আমরা কিছুতেই বিয়ে হতে দেবো না?'
ভদ্রলোক কাকুতি-মিনতি করে বললেন' দিদিমণি, এই কাজটি করবেন না।'
রেখা তো রেগে গেল এবং বলল 'আপনি জানেন না এটা অপরাধ?'
ভদ্রলোক বললেন 'একটা ভালো সম্বন্ধ পেয়েছি দিদিমণি।'
রেখা বললো 'ভালো সম্বন্ধ ?কি ভালো সম্বন্ধ?'
ভদ্রলোক বললেন 'দেখুন আমরা খেটে খাই, ছেলেটার মুদির দোকান আছে।'
রেখা বলল 'শুধু মুদির দোকান দেখেই মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেবেন?'
ভদ্রলোক বললো 'তা ছাড়া আর কি করি বলুন 'আমাদের অত টাকা পয়সা কোথায়? খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকলেই হল।'
রেখা বললো' তা ঠিক জয় গোস্বামীর 'নুন' কবিতাটা মনে পড়ে গেল। যদিও সেটার মানে আপনাকে বোঝানো যাবে না ।কবিতার লাইনটা এরকম
'আমরা তো অল্পে খুশি, বলো আর অধিক কে চায়?
হেসে খেলে ,কষ্ট করে, আমাদের দিন চলে যায়।'
ভদ্রলোক বললেন 'যিনি লিখেছেন তা একদম আমাদের মনের কথা।'
রেখা এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি উত্তর দেবে তার ভাষা খুঁজে পেল না ।তারপর মনে মনে ভাবতে লাগল তাই তো কোথায় আমি ওনাকে বোঝাতে গেলাম, উল্টে উনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন তাদের জীবনালেখ্য।'
ভদ্রলোক আবার বললেন' দিদিমণি ,আমার মেয়ের বিয়েটা যেন বন্ধ করবেন না ।বুঝতেই পারছেন ,আমরা সমাজে থাকি ।বিয়ে ভেঙে গেলে আমার মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারব না।'
রেখা এ কথার কোন উত্তর দিতে পারল না ।আর মনে মনে ভাবতে লাগল' এখনও আমরা কোথায় পড়ে আছি। কোথায় আমাদের বিদ্যাসাগর মহাশয় ,কোথায় আমাদের রাজা রামমোহন রায় ?তাদের দেখানো পথে আমরা কবে হাঁটতে পারব?'
শুধু বললো 'কিন্তু আপনার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আপনি ভাবছেন ?সরকার তো এখন অনেক ব্যবস্থা করেছে লেখাপড়া শেখালে কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় টাকা পাবে। আর 18 বছর হলে তো 25000 টাকা এককালীন পাবে।লেখাপড়ার তো আপনাদের কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।'
ভদ্রলোক বললেন 'হ্যাঁ ,সে জানি।'
রেখা বললো 'তাহলে কেন আপনি মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছেন বলুন? আমাদের তো সরকার এই জন্যই বাল্যবিবাহ রোধ করার জন্যই তো এই প্রকল্প আর তাছাড়া যাতে মেয়েরা স্বনির্ভরশীল হতে পারে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে?'
ভদ্রলোক বললেন 'আসলে আমার তিনটি মেয়ে বুঝতে পারছেন ?ওই বড় এখনো দুজনে ঘাড়ের উপর ।এরকম করে থাকলে আমরা তো খেটে খাওয়া মানুষ ।আগেই বললাম।
রেখা বলল' তা ছাড়া মেয়েদের বিয়ের জন্য রূপশ্রী রয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে দিলে তো রূপশ্রী প্রকল্পের আওতায় আপনারা টাকা পেতেন?'
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন।
রেখা বলল' ঠিক আছে মেয়েকে পরীক্ষাটা দেওয়ার ব্যবস্থা অন্তত করুন।'
ভদ্রলোক বললেন' ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন তাহলে বলবো পরীক্ষাটা দিতে।'
রেখা বলল 'সেজন্য তো বলুন মেয়েকে প্রজেক্টটা যেন জমা দিয়ে যায় ।ঠিক আছে।'
ভদ্রলোক বললেন ' আচ্ছা, দিদিমনি আমি বলব।'
ফোনটা কেটে রেখার ভাবতে সময় কেটে গেল অনেকটা। কি করে এই মানুষদের বোঝানো যেতে পারে, কি করে?'
এখনো কয়েকটা মেয়ের বাকি আছে ফোন করার।
রেখা মনে মনে ভাবতে লাগল মেয়েটার বিয়ে আটকানোটা জরুরী ছিল কিন্তু ভদ্রলোক এমন অসহায় ভাবে বললেন, সেখানে রেখা যেন আটকে গেলো।
রেখাকে নিজের প্রতি খুব অসহায় মনে হল।
সঠিক সিদ্ধান্ত কোনটা সেটা জেনেও আজকে রেখাকে চুপ করে মেনে নিতে হচ্ছে। প্রতিনিয়তঃ আমাদেরকে এই ভাবেই মেনে নিতে হয়।
এর পরবর্তী ফোন নম্বর রেখা ডায়াল করলো
*******২৪৩২
দুবার তিনবার বেজে গেল কিন্তু ফোন তুললো না।
রেখা এবার নেক্সট নম্বর ডায়াল করলো******৪৩২৬
এই ফোন নম্বরে ডায়াল করার পর দু-তিনবার বাজার পর ফোনটা রিসিভ করে ভারিক্কি গলায় বললেন 'হ্যালো'।
একটু ঘাবড়ে গিয়ে রেখা বলল,' এটা কি অনিন্দিতা বালার ফোন নম্বর? আমি স্কুল থেকে বলছি।'
ভদ্রলোক বললেন 'না" না না ও পড়াশোনা করবে না।'
রেখা রীতিমতো ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
রেখা বুঝতে পারল 'নিশ্চয়ই অন্য কোন দিদিমণি ফোন করেছিল?
ভদ্রলোক বললেন 'একবার তো বলে দিয়েছি যে আমার মেয়ে পড়াশোনা করবে না ।তারপরও আবার ফোন করছেন?'
রেখা বলল না না আমি অন্য সাবজেক্টের টিচার বলছি।
ভদ্রলোক বললেন' আপনি আবার কি বলতে চাইছেন?'
রেখা বলল প্রজেক্ট এর ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি।
ভদ্রলোক বললেন' ওই দিদিমনিও তো প্রজেক্ট এর ব্যাপারে বললেন।'
রেখা বলল ' হ্যাঁ,ও দিদিমণি অন্য সাবজেক্টের কথা বলেছেন।'
ভদ্রলোক বললেন 'ঠিক আছে বলবো?কবে দিতে হবে?'
রেখা বলল 'এই সপ্তাহের মধ্যে।'
ভদ্রলোক বললেন ও তো নেই বাড়িতে। এ সপ্তাহে কি করে দেবে?''
রেখা বলল' মেয়েকে খবর দিন, এখনো তো সময় আছে।'
ভদ্রলোক বললেন" ঠিক আছে ফোন করে দেখবো?'
কিন্তু ও তো পড়তে চাইছে না।'
রেখা ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলল' মেয়েকে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে বলবেন। বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের।'
ভদ্রলোক বললেন' ঠিক আছে বলব?'
ফোনটা রেখে রেখা বিরক্তির স্বরে বললো 'বাপ রে, বাপ ।ওরে বাবা ,এ যেন টিচার এর দায় হয়ে গেছে সব ব্যাপারে।'
মনোজ এসে বলল' কি হয়েছে? তুমি আপন মনে কথা বলে যাচ্ছ?'
রেখা বললো 'আর কি বলি বলো তো ?এতজন মেয়ের গার্জেনকে ফোন করে জানতে জানতে, তাদের অসুবিধার কথা জানতে জানতে আমার সময় নষ্ট হয়ে গেলো। দেখো কটা বাজে?(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে)
এবার কি হবে বলো তো প্রজেক্ট যদি না পাই?'
মনোজ বলল 'আর মাথায় চাপ নিও না তো ,যা হবে হবে।'
এরমধ্যে আবার ফোন বেজে উঠল'আমি কার, কে আমার ,কী যে তার আমি হই..।'
মনোজ বলল' কার ফোন বাজছে?'
রেখা বলল' আমার ফোন?'
মনোজ বললো' বাপ রে ,তুমি আবার রিংটোন চেঞ্জ করেছ?'
রেখা হেসে উঠল' হ্যাঁ করেছি। তো?'
মনোজ বলল 'না না। আমি এমনি বললাম।'
রেখা বলল 'তাই বলো? আমি ভাবলাম তুমি আবার কি ভাবছ কে জানে?
মনোজ হো হো করে শুধু হাসতে লাগলো।
আবার ফোন বেজে উঠলো'আমি কার, কে আমার
কী যে তার আমি হই...।'
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল' হ্যালো।'
অপরপ্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক বললেন' ম্যাম আমি পত্রিকা থেকে বলছিলাম।'
রেখা বললো' কোন পত্রিকা?'
ভদ্রলোক বললেন "'আমি' সিঁড়ি' পত্রিকার সম্পাদক বলছিলাম।"
রেখা হাসতে হাসতে বলল ' ও নমস্কার'।
সিঁড়ি পত্রিকার সম্পাদক বললেন' এখন চিনতে পারছেন তো?'
রেখা হাত জোড় করে বলল 'কিছু মনে করবেন না ।আমি লজ্জিত। আসলে...
সম্পাদক বললেন 'আপনার কোন দোষ নেই ।আমি অন্য নম্বর থেকে ফোন করেছি।'
রেখা বললো 'এগজ্যাক্টলি। সেজন্য ই বুঝতে পারছিলাম না।'
সম্পাদক মহাশয় হাসতে লাগলেন আর বললেন 'কেমন চমকে দিলাম বলুন?'
রেখা ও হাসতে হাসতে বললো' তা আর বলতে?'
সম্পাদক মহাশয় বললেন' এবার কাজের কথায় আসি ম্যাম।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ বলুন'।
সম্পাদক বলেন' আপনার 'ওদের যন্ত্রণা 'গল্পটি কিন্তু লোকে ভীষণ ভাবে খাচ্ছে?'
রেখা বললো' মানে?'
সম্পাদক বলেন 'ও ম্যাম, সরি ।আসলে মানুষের চাহিদার মধ্যে রয়েছে গল্পটি।'
রেখা বলল 'তাই?'
সম্পাদক বললেন 'মনে হচ্ছে এই গল্পটির জন্য আপনার কিছু প্রাপ্তির..
রেখা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল' আমি ভীষণভাবে আপ্লুত।'
সম্পাদক বলেন 'আমরাও আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে আপনি এ ধরনের লেখা আমাদের পত্রিকায় দিয়েছেন।'
রেখা বলল 'দেখুন ,এটা আমাদের নিত্য ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা নিয়ে আমি লিখেছি ।মানে সময় ,বাস্তবতা নিয়ে লেখা একটা ঘটনা এতটা আমার মনে আঘাত হেনেছিল ।যার থেকে আমার লেখা ।যাক পাঠকের ভালো লেগেছে ।এজন্য সত্যিই আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই।'
সম্পাদক বললেন' ঠিক আছে ম্যাম, এই গল্প তো রইলোই ।এই গল্পের জন্য একদিন আলাদা ভাবে আপনার কাছে সাক্ষাৎকার নেয়া যাবে। আজকে রাখছি। আপনার কলমে এভাবে এগিয়ে চলুক ।শুভকামনা থাকলো।'
ফোনটা রেখে এতটা উত্তেজিত হয়ে গেছিল যে মনোজকে জড়িয়ে ধরে, আর আনন্দে ওর মন নেচে গান গেয়ে ওঠে ''শুধু তোমায় ভেবে ভেবে কত দিন রাত গেছে বয়ে..শুধু ভোরের স্বপ্ন হয়ে..।'নাকি
থেকে যাবে সাজবাতির রূপকথা হয়ে।
মনোজ বলল 'তাহলে কি এখন তোমার সেই ভোরের স্বপ্ন বাস্তব হচ্ছে।'
রেখা হাত দিয়ে ঈশ্বরের দিকে দেখায়।