উপন্যাস
টানাপোড়েন১২৩
অন্য খামের চিঠি
মমতা রায় চৌধুরী
সারাটা দিন পানকৌড়ির মত টুক করে ডুব দিয়েছিল স্বপ্নীলের মনে। বাড়িতে এসেই সেই ঘোর কাটল।অটো করে নামতেই বাড়ির সামনে
টাটা সুমো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হল ' কে এসেছেন বাড়িতে?
সেরকম কেউ হলে তো মনোজ তাকে ফোন করে জানাত অন্তত।'
বাড়ির সামনে গেটের কাছে একটু দাঁড়াল কলিংবেলটা বাজাবে ।ভাবতে ভাবতে আর একবার চিন্তা করে নিল' মনোজ কি জানতো?'
'কাকে জিজ্ঞেস করবে?'
'না না কাউকে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না তাহলে ভাববে বাড়ির খবর জানে না এ নিয়ে অনেকে নিজেরা হাসাহাসি করবে।'৯
তার থেকে নিজের থেকেই ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখাই ভাল। সেরকম কেউ হলে তো মনোজ অন্তত জানাতো। মনের দোলাচলতা নিয়ে রেখা গিয়ে কলিং বেল বাজাল। বেশ কয়েকবার বেজে গেলেও কেউ দরজা খুললো না।
রেখা ভাবছে 'সবাই কি এতই ব্যস্ত? নাকি বাড়িতে কিছু হয়েছে?'
তখন আপন মনেই কলাপসিবল গেট টা গিয়ে দেখল না গেটে তালা লাগানো নেই ।নিজে গিয়ে দুই হাত দিয়ে টান দিল। ভেতরের দরজা ছিল দরজাটায় গিয়ে নক করল। দরজা খুলে গেল 'ব্যাপারটা কি?'
আশ্চর্য হয়ে রে খা ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে ,কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ।কারা এসেছে? সন্ধিগ্ধ চিত্তে কাকিমা কাকুরা এসেছে?'
মনের ভেতরে একটা আলাদা উৎসাহ, উদ্দীপনা যেন কাজ করছে। যাক তাহলে তো ভালোই
হলো ।হয়তো আমাকে সারপ্রাইজ দেবে ,সে জন্য ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরের দিকে গেল।
ও বাবা ঘরে গিয়ে উঁকি মারতেই যেন ভূত দেখার মত দেখল । তাছাড়া কারেন্ট লাগলে যেমন শক খেয়ে যায় ,ঠিক এক ঝটকায় নিজেকে যেন সামলানোর চেষ্টা করল।বুকের ভেতরে যেন হঠাৎ করেই একটা ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।' কাকে দেখছে?'ও বাবা ননদও আছে?
শাশুড়ি মা ,ননদ ফুল ফ্যামিলি নিয়ে এসে উপস্থিত।'
রেখা এ কতগুলো মনের ভেতরে রাখল প্রকাশ করলে কি আর রক্ষে আছে?
রেখা তখন ব্যাগটা নামিয়ে শাশুড়ি মাকে প্রণাম করতে গেল।
শাশুড়ি মা দূর থেকেই বললেন 'থাক বাবা আর প্রণাম করতে হবে না। এমনিতে তো একটা খোঁজখবরও নাও না। এখন আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।'
রেখা কোন কথা বলল না। চুপচাপ থাকলো তারপর ননদকে প্রণাম করতে গেল ননদ পা সরিয়ে নিল ।প্র নাম নেব তুমি ভাবলে কি
করে ?তোমার জন্যই আজকে এই অবস্থা।
আমার মাকে অন্য জায়গায় থাকতে হয় ।তোমার লজ্জা করে না।."
রেখা খুব মনের ভেতর কষ্ট পেল কিন্তু কিছু বললো না ।তখন রেখা বেরিয়ে আসছে। মা কিন্তু এই ঘরেই থাকবে ,কথাটা মাথায় রেখো।
রেখা কিছু বললো না। সোজা চলে আসলো আর মনে মনে ভাবল যে ঘরে মনের মত করে সাজিয়েছে সেই ঘরে আজ তার অস্তিত্ব নেই আর যে কি দেখতে হবে কে জানে থাক যদি ওই ঘরেই তিনি ভাল থাকেন তাই থাকুন।
রেখা কোন কথা না বলে মনের কষ্টটাকে চেপে রেখে মিলিদllll ওদেরকে আদর করে কয়েকটা বিস্কিট রেখা এবার গেল ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে।
বাথরুমের জলের কল চালিয়ে দিয়ে রেখা অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল মাথাটা যেন কেমন অদ্ভুত ভাবে গরম হয়ে গেছে। কেন গরম হলো প্রেসার বাড়ে নি তো ? এসব কথা মনের ভেতরে তোলপাড় করছে। সেজন্য ভাবতে-ভাবতে রেখা ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে এলো কিন্তু তার তো সমস্ত জামাকাপড় তার ওয়ারড্রব এর মধ্যে
রয়েছে । বাইরে কিছুটা আছে । তার থেকে একটা পড়ে নেবে মনে মনে ভাবল।
রেখা বসার ঘরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে ঠাকুর ঘরের দিকে গেল। ঠাকুর ঘরের দিকে যাবার সময় শাশুড়ি মা বললেন'
' আর তোমাকে ঠাকুর ঘরে ঢুকতে হবে
না ।আজকের দিনটা করে নাও। কাল থেকে আমি ঠাকুরঘরের দায়িত্ব নেব।'
রেখা এখনো কিছু বলল না। শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে ।ধৈর্য কতটা থাকবে। ধৈর্যের বাঁধ একদিন ভাঙবে। চলন্ত নদীর স্রোতকে যদি বাঁধ দিয়ে তার গতিবেগকে রুদ্ধ করা হয় , বাঁধকে ইট-সিমেন্টের সুরকি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, তার স্বাভাবিক গতিতে রুদ্ধ করলে সে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।
রেখা মনে মনে ভাবছে তার ধৈর্যের বাঁধ ও কি এভাবেই ভেঙ্গে গিয়ে একদিন সে তছনছ করে দেবে
ভাবতে ভাবতে ঠাকুর ঘরের দিকে এগোয়। রাধা মাধব কে খুব সুন্দর করে সাজায়, আরতি করে
ভোগ নিবেদন করে ।আর মনে মনে শুধু বলে 'ঠাকুর ধৈর্য শক্তি দাও , সহনশীলতা দাও। সকল প্রতিবন্ধকতাকে যেন জয় করতে পারি।'
শাঁখ বাজিয়ে পূজা সমাপ্ত করে ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
এবার রেখা রান্নাঘরের দিকে যায় চা বানাতে। চা বানিয়ে কিছু ফুলকপির পাকোড়া বানাল। তারপর প্লেটে করে সাজিয়ে শাশুড়ি মার ঘরে যায় দিতে।
শাশুড়ি মা বললেন 'এগুলো বানিয়েছে? তা বেশ করেছো ।এসে তো কিছু সেরকম খাওয়া হয়নি।
ননদ বলল ফুলকপির পাকোড়া বানালে? অন্য কিছু বানালে হ'তো এত গ্যাস ফর্ম করে যাবে।'
রেখা বললো 'আসলে ঘরে তো সেরকম কিছু ছিল না আপনারা আসবেন সেটা তো জানা ছিল না।'
সে কি আমরা আসলে বাজার হবে আমরা না আসলে বাজার হবে না তোমরা কি উপোস করবে নাকি?
রেখা বলল " না ,আমি ঠিক সেইভাবে বলিনি।'
কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে শাশুড়ি মার পকরা খাওয়া হয়ে গেছে।
তিনি বললেন আরেকখানা দেখ ভালো হয়েছে কিচ্ছু হবে না।
রেখা অত্যন্ত আশান্বিত হয়ে সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে ঘাড় নাড়ল। '
তুমি এসব খাচ্ছ মা?
হ্যাঁরে তুইও খা দেখ ভালো হয়েছে।
রেখা কোন কথা না বাড়িয়ে চলে আসে তারপর মনোজের ঘরে দিতে যায়।
মনোজ বলল বাবা আজকে চায়ের সাথে টা টা তো বেশ ভালো বানিয়েছো।
রহস্যটা কি?
রেখার কোন কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না।
কি হল কথা বলছো না?
কি বলবো?
সে কি কোন কথা নেই?'
কথা হারিয়ে যাচ্ছে।
ও তাই বুঝি?
মা আসবে তো আগে বললে না?
ও বুঝেছি যেন তোমার কথা হারিয়ে গেছে।
মা আসবে কিনা সেতু কত আগে বলেছিল আসবে কবে আসবে সেটা আমাকেও জানায় নি হঠাৎ করেই তো চলে এসেছে।
রেখার মনের ভেতরে যে পাথরটা চাপানো ছিল অভিমান ক্ষোভ সেটা যেন দ্রুত হালকা হতে শুরু করল।
কামনারা কি আমাদের ঘরেই থাকবেন?
হ্যাঁ সেরকমই তো মা বলল কন বাথরুমটা একটু কাছে হবে।
রেখা জানে যে ঘরের এখানে থাকবে সে ঘর থেকেও বাথরুমের দূরত্ব বেশি নয়।
তাহলেও সে মুখে কিছু বলল না কারণ এটা একটা সেনসেটিভ এস এটা নিয়ে কিছু বলতে গেলে উল্টে রেখা কি সবাই দোষারোপ করবে।
তাই এড়িয়ে গেলে।
রাত্রে কি রান্না করবো?
মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো না?
মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে আমি রান্না করলে খাবেন তো?
না খেতে ইচ্ছে করলে কিছু করার নেই।
আমার হয়েছে জ্বালা এই বলেই পেতে পারে দিকে মনোনিবেশ করল।
রেখা কি বলবে।
রেখা সরাসরি শাশুড়ি মার ঘরে গিয়ে বলল কি রান্না করবো বলুন তো?
ওমা তুমি কি রান্না করবে তা আমি কি করে বলবো?
না আসলে শুনে নিলে ভালো হতো।
আসলে ঘরেবাজার তো সেরকম নেই আপনারা আসবেন আজকে সেটাও জানা ছিল না।
ডাল ঘরে আছে তো?
রেখা ঘাড় নাড়লো।
তাহলে মিক্সড সবজি ডাল করো।
আর কি বাজার আছে একটু বল?
আলু বেগুন ব্রকলি।
ঠিক আছে এক কাজ করো ব্রকলি আর আলুভাজা করো। বেগুন পোড়া করো।
রেখা ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
রেখার মনটা আনন্দে নেচে উঠল ।কিছুক্ষণ আগেও মনটায় যে আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল ভেবেছিল কখনো কি সেই আঁধার কাটবে?বিষন্নতায় ভরা ছিল তার মনের ভেতরটা। রেখা সব সময় একটা বিয়ের আগে কল্পনা করত শ্বশুর -শাশুড়ি মাকে নিয়ে সুখের সংসার করবে। কিন্তু সে আশা তার পূর্ণ হয়নি শ্বশুর মশাই তার বিয়ে হওয়ার আগেই পরলোকগমন
করেছেন ।আর শাশুড়ি মা ... না থাক, আজকে আর সেসব কথা সে ভাবতে চায় না ।যদি তার মনটা বদলে গিয়ে থাকে। তাহলে তো সোনায় সোহাগা ।সে রান্না ঘরের দিকে এগোয় রান্নার জোগাড় করবে বলে। যে ক্লান্তি গ্রাস তাকে গ্রাস করেছিল সেটা অনেকটা কেটে গেছে। দুচোখে শীতের বাহারি ডাকটিকিট তার কল্পনার রং হৃদয় ছুঁয়ে গেছিল। আলসে রোদের পিয়ন এসেযে খাম ধরিয়ে দিয়েছিল ,রেখা তা মনের কোণে সযত্নে সেগুলোকে রেখে দিয়ে ।এবার অন্য খামের চিঠি পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।