০৫ মার্চ ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২২




উপন্যাস 

টানাপোড়েন ১২২
তোর উঠোনের  বিশাল অংক, কষতে বারণ

মমতা রায় চৌধুরী




সেদিন ছিল নীল আকাশের গায় কোদালিয়া মেঘ। পড়ন্ত বিকেলের সূর্য যেন তার চলে চাইছে অন্য দেশে। যাবার তাড়া অন্য দেশে মুখ দেখাতে ।তার দেরি হয়ে যাবে যেন মনে হচ্ছিল। তার যাওয়ার তাড়া আছে। এদেশে তখন নামবে আঁধার । আজ রেখার মনেও যে একটু অন্ধকারের ছোঁয়া। বিসর্জনের শেষে মাকে বিদায় জানিয়ে
 ক্লান্ত ,অবসন্ন মন খুঁজে চলেএকটু ভালোবাসা একটু বিশ্বাস ,একটু ভরসার হাত,আশ্রয়। ভাঙ্গা মন নিয়ে ট্রেনে চেপে বসে। কয়েক বছর আগের দিনটা কত ভালো কেটেছে, বার বার মনে পড়ছে, স্বপ্নীল এর সঙ্গে কাটানো স্বর্ণালী মুহূর্ত। তাদের সম্পর্ক কখনো ক্লেদাক্ত তা ছিল না, ছিলনা কোন চাওয়া পাওয়া। জানতো যে চাওয়া পাওয়ার মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণতা দুটি নর-নারীর। সেই চাওয়া-পাওয়া কখনোই তারা পূর্ণতা দিতে পারবে না ।তবুও কেমন একটা আকর্ষণ চুম্বকের মত যেন তাদের আটকে রেখেছিল। সেদিনের সেই বিকেলে বাইকে চেপে কখনো বা তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল রেখা ।কখনো বা বাইক থামিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেছে সময় এর হিসেব। স্বপ্নীল
রেখাকে শুধুমাত্র একবার হাত ছুঁয়ে দেখেছিল রেখা চমকে উঠেছিল। রেখার ভেতরে রক্ত ছলকে উঠতে চাইছিল। স্বপ্নীলের ও হয়তো বা তাই ।কিন্তু তার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় নি ।পারদ একটা নির্দিষ্ট হারে উচ্চতা বাড়ালেও থেমে গেছে দুজনে। শুধু হাতে হাত রেখে গেছে তারা ।আর অনবরত তাদের প্রতিটি শ্বাস-পরছিল ঘনঘন। 
স্বপ্নীল আবেগঘন ভাষায় বলেছিল 
' কোনদিনও কি তাকে পরিপূর্ণ ভাবে ছুঁতে পারবে না ।'
রেখা শুধু তাকিয়ে ছিল স্বপ্নীলের দিকে। সেই তাকানোতে ছিল পরম চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আর না পাওয়ার একটা কি বেদনা ।
সেটা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ।রেখার চোখে জল ।স্বপ্নীল তার হাত পেতে তার চোখের জলটা তুলে ধরেছিল আর বলেছিল 
'এটা মূল্যবান এভাবে নষ্ট ক'রো না। '
কথা বলতে বলতে স্বপ্নীলের চোখ জলে ভিজে উঠেছিল ।
'একটা নারীর মন তাকে এতোটা আকর্ষণ করেছে কিন্তু সেই নারীর হৃদয়ের স্রোতে ভেসে যেতে পারছে না। তাকে ছুঁতে পারছে না।'
 দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল স্বপ্নীল ।
'পুনর্জন্মে বিশ্বাস করো তুমি?'
রেখা একটু মলিন হেসে বলেছিল
' যদি সত্যিই পুনর্জন্ম থাকে…।'
কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে স্বপ্নিল বলেছিল 'তাহলে সেই জন্মে সব আশা পূর্ণ হবে।
আমি না হয় এই জীবনে থেকে গেলাম তোমার কাব্যের বিরহের নায়ক হয়েই।'
'কেন এভাবে বলছ ?তোমার জীবনেও কোন নারী আসবে যে তোমাকে ভরিয়ে দেবে অন্য সুখ, অন্য স্বাচ্ছন্দে ,অন্য ভালোবাসায় ।তখন কি তুমি আর রেখাকে মনে করতে পারবে?'
স্বপ্নীল হেসে রেখার হাত দুটোকে ধরে বলেছিলো 'তোমার কি মনে হয় আমি পারবো?'
রেখা বলেছিল' জীবনে অবশ্যই দরকার আছে সবকিছু র।'
স্বপ্নীল বলেছিল 'আমি জানি প্রতিটা দেহের ভেতরে একটা খিদে থাকে। সেই শারীরিক চাহিদা মেটানোর দরকার। সবকিছুরই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকে।'
রেখা বলছে 'সে জন্যই তো বলছি।'
'কিন্তু আমার মনে হয় আমি পারবো না।
নারী মানে কি বলতো তার তো সবকিছুই আমার জানা। হ্যাঁ ,যে টুকু অজানা ।শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা টুকুনি বৃদ্ধির জন্য কি পেতে হবে?'
আজ তুমি যা বলছ দেখবে যখন তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাবে তখন কিন্তু এটা মনে হবে না।'
স্বপ্নীল আবেগ কম্পিত কন্ঠে বলে যাচ্ছে
'জানো মাঝে মাঝে কি মনে হয় যখন তোমার গলাটা শুনতে পাই না ।তখন মনে হয় আমি তোমার থেকে শত শত আলোকবর্ষ দূরে। শুধুমাত্র একটা ফোন কলের জন্য আমি ওয়েট 
করি ।শুধুমাত্র একটু কথা ,তোমার আওয়াজ শোনার জন্য ...তুমি কি উপলব্ধি করতে পারো?'
রেখা হেসে বলে 'জানো তো স্বপ্নীল একেতে তুমি আমার থেকে বয়সে ছোট। তোমার থেকে আমি অনেকটাই বড়। তুমি কোন মোহতে  পড়ে নেই
 তো ?মাঝে মাঝে. আমার বড্ড ভয় হয়।'
স্বপ্নীল বলেছিল' আমার কাব্যের মূল প্রেরণা তুমি
তোমাকে দেখেই আমার না ভেতরে একটা অনুপ্রেরণা পায় ।লেখার রসদ খুঁজে পাই। তুমি আমার কাব্যের মানসপ্রতিমা ।তোমাকে ঘিরেই আমি অবয়ব দি ই।
কিন্তু আমার আগে কি তোমার কোন মেয়েকে ভালো লাগে নি?'
স্বপ্নীল একটু হেসে বলেছিল' হ্যাঁ । মা কে।'
রেখা একটু অবাক হয়ে গেছিল।
কিন্তু জানিনা সেই বসন্তের দিনে তোমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ।সেদিনের তোমাকে যে দেখেছিলাম ,সেদিনই তোমাকে প্রথম বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিলাম তোমার হৃদয় ।তখন আমি ছুঁতে পারিনি কিন্তু তুমি আমার হৃদয় কে স্পর্শ করে গেছিলে।

স্বপ্নীল গুন গুন করে গান গাইতে থাকলো 'কতবার তোর বাড়ি গিয়ে ফিরে ফিরে এলাম আমার মতে তোর মতোন কেউ নেই 
কতবার তোর জানলা দিয়ে গলে হলুদ খাম
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই।
তোর বাড়ির পথে যুক্তির সৈন্য
যতটা লুকিয়েছিল কবিতায়
তারও বেশি ধরা পড়ে যায়।
তোর উঠান জুড়ে বিশাল অংক
কষতে বারণ ছিল তাই
কিছুই বোঝা গেল না প্রায়।
কখনো চটি জামা ছেড়ে এসে রাস্তায় দাড়ায়।
... আমার মতে তোর মতন কেউ নেই।"
কি অসাধারণ গাইল রেখা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়েছিল স্বপ্নীলের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে শুধু বিদ্যুত খেলে যাচ্ছিলো শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে। মনে হয়েছিল সত্যি স্বপ্নীল কে  যদি ছুঁয়ে দেখত এত কাছে থেকেও কোথায় যেন একটা কাঁটাতারের বাধা নিজেকে সংযত করে রেখেছে, রাখতে হয়েছে।
চায়নি সে কাঁটাতারের বাধাটাকে পেরিয়ে আসতে মনের ভেতরেই রেখে দিয়েছে ।তার আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো কখনো চেয়েছিল মনে মনে হয় তো একবার সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দুজনে পাশাপাশি চোখে চোখ হাতে হাত শুধু এইটুকু আশ।
স্বপ্নীল গান থামিয়ে রেখার চোখের সামনে হাত নেড়ে জানতে চেয়েছে কি হয়েছে কি দেখছ তুমি?
রেখা রেখা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেছিল মাথা নিচু করে নিয়েছিল স্বপ্নীল একটু হেসে ছিল আর বলেছিল আমি জানি তুমি দোলাচলতায়, টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ।
তোমার ভিতরেও পানকৌড়ির মত করে মাথা তুলে স্বপ্নগুলো ভালোবাসার ঘ্রাণ গুলো পেতে চায় হৃদয়ের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাকে অনুভব করতে। 
রেখা বলে কেন তুমি কি আমাকে রেখে তাই বুঝছো?
স্বপ্নীল গভীর মনোযোগের সঙ্গে রেখার দিকে তাকিয়ে বলে তোমার মনের আর মুখের ভেতরের অভিব্যক্তিগুলো জমিন পড়তে পেরে গেছি আঙ্গুল দিয়ে রেখার দিকে তাকিয়ে তার হৃদয়ের দিকে আঙুলটা তাক করে রেখে বলেছিল ওখানে তোমাকে আমি ছুঁয়ে ফেলেছি তুমি যতই অস্বীকার করো না কেন ?একদিন তুমি বুঝতে পারবে আজ তুমি আমার ডাকে সাড়া দিলে না বেশ 
ভালো ।তোমার যতটুকু সঙ্গ ,যতটুকু কথা ,হৃদয় স্পর্শ করেছে এইটুকুনি আমি বেঁচে 
থাকব ।জানিনা কোনদিন তুমি আমার থেকে হারিয়ে যাবে কিনা কিন্তু আমি তোমাকে সারা পৃথিবী জুড়ে খুঁজে বের করবই।
এর মধ্যে কয়েকজন প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়াতেও দিদি আমার ব্যাগটা দিন আমার ব্যাগটা দিন না।স্টেশন এসে গেছে কল্যাণী স্টেশন ,কল্যাণী স্টেশন এই ছোট বাচ্চাটাকে টেনে তুলল ঘুমিয়ে পড়েছে ।এর ভেতরে নিয়ে আর পারা যায় না এমন সময় হঠাৎই তার ভাবনায় ছন্দপতন ঘটে সে চলে গেছিল ।নস্টালজিক হয়ে গেছিল সে যেন সোদা মাটির গন্ধ পেয়েছে সেই গন্ধটুকু মনেপ্রাণে নিয়ে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে আসে ট্রেন থেকে নেমে পড়েন যখন সে হাঁটছে তখনো যেন সে একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আজ দুটো কথা বলার জন্য একটা ভালো মনের সঙ্গী পাবার জন্য মনের ভেতরে কতইনা আকুলি-বিকুলি।
স্বপ্নীল যখন কার চোখের তারা বিন্দুতে চোখ রেখে বলেছিল কিছু বলবে বলো না ,চল না মনের ভেলায় দুজনা ডানা মেলে উড়ে যাই নীল আকাশ,
 নীল আকাশ।
রেখার দু'চোখ জলে ভিজে ওঠে। অটোআলা সামনে এসে দাঁড়ায় 'দিদি ,কোথায় যাচ্ছেন হনহন করে হেঁটে এইতো এখানে দাঁড়িয়ে আসুন বসুন।
রেখা একটু মুলান হেসে বলেছিল 'হ্যাঁ ভাই চলো।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much