টানাপোড়েন পর্ব ৩৯
এক পশলা বৃষ্টির জন্য
মনোজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। রেখা অবাক হয়ে গেল। যা ঘুম কাতুরে। ব্যাপারটা কি?
রেখা বলল 'আজ কোথাও যাবে?'
মনোজ বলল 'হ্যাঁ'। সুমিতা আসে নি?'
রেখা বলল 'না।আডভ্যান্স টাকা নিল । তারপর থেকে বেপাত্তা।'
মনোজ বলল 'ভালোই চালাচ্ছে। তুমি স্কুলে যাবে তো?'
রেখা বলল ' হ্যাঁ ।ভুলে গেলে আজ খাতা জমা দিতে হবে। আমার মিলির জন্য চিন্তা হচ্ছে। ওকে কে খেতে দেবে?'
মনোজ বলল 'কে দেবে গৌরী সেন'। কেন আমাদের সন্টু দা ?ওকে বলে যাব।'
রেখা বলল ' কি ভাববে?'
মনোজ বলল ' কিছু ই ভাববে না। সন্টুদা তো ভালোবাসে ওদের।'
রেখা বলল 'দু শ্চিন্তা মুক্ত হলাম।'
এরমধ্যে মনোজের ফোন বেজে উঠল।
মনোজ ফোনটা রিসিভ করে বলল 'আমি ঠিক টাইমে পৌঁছে যাব।'
রেখা তখন রেডি হচ্ছিল স্কুলে যাবার জন্য ।কথাটা কানে আসলো কিন্তু কিছুই বললো না।
মনোজ বলল 'মিলিদের কিছু খাবার দিয়েছো?'
রেখা বলল 'দিয়েছি। (মুখে সেফটিপিনটা রেখে , শাড়ির কুচি কুচি করতে করতে )।এখন ওর একটু ঘন ঘন খিদে পায় না, দিতে তো হবেই। বলতে বলতেই তাড়াতাড়ি জুতোটা পরে নিল পায়ে আর বলল' বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে' ।ট্রেনটা পেলে হয়?'
মনোজ বলল 'চলো তোমাকে আমি পৌঁছে দিচ্ছি ।অটোতে যেতে হবে না।'
রেখা বলল ' তুমি যে কোথায় যাবে ?তোমার দেরি হয়ে যাবে না?'
মনোজ বলল ' আমি ও তো স্টেশনে যাব।ট্রেন ধরবো?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে চলো।'
রেখা মনে মনে বাইকে যেতে যেতে ভাবলো আজকে মনোজের মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে ,গত দু'দিন ধরে যা চলছিল..।
স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ঢুকলো ।
রেখা মনোজকে বলল 'আসি'।
মনোজ বলল 'সাবধানে?'
এবার মনোজের যাবার ট্রেন এসে গেল প্লাটফর্মে ।মনোজ ও ট্রেনে উঠে পড়ল। কিন্তু জায়গা পাওয়া যায় নি, যা ভিড় ট্রেনে,?ভাবতে লাগলো কি হবে তিথির সঙ্গে দেখা করে ,কে জানে?'ভালো ভালো কথা ভাবতে লাগলো ।পুরনো দিনের। প্রথম যখন তিথিকে কলেজে দেখেছিল ।তখন খুব সহজ সরল ছিল আর সুন্দরী তো ছিল ই। প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মনোজ ও তাই। অপরিচিত পরিবেশ কিন্তু সুরঞ্জন ছিল মনোজের পরিচিত। মনে আছে সে দিনও খুব বৃষ্টি পড়ছিল ।তিথি লেটে পৌঁছেছিল ক্লাসে। তাই ওই ক্লাসের নোটটা নিতে চেয়েছিল মনোজ এর কাছে। মনোজের প্রথম দেখাতেই তিথিকে ভালো লেগেছিল। তাই তিথি যখন মনোজের কাছে নোটটা চেয়েছিল। মনোজ ও দ্বিধাহীনচিত্তে তাকে দিয়ে দিয়েছিল তার নোটের খাতা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তিথির দিকে। তারপর আস্তে আস্তে মনোজের মনের কথাটা বলেছিল প্রায় ছমাস পর। তিথির ও ভালো লেগে ছিলো। তারপর কলেজ কমপ্লিট করে ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি। ইউনিভার্সিটি পর থেকেই বাকিটা ইতিহাস। কত খুনসুটি চলেছে।
মনোজ তিথিকে ভালোই বাসতো। কথা দিয়েছিল মনোজ কিছু একটা করলে ওরা দুজন একটা সুখের স্বপ্নের নীড় গড়বে। কিন্তু ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং ছেলে পেয়ে তিথি চলে গেল বিদেশে। সেদিন মনোজের কত কষ্ট হয়েছিল। একবারও ভাবেনি মনোজ এর জন্য। আজ মনোজের জীবনে রেখা এসেছে। আজ সমস্ত হৃদয়াকাশ জুড়ে শুধুই রেখা। এখানে তিথির অস্তিত্ব ফিকে। তিথির জন্য ভেতরে কোনো আলোড়িত হয় না। বরং যেন তার সুখের পৃথিবীতে তিথি বড়ো বেমানান। তবুও তার ডাকে সাড়া দিয়ে যেতেই হচ্ছে। শুধু বন্ধুত্বের দাবিতে যাচ্ছে ।যদি ওর ভেতরে কোন ক্রাইসিস থাকে সেটাকে মেটানোর জন্য। রেখা খুবই ভালো মেয়ে ওকে কোন দিনের জন্য কষ্ট দিতে পারবে না। দুইদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছে ওর সাথে। সে জন্য খুব খারাপ লাগছে। বলতে বলতে ট্রেনে শিয়ালদা স্টেশনে থামলো।
ট্রেন থেকে নেমে রেখাকে কল করল। রেখার ফোন রিং হয়ে যাচ্ছে। রেখা তখন স্টাফ রুমে ছিল না।
রিম্পাদি ওর ফোনের রিং শুনতে পেয়ে রেখাকে ডাকতে গেল। রেখা তখন বড়দির ঘরে।
রিম্পাদি বলল 'এই রেখা তোর ফোন বেজে যাচ্ছে। দু-তিনবার বাজলো।'
রেখা আশ্চর্য হয়ে বলল ' এই সময় আমার ফোন! কে করলো রে বাবা ।বড়দি তাহলে আমি আসছি।'
বড়দি বললেন' হ্যাঁ এসো।'
রেখা বলল 'আর একটা কথা বড়দি, আজকে আমি একটু তাড়াতাড়ি যেতে পারবো?'
বড়দি বললেন 'তোমার নম্বর সাবমিট করা হয়ে গেছে তো ?'
রেখা বলল-'হ্যাঁ বড়দি।'
বড়দি হেসে বললেন' কি করবে আর বসে থেকে।'
রেখা বলল 'এইজন্যেই দিদি আপনাকে সত্যিই এত শ্রদ্ধা করি, আমাদের সুবিধা -অসুবিধাগুলো আপনি বোঝেন বলে ।
থ্যাংক ইউ বড়দি।'
বড়দি বললেন'আমি চাই তোমরা সকলে খুশিমনে কাজ করো। তাহলে ছেলেমেয়েদের অনেকটা দিতে পারবে। শুধু শুধু প্রেশার ক্রিয়েট করে তো লাভ নেই ।তবে অনেকে আছেন/আছে সুবিধা নিতে ব্যস্ত ।এটা আমাকে কষ্ট দেয়।'
রিম্পাদি বলল 'বড়দি আমার ব্যাপারটা।'
বড়দি হেসে বললেন 'হ্যাঁ তুমিও যাবে। রেখা না থাকলে তুমি কি আর থাকবে ,সেটা আমি জানি না?'
রিম্পাদি জোড়হাত করে মাথা নিচু করল।
রেখা বললো 'চলো রিম্পাদি দেখি কে ফোন করেছে?'
দুজনে মিলে স্টাফ রুমে আসলো ।রেখা ফোনটা ঘেটে দেখল তিন থেকে চারটি মিস কল হয়ে আছে মনোজের।
রেখা ফোনটা নিয়ে মনোজকে ফোন লাগালো কিন্তু নট রিচেবল।
রেখা রিম্পাদিকে বললো 'চলো ট্রেনের
টাইম হয়ে যাবে। টোটো ধরতে হবে।'
রিম্পাদি বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো 'হ্যাঁ ,চল চল ,চল।'
রেখা মনে মনে ভাবল 'মনোজ কেন ফোন করেছিল কে জানে?'
অন্যদিকে মনোজ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস এর কাছে এসে দেখে তিথি দাঁড়িয়ে আছে।চেনাই যাচ্ছে না। কি যেন একটা হতাশা ওর মন জুড়ে রয়েছে। কি চেহারা হয়েছে ওর?'
মনোজকে দেখে তিথি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ।তারপর বললো 'চলো ন্যাশনাল লাইব্রেরী যাই।'
মনোজ মাথা নেড়ে বললো ' চলো।'
মনোজ মাথা নেড়ে বলল 'ঠিক আছে ।চলো।'
মনোজের একদমই ভালো লাগছে না ।তবুও যেতে হচ্ছে। আগে যে তিথির জন্য আবেগ ছিল, উত্তাপ ছিল। আজকে সেসব কিছুই নেই। আগে একটু ওর ছোঁয়া একটু পরশ পাওয়ার জন্য, এক পলক দেখার জন্য মনে ভেতরে একটা কেমন আনচান তৈরি হতো।
আজ যেন শুধু কথা দিয়েছে আসবে তাই।সেই চলায় কিছুই নেই। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পৌঁছে যখন দুজনে বসে ।তখন হঠাৎ তিথি মনোজকে জড়িয়ে ধরে । মনোজ কেমন হকচকিয়ে যায় ।ওর যেন কোনো তাপ উত্তাপ বলে কিছু নেই ।লোকে দেখছে ,কি দেখছে না? শেষে ৫ সেকেন্ড পর মনোজ তিথিকে বাহুবন্ধনে থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল আর বলল 'তিথি এটা তুমি করো না। বড্ড বেমানান ।'
তিথি বললো 'কেন আমি তো শুধু তোমার জন্য এসেছি ।আমি তো তোমাকে ভালবাসি ।'
মনোজ বলল 'আজ সেই ভালবাসার কোন মূল্য নেই। আজ তুমি আলাদা । আমি আলাদা। আমার সংসার আছে ।আমার স্ত্রী আছে ।আমি তাকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসি ।তোমার কি সমস্যা তুমি আমাকে বল ?সে জন্যই আমি এসেছি।'
মনোজ বুঝতে পারছে যতই ওকে বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিছুতেই সেটা করতে পারছে না। তিথির ভেতরে যেন বহুদিনের সঞ্চিত আবেগ হঠাৎ করেই বাঁধ ভেঙেছে। মনোজকে সেই জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে দূর থেকে বহু দূরে কিন্তু মনোজ সেই ডাকে সাড়া দিতে পারছে না।
মনোজ বলল 'তিথি সবাই দেখছে ।একটু জোর করেই নিজেকে ছাড়ালো ।তারপর বলল ' তোমার কিছু বলার না থাকলে ,তাহলে আমি আসছি ।আমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে।'
তিথি বললো 'আমি আজকে তোমার সঙ্গে সারাটা দিন কাটাতে চাই। আজকে কিছু বলব না আমি তোমায়। তুমি আমাকে সময়টুকু দাও।'
মনোজ বলল 'এ কথা তো ,তুমি আমাকে বল নি আগে ?আমার সময় নেই ।আমাকে যে বাড়ি ফিরতেই হবে।'
তিথি বলল 'সেটা কখনো সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ফেলে দিয়ে যেতে পারো না।'
মনোজ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল তার বাড়িতে সমস্যা গুলোর কথা বলল ।
তিথি বলল ' ঠিক আছে। বহুদিন পর দেখা ।ভেবেছিলাম যে ,তুমি অন্তত আমার সঙ্গে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে কিছুটা সময় কাটাবে ।তাহলে তোমাকে আজকে কথা দিতে হবে, তুমি কবে আমার সঙ্গে আবার দেখা করবে ?'
মনোজ ভেবে দেখল _আজকের মত মুক্তি পেতে হলে তিথিকে কথা দিতেই হবে ।তারপর পরে ভেবে দেখা যাবে ।
তখন মনোজ বলল 'ঠিক আছে। আমি অন্যদিন তোমার সঙ্গে দেখা করব। তুমি যাও ।ঠিক আছে ।আমিও আসছি।'
মনোজ ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো আর তিথি ওখানেই দাঁড়িয়ে যতক্ষণ মনোজকে দেখা যায় দেখতে লাগল ।
মনোজ কিন্তু একবারও তাকিয়ে দেখল না যে চাতক পাখির মতো তিথি কেমন তাকিয়ে আছে ,একপশলা বৃষ্টি কখন তৃষ্ণার্ত বুকটাকে ভিজিয়ে দেবে।