উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৮৯
কখন যে কি হয়
মমতা রায়চৌধুরী
ফিরতে ফিরতে রাত নটা হলো। স্টেশনে এসে রেখা মনে মনে ভাবছে মনোজ একবারও তো আজকে ফোন করল না যদিও ওই সময়টা ফোনটা অফ রেখেছিল। ও কি এসেছে বাড়িতে?
এদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ও বাবা এদিকে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে ।তাড়াতাড়ি পা চালালো। "টোটো টোটো অ্যাই টোটো। "কি ব্যাপার আজকে একটা চেনা টোটো দেখতে পাচ্ছি না ।তখনো যাবার সময় অচেনা টোটো। টোটোওয়ালা কাছে এগিয়ে এসে বলল" হ্যাঁ দিদি ,বলুন।"
বলছি "বি ব্লক যাবে?"
"না দিদি।'
এদিকে বৃষ্টি ভালই পড়তে শুরু করেছে । রেখা কি করবে ছাতাও তো আনে নি । এদিকে লোকজনের সমাগমও কম। মনোজকে ফোন করবে? করেই বা কি করব বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আবার ও আসবে?'
আবার একটা টোটো দেখতে পেল।" এই টোটো যাবে?"
"কোথায়?"
"বি-ব্লক যাব।"
"না দিদি।'
"কেনো যাবেন না কেন?"
"ওদিকে অবরোধ চলছে।"
রেখা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল
"অবরোধ !কিসের?"
টোটোওয়ালা কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেল।
ভারী চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো তো।
ইতিমধ্যে রেখা দেখতে পেলো "এক তরুণ তরুণী খুব ক্লোজ দাঁড়িয়ে আছে, ছাতা মাথায় দিয়ে।"রেখা একটু আশার আলো দেখলো জনসমাগম স্টেশন চত্বরে এরকম দু-একজনকে দেখতে পেলে ভালই লাগে।
রেখা ভাবল এরাও বোধহয় টোটো করে যাবে একটু এগিয়ে গেল। কিন্তু অবাক হয়ে গেল মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে কুড়ি বাইশ বছরের একটি মেয়ে লেপ্টে আছে।
দেখেই কেমন রেখার গাটা ঘিনঘিন করে উঠলো।আর মনে মনে ভাবলো
"কোন বাবা মায়ের সন্তান এরকম বিপথে চালিত হচ্ছে কে জানে?লাজ লজ্জা বলে ও তো কিছু নেই।'
এখানে তো ভালবাসার চিহ্ন নেই লোকটাকে তো দেখেই মনে হচ্ছে তার জিভ যেন লকলক করছে, এতটাই লালায়িত যে এক নিমিষে এর সমস্ত শরীরটাকে গিলে খেয়ে নেবে।
মেয়েটা মাঝে মাঝে অস্বস্তিতে দূরে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার চেষ্টা বৃথা।
এক সময় কথা শুনতে পেল লোকটা বলছে "আমার কথা না শুনলে তোমার সমস্যার সমাধান হবে না।"
রেখা ভাবলো "মেয়েটা কি সমস্যার মধ্যে আছে।
যার জন্য মাঝ বয়সী লোকের সঙ্গে আজ নিজেকে হারিয়ে যেতে দিতে হচ্ছে।"
"তুমি আজ আমাকে সময় না দিলে তোমার ওদিকে সব শেষ।"
মেয়েটা কেমন উদাসিন ভাবে বলল আপনি আমাকে সাহায্য করুন আমি পরে আপনার সব কথা শুনব ।এই মুহূর্তে আমার মন মেজাজ কিচ্ছু ভালো নেই।"
"মামদো বাজী নাকি? দিলে তবেই তো কিছু পাওয়া যায়? দুনিয়াটাই গিভ এন্ড টেক পলিসি তে চলে বুঝলে সোনা বলেই আবার মেয়েটিকে কাছে টেনে নিল।'
রেখা ভাবল "মেয়েটা নির্ঘাত বড় সমস্যার মধ্যে আছে।"
আরো কত কিছু বকে যেতে লাগল সব কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল না।
রেখা মত ভাবছে না ওদের কথা এখন একটাই চিন্তা সে টোটো ,অটো যদি না পায় তাহলে কি করে বাড়ি যাবে?"
এমন সময় একটা অটো দেখতে পেল।
হ্যাঁ চেনা অটো ই মনে হচ্ছে।
বীজন মনে হচ্ছে।
অটো তো রেখার দিকেই এগোচ্ছে ।রেখাও একটু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
"দিদি, উঠুন ,উঠুন।"
"আরে বিজন বাঁচিয়েছ ভাই ।কখন থেকে অপেক্ষা করছি জানো, একটা টোটো, বা একটা অটো ও পাচ্ছি না ।যাও বা টোটো পেলাম ।তারা যাবে না কেউ।"
"আরে দিদি, যাবে কি করে আমাদের ওই দিকটা তো আজকে অবরোধ চলছিল এই উঠলো।"
"দাদা ,একটু সরে সরে বসুন দিদিকে জায়গা দিন।"
"দিদি কোথায় গিয়েছিলেন, এত রাত
হল ।ভিজেও তো গেছেন।'
"আর ব'লো না আমাদের স্কুল থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছিল কলেজে ।একটা প্রোগ্রাম ছিল সেখানে তো বড়দি আমাকে সিলেক্ট করে পাঠিয়েছেন ।সেই জন্যই তো দেরি হল।"
"বসতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল রেখার কিন্তু কিছু করার নেই যে।তেই হবে এভাবে।"
রেখার বিরক্তি সূচক অভিব্যক্তি বিজন আয়নাতে দেখতে পেয়ে বলল "দাদা, আপনারা একটু চেপে আসুন না ,মহিলা বসেছেন।"
বিজন এর বলাতে লোকগুলো একটু চেপে বসলো।
তবে কথা শোনাতে ছাড়েনি বিজন কে।
"টোটো অটোতে তো এভাবেই বসতে হয় দাদা ।না হলে তো যাদের অসুবিধা হয় তারা প্রাইভেট কারে গেলেই পারেন?"
বিজন বলল "এভাবে বলবেন না ।সবাই প্রাইভেটকারে গেলে আমাদের কি হবে?,'
সবাই যদি একটু কম্প্রোমাইজ করে চলি তাহলেই তো হয়। চ"
ভদ্রলোক দুজনের দুটো গালে চুন কালি লাগিয়ে দিল
রেখাকে কিছু বলতে হলো না। রেখা শুধু মনে মনে ভাবল চেনা অটো অথবা টোটোতে তো এটাই সুবিধা।
নামানোর সময় বিজন হাঁক দিলো' দাদা ,নামুন বুদ্ধ পার্ক এসে গেছেন।"
তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
লোক দুটো নেমে যাওয়ার পর বিজন বলল "দিদি পোশাক আশাক দেখে ভদ্রলোক মনে হয় কিন্তু ভেতরটা দেখুন কত ইতর শ্রেণীর।আমরা কোন ক্লাসে যেন পাঠ্য বইতে পড়েছিলাম বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এরকম একটা গল্প । শুধুমাত্র শিক্ষাদীক্ষা ,পোশাক-আশাক পড়লেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না ম।নটাকে অনেক উন্নত করতে হয় শিক্ষা নাকি মানুষের ভেতরে চেতনা আনে।"
রেখা বলে কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ প্রকৃত শিক্ষা কজন পায় বলো শুধু ডিগ্রি লাভ করলেই তো হয় না।
"হ্যাঁ দিদি আজকে এই সবকিছু বিচার হয় আমরা অটো চালাই টোটো চালাই। আমাদেরকে কেউ মানুষ বলে ভাবেই না ।আমরা হচ্ছি ছোটলোক।
কি বৃষ্টি শুরু হল দিদি দেখুন ।পর্দাটা চেপে ধরুন যেটুকু সামলানো যায় ।আমি দ্রুত টানার চেষ্টা করছি ঠি।"
ঠিক আছে বিজন ।তোমাকে অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না ।তুমি দেখে চলো।"
বিজন তখনওবকবক করে চলেছে কিন্তু রেখার মনটা তখন চলে গেছে সেই স্টেশন চত্বরে মাঝ বয়সী লোকদের কান্ড-কারখানা দেখে মেয়েটাকে কি অসহায় মনে হল ।আসলে আমরা সবসময় যেন সত্যিই অসহায় ।কবে আমরা প্রকৃত মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবো কে
জানে ?সমাজব্যবস্থার গভীরে তো অসুখ দানা বেঁধেছে জানিনা মেয়েটা কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারবে কে জানে?"
"দিদি , নামুন এসে গেছেন।"
"ও আচ্ছা আচ্ছা এই নাও ভাড়া।"
"দিদি বেশি দিয়েছেন আপনি বোধহয় ভুল করে দিয়েছেন এই নিন ফেরত নিন
" ভুল করে দিই নি আমি ইচ্ছে করে দিয়েছি ওটা তুমি রাখো।"
"দিদি আমার ভারতেই হয় আমি কেন নেব?"
"আমিতো তোমাকে ইচ্ছে করে দিলাম,,। বললাম তো" তুমি বল তো কতবড় উপকারটা করেছো আমার। এই ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির সময় একটা টোটো ,অটো পাচ্ছিলাম না। তুমি আমাকে দেখতে পেয়ে আমার কাছে এলে তাহলে আমার উপকার করলে না বিজন ?
বিজন হেসে বলল "দিদি উপকার যখন করেছি উপকার টা বিক্রি করতে চাই না.। আপনি রাখুন এটা।"
রেখা কেমন বোকা বনে গেলো। সত্যিই তো তাই আমরা উপকার এর মধ্যে দিয়ে নিজের অহংকার এ জাহির করতে চেয়েছি। ছি: ছি: ছি:নিজেকে খুব লজ্জিত বলে মনে হলো ।
"দিদি আসছি।"
মুখের ভাষা যেন আর বেরোলো না একজন অটো ওয়ালা "ও রেখাকে শিক্ষা দিয়ে গেল সত্যিই তো আমাদের মতো ভদ্র শিক্ষিত সমাজ যারা আমরা নিজেদেরকে সবথেকে উচ্চ শ্রেণীর সভ্য মানুষ বলে অভিহিত করে থাখি। আদৌ কি আমরা সত্যিই সেই পদমর্যাদার অধিকারী ? প্রায় ই প্রশ্ন জাগে মনে। রেখা অনেকক্ষণ অটোটা চলে যাবার পর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল ।ভিজে গেছে রেখা এমন সময় পার্থ হাঁক দিল "বৌদি একি এতো ভিজে গেছ।শরীর খারাপ হবে তখন কি দেখছিলে আর কি ভাবছিলে?
রেখা জিজ্ঞেস করে তোমার দাদা ফিরেছে?"
" একটু আগেই ফিরেছে। তাও কতক্ষণ হবে 40 45 মিনিট হবে।'
"ও আচ্ছা।"
"মিলিরা খুব জ্বালাতন করেছে পার্থ না?"
" না ,না ওরা কিছু করেনি ।তবে কিছুটা একটু এদিক-ওদিক করছিল খুঁজছিল আমরা এসে আদর করলাম তো তখন চুপ করে আছে। দেখুন দরজাটা খুলে দেখতে পাবেন। তাই।শাটার নামিয়ে দিলাম ভিজে যাচ্ছিল ।কিছুটা খোলা
আছে ।কথার আওয়াজ পেলেই বেরিয়ে আসবে দেখুন না বলতে না বলতেই দুটো কিউকিউ আওয়াজ করতে লাগল। সঙ্গে তুতু ও বেরিয়ে আসলো ।রেখা বললো কি হয়েছে ?তারপর কলাপসিবলগেটটা খুলল।
"খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তুতু ঘরে ঢুকে গেল।'
মনোজ তখন খেলা দেখছে টিভিতে বলল সব মিটলো তোমার।
রেখা নল" তুমি একটাও ফোন করোনি কেন আমাকে?"
"অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম তারপর যখন সময় পেলাম তখন ভাবলাম হয়তো সে সময় কাজে ব্যস্ত থাকবে শুধু শুধু তোমাকে ডিস্টার্ব করা আর তাছাড়া আজকে আমার অফিসে প্রচুর কাজও ছিল। "
"তুমি তুতু কে ঘরে ঢোকাও নি কেনো?"
"ওকে ঢুকাতে হয় নিজের থেকেই,।কাছে আসলো না। মনোজ বলল 'ঠিক আছে,,,। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।"
"আমি চা করছি। তারপর দুজনে মিলে আড্ডা দেবো।"