একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন ৪৫
যাত্রাপথে
'জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা' মনোজ রেখাকে বাথরুম থেকে বলল ' দেখো তো কে কলিং বেল বাজাচ্ছে?আমার মনে হয় পার্থ এসেছে।'
রেখা বলল ' হ্যাঁ, দেখছি ।কেন তুমি পার্থকে ফোন করেছিলে?'
মনোজ বাথরুমের কলটা খুলে দিয়ে বলে গাড়ির ব্যাপারে ।গাড়ি ঠিক না হলে তো আজকে যেতে পারবো না।'
রেখা বলল 'এরকম কথা বোলো না ।আমার ভালো লাগছে না ।যেদিনই যাবার চেষ্টা করছি কিছু না কিছু বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছি। দূর ছাই ভালো লাগে না'।
মনোজ বাথরুমের কলটা বন্ধ করতে করতে যখন কথা বলছিল,তখন বাথরুমের কলের জলের যে আওয়াজটা ছিল তা ক্রমশ মৃদু হয়ে এল ,আর মনোজ বলল 'আমি কি বলছি বলো? যদি না পায় তাহলে কি করবে বলো?'
রেখা বলল 'কেন যে এত অলক্ষুণে কথা বলো কে জানে বাবা?'
রেখা গজ গজ করতে করতে গিয়ে দরজা খুলল।
পার্থ বলল 'বৌদি কখন বেরোবেন?'
রেখা বলল 'এই তো নাস্তা করেই।'
পার্থ বলল 'ঠিক আছে ।তাহলে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
রেখা বলল 'কি উপকার যে করলে ভাই ,তোমাকে আর ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।'
পার্থ বলল 'কি বলেন যে বৌদি পাশাপাশি থাকি মানে প্রতিবেশী ।এটুকু করবো না ?তবে হ্যাঁ ,এটা আমার নিজের গাড়ি নয় ।আমার গাড়িগুলো সব বুকিং আছে?'
রেখা বললো 'তাহলে কি হবে?'
পার্থ বলল 'না বৌদি ,কোনো চিন্তা করবেন না ।আর দাদা কোথায় ?দাদাকেও চিন্তা করতে বারণ করবেন ।কারণ আমি যে গাড়ি দিচ্ছি ,তার ড্রাইভার খুব ভাল ।আপনারা নিশ্চিন্তে যাত্রা করুন।'
রেখা বাথরুম দেখিয়ে বলল 'ওই যে বাথরুমে।'
পার্থ বলল 'আপনারা যখন যাবেন ই ,গতকাল বললেই তো পারতেন?'
রেখা বলল 'না গো ,এবার ভেবেছিলাম যে ট্রেনে যাবো ।সেজন্য জানানো হয় নি।'
পার্থ বলল 'ও আচ্ছা।'
রেখা বলল 'ট্রেন তো মিস হয়ে গেল ।সেই তোমাকেই বলতে হল।'
পার্থ বলল 'না ,না এরকম কেন কথা বলছেন, আমরা তো সব সময়ই আছি।'
রেখা হেসে বলল 'হ্যাঁ ,সে তো ঠিকই।'
পার্থ বলল 'বৌদি তাড়া আছে আসছি ।আমার আবার ওই টাটা সুমো গাড়িটা ভাড়া যাবে, ওর ড্রাইভার এসেছে কিনা দেখি ।এ আবার নতুন ড্রাইভার।'
রেখা বললো 'আরে সকালবেলা এসেছো ,একটু চা খেয়ে যাও ভাই।'
পার্থ বলল 'না বৌদি ,আপনাদের দেরি হয়ে যাবে চা করতে গেলে। আমি অন্যদিন খাব।'
রেখা বলল ' কতক্ষণ আর লাগবে?'
পার্থ বলল 'না, না, ঠিক আছে বৌদি। সেফ জার্নি। আসছি বৌদি।'
রেখা বলল ' ঠিক আছে ভাই এসো।'
রেখা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে ,তখনই দেখছে চৈতির মা।
চৈতির মা বলল ' দিদি একটা কথা আছে।'
রেখা একটু মনে মনে বিরক্ত হলো তবুও ভদ্রতা বশে স বলল 'কি কথা দিদি?'
চৈতির মা বলল 'একটু ভেতরে যাব গিয়ে বসে বলব ?একটু সময় লাগবে।'
রেখা বলল ' দিদি আমি এসে শুনি ।আমরা না আজকে এক জায়গায় যাব।'
চৈতির মা বলল ' কোথায় যাবেন দিদি?'
এমন সময় মনোজ হাঁক দিচ্ছে 'রেখা, রেখা ,রেখা।'
রেখা দরজার দিকে তাকিয়ে বলল 'যাচ্ছি ।একটু কথা বলছি।"
চৈতির মায়ের এই কৌতুহলগুলো একদমই রেখার ভালো লাগে না কিন্তু মানুষ হিসেবে চৈতির মা খুবই ভালো ।
রেখা বলল 'দেশের বাড়ি যাবো।'
চৈতির মা বলল 'ও আচ্ছা। দিদি ,তাহলে আমি আসি ।পরে আপনাদের সঙ্গে কথা হবে।'
রেখা বলল ' আচ্ছা দিদি ।কিছু মনে করবেন না।'
চৈতির মা বলেল ' এরকম কথা কেন বলছেন দিদি ?'
চৈতির মা বলল 'না আমি না বুঝতে পেরে আপনাদের একটু বিরক্ত করলাম।'
রেখা বলল ' না না বিরক্তির কি আছে?'
রেখা দরজাটা বন্ধ করে দিল।
রেখা হন হন করে এসে ঢুকলো মনোজের ঘরে
বলল 'কি বলছো, বলো?'
মনোজ বলল 'কোন প্যান্ট ,কোন শার্ট পরবো কিছুই তো রেখে দাও নি।'(ওয়ারড্রব দরজা খুলে দাঁড়িয়ে)
রেখা একটু বিরক্ত হয়ে মনোজকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল'বাপরে বাপ একটা জিনিস কি তুমি নিয়ে নিতে পারো না?'
মনোজ একটু আহ্লাদের সুরে বলল'রেখা তুমি তো জানো আমি এসব পারি না । তুমিই আমাকে বদঅভ্যাসে পরিনত করেছ।'
রেখা বলল 'তাই নাকি?'
মনোজ (রেখার চিবুক দুটো ধরে) বলল 'ইয়েস ম্যাম'।
রেখা বলল 'অতো আদিখ্যেতার দরকার নেই। এবার দেখো, ব্ল্যাক প্যান্ট আর black-white কম্বিনেশনের চেক শার্ট টা দিচ্ছি কেমন।'
রেখা প্যান্ট শার্ট বের করে দিয়ে মনোজকে বলল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে খাবার টেবিলে এসো আমার অনেক কাজ বাকি আছে বলেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো।
ঠিক তখনই মনোজ 'রেখা রেখা রে খা আ.. আ বলে ডেকে উঠল।
রেখা কাছে এসে বলল ' কি হল ডাকছো কেন?'
'তুমি কার সঙ্গে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে পার্থর সঙ্গে?'
রেখা বলল " আরে না চৈতির মা এসেছিল।'
মনোজ বলল "কেন?'
রেখা বলল ' কে জানে?'
মনোজ বলল ' মেয়ের ব্যাপারে হতে পারে'
রেখা বলল'আমায় বলছিলে একটু সময় নিয়ে কথা বলতে হবে । আমি বললাম অন্য দিন আসতে'।
মনোজ বলল ' দেখছো না, অনেকদিন ধরে মেয়েটা আছে মনে হচ্ছে কিছু সমস্যা হয়েছে'।
রেখা বলল'তুমি তাড়াতাড়ি এসো আমি খেতে দিয়ে দেবো। এরপর মিলিদের খাবার আছে।'
মনোজ চুলটা নিয়ে বললো চলো।'
মনোজ খাবার টেবিলে বসে আর রেখা রান্নাঘরে।
মনোজ রেখাকে জিজ্ঞেস করছে 'আজ কি মেনু হয়েছে।'
রেখা বলল ' পরোটা আর আলুর দম।'
মনোজ বলল ,'নাও তাড়াতাড়ি দাও।'
রেখা রান্নাঘর থেকে পরোটা আলুর দম মনোজকে দেয়
মনোজ বলল মিলিদের খাইয়ে যাবে তো?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ',
রেখা রান্নাঘর থেকে মেয়েদের খাবারটা নিয়ে দিতে গেল।
কিছুক্ষণ পর মনোজ রেখা রেখা বলে ডাকতে লাগল
রেখা বলল কি হয়েছে?
মনোজ বলল 'আর পরোটা হবে?'
রেখার হাতের আলুর দম খুবই টেস্টি।
রেখা বলল ' হ্যাঁ।'
রেখা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পরোটা দিতে গেলো।
তখন মনোজ বলল 'এক্সট্রা আছে তো?'
রেখা জানে আর এক্সট্রা নেই তবু বলল 'আছে?'
মনোজ রেখাকে মাথায় হাত দিয়ে বললো 'সত্যি করে বলো?'
রেখা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল'আরে আমি আজকে ওটস খাব।'
মনোজ বললো ' কি ব্যাপার ওটস খাবে?'
রেখা বললো ' তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তাই।'
মনোজ এখানেও ধরে ফেলল। ঘরে ওটস নেই কারণ মাসকাবারিতে এবার ওটস লেখানো হয় নি।
মনোজ বলল 'রেখা তুমি তোমার খাবারটা আমাকে দিয়ে দিলে।'
রেখা বলল ' তাতে কি হয়েছে তুমি খেতে ভালোবাসো আমি পা রুটি, কলা ,ডিম সেদ্ধ খেয়ে নেব।'
মনোজ বলল'তুমি এত ভালো কেন?'
রেখা বলল এ আবার কি কথা?'
রেখা বললো 'এসব কথা ছাড়ো মিলিদের খাবার দেবার ব্যবস্থা করে গেলে।'
মনোজ বলল 'চিন্তা কি আছে দেবে গৌরী সেন।"
রেখা হেসে বললো ' তুমি পারোও বটে। নাও তাড়াতাড়ি ওঠো।'
ওদিকে পার্থর পাঠানো গাড়ি এসে হর্ন দিতে শুরু করলো। রেখা বলল 'দেখলে গাড়ি এসে গেছে এখনো আমার কিচ্ছু হলো না।'
মনোজ বললো টেনশন নিও না দেখছি।'
রেখা চটপট তৈরি নিল। তারপর গাড়িতে উঠল আবার গাড়ি থেকে নেমে পরল। মনোজ বললো ' কি হলো?'
রেখা বললো ' মিলি, মিলির বাচ্চাদের একটু দেখে আসি।'
তারপর আবার এসে গাড়িতে চাপল রেখা, আবার নেমে পরল।
মনোজ বললো 'এবার আবার কি হলো?'
রেখা বলল' চৈতির মাকে একটু বলে যাই। বলে গাড়ি থেকে নেমে ডাকতে শুরু করলো দিদি দিদি।'
চৈতির মা বলল ' কি হলো দিদি?'
রেখা বলল 'একটু খেয়াল রাখবেন'.।
চৈতির মা বললো'তা আর বলতে।'
রেখা বলল ''আসছি।'
চৈতির মা বলল 'দুর্গা দুর্গা যাত্রা পথ শুভ হোক।'
রেখা গাড়িতে উঠে বসল । ড্রাইভার বলল' দাদা কোন দিক দিয়ে যাবেন।'
মনোজ বলল'ত্রিবেণী হয়ে কালনা রোড ধরে বৈচি দিয়ে মেমারি হয়ে।'
ড্রাইভার বলল 'ঠিক আছে দাদা দিয়ে গাড়ি ছোটালো'
গাড়িতে তখন বাজছে 'আমারো পরানো যাহা চায়।'
রেখা বললো ' নতুন ড্রাইভার কি করে জানল আমার পছন্দের গান।'
মনোজ বলল'এই হচ্ছে পার্থ বেটার কাজ।'
রেখা বললো 'সত্যিই পার্থ ছেলেটা খুব ভালো।'
এমন সময় ব্যাগে রেখার ফোন বেজে উঠল ।
রেখা ফোনটা বের করে দেখে রিম্পা দি ফোন।
রেখা বলল ''বলো।'
রিম্পা দি বলল বেরিয়ে গেছিস?'
রেখা বলল 'তোমার মনে আছে?'
রিম্পা দি বললো 'তা মনে থাকবে না। এখন কোথায় আছিস?'
রেখা বলল 'এই তো বৈঁচি ক্রস করে জিটি রোডে উঠছে গাড়ি।'
রিম্পা দি বলল ' ঠিক আছে। সাবধানে যা ।যাত্রাপথ শুভ হোক ।পৌঁছে কিন্তু আমাকে ফোন করিস কেমন।'
রেখা বলল 'অবশ্যই।'
রিম্পা দি বলল 'ঠিক আছে ফোন ছাড়ছি।'
রেখা বলল'ok'
রেখা অনেকদিন পর চেনা রোড দেখতে পেয়ে মনে পড়ে গেল তার সেই জনম দুখিনীর ঘরের কথা। তার দুচোখ বেয়ে জল বের হতে লাগলো। মা সন্তানের যে আত্মিক সম্পর্ক হয়তো আজ কাছে নেই কিন্তু মায়ের সেই চেনা গন্ধ মায়ের হাতের স্পর্শ করা জিনিসগুলো সমস্ত কিছু আজকে রেখা নিজের হাতে স্পর্শ করে দেখতে পারবে। একটাকা আনন্দের আর কি হতে পারে। আজ তাই বারবার কবি অরুণ মিত্রের কবিতা লাইন মনে পড়ছে'সলতেটা নেভার পরও এই ডাক ঘুরতে থাকবে।'এ যেন জননী তার ক্লান্ত প্রাণ সন্তানকে ঘরে ফেরার আহ্বান জানাচ্ছে।
মনোজ দেখছে রেখার চোখে জল। তখন বলল'কাঁদছো কেন? না না থাকলেও মায়ের সমতুল্য তোমার কাকিমা আছেন তোমাকে ভীষণ স্নেহ করেন ভালোবাসেন। সেখানে গেলে তোমার খুব ভালো লাগবে। মনের ভেতরে কোন টানাপোড়েন রেখো না। যাত্রাপথ চোখের জলে সিক্ত ক'রো না। বলেই রেখাকে দু'হাত দিয়ে কাছে টেনে নিল। মনোজ রেখার কন্ঠে কতবার শুনেছি এই কবিতার লাইন তাই সে বললো'বিভুঁই মনের মধ্যে পথ খুঁজে কতবার দিশেহারা'। আজ তুমি সেই পথের সন্ধানে চলেছ।