উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৫৮
ওয়ার্কশপ ও ভদ্রলোক
মমতা রায়চৌধুরী
বাপরে বাপ আজ কালীনারায়নপুরের আগে এসে ট্রেনটা এতটাই লেট খাইয়ে দিল। যার ফলে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছে রেখা ছুটতে শুরু করল অটো ধরার জন্য ।ওয়ার্কশপের টাইম ছিল সাড়ে দশটা । স্টেশনেই10:30 রেখা অটোতে গিয়ে বসলো ।অটোওয়ালাকে তাড়া দিতে লাগল' দাদা একটু তাড়াতাড়ি চলুন না ।'
অটোওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল" এই আপনাদের দোষ দিদি। সারা দুনিয়ায় লেট হলে কিছু বলবেন না ।ট্রেন তো লেট ছিল ট্রেনের ড্রাইভারকে কিছু বলেছেন? বা ব্যাংকে গিয়ে লেট হয় ,ব্যাংকে গিয়ে তাড়া দেন ?হসপিটালে গিয়ে লেট হলে তাড়া
দেন ?যত তাড়া আপনাদের আমাদের গাড়িতে উঠলে।
রেখা দেখল কথাগুলো বেঠিক কিছু বলছে না। তবুও বললো 'এমনি ,এমনি কি আর তাড়া দিচ্ছি বলুন ?ট্রেন লেট ছিল বলেই তো ,আমার ওয়ার্কশপে পৌঁছাতে লেট হয়ে যাবে,
দাদা ।সেজন্যই।'
অটওয়ালা বলল 'তাহলে অন্য অটোতে যান।'
লেখা মনে মনে ভাবল কি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা রে বাবা।
রেখা বললো ' দেখুন আপনার সঙ্গে আমি তর্কে যেতে চাইনা ।আপনি যেতে পারবেন না ব্যস ,এত কথা বলেন কেন ?তাছাড়া আপনি তাহলে লিখিত দিন যে আপনি অটো চালাবেন না ।আমি অন্য অটোতে গিয়ে বসি।'
অটোওইয়ালা এবার চুপ করে গেল । এবার একটু নরম সুরে বলল' আসলে দিদি আমি তো কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেব?'
'ঠিক আছে ,এই কথাটা তো আপনি ভাল ভাবে বলতে পারতেন ।এতগুলো অকারণ বাজে কথা।'
মেজাজটা বিগড়ে গেল রেখার । কিন্তু কিছু করার নেই ,বসেই থাকতে হবে।
অন্য অটোতে গেলেও একই হাল হবে আর তাছাড়া এদের তো আবার লাইন আছে।
কি করবে আর রেখা চুপ করে বসে রইল। লেট এমনিতে হয়েই গেছে ,যা হবে ,হবে।
অটোওয়ালা হাঁক তে লাগলো' ডন বক্স স্কুল,কলেজস্ট্রিট , নেদেরপাড়া , বেজি খালি…।'
আস্তে আস্তে প্যাসেঞ্জার হতে লাগলো এবার অটোওয়ালা গাড়ি স্টার্ট করল।
রেখা দুর্গানাম জপতে লাগলো ।
ডন বক্স স্কুল এর কাছে না এসে অটো বেশ খানিকটা দুরে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল 'দিদি নেমে যান।'
রেখা বললl' আর যাবেন না?'
"না আর যাবে না?"
অটওয়ালা যেভাবে কথাটা বলল রেখার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।
রেখা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো।
"তার কি একাই লেট হল?' রুমে ঢুকতে
লজ্জা করছে।
রেখা মনে মনে সাহস আনলো। লজ্জার কি আছে ট্রেন লেট থাকলে রেখার তাতে দোষ কী।
আবার পরক্ষণেই ভাবছে লাস্ট একটা সেমিনারে একজন লেট করে ঢুকছিলেন বলে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন আর পি।
সে কথাটা মনে হতেই ভেতরে ভেতরে আবারো প্যালপিটিশন শুরু হয়ে গেল।
রিসেপশনরুমে ঢুকেই স্কুলের নাম নিজের নাম এন্ট্রি করল।
তারপর জিজ্ঞেস করল কত নম্বর রুমে ওয়ার্কশপ শুরু হয়েছে?
একজন বললেন দোতালায় 10 নম্বর রুম।
তারমধ্যে দেখা গেল আরও কয়েকজন তারাও ভুলে 10 নম্বর রুমে?
রেখা এবার মনে মনে একটু সাহস পেল তার একার লেট হয়নি।
এবার যেন তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো।
10 নম্বর রুমে কাছে গিয়ে বলল'আসবো?'
একজন তাকিয়ে হেসে বললেন 'আসুন।'
রেখা নিজের জায়গা বেছে নিয়ে বসলো।
এখনো শুরু হয়নি ভেবে রেখা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে লাগলো ।
অন্য কয়েকজন জিজ্ঞেস করলেন আসবো ?
ভদ্রলোক আবার হেসে বললেন 'আসুন ,আসুন।'
এবার ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন এভাবে বলছেন । রেখাতাকিয়ে দেখছে তার চেনা পরিচিত পাশের স্কুলের মাস্টার মশাই ওই জন্য এরকম হাসছেন।
রেখানএবার খুশি হল।
ওয়ার্কশপটা ছিল কোভিদ সিচুয়েশনে স্কুল ছুটের সংখ্যা বেড়েছে তাদেরকে আবার কিভাবে স্কুলমুখী করা যায়। সে প্রসঙ্গে আলোচনা।
প্রথমে গ্রুপ ঠিক করে দেয়া হল ।প্রতি গ্রুপে 5 জন 6 জন করে টিচার থাকবে।সেই গ্রুপ থেকে উক্ত বিষয়ের উপর একটা কাল্পনিক সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হলো।তারপর সেই বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা। সমস্যা ,সমাধান সিদ্ধান্ত এই তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হলো।
প্রতি গ্রুপে নিজের নিজের গ্রুপ লিডার ঠিক করে নিল। সার্ভে রিপোর্ট করার পর একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হলো।
আর সার্ভে রিপোর্ট করার পর টিফিন আওয়ার্স একটু বিরতি দেয়া হলো।
প্রত্যেকে মধ্যাহ্নভোজন পর্ব শেষ করে প্রতিবেদন সাবমিট করার কথা বলা হলো ।প্রতিবেদন সাবমিট করা হলে , সর্বপর্যায়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা হলো ।এই সিদ্ধান্তের ওপর বেস করে নিজে নিজে স্কুলের ক্ষেত্রে সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করা ,কতগুলো ছাত্র বা ছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে ,তাদের একটা লিস্ট তৈরি করা ।দরকার হলে তাদের বাড়ীতে যাওয়া ,বাড়িতে গিয়ে গার্জেন কে বোঝানো ,স্টুডেন্টকে বোঝানো যে করেই হোক তাদের মোল্ড করে স্কুলে আনা।
এবং কতজন স্টুডেন্ট স্কুলে আনা যাচ্ছে, কতজন যাচ্ছে না ,সে বিষয়ে এস আই অফিসে সার্ভে রিপোর্ট পাঠানো।'
বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সব কিছু মিটতে মিটতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল এদিকে ছটাতে ট্রেন আছে।
রেখা জিজ্ঞেস করল "ওয়ার্ক শপ কদিনের জন্য?'
" আজকের যে বিষয়টা ওপর ওয়ার্কশপ ছিল, তা আজকেই শেষ হয়ে গেল ।নেক্সট আবার ওয়ার্কশপ আছে ।সেটা প্রতি স্কুলকে জানিয়ে দেয়া হবে ।সেটা অন্য বিষয়ের উপর হবে।'
রেখা বলল ok
রেখার একটু সাহস করে বলল' এবার কী আমরা যেতে পারি ?আসলে আমাদের ট্রেন আছে তো (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে।)
'হ্যাঁ ,হ্যাঁ আসুন আসুন ।ট্রেন মিস করলে অনেকটা সময় পর ট্রেন আছে ।আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।আজকের ওয়ার্কশপে অ্যাটেন্ড করার জন্য।"
প্রত্যেকে এবার বেরিয়ে যাবার উপক্রম করলে উনি (আর পি)আর একবার বললেন 'শুনুন ,শুনুন আপনাদের জন্য একটা সার্টিফিকেট থাকবে, সেটা জানিয়ে দেয়া হবে কবে দেয়া হবে। আমরা স্কুলেও পাঠিয়ে দিতে পারি ।না হলে এই স্কুলে থাকবে ।আপনারা এসে কালেক্ট করে নেবেন।"
রেখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ওরে বাপরে অলরেডি 5:35 বেজে গেছে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।
তার মধ্যে একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন "আপনি ট্রেন ধরবেন?"
রেখা বলল ' হ্যাঁ'
ভদ্রলোক বললেন"ট্রেন ধরবো তো ,দেখুন ,এখন সঙ্গে সঙ্গে সব জিনিস খেলে তবে তো ট্রেনটা পাবো ,না হলে মিস করলেই বুঝতে পারছেন?'
রেখা মনে মনে ভাবল বুঝতে পারছেনা তারপর বলল" হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।'
ভদ্রলোক বললেন "ভালোই হলো দুজনে একসঙ্গে তাহলে অটো ধরতে সুবিধা হবে ওরা তো আবার প্যাসেঞ্জার ছাড়া যেতে চায়না।"
রেখা বললো" ঠিকই। চলুন ,চলুন।"
গেটের কাছে আসতে দেখল একটা অটো দাঁড়িয়ে আছে অটো ওয়ালা কে বলল" স্টেশনে যাবেন?'
"হ্যাঁ যাবো ।"
রেখা ভালো করে অটোতে উঠতে উঠতে তাকিয়ে দেখল আয়নায় অটো ওয়ালার মুখ দেখা
যাচ্ছে ।' এ তো যে অটোতে এসেছিল,সেই অটোওয়ালা। আর মনে মনে ভাবল এ কি আবার ভোগাবে নাকি?'
এরই মধ্যে ওই ভদ্রলোক বললেন' আপনি চলুন দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?'
'কয়েকজন দেখি?''
'মানে আমরা ট্রেন পাব না বুঝতে পারছেন?
'আপনারা ট্রেনের একদম মুখোমুখি টাইমে আসবে আর বলবেন ট্রেন পাবেন না ।সে দায়িত্ব আমার নয়।"
রেখা এবার মুখ খুলে বলল 'আজকে জানেন দাদা আসার সময় উনার অটোতে এসেছি ,এই একই রকম কথাবার্তা।'
ভদ্রলোক বললেন 'আপনি মানুষের সুবিধার জন্য রয়েছেন তো , অসুবিধা হলে আপনার অটোতে লোকে যাবে কেন বলুন তো?'
"তাহলে নেমে যান।'
রেখা বললো 'দেখলেন কি মেজাজ !এদের
দাদা ।চলুন ট্রেন পাব ,না,পাব, তবু এর অটোতে যাব না ।চলুন তো নেমে যাই।'
ঠিক বলেছেন' চলুন দেখি টোটো তে যাব।'
এরই মধ্যে এক টোটোওয়ালা হাঁকছে' স্টেশন স্টেশন ,ট্রেন ধরাবে দ্রুত।"
রেখা নামতে যাচ্ছে তখন অটোআলা বলল নরম সুরে 'আমি তো এক্ষুনি ছাড়বো।'
"তখন থেকে আমরা বলছি ছাড়ুন আপনি তো ছাড়ছেন না।"
এবার অটোওয়ালা স্টার্ট দিল তখন রেখা ঈশারায় ভদ্রলোককে বললেন "চলুন।'
এবার অটোআলা খুব দ্রুত ছোটালো এবং দেখা গেল যে ঠিক ট্রেন ঢোকার 5 মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছে গেল।
রেখা আর ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল ।ঠিক তখনই অটোওয়ালা বলল "ট্রেনটা তাহলে ধরালাম তো দাদা ,দিদি?'
রেখা আর ভদ্রলোক পিছন ফিরে তাকালো না।
রেখা ভদ্রলোককে বলল 'দেখলেন এদের মেজাজ কত?'
ভদ্রলোক বললেন' যা বলেছেন। এদের মেজাজ লাটসাহেবকেও হার মানায় ।দুজন হো ,হো ,হো ,করে হাসতে লাগলেন।'
ভদ্রলোক বললেন' ওই দেখুন দু'নম্বরে খবর হয়েছে। দ্রুত পা চালান।'
রেখা বললো' ও বাবা'।
ভদ্রলোক বললেন আপনি কি লেডিসে উঠবেন?'
রেখা বলে "আমি তো লেডিসেই …
রেখার কথা সম্পূর্ণ না হতেই ভদ্রলোক বলেন "প্রতিদিন লেডিসে ওঠেন ঠিক আছে,আজকে না হয় জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠলেন গল্প করতে করতে যাব।
রেখা মনে মনে ভাবল তা অবশ্য ঠিক কারণ ডেলি প্যাসেঞ্জার যারা আছে প্রত্যেকে তো সাড়ে 4 টার ট্রেনে চলে গেছে একাই যেতে হবে।
রেখা একটু নিজের ওয়েট বাড়ালো তারপর বলল "আসলে আমি বরাবর লেডিসের উঠে অভ্যস্ত তো তাই কেমন একটু অস্বস্তি হয়। অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠতে।'
ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন' চলুন না'।
রেখা আর কথা না বাড়িয়ে বগির কাছে আসতেই ভদ্রলোক বললেন ', আসুন, আসুন বলতে গেলে হাত ধরে টেনে তুললেন।'
কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো
রেখা ।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়ল না উঠে উপায়ও ছিল না ।এমন জোরে হাত টেনে তুললেন ।এদিকে ট্রেন ছেড়ে দেবার হুইসেল বাজিয়ে দিলো।
ভদ্রলোক জায়গা পেয়ে রেখাকে জায়গা দিলেন এবং নিজেও জায়গাটা নিলেন।
"আপনি জানলার ধারে টা পছন্দ করেন
তো "ভদ্রলোক বললেন।
রেখা অবাক হয়ে বলল" আপনি কি করে জানলেন?"
ভদ্র লোক হেসে বললেন' এগুলো তো জানা কথাই মেয়েরা স্বাভাবিকভাবে জানলার কাছে বসতে চায় ।পুরুষরা যে জানালার কাছে বসে না সেটা কিন্তু বলছি না। আসলে এখানে জানলার ধারে সিট পাওয়া গেছে ,অফার করা হচ্ছে ন্যাচারেলি আপনি জানলার ধার বেছে
নেবেন ।কি রাইট ?আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন।"
রেখা বেশ ভদ্র লোকের কথায় মুগ্ধ হল।
"একদম ঠিক বলেছেন আমি জানালার ধার টাই নেবো।'
ভদ্রলোক বললেন "বসুন ,বসুন ,বসুন।"
এরমধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল ভদ্রলোক মুখিয়ে রয়েছে রেখার সঙ্গে কথা বলার জন্য ।ঠিক সেইসময় রেখার ফোন বেজে উঠল ।রেখা ফোনটা রিসিভ করে বললেন "হ্যালো"
"কে বলছেন,?"
"আমাকে চিনতে পারছেন না ম্যাডাম?"
"ও আপনি ?আসলে এখানে একটু কথা হচ্ছে তো আমি ভালো বুঝতে পারছিনা।"
"বলুন ।"
"শুভ সন্ধ্যা ম্যাডাম।'
"হ্যাঁ শুভ সন্ধ্যা।"
"আপনার লেখা রেডি তো?"
"হ্যাঁ পুরোটা হয়নি।'
"কেন ম্যাডাম এনার্জি পাচ্ছেন না।"
ঠিক তা নয়। আসলে গতকাল একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, ফলে ফিরতে দেরি হয়েছে। আর আজকে আবার একটা ওয়ার্কশপ থেকে ফিরছি। সেই জন্য ।ঠিক আছে ,আমি বাড়ি গিয়ে দেখছি।"
"ঠিক আছে, তাহলে আর কথা বাড়াবো
না ।আপনি সাবধানে আসুন।"
পাশের ভদ্রলোক রেখার দিকে' মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন "আপনি লেখালেখি করেন?
আমি একজন লেখিকার সঙ্গে যাচ্ছি।'
রেখাএকটু মুচকি হাসল।
ভদ্রলোক বিশ্বাসের সঙ্গে বললেন"আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা দেয়া যাবে?"