উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৫৯
দিবসও রজনী আমি যেন কার..
মমতা রায় চৌধুরী
৪.৩.২২. সন্ধ্যে ৭.৩৯
আচ্ছা জ্বালাতনে পড়ল রেখা।' ভদ্রলোক এতো প্রশ্ন করছেন কেন? '
"ম্যাডাম বলুন না?"
"একটু-আধটু লেখালিখি করি।"
"Wow ,অসাধারণ ,কনগ্রাচুলেশন্স।"
ভদ্রলোক হাতটা বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডসেক করবেন বলে।
রেখা দুই হাত জোড় করে নমস্কার জানালো।
"কোন পত্রিকায় বেরিয়েছে ম্যাডাম একটু বলুন না?"
"বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় পত্রিকায় ।কোনটা বলব বলুন?'
"ভদ্রলোক বললেন আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিতে বললাম দেবেন না?"
"কি করবেন আপনি কন্টাক্ট নম্বর নিয়ে ।
যদি লেখা পড়তে চান তাহলে তো পত্রিকাগুলো ঘাটলেই পেয়ে যাবেন।"
"না ফোন নম্বরটা থাকলে অন্তত বলতে পারব সবাইকে যে এরকম একজন বিখ্যাত লেখিকার কন্টাক্ট নম্বর আমার কাছে আছে। নিজেকে খুব প্রাউড ফিল করব।'
রেখা আর কি করবে "বাধ্য হয়ে কন্টাক্ট নম্বর টা দিলো।
ভদ্রলোক বললেন অসংখ্য ধন্যবাদ।"
দেখতে দেখতেই ট্রেন পালপাড়া ক্রস করলো।
এরমধ্যে রেখার ফোন বেজে উঠলো।
রেখা একটু জানলা দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে ছিল। তখন ভদ্রলোক রেখাকে বললেন "আপনার ফোন বাজছে।'
রেখার যে ফোন বাজার আওয়াজ কানে আসে নি তা নয় ,কেন যেন ফোনটা বার করলো না। এখনও যেহেতু বেজেই যাচ্ছে ,তাই বাধ্য হয়ে ফোনটা বার করলো।
ভদ্রলোক তখনও বলে যাচ্ছেন 'বোধহয় আপনার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে না?'
রেখা মনে মনে ভাবলো যে এরকম অকারণ কৌতুহল মোটেই পছন্দ নয় কিন্তু কিছু করার নেই ফোনটা বের করে দেখছে বড়দি ফোন করেছে।
"হ্যালো দিদি।"
"তুমি এখনো বাড়ি পৌঁছাও নি?"
"না দিদি।"
"বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেল না।"
"তা তো হবেই।"
"তাহলে ওয়ার্কশপ কদিনের?"
"আজকেই শেষ দিদি।"
"কি বলছ? "বড়দি অবাক হয়ে বললেন।
"হ্যাঁ আজকের ওয়ার্কশপ আজকেই শেষ হলো আর এরপরেও আরো অন্য কিছু হলে, সেটা ওনারা জানিয়ে দেবেন।'
বড়দি বললেন "তাই বল?'
রেখা বলল"আমি আপনাকে ফোন করতাম বেরিয়ে কিন্তু দিদি এমনিতেই মানে ট্রেন পেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল এমন টাইমে ছেড়েছেন যার জন্য এসে ট্রেনে বসেছি তার পরে ভাবলাম থাক বাড়িতে পৌঁছে ফোন করবো।"
"ঠিক আছে। সেজন্য নয়। আমিও ফোন করলাম যে দেখি কালকের প্রোগ্রামগুলো কিরকম আছে না আছে জানার জন্য।'
*ঠিক আছে রেখা, কালকে যদি সেরকম হয় তুমি পরের ট্রেনটা তে এসো ।আজকে তো ফিরছ লেট করে।"
রেখা হেসে বলল" থ্যাংক ইউ দিদি।"এ জন্য "আপনাকে এত ভালোবাসি।'
"না ,না তোমাদের সুবিধা-অসুবিধা তো দেখতেই হবে বলো ?এই দেখো অনিন্দিতা যেতে পারল না অথচ ওর কথা ছিল তোমাকে বললাম তুমি রাজি হয়ে গেল তা তোমার এইটুকু সুবিধা করবো না?'
"ঠিক আছে ,তুমি সাবধানে ফিরো। রাখছি তাহলে?"
ফোন রাখতে না রাখতেই ভদ্রলোক বললেন "আপনার স্কুলের বড় দি ফোন করেছিলেন?'
"হ্যাঁ, মাথা নাড়িয়ে রেখা বলল।
"যেটুকু কথাবার্তায় বুঝলাম আপনার বড়দি তো বেশ ভালো।"
"হ্যাঁ তা ভালো।
এই কথা বলতে বলতেই কল্যাণী স্টেশন এসে গেল। রেখা ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
ভদ্রলোক বললেন' "আপনি কল্যাণীতে থাকেন?'
রেখা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
ভদ্রলোক বললেন" নাইস টু মিট ইউ।
"খুব ভালো লাগলো।"
"আশা করি আবার দেখা হবে আপনার সাথে।"
রেখা বলল পৃথিবীটা অভিগত গোলক নিশ্চয়ই কোনোদিন কোথাও না কোথাও দেখা হবে। ভালো থাকবেন।"
ভদ্রলোক হা করে রেখার কথা শুনল আর বলল "হ্যাঁ আপনিও ভালো থাকবেন।'
রেখা আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো ভদ্রলোক উঠে রেখার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় ট্রেন স্টেশনে থামলো।
ভদ্রলোক রেখাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। রেখা ভদ্রতাবশত নিজেও হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
তারপর দ্রুতবেগে হেঁটে অটো স্ট্যান্ডে আসল।
চেনা অটোওয়ালা নিজে থেকে ডাকলো" দিদি, ও দিদি আসুন, আসুন।"
রেখার নিজেকে খুব টায়ার্ড মনে হচ্ছিল।
বলল" হ্যাঁ ,চলো।'
অটো ওয়ালা বলল 'আজকে আপনার লেট হল।
একটু কাজ ছিল?"
"তাই বলি যে টাইমে ফেরেন কিছুক্ষণ আপনার জন্য ওয়েট করছিলাম দেখতে না পেয়ে চলে গেলাম।'
এরমধ্যে অটোওয়ালা হাঁকতে লাগলো "বুদ্ধপার্ক কল্যাণী বি ব্লক' বাঘের মোর, আসুন ,আসুন ।কে যাবেন?"
রেখা অটোতে বসেই চোখটা যেন বুজে আসছিল।
কখন যে অটোতে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই
পারেনি ।যখন অটো রেখার বাড়ির কাছে এসেছে তখন অটোওয়ালা বলল' ও দিদি এসে গেছেন নামুন'।
রেখার বুকটা কেঁপে উঠলো তারপর বলল" হ্যাঁ এইতো নামছি।" ব্যাগ থেকে হাতরে পার্স বের করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে , গেটটার কাছে
আসলো । ঠিক তখনই মিলি আর মিলির বাচ্চারা জোরে চিৎকার করে উঠলো আর বাচ্চাগুলো কাছে এসে আদর করতে লাগল।
রেখা কিছুক্ষণ ওদেরকে আদর করলো আর বলল "অনেকক্ষণ তোদের দেখিনি তোরাও আমাকে দেখিস নি বল ?খাবার খেয়েছিস তো?
আদর খেয়ে ওরা একটু শান্ত হল।
রেখা কলিং বেল বাজালো কিন্তু কেউ দরজা খুললো না । ভাল করে দেখল বাইরে থেকেই লক করা। রেখার কাছে একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল সেই চাবিটা দিয়ে লক খুলল। তারপর ঢুকলো।
"কি ব্যাপার মনোজ কি ফেরেনি ব্যাগটা রাখতে রাখতে ড্রইংরুমে রেখা নানা কথা ভাবতে
লাগলো ।তারপর দেখল না ,না মনোজের জিনিসপত্র রয়েছে ।তো ফিরে গেছে। তাহলে আবার কোথায় গেল?"
রেখা এবার ফোন করলো
"হ্যালো"
হ্যাঁ তুমি কোথায়?
"আমি এইতো পার্থদের বাড়ি।"
"ওখানে কি করছ?"
আরে সবাই তো স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে । ওকে নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। তাই পার্থ ডেকেছে।'
"ও আচ্ছা আচ্ছা।"
"ফিরলে?"
" হ্যাঁ এইতো ফিরলাম।
"ঠিক আছে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।"
রেখা বলল 'ঠিক আছে।"
রেখা ফ্রেশ হতে গেল। বাথরুমের সাওয়ারটা খুলে দিয়ে মাথার সামনে ভিজিয়ে সারা গায়ে ভাল করে স্নান করে নিচ্ছে। আর বেশ গান গাইছে "দিবস রজনী আমি যেন কার, আশায় আশায় থাকি।…. চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই, সদা মনে হয়
যদি দেখা পাই..।'
বাথরুমের শাওয়ারের কলটা এতটাই স্পিডে চলছে ,আর আপন-মনে গান গেয়েই যাচ্ছে ওদিকে মনোজ ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে বাথরুমের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রেখার গান শুনে যাচ্ছে মুগ্ধ হয়ে ।একসময় রেখার গান থামলো শাওয়ার কল টা বন্ধ করলো রেখা বলছে "বাপরে বাপ এই ক'দিনের মধ্যে এত গরম পড়ে গেল বলতে বলতে টাওয়াল গায়ে দিয়ে বের হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ভুত দেখার মত চমকে উঠলো।
"একি তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?'
'তোমার গান শুনছিলাম কতদিন পর বাথরুমে তুমি গান করলে।"
"বাববা যেন গান কখনো শোন নি ।বাথরুমের কাছে এসেই তোমাকে কান পেতে গান শুনতে হচ্ছে ।'
"বলতে পারো সেরকমই।'
"নাও হয়েছে ,হয়েছে ,চলো।"
রেখা ঘরে ঢুকে নাইটিটা পরে নিল। তারপর বলল "কি হয়েছে গো সোনাইয়ের।'
" আর ব'লো না সেই হারটা চুরি হয়ে যাবার পর থেকে ওকে তো স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে না।"
" সে কি এখনো কি স্কুলে যায়নি? সেতো প্রথম প্রথম শুনেছিলাম যে স্কুলে যেতে চাইছে না ।'
"না গো ভেতরে একটা ভীতি কাজ করছে। যে ছেলে এত চনমনে এত কথা বলে ।না এখন আস্তে আস্তে একটু কমিয়ে দিয়েছে ।রেখা অবাক হয়ে বলল" কি বলছো তুমি?'
" হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি ।তাহলে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।'
" আমিও সেরকমই বলে আসলাম জানো ।"
এ বাবা এ তো ভারি চিন্তার ব্যাপার হলো' হ্যাঁ ওর মা-বাবা ও এখন খুব চিন্তিত আছে।"
তাই আমাকে ডেকেছিল কোন ডাক্তারের কাছে যাবে ?তা আমি বললাম একবার কাউন্সিলিং করানোর দরকার তা কোন ডাক্তারের কথা বললে আমি একবার সুরোকে ফোন করেছিলাম সুরো কে ।তখন ফোন ধরতে পারেনি ।পরে রিং ব্যাক করেছিল ।'ও বলল খোঁজ নিয়ে ও
জানাচ্ছে ।তারপর পুরো ডিটেলস এর ঠিকানা নিয়ে পার্থ দেরকে জানিয়ে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বাচ্চাটিকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে '
"একদমই তাই।'
" বাচ্চাদের দেখো কত রকম সমস্যা না?'
'আমাদের স্কুলের বড়দি ফোনে বলছিলেন অনিন্দিতার বাচ্চাটার সমস্যা ও কথা বলে না। সে তো এখন ওকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। স্কুল থেকে ওকে তাড়িয়ে দেবে বলেছে ।'
"এ বাবা কি বলছো তুমি?
" হ্যাঁ গো অনিন্দিতা তো এতদিন শুধু বাচ্চার খাওয়া-দাওয়া এসবের দিকে নজর দিয়েছে বাচ্চার কথা বলার দিকে কোনো নজরই ছিলনা" এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেখি ও বোধহয় কালকে স্কুলে গেলেই বুঝতে পারবো। আজকে বড়দি ফোন করেছিলেন কিন্তু আমি ট্রেনে ছিলাম তো অপরদিকে আর ঘাঁটালাম না।"
"কি অবাক কান্ড দেখো?'
"ওদিকে তোমার নাতি নাতনীদের কান্ড শুনেছো?'
"ওরা আবার কী করল ওরা তো আমাদের ভাল বেবি।"
"সে তো ভালো বেবি বটেই। তাহলে আবার কি করেছ ওরা,?'
আজকে একটা মরা পাখি সেটাকে মুখে করে নিয়ে চলে এসেছে গ্যারেজ রুমে। সেখানে এনে রেখে দিয়েছে আর কি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমি তো গেটে পা দিয়েই সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেখানে গেলাম।
' যেন কত ভাল গন্ধ'!
তুমি গন্ধ শুঁকে শুঁকে ওখানে গেলে
না গো ?তাছাড়া কি করব?
"বাজে বন্ধ হোক যাই হোক গন্ধ শুঁকেই তোমাকে সেই জায়গা ঠিক করতে হলো। তারপর সেটা ফেললাম জানো?"
"তা বেশ করেছো।'
রেখা একটু হাই তুলল।
বলল" রাত্রে কি খাবে?'
মনোজ বললো" যা খাওয়াবে ।'
"আমার না রান্না করতে ভালো লাগছে না ।খুব টায়ার্ড লাগছে।"
মনোজ বলল" ঠিক আছে ওট স খেয়ে নেব ।"
"আমি একটু 5 মিনিট গড়িয়ে নিই বুঝলে?"
ভালো হয় রবীন্দ্র সংগীতে।
চালিয়ে দাও তো? আমার ঘুম গুরুদেবের গানেই ভাল হয় এবং একটু রিলাক্স হয়।"
"ঠিক আছে চালিয়ে দিচ্ছি ।তুমি কি গান
শুনবে ?
"দাও না। রবি ঠাকুরের গান কোনটা
খারাপ লাগে নাকি?"
"দিবসও রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি..
চঞ্চল হয়ে ঘুরিয়ে বেড়াই , সদা মনে হয় যদি দেখা পাই….।"