০৪ মে ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৬৯





উপন্যাস



 টানাপোড়েন  ১৬৯

একটা মিষ্টি গন্ধ

মমতা রায়চৌধুরী



বসন্তের শেষ লগ্নে এসে নীল গাজনের ঢেউ দোলা দিয়ে যায় রেখার মনে। আসলে কিছু কিছু অনুভূতি আছে যেগুলো শব্দের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা যায় না আবার কিছু শব্দ আছে যার ভেতর দিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করা যায় ।এক বৈচিত্র্য বিরাজ করে মনের চোরা কুঠুরিতে। সকাল সকাল মনোজের ভালোবাসায় আপ্লুত রেখা স্কুলে পৌঁছে স্কুলের হাজারো কাজের মধ্যেও সুন্দর অনুভূতি গুলো বারবার অনুরণিত করে। শুকনো হৃদয় টাকে এক পশলা ভালোবাসার উষ্ণতায় ভিজিয়ে রাখে।
তারপরেও ক্লাসের ফাঁকে অফ পিরিওডে রেখার মন হু হু করতে থাকে কোন এক উদাস ঘুঘুর ডাকে। রেখাকে নিয়ে যায় তার অতীত স্মৃতিচারণায়। গতকালকে পাওয়া কবিতার বই স্বপ্নীল ভট্টাচার্যের লেখা, রেখা বারবার সেই বইটার গন্ধ নিতে থাকে আর ভাবে এর মধ্যেই তার অতৃপ্ত স্বপ্নগুলো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। রেখা বইটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল স্কুলে কিন্তু এই রাইটার বইটা এত টানছে কেন ?শুধুমাত্র নামের সাথে সাযুজ্য আছে বলে নাকি সত্যি সত্যি তার মনের বালিয়াড়িতে চাপা পড়ে যাওয়া নামটি হঠাৎ কোন এক বদলের বৃষ্টিতে সজীব হয়ে উঠেছে।
রেখা প্রথম দুটো ক্লাস নেওয়ার পর থার্ড পিরিওড অফ পাওয়াতে বইটা খুলে বসে।
একমনে বইটা খুলে কবিতা তে মনোনিবেশ করেছে। প্রথম কবিতার নাম" ভালোবাসা।"
কতবার কবিতাটা পড়ল রেখা।
কিছু শব্দ রেখার এত পরিচিত কেন?
যে শব্দগুলো বারবার শুনেছে কারোর কাছ 
থেকে। শব্দগুলোই রেখার মনের ভেতরে তোলপাড় শুরু করেছে।
"এসব কি হচ্ছে রেখার সাথে?"
রেখা যখনই একটি স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে ঠিক তখনই যেন রেখার মন উথাল পাথাল  করে।
কবিতা পড়তে পড়তে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
ঠিক সেই সময় শুভ্রা এ সে বলে' কি করছো গো রেখা দি,?"
রেখা ছিল অন্য জগতে।
রেখা বলল"এই বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।,
"কি নাম কবির?'
"স্বপ্নীল ভট্টাচার্য।'
শুভ্রা বললো 'এই নামটা না আজকাল লোকের মুখে মুখে ফিরছে।"
রেখা চুপ করে থাকে।
শুভ্রা আবার বলে 'এই কবিকে জানো কি বলা হয় ভালোবাসার কবি।"
রেখা একটু হেসে বলল 'ও তাই বুঝি?"
হ্যাঁগো অনেকের মনে নাকি এই  কবি  হার্টথ্রব হয়ে গেছে।
রেখা মনে মনে বলল" না ,শুধু হার্ট থ্রব অন্য একজনের…।'
শুভ্রা বললো 'অ্যাই রেখা দি কিছু মনে করবে না বলো?'

রেখা একটু হেসে বলে "কি জন্য মনে করব?'
'তাহলে সাহস করে বলেই ফেলি' শুভ্রা বললো।
"হ্যাঁ কি বলবি বল?'
"বলছি "মানে বলছিলাম…।"
রেখা পোলার কিন্তু কিন্তু করিস না তো
কি বলবি সেটাতো বল।"
' শুভ্রা আমতা-আমতা করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল"বলছি একদিনের জন্য তোমার এই কবিতার বই টা আমাকে দেবে?"
রেখা জানে বই আর বউ নাকি একবার হাতছাড়া হলে খুব মুশকিল হয়ে যায় ঘরে ফেরানো।
তাই রেখা চুপ করে থাকে।
শুভ্রা বললো আবার" তুমি চুপ করে রইলে যে।'
'কি বলি বলতো?'
সত্যি কথা বলতে কি বইটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করছে না, আমার বনএখনো পড়া হয়নি।'
শুভ্রার মুখটা নিমেষের মধ্যে যেন বর্ষার মেঘ ঘনিয়ে আসল।।
শুভ্রা বললো 'জানো রেখা দি।'
রেখা কৌতুহল আর উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে 'হ্যা কি বলছিস বল?'
'কোথা থেকে যে শুরু করি বুঝতে পারছি না।'
এরমধ্যে পঞ্চমী দি  এসে খবর দিয়ে গেল" রেখাদি বড় দি আপনাকে ডাকছেন।'
রেখা বলল," যাই।'
 পঞ্চমীদি  বলল' তাড়াতাড়ি 
আসুন ।জরুরী তলব।'
রেখা হেসে ফেলে তারপর বলে 'তুমি যাও আমি এক্ষুনি আসছি।'
রেখা বড়দির ঘরের দিকে এগোয়
'মনের ভেতরে কবিতার লাইনগুলো বারবার মোচড় দিতে থাকে।'
রেখা বলল 'ও বড়দি আসব?'
বড়দি বললেন 'আরে এসো এসো তোমার জন্যই ওয়েট করছি।'
রেখা বড়দির  সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
বড়দি বললেন 'আবার ওয়ার্কশপে চিঠি এসেছে।'
রেখা খুব কৌতুহলী হয়ে বলল" ও তাই বুঝি?"
রেখা বলল" lকাউকে পাঠাচ্ছেন?
 বড়দি বললেন 'সেটাই তো ভাবছি?
কাকে পাঠাই বলতো?
রেখা বলল "কি বলি বলুন তো,,?
বরদি একটু চিন্তিত হয়ে বললেন এদিকে তোমার বোর্ডের খাতা এসেছে তোমাকেও বলতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে?"
রেখা বলল আপনি একবার শুভ্রাকে বলে দেখতে পারেন,?
বড়দি নিরুৎসাহ ভাবে বললেন" ভালো জেনারেল নাম করেছ?'
রেখা বলল "তাহলে কাকে পাঠাবেন?'
ওটাই তো এদের তো শুধু "মুখেই মারিতং জগত।' কাজের বেলায় লবডঙ্কা।
"তোমার খাতা দেবার ডেট কবে?'
'এই তো সামনের সপ্তাহেই দিদি।:
"এদিকে সামনের সপ্তাহেই আছে ওয়র্কশপ।"
রেখা বুঝতে পারল বড়দি মনে মনে রেখাকেই  পছন্দ করছেন  ওয়ার্কশপে পাঠানোর জন্য।'
"ঠিক আছে , রেখা তুমি এসো। দেখি কি করা যায়।'
রেখা বলল 'আসছি তাহলে দিদি।'
এরমধ্যে টিফিন আওয়ার্স। ও যে  লাঞ্চ ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অর্ডার করেছিল toসেটা এখনো এসে পৌঁছায়নি ভাবছে আর একবার ফোন করবে।
ঠিক এমন সময় পঞ্চমী দি এসে বলল রেখাদি আপনার বোধহয় কোন খাবার অর্ডার দেওয়া ছিল ।ওটা এসেছে।"
রেখা বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলেছে আচ্ছা দাঁড়াতে বল ,।আমি যাচ্ছি।'
রেখা তাড়াতাড়ি যায়  ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে লাঞ্চের প্যাকেটটা সংগ্রহ করে আর টাকা মিটিয়ে দেয়।
খেতে যাবে ঠিক সেই সময় মনে হল 'মনোজ ও খাবার খাচ্ছে তো?'
এইভেবে রেখা একটা ফোন করল।
মনোজের রিংটোন বেজে যাচ্ছে'

বাবা লোকটার হলো কি?
আবার রিং করলো এবার অপরপ্রান্ত ফোন ধরল বলল ''হ্যালো"
বলছি তুমি লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছো? খাচ্ছ খাবার?'
'হ্যাঁ দিয়েছি এখনো এসে পৌঁছায়নি।'
'তুমি খাচ্ছ?'
এইতো সবে বসেছি ভাবলাম তোমাকে একটা ফোন করে জেনে নি।
"বাবা তুমি আমার কথা মনে করলে?"
রেখা বললো "এমন করে বলো না যেন আমি তোমার কথা মনেই করি না।'
মনোজ বলল-এই রেখা রাগ করোনা আমি এমনি বললাম আসলে ফোনটা করলে আমার ভাল লাগল তাই।
আজকের সকালটা বেশ ভালো কাটলো বলো?
কে বলবে 40 বছর পেরিয়ে গেছ?'
রেখা বলল 'ঠিক আছে বুঝেছি রাখছি এখন।"
মনোজ বলল-এই হচ্ছে তোমার দোষ জানো তো ?কোনো কথা বলতে গেলে তুমি আগে রেখে দাও ফোন।"
'এটা কথা বলার সময় বলো তুমি?
বাড়িতে থাকলে তো তোমার কথা বলার সময় থাকেনা তখন ফোন নিয়ে বসে থাকবো নয় টিভিতে খেলা নিয়ে বসে থাকো"।
মনোজ হো হো হো করে হেসে
 উঠলো ।'ঠিক আছে রাখ।'
রেখা খেতে বসে ভাবলো কবিতার বই টা একটু খুলে পড়বে। কিন্তু কোথাও কবিতার বই টা খুজে পাচ্ছে না। রেখা খাওয়া বাদ দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে।
হঠাৎ শুভ্রার টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্র একমনে বইটা পড়ছে।
রেখা বলল শুভ্র তুই কি বইটা নিলি?
এতটাই কবিতায় মনোনিবেশ করেছে যে রেখার প্রথম ডাক শুনতে পেল না।
রেখার এমনিতেই মনে মনে রাগ রয়েছে কিন্তু প্রকাশ করছে না তারপর আবার বলল" শুভ্রা তুই কি আমার বইটা নিয়েছিস?"
"কি বলছো রেখা দি?"
'বলছিআমার কবিতার বই টা কি তোর কাছে?'
হ্যাঁ'
কিছু মনে করিস না তুই একবার আমাকে বলেছিস যে আমি বইটা নিয়েছি এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয় আমি খাওয়া বাদ দিয়ে তন্নতন্ন করে বইটা খুঁজে যাচ্ছি।
শুভ্রা বললো 'এই রেখা দি, কিছু মনে করো না ।আসলে তখন তুমি ফোনে কথা বলছিলে তো  বইটা তোমার টেবিলের উপরে ছিলো। আমি বললাম ততক্ষণ আমি একটু যদি পড়ে নি।'
রেখা আর কোন কথা বলল না।
রেখা তখন ভালো করে হাত ধুয়ে এসে খেতে বসলো আর মনে মনে ভাবল কিরকম নির্লজ্জ দেখো বইটা নিল। এখন তো  সেটা ফেরত দেবে, সে সবের কোন বালাই নেই।"
রেখা মনে মনে ভাবল খাওয়া শেষ করে যদি বইটা না পায় আজকে শুভ্রাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দেবে।
খাওয়া শেষ করে উঠতে যাবে শুভ্রা এসে বইটা রেখার কাছে দিল।
বলল '
রেখাদি এই নাও তোমার বই।"
রেখা বইটাকে হাতে পেয়ে মনেপ্রাণে সেই বইয়ের গন্ধ নিল। শুধু কি বইটার জন্য নাকি বইয়ের ভেতরে যার লেখাগুলো ফুটে আছে ,সেই প্রতিটা শব্দের সঙ্গে যার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে তার জন্য।
এই মিষ্টি গন্ধটা যে তার আবহমানকালের।

Jhhj

LOVE