উপন্যাস
টানাপোড়েন ১১২
ছুঁ কার মেরে মনকো
মমতা রায় চৌধুরী
রেখার আজ অলস বিকেল কাটছে শুধু ওদেরকে নিয়েই ।মিলি আগের থেকে স্টেবল হয়েছে ওষুধ খাওয়ানোর পর কিন্তু পাইলটের অবস্থা এখনো ঠিক হয়নি ।বিকেলবেলায় ওদের আদর করতে করতে হঠাৎ করে নজর পড়ে পাইলটের দিকে । রেখা খেয়াল করল'ও পটি করল কিন্তু পটিটা ভীষণ পাতলা ।
তখন সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে মনোজের
ঘরে ।রেখার ভেতরটা যেন পাইলটের জন্য কেমন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। যে বাচ্চাটি সবসময় এত উচ্ছ্বসিত থাকে রেখাকে দেখলে তো রক্ষে নেই ।আগে রেখাকে ধরবে জড়িয়ে দুই হাত
দিয়ে । তারপর ওর গালে ঠোঁটে অসংখ্য অসংখ্য আদর করতে থাকে। তারপর ওকে রেখা যখন নিজে আদর করবে ভালো করে কোলে নিয়ে ,তখন ও শান্ত হয় ।আজকে এরকম নিস্তেজ অবস্থা দেখে রেখার চোখ ফেটে জল আসে। তবু ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। এঅবস্থাতেও কোনরকমে রেখার গালে চুম্বন এঁকে দেয়।
রেখা আর রিক্স নিতে পারে না। ছুটে আসে মনোজের ঘরে।
মনোজ তখন অলস বিকেল, মেঘলা দিনে বিছানা নিয়েছে। বিছানায় ঘুমিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না দরজায় নক করার প্রয়োজন মনে করেনি সরাসরি ছুটে গেছে।
গিয়ে ডাকছে 'কিগো শুনছো? শুনছো ?
সাড়া না দেওয়াতে মনোজের গায়ে হাত দিয়ে ওকে ডেকে তোলে। আর রেখা দেখছে মনোজ ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ মনোজ রেখার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।মানে বোঝাতে চায় ব্যাপারটা কি হলো ?
রেখা উদগ্রীব হয়ে বলল 'পাইলট পটি করেছে,খুব পাতলা হয়েছে আর কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। তুমি এক্ষুনি একবার মন্টু ডাক্তারকে ফোন করো।,'
মনোজের ভেতরেও কেমনএকটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেল ।ফোনটা দাও । দাও প্লিজ তাড়াতাড়ি।টেবিলের কাছে চার্জে দেয়া আছে ।'
রেখা ছুটে গিয়ে ফোনটা এনে দেয়।
মনোজ ফোন করে মন্টু ডাক্তারকে।
একবার রিং হয়ে গেল আবার ফোন ধরাল মনোজ ।এবারও রিং হয়ে গেল ।ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে ।
রেখার লক্ষ্য করলো মনোজের কেমন যেন একটা চোখেমুখে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। রেখার দিকে তাকিয়ে বলছে 'ফোন কেন রিসিভ করছেন
না ?'এরকম তো করেন না ।তাহলে কি উনি আর্জেন্ট কোন কাজে আছেন?'
রেখা সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে দুই হাত জ্ড়ো করে প্রণাম করে আর বলে ঈশ্বর ফোনটা যেন ডাক্তারবাবু ধরেন ।করুণা করো আমাদের
প্রতি ।ঈশ্বরের করুণা অবশ্য অশেষ তাই ডাক্তারবাবু এবার ফোনটা ধরলেন।
মনোজ আনন্দে চেঁচিয়ে বলল' ডাক্তারবাবু ফোন ধরেছেন ।
'হ্যালো '
এ প্রান্ত থেকে' ডাক্তারবাবু আমি মনোজ
বলছি।
''হ্যাঁ বলুন ।ওদের কি খবর বলুন তো? '
ডাক্তারবাবু বললেন।
মনোজ বলল' হ্যাঁ, আপনাকে জানানো হয়নি দুজন ঠিকই আছে, কিন্তু ছেলে বাচ্চাটি পাইলট যার নাম ও কিন্তু নিস্তেজ হয়ে গেছে ।একটু আগে আমার স্ত্রী ওদেরকে যখন আদর করতে
গেছে ।খেতে দিতে গেছে, তখন দেখছে, পাইলট পটি করেছে খুবই পাতলা ,আর কেমন যেন একটু নিস্তেজ প্রকৃতির হয়ে গেছে।'
ডাক্তারবাবু বললেন ' সে কি কথা? আপনারা এক কাজ করুন ,দ্বিতীয় ওষুধ টা অর্থাৎTaxim-0 বন্ধ করে দিন ।
আর বদলে আমি একটা ওষুধ বলছি ওটা লিখে নিন।
মনোজ বলল একটু হোল্ড করুন ডাক্তার বাবু। আর রেখার দিকে তাকিয়ে বলল পেনটা দাও ।
দাও প্লিজ তাড়াতাড়ি।'
রেখা পেন্ টা এগিয়ে দিল।
মনোজ বলল 'শুধু পেন্ দিলে? লিখবো
কিসে ?রাইটিং প্যাডটা দাও বিরক্তির স্বরে বলল।
রেখা তড়িঘড়ি করে রাইটিং প্যাড টা এগিয়ে দিল
আর অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের কথোপকথনের শুনতে লাগল ফোনটা স্পিকারে দেয়া ছিল।
মনোজ বলল 'হ্যাঁ বলুন ডাক্তার বাবু।'
ডাক্তারবাবু বললেন
Nor-metrogyl(R)o
খাবার আগে দিনে দুবার খাইয়ে দিন 2ml করে।
ইমিডিয়েট খাইয়ে দিন।
আর একটাWalyte-ors
জলে গুলে রেখে দিন এই জল খেলেও কাজে দেবে।'
মনোজ বলল' অবশ্যই ডাক্তারবাবু। অসংখ্য ধন্যবাদ।'
ডাক্তারবাবু বললেন 'কেমন থাকে না থাকে জানাবেন অবশ্যই
মনোজ বলল 'ডেফিনেটলি'
এবার ফোনটা কেটে দিলো।
মনোজ তাড়াতাড়ি হাফপ্যান্ট পরা ছিল সেটাকে ছেড়ে দিয়ে একটা ফুলপ্যান্ট পড়ে নিল সঙ্গে করসুলের শার্ট,মাফলার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল।'
রেখা দুশ্চিন্তা নিয়ে গোপালকে ভোগ চাপাতে
গেল।
আজ পূজো করতে বসেও রেখার মন নেই। এরমধ্যে মনোজ ওষুধ নিয়ে এসে হাজির। এসেই রেখা রেখা বলে শোরগোল করতে শুরু করলো।
মনোজ রেখাকে বললো 'এসো ধরবে ওষুধ খাওয়াবো ।
রেখা সঙ্গে সঙ্গে গেল ।গিয়ে ধরলো পাইলট কে। খুব কষ্ট করে ওষুধটা খাওয়ানো হলো।
থ্যাংকস গড যে তাড়াতাড়ি ওষুধ খাওয়ানো গেলো রেখা বলল।
রেখl একটু নিশ্চিন্ত হল' দেখা যাক কি হয়।'
এবার রেখা নিজের রুমে চলে আসলো। এসে উপন্যাসের নেক্সট পার্ট লিখতে শুরু করলো। কিন্তু লিখতে শুরু করার আগে বারবার মনে হতে লাগলো সম্পাদককে । তিনি যে নাম বলছেন এই নামটা তো অনেক আগে তার জীবনে একটা দাগ কেটে গেছে। ডিপিতে কোন ছবি দেখা যাচ্ছে না। অনেক কথাই মিলে যায় তার সঙ্গে। হঠাৎ করে রেখাকেই বা কেন এত উৎসাহিত করছেন,?'
সাত-পাঁচ ভেবে কূলকিনারা করতে পারল না,। সে পেন্ নিয়ে বসল লিখতে। শুরু করলো লেখা।
এর মধ্যেই ফোন বেজে ওঠে' তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম..।'
রেখা একটু বিরক্ত হল এক আকাশ ইচ্ছে নিয়ে বসেছে লিখতে ।লেখার মাঝে তার কেটে দিলে ভাবনায় ছেদ পড়ে।'
একটু বিরক্ত নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে বলে "হ্যালো'।
হ্যালো লিখছেন?
রেখা বলল হ্যাঁ লিখছি
সম্পাদক বললেন'বাচ্চাগুলো কেমন আছে?
রেখা বলল দুজন ভালো আছে আর একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সম্পাদক বললেন সে কি?
রেখা বলল' হ্যাঁ,তাছাড়া কি বলছি।
সম্পাদক বললেন' তাহলে তো আপনার খুব চিন্তা বাড়লো।'
রেখা বললো' তা ঠিকই বলেছেন।'
সম্পাদক হেসে বললেন 'আমাকে আপনি না করে বললেও হয় ।আমি কিন্তু আপনার থেকে বয়সে ছোট?'
রেখা বলল 'তা হয়ত হতে পারেন কিন্তু অচেনা-অজানা একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে প্রথমেই তুমি করে বলা যায় না আপনি তাই প্রযোজ্য বেশি।'
সম্পাদক বললেন তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।
তবে এখন যেখানে আমি বলছি আপনি আমাকে '' আপনি'শব্দটা বাদ দিতে পারেন।
রেখা বলে চেষ্টা করব?
সম্পাদক বলেন' সেই চেষ্টা।'
রেখার বুকের ভেতরে এসে যেন ধাক্কা দিলো কথাটা।
এ তো অবিকল তার মত কথা।
কি করে হতে পারে?'
সম্পাদক বললেন' ভাবনায় পড়ে গেলেন না?'
রেখা মনে মনে ভাবল একি রে বাবা কি হচ্ছে এসব। আমার মনের ভেতরে কিছু আছে তিনি কি করে বলছেন?'
সম্পাদক বললেন' মাইগ্রেন আছে?'
রেখা এবার অবাক হয়ে যাচ্ছে ,সে তো কখনো বলেনি তার মাইগ্রেন আছে? 'তাহলে এ প্রশ্ন কেন করছেন?'
সম্পাদক হেসে বললেন'এখন কি বসে বসে ভাবার চেষ্টা করবেন, কী রহস্য?
বলেই ফোনটা কেটে দেন।
রেখা সত্যিই উপন্যাসের পার্ট লিখতে বসে জীবনের পার্ট একের পর এক মেলে ধরছে ।কি যেন প্রজাপতির ডানায় চেপে এসেছে ভাবনাগুলো।
রেখার কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগলো। আবার নতুন কোন জীবনে কেউ আসতে চলেছে। এই ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে না তো দূর
বহুদূরে ?নাকি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে আপন মনে ।
রেখা ভাবনাটাকে মন থেকে সরিয়ে দিয়ে উপন্যাস লেখায় মনোযোগী হল।'
রেখার ভাবনায় উপন্যাসের চরিত্র কথা নিয়ে আসে।
উপন্যাসে মেঘ বৃষ্টির খেলা, আর নির্জন দুপুরে কারো ভাবনায় কেটে যায় কত মুহূর্ত। এ যেন রেখার জীবনেও ঘুরছে। ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতি গুলো আবার কেন রঙিন বসন্ত হয়ে উঠছে।
এ যেন' ' ছু কর মেরে মনকো, কিয়া ত্যুনে কিয়া ইশারা….।'
রেখার এবার পাগল পাগল মনে হচ্ছে। পেন টা নিয়ে হিজিবিজি দাগ কেটে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই মনোজ চিৎকার করে ডেকে ওঠে রেখা, রেখা, রেখাআ আ আ হঠাৎই রেখার ধ্যান ভাঙ্গে।
সে সাড়া দেয়'কি হলো?'
মনোজ পাশের ঘর থেকে বলে কি হলো মানে কটা বাজে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছ?
রেখা সত্যিই ঘড়ির দিকে তাকায় নি খেয়ালই করে নি তাকিয়ে দেখে সাড়ে নটা বাজে। ইসসস কত দেরি হয়ে গেল।
মনোজ বলে ওদেরকে খেতে দেবে তো?
রেখা বলে হ্যাঁ দেবো তো?
রেখা পেন খাতা রেখে দিয়ে ছুটতে থাকে রান্নাঘরের দিকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে আহা রে কত দেরি হয়ে গেল ।রেখার ভুলের জন্য বারবার ওদের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে ।এবার খাবার নিয়ে গিয়ে হাজির হয় মিলিদের কাছে কিন্তু সেই একই মিলি, তুলি খেলো বটে পাইলট কিন্তু ধারেকাছেও আসলো না। রেখা এত বার চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারল না। চিন্তিত মনে তালা রান্নাঘরের বেসিন এর রেখে দিয়ে মনোজের ঘরে আসে এবং বলে পাইলট কিন্তু খাইনি।
মনোজ একটু চিন্তিত ভাবে বলল 'সবে তো ওষুধ পড়েছে একবার ।দেখো নিশ্চয়ই খাবে?'
রেখা ও তাই ভাবতে থাকে নিশ্চয়ই খাবে। একটা অনিশ্চয়তা' এই হবে ,হয়তো ,বোধহয় ,শব্দগুলো জীবনে একটা গভীর প্রভাব ফেলে। আর মন ছুঁয়ে যায়। তাইতো মন বলে ওঠে ছুঁকার মেরে মনকো কিয়া তুনে কেয়া ইশারা...।'