উপন্যাস
টানাপোড়েন ৬৯
প্রতিবন্ধীর স্বপ্ন
মমতা রায় চৌধুরী
মনোজের এতবার ডাকাতে রেখা একটু বিরক্তিস্বরে এসে বলল" কেন গো এত ডাকছিলে কেন? কি হয়েছে ?কি চাই?'
মনোজ যেন হঠাৎ করে রেখাকে এভাবে কথা বলতে দেখে একটু বিস্মিত হয়।মনোজ ভাবতে থাকে এ কোন রেখাকে দেখছে হঠাৎ করে রেখার ভিতর এমন কি রেখাপাত করলো ?এমন কি দ্বন্দ্ব হলো? যার জন্য এভাবে কথা বলছে?"
রেখা বলল 'হ্যাঁ, করে মুখের দিকে তাকিয়ে কেন বল?"
মনোজ বললো 'না মানে তোমার ফোন?"
রেখা বললা" আমার ফোন কি হয়েছে?'
মনোজ বলল'তোমার ফোন বেজেছে কয়েকবার।'
রেখা বলল 'কে করেছে?'
মনোজ বলল 'আমি দেখি নি।'
রেখা বলল ' তুমি কি ফোনটা কে করেছে দেখলে না?
রেখা একটু গজ গজ করতে করতে ফোনটা ঘেটে দেখল কাকিমার মিস কল হয়ে আছে আর রিম্পাদির
আরেকটা অচেনা নম্বরের মিসকল হয়েছে।
মনে মনে ভাবছে এই নম্বরটা তো ওর ফোনে সেভ করা নেই ।কে করতে পারে?
মনোজ বললো 'কি ব্যাপার ফোনটা হাতে নিয়ে মিসকল দেখে এত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লে?'
রেখা বলল 'দুটো নম্বর তো চেনা কিন্তু আর একটা নম্বর না আননোন নম্বর?'
মনোজ বলল 'তোমার চেনা কেউ হয় তো। না হলে এত বার মিসকল কেন করবে বলো?'
রেখা বলল 'আননোন নম্বরটাই বেশি বার রিং হয়েছে। কিন্তু ফোন করব কিনা বুঝতে পারছি না? কি যে করি?'
মনোজ বললো 'একবার করে দেখো যদি কেউ তোমার চেনা কেও হয় ।হয়তো নম্বরটা চেঞ্জ করেছে এমন হতো হতে পারে?'
রেখা বললো 'তাহলে করেই দেখি? না কি?'
মনোজ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
রেখা নাম্বরটা ডায়াল করল********৩২
রেখা ফোন নম্বরটা ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গে রিং হলো
'আমি শুধু রইনু বাকি, যা ছিল গেল দূরে... ।'রেখা মনে মনে ভাবলো এত সুন্দর একটি গান কে হতে পারে ?নিশ্চয়ই তার মনটাও খুব সুন্দর। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একজন সুন্দর সুরেলা কণ্ঠে বলল' 'হ্যালো'।
রেখা একটু হকচকিয়ে গলায় বলল' হ্যালো আমার এই নম্বর থেকে ফোন এসেছিল?'
অপরিচিতা বলল'ম্যাডাম আমি নির্মলা বলছি।'
রেখা একটু অবাক হয়ে বললো' কোন নির্মলা?'
নির্মলা বলল 'আমি আপনার প্রতিবন্ধী ছাত্রী নির্মলা।'
রেখা একটু মনে কষ্ট পেল ।তারপর বলল কিছু মনে করো না ,আসলে আমি চিনতে পারি নি তো তাই?'
নির্মলা বলল 'না, না ম্যাম ।এত এত মেয়ের মাঝখানে কি সবার কথা মনে থাকে?'
রেখা বললো' এখনও কিন্তু আমার মনে আছে ।তোমার অপরিসীম ধৈর্য, তোমার একাগ্রতা, আর মনোবলের জন্য। আসলে আর একজনের নাম ও তো নির্মলা ছিল ।এজন্য একটু জিজ্ঞেস করেছি গো, কোন নির্মলা? কষ্ট পাও নি তো?'
নির্মালা বলল' না ,না ,ম্যাম ।আপনার কথায় আমি কষ্ট পাব ?সেটা কখনো হয়। আপনি আমার জীবনে কি ?সেটা তো শুধু আমিই জানি।'
রেখা বলল 'না ,না , কি এমন করেছি আমি বলো?'
নির্মালা বলল 'সেটা তো আপনার মহানুভবতা ম্যাম।'
রেখা বলল'নির্মলা ,আমাকে ওই আসনে ফেলো না প্লিজ।'
নির্মালা এবার হেসে বলল' প্রণাম নেবেন ম্যাম। আর আশীর্বাদ করুন জীবনে যেন অনেক বড় হতে পারি ।আর মানুষের মতো মানুষ হতে পারি।'
রেখা বলল 'কি যে ভালো লাগছে তোমার ফোনটা পেয়ে ,কি বলবো তোমায় ।কিছু মনে করো না তোমার ফোনটা বেজে গেছে ,আমি ধরতে পারি নি ।আমি একটু অন্য দিকে কাজে ব্যস্ত ছিলাম তো?'
নির্মলা বলল 'না আমারও ঠিক হয় নি ।এটা আমার বোঝা উচিত ছিল কাজের টাইম। আসলে আমি একটা খবর দেবার জন্যে আপনাকে ফোনটা করেছি।'
রেখা বলল 'ও তাই?'
নির্মলা বলল' হ্যাঁ ম্যাম ,আপনি যদি না থাকতেন আজকে আমার এই দিনটা দেখা সম্ভব হতো না।
আমি এতদূর আসতেই পারতাম না।'
রেখা বলল' আমি আবার তোমার জন্য কি করলাম?'
নির্মলা বলল 'সে তো আমি জানি। আমি অতটা অকৃতজ্ঞ নই।'
রেখা বলল 'সে আমি জানি। তুমি কি খবর দিতে চাইছো? যেটা গেস করছি সেটাই কি? তোমার কি ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট হল?'
নির্মলা বলল' আমি' ল' নিয়ে পড়ছিলাম ।আমার যেটা ইচ্ছে ছিলো , সেটা পূরণ হয়েছে ম্যাম ।আমার ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট হল।'
রেখা বলল 'তাই বুঝি? প্রথমে তোমাকে অনেক অনেক ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। সঙ্গে আমার স্নেহ ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ।তুমি জীবনে আরো অনেক বড় হও ।কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হও। সঙ্গ
সুনামের সঙ্গে তুমি কাজ করো।'
নির্মলা বলল' থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম'।
রেখা বলল 'ও একদিন তুমি আমার বাড়িতে চলে এসো।'
নির্মলা বলল 'যাব ,একদিন ম্যাম ।আপনাকে তো আমায় প্রণাম করতেই হবে ।যাবো সময় করে একদিন যাবো।'
নির্মলা বলল' ম্যাম আজকে আরো অনেক বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আমার একটা আর্জেন্ট কাজ এসে গেছে। আমি যার আন্ডারে প্র্যাকটিস করছি ,ওই স্যারের বাড়ি যেতে হবে।'
রেখা বলল'ও শিওর।'
নির্মলা বলল 'ফোনটা তাহলে রাখছি।'
রেখা বললো 'হ্যাঁ রাখো। ভালো থেকো। সর্বদা আনন্দে থেকো।'
হঠাৎই রেখার মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল। ভাবতে লাগল প্রতিভা মানুষকে পরিচিতি দেয় আর সেই পরিচয় নিয়ে সমাজকে ফুলে ফলে বিকশিত করে তোলে ।সমৃদ্ধ হয় দেশ ।নিকষ কালো অন্ধকার জীবনে উজ্জ্বল আলোর বাতাবরণ তৈরি হয় । প্রতিভার মধ্যে দিয়েই সে রকম একজন প্রতিভাধারী হচ্ছে এই নির্মলা।'
মনোজ বলল 'কি গো ফোনটা কেটে কেমন যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে চলে গেলে?'
রেখা বললো 'আজকে আমার আনন্দ করার দিন ।এত আনন্দ আমি কোথায় রাখবো ?আমি জানি না।
মনোজ বলল 'কি হয়েছে?'
রেখা বললো 'আমার একজন প্রতিবন্ধী ছাত্রী । প্রথমে স্কুলে ভর্তি নেয়া হচ্ছিল না শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। আমি এর জন্য ভীষণভাবে বরদি কে জোরজবস্তি করেছিলাম এবং অনেকটা লড়তে হয়েছিল বলা যায়।
মনোজ বলল 'তাই বুঝি? জানো এই মেয়েটি
প্রতিনিয়ত লড়াই করেছে ।সেই লড়াই করার মানসিকতাকে পাথেয় করে ও লড়াকু আর সংগ্রামী হয়ে উঠেছিল।'
মনোজ বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ছিল এবার উঠে বসে বলল'খুবই ইন্টারেস্টিং তো? বলো তুমি এর সম্পর্কে একটু শুনি। জানতে বড় লোভ
হচ্ছে।'
রেখা বলল' নির্মলা ডাক নাম নিমু। জন্ম থেকেই ওর দুটো হাত আর একটা পা অকেজো।
মনোজ বলল 'বলছ কি?'
রেখা বললো 'ঠিকই বলছি ।শুধু তাই নয় জানো তো হাত দিয়ে লিখতে পারতো না, তাই পায়ের সাহায্য নিয়ে লিখত। ৮০শতাংশ প্রতিবন্ধী ,।তাই বলে কিন্তু সহজে হাল ছেড়ে দেয় নি। '
মনোজ বলল 'সঙ্গে ছিল দারিদ্র আর আর্থিক অনটন। এজন্য স্কুলে ভর্তি নেওয়া হলেও সমস্যা হচ্ছিল। তখন আমি নিজের দায়িত্বে ওকে ভর্তি করেছিলাম ।জানো তো আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল ওকে নিয়ে ।কারণ আমি জানতাম ও পারবে ,ওর ভেতরে আমি সেই আগুনটা দেখতে পেয়েছিলাম ,ওর ভেতরে একটা খিদে ছিল জানো তো?
রেখা আপন মনে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। মনোজ কথা বলা রেখার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর শুনছে।
হঠাৎ রেখা চোখ বোলাতে বোলাতে বলল 'কি দেখছ তুমি এমন করে ?আমার কথা তুমি শুনছো না?'
মনোজ বলল' শুনছি, তুমি বলো।'
রেখা বললো 'জান ,ওর সেসময় ভর্তির টাকা ,তাছাড়া স্কুলে যে 'যাবতীয় খরচগুলো ছিল ।সেগুলো আমি বেয়ার করতাম ।তোমাকে বলা হয় নি।'
মনোজ বলল' আমাকে বলো নি কেন? আমি বারন করতাম?'
রেখা বলল 'কি জানি কেন বললাম না তোমাকে?'
মনোজ বলল ' ঠিক আছে ।তার পরের কথা বলো?' রেখা বলল'বলছি ২০১৩ সালে তো আমাদের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করল কৃতিত্বের সঙ্গে। তারপরে উচ্চমাধ্যমিক তারপর কলেজ ।এরপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন :নিয়ে পড়াশোনা করল।'
মনোজ বলল 'তারপর?'
রেখা বলল 'ও একদিন কেঁদে কেঁদে বলেছিল ও প্রতিবন্ধী বলে ওর আশেপাশে যারা ছিল প্রত্যেকেই ওর কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল ।এমন কি পড়াশোনার ব্যাপারেও স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ব্লক ,প্রশাসন কেউ বিন্দুমাত্র কোন সহযোগিতা করে নি ।তারপর একদিন আমার কাছে আসলো । ওর খরচ আমিই চালিয়েছিলাম।
মনোজ বলল 'কলেজের খরচ কে চালাবে?'
বাড়ির লোকজন এই কথাটাই তো বলছিল' একদিন এসে খুব কান্নাকাটি শুরু করলো ।স্কুলের বাইরে আমাকে ডেকে নিয়ে তখন আমি বললাম যে ,তুই কান্নাকাটি করিস না। এই দুর্দিনে তোকে কেউ সাহায্য করুক না ,করুক আমি তোকে সাহায্য করবো ।সেই সময় তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না যে, হঠাৎ করে তোমার এত টাকার প্রয়োজন এসে পড়ল? 60 হাজার টাকার মতো খরচ করেছিলাম ওর পড়ার জন্য ।আজ ও একজন সফল আইনজীবী হতে চলেছে ।এর থেকে গর্বের আর কী হতে পারে বল তো?'
মনোজ বলল 'এটা তো গর্ব করার মতোই।'
রেখা বলল 'জানো আমি চেয়েছিলাম যে প্রতিবন্ধী বলে হেলা ফেলা নয়। যদি প্রতিভা থাকে, মনের জোর থাকে , তাকে বাইরে থেকে আরও বেশি সাপোর্ট করা উচিত ।যেটা ওর ক্ষেত্রে হচ্ছিল না ।ওর বাবা-মা ও ভেঙে পড়েছিল ।'
মনোজ বলল 'তাই?'
রেখা বলল' ওর মা বাবা বলেছিল কি করে মেয়ের পড়াশোনার খরচ টা চালাবে ?তখন আমার কাছে এসেছিলো।'
মনোজ বলল 'তুমি এক মানবিক কাজ করেছো। এটাই করা উচিত ছিল।'
রেখা মনোজকে জড়িয়ে ধরে বলল 'সত্যি বলছো?'
মনোজ বলল' হ্যাঁ গো।'
রেখা বলল' জানো, আজকে আমার টিচার হিসেবে মনে হচ্ছে , টিচাররা সত্যিই মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতার পেশার মহান ব্রত নিয়ে এসেছিলাম, তার কিছুটা হলেও করতে পেরেছি।'
মনোজ বলল'একদম ।তুমি ভেবো না ওই মেয়ে অনেক দূর এগোবে।'
রেখা বলল শারীরিক অক্ষমতা জীবনে সাফল্য পাবার জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নয় ।যদি মনের জোর ,অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ,একাগ্রতা এবং ধৈর্য থাকে তাহলে সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যাবেই।'
মনোজ বলল' ১০০ বার।'
রেখা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলে উঠলো'দেখো একদিন
নির্মলা সকলকে তাক লাগিয়ে দেবে । স্বর্ণালী দিনের অপেক্ষায় যেদিন খবরের কাগজে বড় বড় করে হেডিং থাকবে প্রতিবন্ধী ছাত্রী নির্মলা একজন সফল আইনজীবী।'
মনোজ বলল' অবশ্যই ওর এই জীবন সংগ্রামের কাহিনি অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করবে।'