উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৫৪
আবার হবে দেখা
মমতা রায় চৌধুরী
অবশেষে একটা স্বপ্ন সত্যি পূরণ হতে চলেছে। মনের ভিতরে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল লেখিকা হওয়ার। কিন্তু কখনো সাহস করে ভাবতে পারে নি যে তার লেখা কখনো ছেপে বেরোবে, ভাবতে পারে নি মানে, কিভাবে সেটা সম্ভব, সেটা বুঝে উঠতে পারে নি। এ বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছে রিম্পা দি। অবশ্য এখন সম্পাদক মহাশয় যথেষ্ট উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছেন। ওনাদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এটা তো ঠিক একটা লেখা কে আরো ভালো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সম্পাদকের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। রেখা এসব ভাবছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ।কালকেই একটা সম্মাননা প্রাপ্তি ।আর কি চাই?'
আজকে ঘুম আসছে না ।ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করছে ।রক্তের ভেতরে যেন পারদের মত উষ্ণতা বেড়ে চলেছে।
হঠাৎ মনোজ পাশ করে শুতে গিয়ে রেখাকে দেখছে আপন মনে বিড়বিড় করছে ওপরের দিকে তাকিয়ে। মনোজ প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেছিল অবাক হয়ে উঠে বসে রেখাকে ধাক্কা দিয়ে বলে 'অ্যাই তুমি এখনো ঘুমাও নি আর বিড়বিড় করে কি বলছো?"
রেখা বলল 'ঘুম আসছে না তো?'
'ও ঘুম না আসলে বুঝি বিড়বিড় করলে ঘুম আসবে এটা আবার নতুন তোমার মেডিসিন
নাকি? তোমার আবিষ্কার?'মনোজ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
রেখা অবাক হয়ে বললো,' আমার ঘুম আসছে না 'তুমি হাসছো?'
মনোজ হাসি থামিয়ে বললো 'ওয়েট ওয়েট, ওয়েট ,তাহলে কি বলবো বলো?'
রেখা খানিকক্ষণ নিরুত্তর থাকলো গাল ফুলিয়ে।
মনোজ বলল'কেন আজকে তো অনেকটা জার্নি করে এসেছ ,টায়ার্ড আছ।তবুও ঘুম আসছে না কেন?'
'জানিনা কালকের ওই ব্যাপারটা নিয়ে একটু টেন্সড, উত্তেজিত আছি। হয়তো সে কারণে।'
মনোজ ঘাড় নেড়ে বলে'হতে পারে।'
'তোমার একটু রিফ্রেশমেন্ট এর দরকার ।না ঘুমালে কালকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তো ঝিমুবে।'
নাও নাও আজেবাজে চিন্তা না করে ঘুমানোর চেষ্টা করো।'
'আচ্ছা তুমি শোও আমার বুকে মাথা রেখে ।আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ।দেখো ,ঘুম পেয়ে যাবে।'
বলেই মনোজ রেখাকে বুকের কাছে নিয়ে আসে।
রেখা, কোন আপত্তি করে না। মনোজের বুকে মাথা রেখে ভাবতে থাকে মনোজকে বুঝে উঠতে পারে না কখনো এত দূর করে দেয় আবার কখনো এত কাছে টেনে নেয় ।কেন ?কেন ?কেন ?কেন এরকম করে? আমি ওকে নিয়ে সুখেই থাকতে চাই ।ভাবতে চাই ওকে নিয়েই। ওকে নিয়েই একটা জগৎ তৈরি করতে চাই কিন্তু সেটা তো হতে দেয় না ।ও আমার স্বপ্নের রঙিন প্রজাপতির ডানা ছেটে দেয়।'
এসব ভাবতে ভাবতেই রেখা কখন ঘুমিয়ে পড়ে? মনোজ আলতো করে ওর বুক থেকে রেখার মাথাটা বালিশে রাখে তারপর মনোজ সিগারেট ধরিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে।
'সে জীবনে কি চেয়েছে? সত্যিই কি সে সবকিছু পেয়েছে জীবনে? অতৃপ্তি কি বাসা বাঁধে নি।
রেখার মধ্যে সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কেন রেখাকে পুরোপুরি ভালবাসতে পারে না ।চেষ্টা করে করে রেখাকে ভালোবাসার পরক্ষণেই রেখার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। মনোজ নিজেকে নিয়ে আত্মসমালোচনা করছে। কেন হয় তার ভেতরে ? কিছু কষ্ট আছে ?কি কষ্ট?'
আজকাল মনটাকে মানাতে হবে বলেই শুধু মানিয়ে নিতে হচ্ছে ।আজও কেন বিরহে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে ।কার জন্য ?কিন্তু যার জন্য তাকেও তো সে এখন মন থেকে ভালবাসতে পারে না ।সে তো চলে গেছে অনেক দূরে। তবুও প্রথম স্মৃতি কেন ভুলতে পারে না?'
তবুও তার কথার সুর আজও বাজে তার জীবনে।
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন রেখার ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে তাকে বলে 'তুমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কি করছ?'
মনোজের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সবকিছুই মনে হয় এ ঘরের গভীরে কেমন যেন একটা নোনা ধরা শরীর ।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে 'না এমনিই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।'
'তুমি শোবে না?'
'হ্যাঁ ,তুমি শুয়ে পড়ো।'
রেখা আর কোন কথা না বলে শুয়ে পড়ে।
আবার সেই কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে।
"জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।'
রেখা ধরফড় করে, উঠে পড়ে বিছানা থেকে।
হঠাৎ করে গভীর ঘুমটা ভাঙ্গায় বুকটা কেমন ধরফর করে ওঠে, গা হাত পা কাঁপতে থাকে।
নিজেকে সামলে নিয়ে রেখা দরজা খোলে।
"ও বৌমা, ঘুমাচ্ছিলে নাকি?'
'হ্যাঁ অনেক রাত্রে শুয়েছি তো?'
'সেইতো।'
"কখন বেরোবে তোমরা?'
'ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করব ।বেরিয়ে যাবো।'
তার মাঝে একবার আমি তাহলে বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো ।কাজগুলো তাড়াতাড়ি করে দিয়ে।
ও ,আবার বাড়ি যাবে?'
"আসলে নাতিটা রাত থেকে জ্বর তো বৌমা ডাক্তারের কাছে যাবে।'
"না ,সে তো ঠিকই তুমি তাড়াতাড়ি কাজ করে যাও বেরিয়ে যাও ।আমরা বেরোনোর আগে চলে এসো মাসি।'
'সেটাই তো করবো , জানি না কি হবে।'
রেখা চটপট চা বানিয়ে মাসিকে দিল।
তারপর রুটি বানিয়ে নিল মিলিদের খাবারটাও বসিয়ে দিল। কারণ মাসি আজকে কখন আসতে পারবে, কি পারবে না?'
অন্তত খাবারটা করা থাকলে কেউ না কেউ দিয়ে দিতে পারবে।'
'মাসি তুমি রুটি খেয়ে যাবে এখন?'
'না গো তুমি রেখে দাও আমি পরে এসে খাবো।
আমার এখন তাড়া আছে।'
রেখা তাড়াতাড়ি বেডরুমের দিকে গেল
মনোজকে ধাক্কা দিয়ে বলল 'কিগো তুমি কখন উঠবে? আজকে তাড়া আছে না ?তুমি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ?'
মনোজ ঘুমের চোখে বলে "কটা বাজে গো?'
'অনেক বাজে তুমি উঠে পড়ো, এই যে চা রইল।'
নিজেদের খাবারটাও ততক্ষণে হয়ে গেছে, গ্যাস থেকে নামিয়ে রেখে দিল। রেখা স্নান করতে ঢুকলো।
স্নান সেরে এসে গোপালের ভোগ চাপিয়ে মনোজকে ডাকতে গেল। দেখলে মনোজ উঠে পড়েছে। রেখাকে দেখে মনোজ বলল' তোমার স্নান হয়ে গেছে?'
'আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই। আপনি উঠুন।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি। টাওয়ালটা বাথরুমে আছে?'
রেখা ততক্ষণ নিজের ব্রেকফাস্ট টা নিয়ে খেয়ে নিল।'
আজ মনোজ বেরিয়ে রেখাকে খেতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
"তুমি খেয়ে নিলে?'
'হ্যাঁ আজ। খেয়ে নিলাম।';;
'আজকে মাসির অনিশ্চয়তা রয়েছে।'
মনোজ অবাক হয়ে বলল 'সে কি?'
ঠিক আছে, তুমি আমার ব্রেকফাস্টে দিয়ে দাও খেয়ে নিচ্ছি তাড়াতাড়ি। ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল 'আমার শর্ট প্যান্টটা কোথায় আছে?'
"আলনাতে আছে।'রেখা এঁটো প্লেট গোছাতে গোছাতে বলল।
সিঙ্কির তলায় বাসন গুলো রাখলো। মনোজের ব্রেকফাস্ট টেবিল এনে দিল।
"চিকেন রেজালা টা কেমন বানিয়েছে গো?"
'খুবই ভালো করেছে।'
'রায়দার হোটেলের নাম আছে জানো তো।"
রেখা বলল 'আমি তাহলে রেডি হয়ে নিই। তুমি খেয়ে নাও।'
রেখা শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিল।
রেখাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মনোজ দেখতে লাগলো।
রেখা, চোখের সামনে হাত গুলো নাড়িয়ে বলল কি দেখছ?
'কি সুন্দর! লাগছে তোমায়। তাই দেখছি।'
'হ্যাঁ গো পার্থকে গাড়ির কথা বলেছ ?আমি তো বলতে ভুলে গেছি তোমাকে।'
"হ্যাঁ বলা আছে।'
"হ্যাঁগো মাসি আসবে তো?"
"হ্যাঁ ,হ্যাঁ মাসি আসবে চিন্তা ক'রো না।'
বলতে বলতেই কলিং বেলের আওয়াজ।
রেখা গিয়ে দরজা খোলে ।
"সত্যি সত্যি মাসি এসেছে। মাসিকে দেখে রেখা ধরে প্রাণ ফিরে পায়।'
মাসি জুতো খুলতে খুলতে বলল" কিগো বৌমা চিন্তা করছিলে? আসবো কি আসবো না?'
রেখা বলল' তা অবশ্য ঠিকই বলেছ ?'
'ডাক্তার দেখালে?'
'বৌমা গেছে নিয়ে।'
মাসি যদি বাড়ি যেতে হয় তুমি তাহলে তালা লাগিয়ে দিয়ে চাবি নিয়ে চলে যেও ।তারপর আবার এসো কিন্তু?তবে মিলিদের খাবারটা ঠিক টাইমে দিও।'
আচ্ছা।
'তোমার রুটি রাখা আছে আর ওখানে দেখবে পনির রেজালা রাখা আছে ।ওটা নিয়ে খেয়ে নিও।আর দুপুরের ভাত তোমার জন্য করে নিও কেমন? ফ্রিজে মাছ রাখা আছে। তুমি তোমার মত রান্না করে নিও।'
মনোজ রেখাকে তাড়া দিল 'এই চলো ,চলো, পার্থ ফোন করেছিল ।গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ।"সত্যি সত্যি গাড়ির হর্ন বাজানোর আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে।
"ওই দেখো বলতে না বলতেই গাড়ি এসে গেছে।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ চলো। না হলে দেরি হয়ে যাবে।'
রেখা বললো 'মাসি আসছি দরজাটা লাগিয়ে দাও।'
মাসি এঁটো হাত ধুতে ধুতে বলল' এই যাই।'
গাড়িতে উঠতে যাবে তখন মিলির বাচ্চারা এসে ভিড় করল। ওদের আদর করতে করতে মাসিকে বলল' মাসি কয়টা বিস্কিট নিয়ে এসো।'
বিস্কিট ভেঙে খেতে দিল। ওরা খেতে
থাকল ।রেখা গাড়িতে উঠলো। হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো।
মাসিও যথারীতি 'দুগ্গা ,দুগ্গা, দুগ্গা 'বলে দু 'হাত জড়ো করল। এরমধ্যেই রিম্পা দি ফোন।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল' হ্যাঁ ,বলো রিম্পা দি।'
'হ্যাঁ রে তোরা বেরিয়েছিস?'
"হ্যাঁ বেরিয়েছি।'
'সাবধানে আয়।'
এর মধ্যে গাড়িতে গান বাজতে থাকলো' এই শহর থেকে আরো অনেক দূরে, চলো কোথাও চলে যাই…।'
গাড়ি যথারীতি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছালো।
ওখানে পৌঁছাতেই আয়োজক উদ্যোক্তারা সাদর সম্ভাষণ জানালো।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু সব ড্রিংক অফার করলো।
গেস্ট রুমে বসিয়ে দিল।
'বাহ কি সুন্দর স্টেজ করেছে গো বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে বেশ কয়েকজন কবি নাম যাদের সম্বর্ধিত করা হবে।'
মনোজ বললো' যাই একটু ছবি তুলে নিয়ে আসি।'
এরমধ্যেই' আশা'র সম্পাদক কাকে যেন বলছেন "এই দেখ কবি সাহিত্যিক স্বপ্নীল এসেছেন
কিনা ?না আসলে তো অনুষ্ঠান শুরু করতে পারছি না।'
স্বপ্নীল নামটা কানে আসাতেই রেখা কেমন উদগ্রীব হয়ে উঠলো।'
পাশের ব্যক্তি বলছেন' উনি টাইম এর ব্যাপারে ভীষণ পাংচুয়াল ।এখনো তো টাইম আছে।'
রেখার কাছে মনে হল যেন আবার স্মৃতির পাতায় জুড়তে আসছে শুধু স্বপ্নীল। একি সেই স্বপ্নীল?আবার কি নতুন করে দেখা হবে? শুরু হবে কি আবার জীবনের নতুন অধ্যায়? রেখার বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো।