
পুরোনো খসড়া থেকে
*১*.
রোগশয্যায় উবু হয়ে মেঘ ও মনকেমন লিখতে গিয়ে মনে পড়লো, এই লেখা দেওয়ালে লাগালেই আবার ঠাট্টার ঝড় উঠবে! তোমার সঙ্গে সেই গজব তামাশায় যোগ দেবে কাকেশ্বর কুচকুচে। অট্টহাসে মাতবে পুরোনো এবং নতুন হরিদাস পাল। অতএব আমি একটা রাগী লেখা লিখবো! কিন্তু রাগী লেখাটার জন্য একটা নিশ্ছিদ্র রাত চাই। আমি এখন সেই রাতের সন্ধানী।
বিনিদ্র রাতেরও নিজস্ব উদযাপন থাকে। রাতের বুক চিরে ধাত্রীশহর যাওয়ার ট্রেন থেকে শুধু সেই উদযাপন দেখবো বলে আমি জায়গা পাল্টে একটা সাইড-লোয়ার বার্থে চলে যাই। রাতের প্রকৃতি খুব মন দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, কী এক আশ্চর্য খেলা! বুঝে গেলে আফশোস হতে পারে, কতটা সময় আমরা ঘুমিয়ে নষ্ট করি! হু-হু হাওয়া আর একের পর এক জনহীন স্টেশন পেরোতে-পেরোতে মনে পড়লো, কয়েকদিন আগেই একটা কবিতা-বই রিভিউ করলাম। নিরালা জংশন। বইটাও যদি নামটার মতো সুন্দর হতো! কিন্তু নাম তো বইয়ের মলাট। নাঃ, ঠিক বললাম না! নাম আসলে বইয়ের মুখের মলাট।
মুখের প্রসঙ্গে মনে পড়ে, নিজের 'মায়া-মায়া' মুখটাকে খুব অপছন্দ হচ্ছে ইদানীং! নার্সিসাস নই, কিন্তু মুখটাকে বেশ পছন্দই করতাম। কিন্তু এখন থেকে আমি নিজের একটা চালাক-চতুর মুখ রাখতে চাই। চশমার আড়ালে চাই মানানসই দুটো ধূর্ত চোখ। ওদের যেরকম আছে। ওটাই এখন দস্তুর। অর্ডার অফ দ্য ডে!
আজকাল অনেকেই বলে, দেওয়ালে লেখা লাগাতে নেই। এরকম ভুলভাল লিখলেও, না! লেখা চুরি হয়ে যায়। এমনকি বাক্যও! এমনকি শব্দও! এমনকি ভাবনাও! আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু এটা আর লেখা হলো কই! বড়োজোর খসড়া। লেখা আর কাটা। কাটা আর লেখা। শেষমেশ শুধুই কাটা আর কাটা! কুচিকুচি করে। এইসব কাটাকুটি চুরি গেলে, যাক। যানে ভি দো ইয়ারোঁ! রাগী লেখাটা না-হয় পরে একদিন লিখবো। ওই কথাই রইলো তাহলে। চলো, ডান!
*২*.
ঘড়িতে তিনটে-চল্লিশ মানে 'বিফোর টাইম'। রাতের অন্ধকার চিরে ঝলমলে প্ল্যাটফর্মে রেখে দিয়ে গেল ট্রেন। আরও যারা নেমেছিল, তারা সব গেল কোথায়! একটু আগেভাগেই এসে পড়েছি, ধাত্রীশহর। এখনই ঘরের দিকে যাওয়ার কোনো মানে হয়! আমি বরং আরও কিছুক্ষণ রাতের অকপট রূপ দেখি।
আমি স্টেশনের ভিতরে দাঁড়িয়ে কফি খাই, স্টেশনের বাইরে গিয়ে সিগারেট। খবর-কাগজ ছেপে নিয়ে আসতে শুরু করা গাড়িগুলো দেখি। তাদের কাছে নিজেদের ভাগ বুঝে নিতে হকারদের কী ব্যস্ততা! কালকেই কিন্তু এই কাগজগুলো ঠোঙার সমান হয়ে যাবে! আমি একমনে ওদের একদিনের আয়ু দেখি। এত রাশিরাশি অক্ষরের অপচয় দেখি।
অপচয় অবশ্য চরাচরের সর্বত্র আছে। গমরঙের চড়াই-উতরাই থেকে আকণ্ঠ শুষে নেওয়া আলোর সব স্বাদ আমার লেখায় অজস্রবার আসে। আসতেই থাকে। সেও তো একরকমের অপচয়! অক্ষরের নয়; অনুভূতির। কারণ, তারপরেও যেমন চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকে এই আদিগন্ত, তাকে অন্ধকার ছাড়া আর কোনো নামে ডাকা যায় না। তবুও আমার তো চিরকালই 'বেচারা দিল ক্যায়া করে, সাওন জলে, ভাদো জলে'!
ঋতুর কথা এল যখন বলি, নকল হেমন্তজাতকে ভরে গেছে পৃথিবী। মুখোশেরা সহজেই মানুষের রূপ ধরে থাকে তাই। মিথ্যার ব্যক্তিগত কুহক নিয়ে বেঁচে আছো ভ্রান্ত মানুষ! তবুও আমাদের যাবতীয় ছয়-নয় এবং নয়-ছয়ের দিব্যি, মুখোশদের ধারেকাছে তুমি যেয়ো না কোনোদিন।
সকালের আলগা পায়ের শব্দে ঘুম আসে, কিন্তু ঘোর ভেঙে যায়। এখানে শহর জেগে উঠছে। ভোরের প্রথম ডাউন ট্রেন ঢুকবে এখনই। মর্নিং-ওয়াকারদের সঙ্গে পা মেলাবো আজ? নোটবুকের এই পাতাটিকে মুড়ে রাখবো। দূর থেকে আশা ভোসলে আবার ভেসে আসবেন, 'আসবো আরেকদিন, আজ যাই'!