উপন্যাস
টানাপোড়েন১১৯
সব লাল পাথর চুনি হয় না
মমতা রায় চৌধুরী
স্কুলে সরস্বতী পুজো তাই ঘটা করে একটা মিটিং হয়ে গেল। ঘটা করে বলতে প্যানডেমিক সিচুয়েশনে যে রকমই হওয়া দরকার মেয়েদের ছাড়া মিটিং। এবার তো পুজো শিক্ষিকাদের। তাই সমস্ত দায়িত্ব শিক্ষিকাদের দেখে নিতে হবে আর কার কি দায় দায়িত্ব আছে সেই ব্যাপারটার জন্য বড়দি মিটিং সারলেন।
বিদ্যালয়ের দেয়াল পত্রিকা' স্বপ্ন উড়ান'বের হবে। প্রতিবছরই হয়ে থাকে এ বছরই বা বাদ যায় কেন? না বাদ দেবোই বা কেন? মানুষের ভেতরে অদম্য শক্তিকে তো আর প্রতিরোধ করা যায়
না ?তা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন ।বিশেষত এই প্যানডেমিক সিচুয়েশনে গৃহবন্দি জীবনের শিক্ষার্থীদের ভেতরের যে কষ্ট ,যন্ত্রণা তাদের মনের ক্যানভাসে উড়ান দিতে চায় ।নানা স্বপ্ন আঁকি-বুকি কাটে। তাই যখন তাদের কাছে তাদের 'স্বপ্ন উড়ান 'কে পৌঁছে দেয়া যায় ,তাদের অদম্য লেখনি শক্তি প্রকাশের জন্য ।তাহলে তো আর কিছু বলার অপেক্ষাই রাখে না। রেখার কাঁধে পড়েছে এই গুরুদায়িত্ব। তাছাড়া ঘর সাজানো এসবেও রয়েছে ওর নাম ।অন্যান্য টিচারদের সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে হবে। মূল দায়িত্ব তাকে সামলাতে হবে। হাসিমুখে মেনে নিয়েছে কারণ পত্রিকার কাজ করতে ভালই লাগে। অন্যান্য কাজগুলো অন্যান্য শিক্ষিকাদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। পূজার তো আর বেশি দেরি নেই।
গ্রুপে আগেই মেয়েদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল অভিভাবককে দিয়ে তাদের লেখা স্কুলে পাঠিয়ে দেবার জন্য। সে সমস্ত কিছু সংগ্রহ করে নিজের দায়িত্বে রেখেছে। সারাদিন নানা পরিশ্রম গেছে স্কুলে।
বাড়িতে ফিরে ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু মনের ভিতর একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস ঢেউ খেলে যাচ্ছিল সারাক্ষণ। আগামীকাল তো পিকনিক। তাই সব অবসাদ, ক্লান্তি ,ধুয়ে মুছে গেল। অনেকদিন পর রিম্পাদির সঙ্গে দেখা হবে।
ফ্রেশ হওয়ার আগে মিলি, তুলি, পাইলটদের চিৎকারে আগে ওদেরকে গিয়ে আচ্ছা করে আদর করে নিল। তারপর ফ্রেশ হতে গেল।
এরমধ্যে বাথরুম থেকে আওয়াজ পাচ্ছে রেখার ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ফোনের আর্তিতে তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
হাতে টাওয়াল ধরাই আছে। তখনো তখনো চুল থেকে জল ঝরছে ফোটা ফোটা। রেখার এটা বদভ্যাস সে যেখানেই যাক বাড়িতে ফিরে এসে সামনের দিকে কিছুটা চুল ফ্রেশ হতে গিয়ে ভেজা তেই হবে। তাই এক হাতে ফোনটা ধরে রিসিভ করে বলল '।
"হ্যালো'।
'কি রে কি করছিস?'
'এইতো বাথরুম থেকে বের হলাম বলো।'
"শোন না .কালকে পিকনিক হচ্ছে না।'
রেখা অত্যন্ত অবাক হয়ে গেল বললো '
'মানে ,মানেটা কি?'
'হ্যাঁ রে।'
তুমি আমার সাথে মজা করছো?
রেখা হাসতে হাসতে বলল নারে মজা নয় সত্যি বলছি বিশ্বাস কর। এই তিন সত্যি বলছি।
' সত্যি ,সত্যি ,সত্যি।'
রেখার অবসাদের মনে যেন হঠাৎ করেই মন খারাপ করা টোকা মেরে দিল।
ভেবেছিলো একটা গেটটুগেদার হবে ভেতরের যে ক্লান্তিগুলো আছে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একটু অক্সিজেন নেবে, হাসি মজা হবে।'
সেখানে রিম্পা দি তোকি বলছে এসব কেমন যেন একটা বেপথু হয়ে গেল।
কিরে কোন জগতে আছিস?
রেখা , এই রেখা।রেখা ,কথা বলছিস কেন?
'কি কথা বলব ?তুমি তো সবকিছুতে জল ঢেলে দিলে।'/
'রাগ করিস না দেখ কি করবো ।হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেল যে।'
কে গো?
ওই তো আমাদের পাশের বাড়ির যে দিদি বলছিলাম না স্কুল শিক্ষিকা।
ওমা,আচ্ছা ,আচ্ছা। কি হয়েছে?
ভালোই সিরিয়াস জানিস তো?
হার্টের প্রবলেম য় ধরা পড়েছে।'
'এ বাবা।'
'ঠিক আছে। কি আর করা যাবে ।এটা তো মেনে নিতেই হবে না ?ঠিকই করেছ।'
এবার রাগ কমলো তো?
না গো কথাটা শুনে খারাপ লাগছে। জানো তো রিম্পা দি।
'খুব চনমনে আর সব ব্যাপারেই এগিয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা আছে যখন আমাদের এই প্ল্যানিংয়ের কথা শুনল বলল
' আমাকে সঙ্গে নিও।'
'ঠিক আছে ভালো করে ডাক্তার দেখাচ্ছেন তো উনার সুস্থতা কামনা করছি।'
আর আজকে কি স্কুলে? কি হলো তোদের?
কি আবার হবে জানো তো সরস্বতী পুজোর আগে কি হয় তবে তোমাকে খুব মিস করছি। স্কুলে সবাই আমাদেরকে বলতো না সোলমেট।
আজকে একবার খোঁচা দিয়ে অনিন্দিতা বলল।
এটা আমার ভালই লেগেছে।
'কি হলো এবার পত্রিকার দায়িত্ব কার পরল?'
'তুমি কি ভাবছো বড়দি অন্য কাউকে দেবেন?
ও তাহলে তোর দায়িত্বে।'
খুব ভালো যে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছে আর কাঁধে দায়িত্ব খুব ভালো।
এই রিম্পা দি শোনো না ,এবারে এসো সরস্বতী পুজোতে।
ঠিক আছে দেখছি মেয়েকে নিয়ে যেতে পারি।
তবে মেয়ে যাবে কিনা কে জানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মত্ত থাকবে।
ওর কি দোষ বলো আমাদের সময়ে সরস্বতী পুজো মানেই আমাদের বসন্ত ছিল তাই না?
ভ্যালেন্টাইন্সডেতে মনে হতো ।ওই সময়েই সবাই ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করে নিত '।
'ঠিক বলেছিস। এই পুজোর সময় গুলিতে দেখা যেত প্রেমিক-প্রেমিকারা দেখা করতো। কি সাগরিকা কি ছটফটানি ছিল ওর মনের ভেতরে তমালের জন্য বাপরে বাপ একপলক
দেখবে ।পুজোতে মিস নেই ।পুজোর সময় বেরোবে, একটু বসে গল্প করা আর পাশাপাশি থাকা ।এখন তো তা নয়।'
'একদমই তাই ।'
আসলে এখন দিনকাল পাল্টেছে ডিজিটাল যুগ এখানে তো সবকিছুই অন্যরকম।
আমাদের সময় টা বেশি ভালো ছিল। সময় গুলো অনেক বেশি উপভোগ করা যেতো।
মনে আছে রিম্পা দি বলেছিলাম না আমার কলেজে তনিমা ও পাগল ছিল কুণালের জন্য। একবার তো কলেজের একটা রুমে প্রায় ওদের দুজনকে দেখা যেত ।ওই যেন ওই ঘরটা নাম দেয়া হয়েছিল সোলমেট রুম।'
', হ্যাঁ, হ্যাঁ বলেছিলি।'
'আর ওর সাথে ওর বিয়ে হয়নি।'
'প্যাথেটিক জানো তো।
মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল একটা বড়লোক ছেলের সঙ্গে।'
কুনাল ওর জন্য পাগল ছিল। প্রথম দিকে তো কুণালকে পাগল-পাগল লাগতো। পরে শুনেছিলাম ওকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হয়েছিল।
তনিমার জন্য তো কুণালের ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়ে গেল।'
"হ্যাঁ রে বাড়ির লোক মেনে নেয়নি বলেছিলি।'
যাইহোক ছাড়ো তো এসব কথা।
'ছাড়বো কিরে আজীবনের বিষাদ, বেদনা যে ওদের ভেতরে দাগ কেটে গেল ।এটা ভেবে ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে।'
কেন খারাপ লাগবে না বল ?যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখা ,এত ভালোবাসা সুখচরের মনভূমিতে যে বীজ বপন করে গেছে অথচ অঙ্কুর বের হয়ে পল্লব পুষ্পরাজিতে ভরে উঠলো না। কেমন খারাপ লাগে ।অথচ তনিমাকে তো সেই অন্য একটি ছেলের পাশে নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছিল বলো?ভাবো সেই রাতের কথা ।সেদিন ওর কেমন লেগেছিল ।একবারও কি ওর মনের ভেতরে কুনাল দাগ কেটে যায় নি ,যখন ওর স্বামী ওকে স্পর্শ করেছিল ,সেই স্পর্শের ভেতরে কি সুখানুভূতি ছিল, নাকি শুধুই একটা শারীরিক উত্তেজনা কাজ করে গেছে? ভাবতে খুব খারাপ লাগে।'
'কি হয়েছে বল তো তোর ?এই সব কথাগুলো বলছিস।'
'আমার মনের ভেতরে ভীষণ ভাবে দাগ কেটে যায়।'
ওই জন্য তো প্রেমটাও ঠিক করে করতে পারলি না ।প্রেম আসলেও তাকে ধরে রাখতে পারিস না।'
'কি করবো বলো?'
তবে তনিমার বর শুনে ছিলাম বড়লোক বাড়ির ছেলে হলে যে রকম হয় ।আজকালকার ছেলেদের ভেতরে যেমন স্বাস্থ্যসচেতনতাএসেছে। তনিমার বরের কিন্তু সে রকম ছিল না। শুনেছি তো মেদবহুল ,গোবর গণেশ একটা।'
তনিমার মত একটা স্মার্ট মেয়ে কি করে ওর সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে বলো?'
'এসব ভাবলে খারাপই লাগে।'
'একবার তনিমার সঙ্গে আমার দেখা
হয়েছিল ।ওকে দেখছি চারচাকা থেকে
নামছে ।সারা গায়ে গয়নায় ভর্তি কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বড় বাড়িতে বিয়ে হয়ে যে উচ্ছ্বাস থাকার দরকার, তা ওর চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেখি নি।
'ও আমাকে দেখে একটু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। যেমন করে খোলসে শামুক নিজেকে ঢুকিয়ে রাখে।আমার ওকে দেখে কি মনে হয়েছিল জানো? মনে হয়েছিল নদী পরিত্যক্ত খাদ বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে গেলে ফের নদীতে মিশতে চাইলে তাকে কি করতে হয় সে ভেবেই পায় নি।
অথচ যখন ওরা দেরাদুনে গেছিল এক্সকারশনে সেখান থেকে ফিরে এসে তনিমাকে দেখতে মনে হয়েছিলো যেন একটা সুগন্ধ তার ফুসফুস থেকে হৃদয় হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
একটা আলাদা লাবণ্য যেন 'ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল। কি সুন্দর ই না লাগছিল।
বিয়ের পর এত গয়নাগাটিতেও ওর লাবণ্য ঝরে পড়তে দেখা যায়নি।'
'আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল কেমন আছিস?
আমি বলেছিলাম ভালো আছি।'
তুই কেমন আছিস?'
'ও বলছিল 'যেমন দেখছিস'।
তারপর মাথা নিচু করে চলে গেল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল শুধু।
রিম্পা দি বলল' সব ভালোবাসা তো আর পরিণতি পায় না।'
"ঠিকই বলেছ।'
'সব লাল পাথরই তো আর চুনি হয় না।
ছেলেটার কি পরিণতি হয়েছিল?'
কেমন ক্ষ্যাপা মত হয়ে গেছিল ।
বললাম তো তোমাকে আগে সাইকো প্রবলেম দেখা দিয়েছিল অথচ পড়াশোনায় কি তুখোর ছিল। ও যেন কক্ষচ্যুত হয়ে গেছিল পুরো।
মাঝে মাঝে নাকি শুধু একটা কথাই বলতো
'সেই দেরাদুন।'
একটা মোলায়েম দুঃখ আর হতাশা যেন তাকে ঢেকে ফেলে দিয়েছিল ।তাই বলতোসেই ঠিকানায় পৌঁছাতে আর পারা গেল না।'
'ঠিক আছে। কি আর করবি বল,? ওর জন্য নিশ্চয়ই অন্য কোন তনিমা টইটম্বুর মেঘ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ওর ই মতো কোন মেঘদূতের জন্য।'
' আদপে সেই মেঘদুত ,মেঘের কাছে গেছিল কিনা কে জানে?'
এসব কথাবার্তার মধ্যেই বেশ কয়েকটা মিসকল হয়ে গেল।
রেখা বললো' ঠিক আছে রাখ ।আমাকে কেউ ফোন করছে।'
'ঠিক আছে রাখ। ভালো থাকিস। আচ্ছা শোন শোন ডাক্তার দেখিয়েছিস?'
'না গো সময় পাইনি।'
'আমি এদিকে তাহলে যোগাযোগ করব ডাক্তারের সঙ্গে?'
'ধেত তেরি, মরার সময় নেই ।ডাক্তার দেখাতে যাবে? সে দেখা যাবে বাড়াবাড়ি হলে ,তখন বলব।'
'শরীর নিয়ে অবহেলা করিস না।'
'না গো ,তুমি এত চিন্তা ক"রো না। ভালো থেকো।'