৩০ ডিসেম্বর ২০২১




অলীক সমীকরণ
সুমী শারমীন

অদ্ভুত এক রঙের মানুষ কাঁদায় বারো মাস
পৌষ ফাগুনী খেলায় মাতে,আমার দীর্ঘস্বাস।

কাছে থেকেও ডাকে না সে , করে অবহেলা
অভিমানের কষ্ট পুষে,হারাই আমার খেলা।

হারতে চাইনা,ছাড়তে চাইনা,নিত্য দিনের মতো
বন্দী পাখির ঝাপটানো ডানা,অন্ধকারের মতো।
 
বুঝবে না জানি,শুধু হয়রানি, তবু্ও আকাশ কাঁদে
ব্যাথার কষ্ট, সুখের আশায়,নিত্যদিনের ফাঁদে।

পারিনা এড়াতে,ছেড়ে যেতে চাই,চেনা পথ ঘাট সব
মনের মাঝেতে বসবাস করে,তারই সব কলরব।
 
হাত রাখতেই সব ভুলে যাই,সেই তো রঙের মানুষ 
সারাটি জীবন কাঁদি তার তরে,উড়াই রঙিন ফানুষ।

মমতা রায়চৌধুরী/ ৮১




উপন্যাস 


টানাপোড়েন ৮১
অনুভূতির উপলব্ধি
মমতা রায়চৌধুরী



সারাটা  শীতের দুপুর   মনে এক অসহ্য যন্ত্রণা ;হ,কষ্ট ।কাকে বলবে রেখা?
মনোজকে বলার মতো নয়। কেন যে নয়, সেটাও বুঝতে পারছে না রেখা।
 কাকিমা (মীনাক্ষী দেবী) যখন বললেন 'রূপসার কথা মানে বিপাশার দিদির কথা ।তখন থেকে শুনেই রেখা ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে। কত কষ্ট করে হারু জেঠু দুই সন্তানকে মানুষ করেছেন ।সে তো চোখের সামনেই সবাই দেখেছে। এত অভাব এর মধ্যেও মেয়ে দুটিকে কখনো কষ্ট দেন নি। যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী মেয়েদের যথাযোগ্য পড়াশোনা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছেন। সুপাত্রস্থ ও করেছেন। রূপসার বর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। অথচ তাকেই ভগবান পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলেন।
বিপাশা যতটা কোয়ালিটি সম্পন্ন মেয়ে ছিল বিয়েটা ঠিক তেমন হয় নি ।হয়তো বর ভালো একটা চাকরি করতো এইটাই। মানুষ হিসেবে ভালো নয়। ওর বর‌ও তো প্রতারণার কেসে জেল হাজতে।রেখা কাকিমার কাছ থেকে ঘটনাটি শোনার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ যদি ছেড়ে চলে যায় ,কেমন হতে পারে সে উপলব্ধি ?রেখা ভাবতে পারে না ।ভয়ে আতঙ্কে রূপসাদির ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সব যেন ভিড় করতে থাকে রেখার চোখেমুখে।
মনে পড়ে বিপাশাকে ভালোবাসতো রেখাদের পাড়ারই একটি ছেলে। বিপাশা বুঝতে পেরেও সেই ডাকে সাড়া দিতে পারে নি।
ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। হয়তো এখন কোন এক সন্ধ্যা বেলায় বা গোধূলিলগ্নে বিপাশা ভাবতে থাকে সেই মুহূর্তের কথা ।
আজ ঘুরে ফিরে অলস শীতের দুপুরে মনে পড়ছে কত কথা। একবার একদিন শীতের সময় ঘোষেদের চাষের জমি পাশেই ,সেখানে দল বেঁধে যেত ছোলা শাক, মটরশুটি আর ধনেপাতা তুলতে ।তার জন্য অবশ্য ঘোষ জেঠু তাড়াও দিয়েছেন কিছুদিন ।
তারপর একদিন ঘোষ জেঠু বললেন 'না  হয় খাবি তো দুটো ধনেপাতা নিয়ে যা না ।'
হেসে আরো বলতেন 'কিন্তু বদলে  কুলমাখা আমাকে দিতে হবে ,মনে রাখিস।'
সেদিনের এক বিকেল বেলায় হঠাৎ বিজয়দা পাকড়াও করে বিপাশাকে একেবারে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে এসে সাইকেল নিয়ে দাঁড়াল পথ আটকে।' যদিও বিপাশার দৃপ্ত ভঙ্গিতে আরষ্ট হয়ে যায় বিজয়দা কি কথা বলতে আসলো ?সব কোথায় যেন আটকে গেল ।
বিজয়দা শেষে বললো' অনেকগুলো কুল আছে নিবি তোরা?'
আমরা কুল নেব কি নেব না ,সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই, সব ঢেলে দিয়ে পালিয়ে গেল ।
কিন্তু রেখার স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের সেই বিজয়দার চাহনিতে ছিল আলাদা একটা মাদকতা ,ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি ,উপলব্ধি।
এভাবে কেটে গেছে কত সুন্দর সোনালী মুহূর্ত ।রুপসাদির তো  তুলনা নেই ।যা কিছু আমাদের ভালোলাগা ,খেতে চাওয়া,আবদার সব রূপসদি তার দাবি মেটাত।তাই ভাবতে পারা যাচ্ছে না রুপসাদির জীবনের এই ঘটনা ।মনের দিক থেকেও যতটা ভালো মানুষ ছিল ,তেমনি আন্তরিকতা সম্পন্ন ।না ছিল কোন অহংবোধ ।হারুদার বাড়িতে নতুন কোন কিছু রান্না হলেই এনে হাজির করত। 
রুপসাদি হেসে বলতো 'তোরা একটু টেস্ট করে দেখ।' 'আমরা জানতাম হারুদার বাড়িতে কতটা অভাব কিন্তু ওই সামান্য জিনিসের ভেতরেও যেন কত ভালোবাসার মিশ্রণ ছিল ।'
হারু কাকাও বলতেন হেসে'  প্রাণ চায় অনেক অনেক তোদেরকে খাওয়াতে কিন্তু আমি পারি না। যেটুকু আছে আয় সবাই মিলে ভাগে ভাগ করে খা ।তোরাও তো আমার মেয়ের ই  মতো।'
উফ অসাধারণ চাটনি করত রূপসাদি ক্যাপসিকামের।
সেই ক্যাপসিকামের চাটনি আমি রুপসাদির কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে আজকাল বাড়িতে বানাই ।ক্যাপসিকামের চাটনির সেই স্বাদ রূপসাদির মত আসে না। কিন্তু তবুও এর মধ্যে যেন ফিরে পাওয়া যায় সেই কৈশোরবেলার দিনগুলির মিষ্টি মধুর স্মৃতি। 
রেখা ভাবে 'এখন যে আমরা অন্য শ্রাবণের জলে ভিজি ।অন্যভুবনে এখন আমাদের বসবাস।'
হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে' একা একা এই বেশ থাকা আলো নেই কোথাও ।সব মেঘে ঢাকা...।'
হঠাৎই  ভাবনায় দোলা লাগে...।'
মনোজ এসে বলে কি গো তোমার ফোন বাজছে তুমি আজ কোন ভাবনায়?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ফোন বাজছে।'
মনোজ বলল 'কার ফোন দেখো । কাকিমার ফোন আসার পর থেকেই তোমার কেমন যেন মুড অফ হয়ে গেল।'
রেখা বলল' হ্যাঁ দেখছি‌'।
মনোজ বলল 'কে ফোন করেছিল?'
রেখা বলল'পত্রিকার সম্পাদক।'
মনোজ বলল 'এ বাবা তোমার লেখার কতদূর কি হলো?''
রেখা বলল'এরমধ্যে পত্রিকার সম্পাদক তাড়া দিয়েছেন লেখা পাঠানোর জন্য।'
মনোজ বলল 'সে তো ঠিকই'। তুমি পাঠিয়ে দাও।'
রেখা বলল' হ্যাঁ কবিতা  ক'টা পাঠাবো।'
মনোজ বলল' আর নতুন করে আরও লেখ।'
রেখা বলল'এতটা ঘেটে আছি না?
কোন কথাই মাথায় আসছে না ।'
মনোজ বললো 'দেখো জীবনে এই দুঃখ ,কষ্ট ,যন্ত্রণা চিরস্থায়ী হয় না ।ওই নিয়ে বেশী নিজেকে হারিয়ে ফেলো না।'
রেখা বলল 'সারাক্ষণ কেমন একটা বিষন্নতা গ্রাস করে আছে মনেপ্রাণে ।কেন কি জন্য তার কৈফিয়ত দিতে পারব না।'
 মনোজ এসে ব্যালকনিতে রেখাকে  দুই 'হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তোলে । আর বলে 'নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না। হারানো স্বপন চোখে এঁকো না ।'
রেখার উদাসী বাউল  মনটা  কোন সাত সমুদ্র পেরিয়ে অজানা দেশে হারিয়ে যেতে চাইছে ।সেই মনের হদিশ কি পাবে?'
মনোজ  বলল 'কি ব্যাপার গো? তুমি  এখানে এসে বসে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ, কি হয়েছে তোমার?""
রেখা বলল' অন্য কেউ ছিলো ভাবনায়?'
মনোজ বললো 'হ্যাঁ।'
রেখা বললো  'হ্যাঁ, সত্যি। 
মনোজ বলল 'তাই তো ভাবছি।'
রেখা বললো তু'মি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না?:
মনোজ বলল 'এতদিন তো ,তাই জানতাম।'
রেখা বললো 'দেখো প্রত্যেকেরই কিছু কিছু একান্ত মুহুর্ত থাকে ।নিজস্ব উপলব্ধি অনুভূতি থাকে।'
মনোজ বলল' হ্যাঁ সেটা ঠিক।'
রেখা বলল 'মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেতে হয় ।আত্মসমালোচনায় ডুবে যেতে হয় ।নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়।'
মনোজ বললো 'কিন্তু আজকাল তোমার ভেতরে একটু বেশিই টানাপোড়েন হচ্ছে, আর তুমি আজকে কি রিংটোন লাগিয়েছ। গানটা তুমি চেঞ্জ করো।'
রেখা বলল' তোমাকে আগেই বললাম মনের একান্ত অনুভূতি উপলব্ধিতে আছে।'
মনোজ বলল 'কোথায় শীতের অলস দুপুরে দুজনে কাছাকাছি বসবো, ভালো ভালো কথা বলব ।মিঠে রোদ্দুর গায়ে মাখবো তা নয়?'
রেখা শুধু ম্লান হেসে মনোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শান্তা কামালী/৫৩ তম পর্ব




বনফুল 
(৫৩ তম পর্ব ) 
শান্তা কামালী

অহনা অনেক্ক্ষণ চিন্তায় বিভোর ছিলো, অহনা ও একটু বেশি সময় দিতে পারতো, কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরিক্ষার জন্য পারেনি। সৈকতের মাস্টার্স শেষ পরিক্ষার আগের দিন আন্টির এই অবস্থা... আল্লাহ পাকই ভালো জানেন সৈকতের পরিক্ষা কেমন হলো?
তিন সপ্তাহে'র মধ্যেই রেজাল্ট বেরোবে। 

পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলেন অলিউর রহমান। যাওয়ার আগে স্ত্রী রাহেলা খাতুনের মাথায়  হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন কাপড় কেনাকাটার জন্য যাচ্ছি। রাহেলা খাতুন স্বামীকে হতে দিয়ে ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করলেন যেন সবকিছু ভালো দেখে নেন... । 
অলিউর রহমানও সম্মতি জানালেন। অলিউর রহমান বড় একটা শাড়ির দোকানে ঢুকে লেহেঙ্গা পছন্দ করলেন যার দাম প্রায় পয়তাল্লিশ হাজার টাকা,দ্বিতীয় শাড়ি বার হাজার টাকায়......। 
সবকিছু এভাবেই মিলিয়ে মিশিয়ে  কিনেছেন। 
কেনা কাটা শেষ করে, সৈকতের বড়ো মামার বাসায় গিয়ে বললেন বৃহস্পতিবার সকালে যেন উনি উপস্থিত থাকেন। সৈকতের মা'য়ের ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে, সঙ্গে করে সৈকতের বড়ো মামানিকে নিয়ে আসার কথা বললেন অলিউর রহমান  সাহেব।তার কারণ খালি বাসায় তো সৈকতের আম্মুকে রেখে যাওয়া যাবে না। বউ বরন করার জন্য ও তো একজন মহিলা দরকার। ছোট শালা আর নিজের দুই ভাইকে ফোনেই সব বুঝিয়ে বলেছেন, যেন বৃহস্পতিবার দিন সকালে সবাই উপস্থিত থাকেন।


চলবে...

রাবেয়া পারভীন/





দুরের বাঁশি 
(৪র্থ পর্ব)  
রাবেয়া পারভীন



-ম্যাম বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? 
 সিস্টারের ডাকে  সম্বিৎ ফিরে  আসে লাবন্যর। শুভর ভাবনায় একদম ডুবে গিয়েছিল সে,  কখন যে ভোরের উদীয়মান সূর্যটা  ডুবে গিয়ে আকাশ মেঘলা হয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে  শুরু করেছে টেরই পায়নি। সিস্টারের দিকে তাকিয়ে  অপরাধীর মত একটু হাসে লাবন্য।
তারাতারি  বারান্দা  থেকে  সড়ে এসে কেবিনে ঢুকল। সিস্টার  তোয়ালে দিয়ে ওর চুল মুছে দিতে দিতে বলল
-মেডাম আপনার কিন্তু ঠান্ডার অসুখ । যান ভিজা জামাটা বদলে আসুন  ওষুধ  খেতে হবে। সকালের নাস্তাও তো পড়ে রয়েছে দেখছি।
লজ্জা পেয়ে  লাবন্য  ওয়াশরুমে গেল । কাপড় বদলে এসে  বিছানায় বসল। সিস্টার নাস্তার প্লেট এগিয়ে দিল  তারপর  ঔষধ। মিষ্টি করে হেসে বলল 
-  আপনাকে আজকে অনেক ফ্রেস লাগছে  মেডাম,  একদম ভালো হয়ে গেছেন। ডাক্তার সাহেব  এলে হয়ত আজকে রিলিজ করে দিবে আপনাকে।
নার্স মেয়েটাকে  বেশ ভালো লেগেছে লাবন্যর। ওর সাথে আলাপ করতে ভালো লাগছিলো। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন  করল
 - আচ্ছা সিস্টার  আপনার নাম  কি ?  
- আমার নাম  গায়ত্রী। 
নামটা শুনে  লাবন্য চকিতে একবার মেয়েটির সিঁথির দিকে তাকালো।   সেখানে সিঁদুরের। কোন চিন্হ নেই। মেয়েটির বয়সও কম মনে হচ্ছেনা।  তবে কি বিধবা?   কৌতুহল চেপে রাখতে পারলোনা সে। জিজ্ঞেস করলো  
- সিস্টার। আপনি  এখনো বিয়ে  করেন  নি ?  
মৃদু হেসে  সিস্টার বলল
- না মেডাম। এখনো করিনি।
- কিছু না মনে করলে জানতে পারি কেন।?  
- সে অনেক কথা।
- একটু বলুন না প্লিজ !
সিস্টার হেসে বলল
- আসলে  একজন কে আমি ভালোবাসি । ছোটবেলা থেকেই প্রেম। সে  আমার পিসির  দেবরের  ছেলে।
- তো  আপনাকে উনি ভালোবাসেনা ?  
- হ্যাঁ হ্যাঁ  বাসে তো। বল্লাম না  ছেলেবেলার প্রেম  
- তাহলে  বিয়ে করছেন না কেন ?
- ও তো কলকাতায় থাকে।  আগে ঢাকায় থাকতো আট বছর আগে পিসিরা কলকাতায় চলে গেছে।  তারপর ওখানে যাওয়ার পর  অসিমের মা মারা গেছেন। সংসার চলছিল না তাই  অসিম বিয়ে করে কলকাতারই মেয়ে। এটুকু বলে মাথা নীচুকরে নিজের চোখের জল লুকাতে চেষ্টা করল  গায়ত্রী ।  এপ্রোনের পকেট থেকে  টিস্যু পেপার নিয়ে নিজের চোখ মুছল। তারপর। ক্রস্ত হয়ে বলল
- মেডাম। দশটা বেজে গেছে এখনি ডাক্তার  চলে আসবেন। আমি গেলাম। 
এগিয়ে যচ্ছিলো গায়ত্রী , খপ করে  ওর  ডান হাতটা চেপে ধরল  লাবন্য , ততক্ষনে  ওর চোখও চিক চিক করছিলো। বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল
 - সরি সিস্টার !  আমি বুঝতে পারিনি। মাফ করবেন।
একটু হাসতে চেষ্টা করল  গায়ত্রী।
- আরে না,  কিযে বলেন  মেডাম।
সিস্টার বেরিয়ে যাবার পরে  কেন  যেন শব্দ  করে কেঁদে ফেলল লাবন্য ।  ওর কানে বাজতে লাগলো  "সেতো কলকাতায় থাকে "। অসীম নামের ছেলেটি কলকাতায় গিয়ে ভুলে গিয়েছে  গায়ত্রী কে  আর গায়ত্রী  এখানে মনপ্রান  ঢেলে দিয়েছে  রুগ্ন মানুষের সেবায়। কিন্তু ভালোবাসার  প্রদ্বীপটি  ঠিক জ্বালিয়ে রেখেছে বুকের ভিতরে। আপন মনে  নিজেকেই শুধায় লাবন্য  শুভও  কি দুরে কোথাও গেলে তাঁকে ভুলে যাবে?  প্লিজ শুভ কখনো এমন কোরোনা  তাহলে ঠিক মরে যাবো আমি। ঠিক তখনি কেবিনের দরোজায়  টোকা পড়ে
- ভেতরে  আসবো ?


চলবে....

আইরিন মনীষা 





প্রতীক্ষার প্রহর


খুব করে জানতে চাই 
কেমন আছো তুমি,
সেই এক বিকেলে আসি বলে চলে গেলে
হয়নি দেখা আর তোমার সাথে কিংবা কথাও হয়নি। 

বকুল ফুলের মালা গুলো শুকিয়ে গেছে
যেন তোমারই অপেক্ষার প্রহর গুনছে এখনো, 
কতদিন দেখিনি তোমার ডাগর কালো চোখের চাহনি
যেখানে আমি হারিয়ে যেতাম এক অথৈ সমুদ্রে। 

কতদিন হাঁটা হয়নি নদীর তীরে হাত ধরাধিরি করে
দেখা হয়নি শরতের বিকেলের কাঁশফুলের সৌন্দর্য, 
কতদিন যাইনি সমুদ্রের প্রশস্ত বালুকা রাশিতে
দেখিনি ভিজিয়ে নগ্ন পদ যুগল সাগরের নোনা জলে। 

বড় সাধ জাগে আবার ও সেই বৈশাখী মেলা দেখতে
বিরহী প্রহরে আজ মনটা বড়ই উতলা হয়ে আছে, 
সময় যে আর কাটে না একাকী আমার
কবে পাবো তোমার দেখা আবার। 

মনে পড়ে খুব সেদিনের কথা
যখন তুমি আমার দীঘল কালো চুলে সাঁতার কাটতে,
আমার খুব করে পেতে চাই সেই মধুময় ক্ষণ
যখন তুমি আমার পাশে বসে হারানো দিনের গান গাইতে।

আমার বিরহী প্রহরে তুমিই একমাত্র সঙ্গী
যার সাথে বেলা অবেলায় কেটে যায় আমার ক্ষণ,
মিলনের দিগন্তে ভাসবো বলে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি
শুনছ কি তুমি আমার অব্যক্ত কথা গুলো ? 

এসো না আবার দুজন হারিয়ে যাই
সেদিনের কাছে যখন শুধু আমি আর তুমি
একান্ত সান্নিধ্যে না বলা কথার ফুলঝুড়িতে 
খুঁজে পেতাম স্বর্গের আছে যত সুখ। 

এখনো বাতাসে কান পেতে থাকি
তোমার আসার মাহেন্দ্রক্ষণ এর প্রতীক্ষায়,
রাত জেগে বিচরণ করি আমার স্বপ্নিল ভুবনে
যেখানে তুমিই আরাধ্য আমার স্বপ্নের সেই রাজকুমার। 

আমার করি ডোরে থাকা কাকাতুয়া ও আছে 
তোমার পথ পানে চেয়ে, 
তোমার নাম ধরে সে বেশ ডাকে 
আর আমাকে শুধায় তোমার গুনগান। 

আমার বাগানের ফুল গুলো ও প্রহর গুনছে
এই বুঝি তুনি এসে কাননে পদ ধুলি দিলে,
কাননের কুসুম কলি ও যেন নতুন ভোরের প্রতীক্ষায়
তোমার আগমনি বার্তা পেয়ে ফুটবে বলে। 

কাটে না সময় লাগে না ভালো 
তোমার বিহনে কি করে সময় কাটে আমার বলো ?
আর কত কাল অপেক্ষার প্রহর গুনলে 
তুমি আমার মন কাননে প্রস্ফুটিত হবে একান্তে ?

শামীমা আহমেদ /পর্ব ৪৪



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ৪৪)
শামীমা আহমেদ 


শিহাব আজ অন্য এক শিহাব রূপে নিজেকে তৈরী করে নিচ্ছে।বিগত জীবনের পটভূমি বদলে নেবার মাহেন্দ্রক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আর পিছুটানে নিজেকে ফেরাবে না স্মৃতিকাতরতায় আবেশিত হয়ে।আজ, এইতো আর কিছুটা  সময় পরই শায়লার সাথে তার দেখা হবে,ভিন্ন ভাবনায়,ভিন্ন আঙ্গিকে, একই পথ রেখায় চলবার অঙ্গীকারে হবে অনেক কথা বিনিময়  হৃদয়ে  ভালবাসা সঞ্চিত রেখে, 
অপ্রাপ্তির তালিকাটিকে ক্ষুদ্র করে দিতে।

যদিও এর আগেও কয়েকবার তাদের দেখা হয়েছে কিন্তু আজকের দেখা হওয়াটায় অন্য এক ধরনের ভাললাগা,অন্য একটি জীবনের শুরুতে নিজেদের এক হওয়া। একটি সুদূরের বোঝাপড়ায় আগামীর স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেয়ার আলাপচারিতা। আজ তাই শিহাব এ প্রসঙ্গ ছাড়া  আর কোন কিছুই ভাবনায় আনতে চাইছে না। সে চট করে লাঞ্চ সেরে সব গুছিয়ে নিলো।আজ লেইট লাঞ্চ হলো।শিহাব সকালে গুলশান মেনজ স্যালুনে গিয়েছিল।একটু নিজেকে তৈরি করে নিতে আর কিছু টুকটাক শপিং করার প্রয়োজনে। 
শিহাব আয়নায় নিজেকে দেখছে। আজকের নতুন কেনা শার্টের সাথে প্যান্ট ম্যাচ করিয়ে নিচ্ছে।আজ হলুদাভ ঘি রঙা একটা শার্ট কেনা হয়েছে। শিহাব তাই কফি ব্রাউন একটা প্যান্ট ম্যাচ করিয়ে নিলো। চুলগুলো নিত্যদিনের সজ্জাতেই থাকবে বলে মনস্থির করে নিলো।ঘড়িতে তাকিয়ে সে ঝটপট তৈরি হয়ে গেলো।চকচকে ব্রাউন কালার সু'পেয়ার পায়ে গলিয়ে, ব্রাউন শেডেড রোদচশমাটা পকেটে পুরে নিলো।একরাশ  সুগন্ধি ঢেলে শিহাব বেরিয়ে পড়লো।এখনো প্রায় অনেকটা সময় বাকী শায়লার আসবার। তবুও,, ঐ যে অপেক্ষায় থাকার আনন্দটা নিতে তাই সে দ্রুত ছুটছে!খুব মনে পড়ছে সেই উঠতি বয়সে তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় নিজেকে রোমিও করে তোলার দিনগুলির কথা! হায়,কি এক পাগল করা সময়ইনা গেছে তখন! শিহাব যেন সেই সময়টাতেই ফিরে গেছে আজ!
এমন অসময়ে ভর দুপুরে স্যার এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছে,এ ভাবনায় কেয়ারটেকার বেলালের চোখ কপালে উঠেছে! সে  গ্যারাজ খুলে দিয়ে ঠাটা পড়া মানুষের মত দাঁড়িয়ে রইল।
দ্রুতই বাইক নিয়ে শিহাব পার্কের গেটে চলে এলো।পার্কের ঢোকার মুখে একটা বড় গাছের নীচে ছায়াতে বাইক থামিয়ে দাঁড়ালো। পার্কটিকে এখন আর চেনাই যায় না।ভেতরের আগের নকশা ভেঙে আবার নতুন করে গড়া হয়েছে।অনেক গাছপালার সাথে  নানান ধরনের নান্দনিক সজ্জাও দেয়া হয়েছে। এখনো প্রায় দুপুরই বলা চলে।পার্কের দর্শনার্থীর সমাগম হয়নি একেবারে।শুধু গুটিকয়েক স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে জুটি বেঁধে আড়াল হয়ে বসে আছে।শিহাব ভাবলো আসলেই, এই বয়সের প্রেমটা এমনি হয়।যেমন প্রচন্ড আবেগ, তেমনি ধরা পড়ার ভয়!
আজ সে নিজেও  কিছুক্ষন পর এমনি একটি জুটিতে বাঁধতে যাচ্ছে।যেখানে দুজনার চোখে মুখে ভাবনায় থাকবে আগামীর স্বপ্ন।
শিহাব হাতে মোবাইল নিয়ে শায়লাকে কল দিলো।শায়লা এক রিংয়েই কলটা রিসিভ করলো! বুঝাই গেলো কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল এই কলটি।শিহাব হেসে ফেললো শায়লার ছেলেমানুষী দেখে। 
শায়লা তুমি কি তৈরি? 
এখনই চলে এসেছো? আমারতো আরেকটু সময় লাগবে।
কোন সমস্যা নেই।সময় নাও।আমি অপেক্ষা করছি। শায়লা কেবল শাড়ি পরে চোখে আইলাইনারের টানটা দিয়েছে।শায়লার হাত কাঁপছিল। নীল শাড়িটা আজ দিনের আলোয় খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে।শায়লা কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ পরে নিলো।মেরুন রঙের লিপস্টিকে ঠোঁট দুটো রাঙিয়ে নিলো।শায়লার মন আজ যেন বাঁধাহীন। কোন কিছুই তাকে বাঁধছে না। খুবই রিল্যাক্স মুডে সে। যদিও সে আজ জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। শায়লা সামান্য উচ্চতার একজোড়া কালো জুতা পায়ে পরে নিলো। ড্রেসিং টেবিলে রাখা সুগন্ধি মেখে হাত ব্যাগটি হাতে নিয়ে আয়নায় নিজেকে  দেখে দুবার হাঁটার প্র‍্যাকটিস করে নিলো। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে! আজ অনেকদিন পর শায়লা এভাবে কারো জন্য  সাজলো। কেউ তার জন্য সত্যিকার তেমনিভাবে অপেক্ষায় আছে।
বাসা লক করে শায়লা নিচে নেমে এলো।বাইরে বেশ রোদ।কি আর করা শিহাব যেভাবে চেয়েছে।শিহাবের প্রতি বরাবরই তার এরকম নির্ভরতা।
শিহাব বাইকে বসে অপেক্ষায়  থেকে শায়লার এফবি প্রোফাইলে ঘুরাঘুরি চলছে।সেই প্রথম দিনের পরিচয়ের কথা মনে পড়ছে।মাঝে চলে গেছে অনেকগুলো দিন মাস সময়। কতনা অনুভুতি আবেগ উৎকন্ঠার দিনাতিপাত।সব শেষ করে দিতে চেয়েও আবার সেখান থেকেই নতুন করে শুরু করা।শিহাব তাই ভাবছে  নিয়তি কোথা থেকে কোথা টেনে নেয়! পথে উৎসুক মানুষজন এমন হ্যান্ডসাম লুকের একজনকে দেখে একবার হলেও উঁকি দিচ্ছে।এদিকটায় প্রায়ই নাটকের স্যুটিং হয়।শিহাবকে আবার নাটকের পাত্রপাত্রীই ভাবছে কিনা! অবশ্য ভুল কেন,বাস্তবে লুকটাতো তেমনি! শিহাব সানগ্লাস চোখে সবই খেয়াল করছে।একটা রিকশায় দুইটি টিনএজার মেয়ে বেশ খোলামেলা অভিব্যক্তিতে শিহাবকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিলো! শিহাব একেবারে চমকে গেলো! হায় ওরা কি বুঝে যে বয়সে আমি ওদের গণ্ডিতে পড়ি না। আজকাল এরা বেশ সাহসী।অনুভুতি প্রকাশ ভীষণ স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। 
দুইজন গৃহিণী শিহাবের দিকে তাকিয়ে থেকে তা প্রায় আরেকটু হলে গাড়ির সামনেই পড়তে যাচ্ছিল। উচ্চ হর্ণের শব্দে এ যাত্রা বেঁচে গেলো! শিহাব হাসবে না দুঃখ প্রকাশ করবে বুঝতে না পেরে মুখকে পাথর বানিয়ে রাখল।
দূর থেকে  রিকশায় নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে।শিহাব এবার সতর্ক হলো। এবার আবার  না জানি কোন অভিজ্ঞতা হয়! আসলে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটায় সত্যিই একটু অস্বস্তি লাগছে।নীল শাড়ির রিকশা তার খুব কাছে চলে এসেছে।শিহাব এবার ভাল করে তাকালো।রিকশায় শায়লা বসে আছে।সাগর নীলা শাড়িটিতে যেন নীলাকাশের ছায়া! শায়লাকে অপূর্ব লাগছে! প্রতিবার দেখা হওয়ায় শায়লা কোন না কোনভাবে চিন্তিত থাকতো কিন্তু আজ চোখে মুখে যেন আনন্দ ঠিকরে পড়ছে! 
কি হলো চিনতে পারোনি?
শায়লার প্রশ্নে শিহাবের পলক পড়লো।
রিকশার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,সত্যিই  তোমাকে আমি চিনতে পারিনি।তোমাকে  অপূর্ব লাগছে! আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি!
বেচারে রিকশাওয়ালা এদের প্রেমালাপের মধ্য কাবাব মে হাড্ডি হয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।আরে,,ভাড়াডা চুকাইয়া দিলেই তো সে পালাইতে পারে! 
শায়লা পার্স থেকে রিকশাভাড়া মিটিয়ে নেমে এলো। খোলা চুল বারবার মুখের উপর  উড়ে উড়ে আসছে আর শায়লা তা সরিয়ে দিচ্ছে।
শিহাবের ভেতরে কি যেন কী ঘটে যাচ্ছে!
শিহাব নিজেকে সামলে নিলো।ভালবাসার অনুভবের শুরুর ক্ষণটা যদি আজীবন  ধরে রাখা যেত! এ এক অপার্থিব  অনুভুতি! শিহাব শায়লাকে বাইকের দিকে এগিয়ে নিলো।কিছু মুরুব্বি গোছের খালাম্মারা সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফেরিওয়ালা তাদের ডাক থামিয়ে মনে হচ্ছে সুটিং দেখছে! 
সামনের ছয়তালা ভবন থেকে কয়েকজন বারান্দায় এসে স্থির হয়ে আছে,ভাবটা এমন নাটকের শেষটা দেখতে হবে!!
শিহাব বুঝলো চারিদিকে উৎসুক চোখ তাদের ঘিরে ধরেছে,শীঘ্রই লোকালয় ছেড়ে পালাতে হবে! 
শায়লা জানতে চাইল,কেমন লাগলো অপেক্ষা করতে?
হু, খুবই অস্বস্তিকর লাগছিল তবে তুমি আসার পর ভালোলাগাটায় তা ছাপিয়ে গেছে।
তাই, আর আমি যে এমন কত অপেক্ষায় থেকেছি!
হু,আজ সব অপেক্ষার অবসান হবে শায়লা।
আমি তোমাকে সেই ভরসাটাই দেবো যেখানে শুধু পাওয়ার আনন্দটাই থাকবে।শিহাব শায়লার অজান্তেই হাত বাড়িয়ে শায়লার হাত ধরলো।শায়লা চমকে উঠলো!
শিহাব শক্ত করে শায়লার হাত ধরে বললো বাইকে উঠে বসো। শিহাব শায়লার হাত ধরেই বাইকে বসিয়ে শাড়ি গুছিয়ে দিলো।চালকের আসনে নিজে বসে নিলো।পিছনে শায়লার দিকে তাকালো বুঝাতে,আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো কিন্তু।সে আর বলতে! অনেক অঘটন ঘটার পর আজ শায়লা, শিহাবকে হারানোর ভয় কাটিয়ে উঠেছে।আর সে ছাড়ছে না। শিহাব হেলমেট পরে লুকিং মিররটা সেট করে বাইকে স্টার্ট দিলো।বাইক চলতে শুরুর মূহুর্তে শায়লা শিহাবের পিঠে আছড়ে পড়লো।শিহরিত ভাললাগায় আবেশিত হলো দুজন।
বাইক ছুটছে তিন'শ ফিটের সেই খোলা যায়গায় যেখানে শিহাবের মন খারাপ থাকলে কখনো একা, কখনোবা বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই চলে আসে।তবে আজকের আসাটা ভিন্ন।আজ সাথে শায়লা আছে। উৎকন্ঠিত শায়লার ভরসাস্থল হয়ে আজ সে শায়লাকে তার ভালোবাসার কথা শোনাবে।


চলবে...