উপন্যাস
টানাপোড়েন ৮১
অনুভূতির উপলব্ধি
মমতা রায়চৌধুরী
সারাটা শীতের দুপুর মনে এক অসহ্য যন্ত্রণা ;হ,কষ্ট ।কাকে বলবে রেখা?
মনোজকে বলার মতো নয়। কেন যে নয়, সেটাও বুঝতে পারছে না রেখা।
কাকিমা (মীনাক্ষী দেবী) যখন বললেন 'রূপসার কথা মানে বিপাশার দিদির কথা ।তখন থেকে শুনেই রেখা ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে। কত কষ্ট করে হারু জেঠু দুই সন্তানকে মানুষ করেছেন ।সে তো চোখের সামনেই সবাই দেখেছে। এত অভাব এর মধ্যেও মেয়ে দুটিকে কখনো কষ্ট দেন নি। যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী মেয়েদের যথাযোগ্য পড়াশোনা থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছেন। সুপাত্রস্থ ও করেছেন। রূপসার বর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। অথচ তাকেই ভগবান পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিলেন।
বিপাশা যতটা কোয়ালিটি সম্পন্ন মেয়ে ছিল বিয়েটা ঠিক তেমন হয় নি ।হয়তো বর ভালো একটা চাকরি করতো এইটাই। মানুষ হিসেবে ভালো নয়। ওর বরও তো প্রতারণার কেসে জেল হাজতে।রেখা কাকিমার কাছ থেকে ঘটনাটি শোনার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ যদি ছেড়ে চলে যায় ,কেমন হতে পারে সে উপলব্ধি ?রেখা ভাবতে পারে না ।ভয়ে আতঙ্কে রূপসাদির ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সব যেন ভিড় করতে থাকে রেখার চোখেমুখে।
মনে পড়ে বিপাশাকে ভালোবাসতো রেখাদের পাড়ারই একটি ছেলে। বিপাশা বুঝতে পেরেও সেই ডাকে সাড়া দিতে পারে নি।
ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। হয়তো এখন কোন এক সন্ধ্যা বেলায় বা গোধূলিলগ্নে বিপাশা ভাবতে থাকে সেই মুহূর্তের কথা ।
আজ ঘুরে ফিরে অলস শীতের দুপুরে মনে পড়ছে কত কথা। একবার একদিন শীতের সময় ঘোষেদের চাষের জমি পাশেই ,সেখানে দল বেঁধে যেত ছোলা শাক, মটরশুটি আর ধনেপাতা তুলতে ।তার জন্য অবশ্য ঘোষ জেঠু তাড়াও দিয়েছেন কিছুদিন ।
তারপর একদিন ঘোষ জেঠু বললেন 'না হয় খাবি তো দুটো ধনেপাতা নিয়ে যা না ।'
হেসে আরো বলতেন 'কিন্তু বদলে কুলমাখা আমাকে দিতে হবে ,মনে রাখিস।'
সেদিনের এক বিকেল বেলায় হঠাৎ বিজয়দা পাকড়াও করে বিপাশাকে একেবারে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে এসে সাইকেল নিয়ে দাঁড়াল পথ আটকে।' যদিও বিপাশার দৃপ্ত ভঙ্গিতে আরষ্ট হয়ে যায় বিজয়দা কি কথা বলতে আসলো ?সব কোথায় যেন আটকে গেল ।
বিজয়দা শেষে বললো' অনেকগুলো কুল আছে নিবি তোরা?'
আমরা কুল নেব কি নেব না ,সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই, সব ঢেলে দিয়ে পালিয়ে গেল ।
কিন্তু রেখার স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিনের সেই বিজয়দার চাহনিতে ছিল আলাদা একটা মাদকতা ,ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি ,উপলব্ধি।
এভাবে কেটে গেছে কত সুন্দর সোনালী মুহূর্ত ।রুপসাদির তো তুলনা নেই ।যা কিছু আমাদের ভালোলাগা ,খেতে চাওয়া,আবদার সব রূপসদি তার দাবি মেটাত।তাই ভাবতে পারা যাচ্ছে না রুপসাদির জীবনের এই ঘটনা ।মনের দিক থেকেও যতটা ভালো মানুষ ছিল ,তেমনি আন্তরিকতা সম্পন্ন ।না ছিল কোন অহংবোধ ।হারুদার বাড়িতে নতুন কোন কিছু রান্না হলেই এনে হাজির করত।
রুপসাদি হেসে বলতো 'তোরা একটু টেস্ট করে দেখ।' 'আমরা জানতাম হারুদার বাড়িতে কতটা অভাব কিন্তু ওই সামান্য জিনিসের ভেতরেও যেন কত ভালোবাসার মিশ্রণ ছিল ।'
হারু কাকাও বলতেন হেসে' প্রাণ চায় অনেক অনেক তোদেরকে খাওয়াতে কিন্তু আমি পারি না। যেটুকু আছে আয় সবাই মিলে ভাগে ভাগ করে খা ।তোরাও তো আমার মেয়ের ই মতো।'
উফ অসাধারণ চাটনি করত রূপসাদি ক্যাপসিকামের।
সেই ক্যাপসিকামের চাটনি আমি রুপসাদির কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে আজকাল বাড়িতে বানাই ।ক্যাপসিকামের চাটনির সেই স্বাদ রূপসাদির মত আসে না। কিন্তু তবুও এর মধ্যে যেন ফিরে পাওয়া যায় সেই কৈশোরবেলার দিনগুলির মিষ্টি মধুর স্মৃতি।
রেখা ভাবে 'এখন যে আমরা অন্য শ্রাবণের জলে ভিজি ।অন্যভুবনে এখন আমাদের বসবাস।'
হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে' একা একা এই বেশ থাকা আলো নেই কোথাও ।সব মেঘে ঢাকা...।'
হঠাৎই ভাবনায় দোলা লাগে...।'
মনোজ এসে বলে কি গো তোমার ফোন বাজছে তুমি আজ কোন ভাবনায়?'
রেখা বলল 'হ্যাঁ ফোন বাজছে।'
মনোজ বলল 'কার ফোন দেখো । কাকিমার ফোন আসার পর থেকেই তোমার কেমন যেন মুড অফ হয়ে গেল।'
রেখা বলল' হ্যাঁ দেখছি'।
মনোজ বলল 'কে ফোন করেছিল?'
রেখা বলল'পত্রিকার সম্পাদক।'
মনোজ বলল 'এ বাবা তোমার লেখার কতদূর কি হলো?''
রেখা বলল'এরমধ্যে পত্রিকার সম্পাদক তাড়া দিয়েছেন লেখা পাঠানোর জন্য।'
মনোজ বলল 'সে তো ঠিকই'। তুমি পাঠিয়ে দাও।'
রেখা বলল' হ্যাঁ কবিতা ক'টা পাঠাবো।'
মনোজ বলল' আর নতুন করে আরও লেখ।'
রেখা বলল'এতটা ঘেটে আছি না?
কোন কথাই মাথায় আসছে না ।'
মনোজ বললো 'দেখো জীবনে এই দুঃখ ,কষ্ট ,যন্ত্রণা চিরস্থায়ী হয় না ।ওই নিয়ে বেশী নিজেকে হারিয়ে ফেলো না।'
রেখা বলল 'সারাক্ষণ কেমন একটা বিষন্নতা গ্রাস করে আছে মনেপ্রাণে ।কেন কি জন্য তার কৈফিয়ত দিতে পারব না।'
মনোজ এসে ব্যালকনিতে রেখাকে দুই 'হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তোলে । আর বলে 'নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না। হারানো স্বপন চোখে এঁকো না ।'
রেখার উদাসী বাউল মনটা কোন সাত সমুদ্র পেরিয়ে অজানা দেশে হারিয়ে যেতে চাইছে ।সেই মনের হদিশ কি পাবে?'
মনোজ বলল 'কি ব্যাপার গো? তুমি এখানে এসে বসে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ, কি হয়েছে তোমার?""
রেখা বলল' অন্য কেউ ছিলো ভাবনায়?'
মনোজ বললো 'হ্যাঁ।'
রেখা বললো 'হ্যাঁ, সত্যি।
মনোজ বলল 'তাই তো ভাবছি।'
রেখা বললো তু'মি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না?:
মনোজ বলল 'এতদিন তো ,তাই জানতাম।'
রেখা বললো 'দেখো প্রত্যেকেরই কিছু কিছু একান্ত মুহুর্ত থাকে ।নিজস্ব উপলব্ধি অনুভূতি থাকে।'
মনোজ বলল' হ্যাঁ সেটা ঠিক।'
রেখা বলল 'মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে যেতে হয় ।আত্মসমালোচনায় ডুবে যেতে হয় ।নিজেকে আবিষ্কার করতে হয়।'
মনোজ বললো 'কিন্তু আজকাল তোমার ভেতরে একটু বেশিই টানাপোড়েন হচ্ছে, আর তুমি আজকে কি রিংটোন লাগিয়েছ। গানটা তুমি চেঞ্জ করো।'
রেখা বলল' তোমাকে আগেই বললাম মনের একান্ত অনুভূতি উপলব্ধিতে আছে।'
মনোজ বলল 'কোথায় শীতের অলস দুপুরে দুজনে কাছাকাছি বসবো, ভালো ভালো কথা বলব ।মিঠে রোদ্দুর গায়ে মাখবো তা নয়?'
রেখা শুধু ম্লান হেসে মনোজের দিকে তাকিয়ে থাকে।