শামীমা আহমেদ /পর্ব ৪৪



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ৪৪)
শামীমা আহমেদ 


শিহাব আজ অন্য এক শিহাব রূপে নিজেকে তৈরী করে নিচ্ছে।বিগত জীবনের পটভূমি বদলে নেবার মাহেন্দ্রক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আর পিছুটানে নিজেকে ফেরাবে না স্মৃতিকাতরতায় আবেশিত হয়ে।আজ, এইতো আর কিছুটা  সময় পরই শায়লার সাথে তার দেখা হবে,ভিন্ন ভাবনায়,ভিন্ন আঙ্গিকে, একই পথ রেখায় চলবার অঙ্গীকারে হবে অনেক কথা বিনিময়  হৃদয়ে  ভালবাসা সঞ্চিত রেখে, 
অপ্রাপ্তির তালিকাটিকে ক্ষুদ্র করে দিতে।

যদিও এর আগেও কয়েকবার তাদের দেখা হয়েছে কিন্তু আজকের দেখা হওয়াটায় অন্য এক ধরনের ভাললাগা,অন্য একটি জীবনের শুরুতে নিজেদের এক হওয়া। একটি সুদূরের বোঝাপড়ায় আগামীর স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেয়ার আলাপচারিতা। আজ তাই শিহাব এ প্রসঙ্গ ছাড়া  আর কোন কিছুই ভাবনায় আনতে চাইছে না। সে চট করে লাঞ্চ সেরে সব গুছিয়ে নিলো।আজ লেইট লাঞ্চ হলো।শিহাব সকালে গুলশান মেনজ স্যালুনে গিয়েছিল।একটু নিজেকে তৈরি করে নিতে আর কিছু টুকটাক শপিং করার প্রয়োজনে। 
শিহাব আয়নায় নিজেকে দেখছে। আজকের নতুন কেনা শার্টের সাথে প্যান্ট ম্যাচ করিয়ে নিচ্ছে।আজ হলুদাভ ঘি রঙা একটা শার্ট কেনা হয়েছে। শিহাব তাই কফি ব্রাউন একটা প্যান্ট ম্যাচ করিয়ে নিলো। চুলগুলো নিত্যদিনের সজ্জাতেই থাকবে বলে মনস্থির করে নিলো।ঘড়িতে তাকিয়ে সে ঝটপট তৈরি হয়ে গেলো।চকচকে ব্রাউন কালার সু'পেয়ার পায়ে গলিয়ে, ব্রাউন শেডেড রোদচশমাটা পকেটে পুরে নিলো।একরাশ  সুগন্ধি ঢেলে শিহাব বেরিয়ে পড়লো।এখনো প্রায় অনেকটা সময় বাকী শায়লার আসবার। তবুও,, ঐ যে অপেক্ষায় থাকার আনন্দটা নিতে তাই সে দ্রুত ছুটছে!খুব মনে পড়ছে সেই উঠতি বয়সে তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় নিজেকে রোমিও করে তোলার দিনগুলির কথা! হায়,কি এক পাগল করা সময়ইনা গেছে তখন! শিহাব যেন সেই সময়টাতেই ফিরে গেছে আজ!
এমন অসময়ে ভর দুপুরে স্যার এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছে,এ ভাবনায় কেয়ারটেকার বেলালের চোখ কপালে উঠেছে! সে  গ্যারাজ খুলে দিয়ে ঠাটা পড়া মানুষের মত দাঁড়িয়ে রইল।
দ্রুতই বাইক নিয়ে শিহাব পার্কের গেটে চলে এলো।পার্কের ঢোকার মুখে একটা বড় গাছের নীচে ছায়াতে বাইক থামিয়ে দাঁড়ালো। পার্কটিকে এখন আর চেনাই যায় না।ভেতরের আগের নকশা ভেঙে আবার নতুন করে গড়া হয়েছে।অনেক গাছপালার সাথে  নানান ধরনের নান্দনিক সজ্জাও দেয়া হয়েছে। এখনো প্রায় দুপুরই বলা চলে।পার্কের দর্শনার্থীর সমাগম হয়নি একেবারে।শুধু গুটিকয়েক স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে জুটি বেঁধে আড়াল হয়ে বসে আছে।শিহাব ভাবলো আসলেই, এই বয়সের প্রেমটা এমনি হয়।যেমন প্রচন্ড আবেগ, তেমনি ধরা পড়ার ভয়!
আজ সে নিজেও  কিছুক্ষন পর এমনি একটি জুটিতে বাঁধতে যাচ্ছে।যেখানে দুজনার চোখে মুখে ভাবনায় থাকবে আগামীর স্বপ্ন।
শিহাব হাতে মোবাইল নিয়ে শায়লাকে কল দিলো।শায়লা এক রিংয়েই কলটা রিসিভ করলো! বুঝাই গেলো কতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল এই কলটি।শিহাব হেসে ফেললো শায়লার ছেলেমানুষী দেখে। 
শায়লা তুমি কি তৈরি? 
এখনই চলে এসেছো? আমারতো আরেকটু সময় লাগবে।
কোন সমস্যা নেই।সময় নাও।আমি অপেক্ষা করছি। শায়লা কেবল শাড়ি পরে চোখে আইলাইনারের টানটা দিয়েছে।শায়লার হাত কাঁপছিল। নীল শাড়িটা আজ দিনের আলোয় খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে।শায়লা কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ পরে নিলো।মেরুন রঙের লিপস্টিকে ঠোঁট দুটো রাঙিয়ে নিলো।শায়লার মন আজ যেন বাঁধাহীন। কোন কিছুই তাকে বাঁধছে না। খুবই রিল্যাক্স মুডে সে। যদিও সে আজ জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। শায়লা সামান্য উচ্চতার একজোড়া কালো জুতা পায়ে পরে নিলো। ড্রেসিং টেবিলে রাখা সুগন্ধি মেখে হাত ব্যাগটি হাতে নিয়ে আয়নায় নিজেকে  দেখে দুবার হাঁটার প্র‍্যাকটিস করে নিলো। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে! আজ অনেকদিন পর শায়লা এভাবে কারো জন্য  সাজলো। কেউ তার জন্য সত্যিকার তেমনিভাবে অপেক্ষায় আছে।
বাসা লক করে শায়লা নিচে নেমে এলো।বাইরে বেশ রোদ।কি আর করা শিহাব যেভাবে চেয়েছে।শিহাবের প্রতি বরাবরই তার এরকম নির্ভরতা।
শিহাব বাইকে বসে অপেক্ষায়  থেকে শায়লার এফবি প্রোফাইলে ঘুরাঘুরি চলছে।সেই প্রথম দিনের পরিচয়ের কথা মনে পড়ছে।মাঝে চলে গেছে অনেকগুলো দিন মাস সময়। কতনা অনুভুতি আবেগ উৎকন্ঠার দিনাতিপাত।সব শেষ করে দিতে চেয়েও আবার সেখান থেকেই নতুন করে শুরু করা।শিহাব তাই ভাবছে  নিয়তি কোথা থেকে কোথা টেনে নেয়! পথে উৎসুক মানুষজন এমন হ্যান্ডসাম লুকের একজনকে দেখে একবার হলেও উঁকি দিচ্ছে।এদিকটায় প্রায়ই নাটকের স্যুটিং হয়।শিহাবকে আবার নাটকের পাত্রপাত্রীই ভাবছে কিনা! অবশ্য ভুল কেন,বাস্তবে লুকটাতো তেমনি! শিহাব সানগ্লাস চোখে সবই খেয়াল করছে।একটা রিকশায় দুইটি টিনএজার মেয়ে বেশ খোলামেলা অভিব্যক্তিতে শিহাবকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিলো! শিহাব একেবারে চমকে গেলো! হায় ওরা কি বুঝে যে বয়সে আমি ওদের গণ্ডিতে পড়ি না। আজকাল এরা বেশ সাহসী।অনুভুতি প্রকাশ ভীষণ স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। 
দুইজন গৃহিণী শিহাবের দিকে তাকিয়ে থেকে তা প্রায় আরেকটু হলে গাড়ির সামনেই পড়তে যাচ্ছিল। উচ্চ হর্ণের শব্দে এ যাত্রা বেঁচে গেলো! শিহাব হাসবে না দুঃখ প্রকাশ করবে বুঝতে না পেরে মুখকে পাথর বানিয়ে রাখল।
দূর থেকে  রিকশায় নীল শাড়ি পরা একটি মেয়ে এগিয়ে আসছে।শিহাব এবার সতর্ক হলো। এবার আবার  না জানি কোন অভিজ্ঞতা হয়! আসলে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটায় সত্যিই একটু অস্বস্তি লাগছে।নীল শাড়ির রিকশা তার খুব কাছে চলে এসেছে।শিহাব এবার ভাল করে তাকালো।রিকশায় শায়লা বসে আছে।সাগর নীলা শাড়িটিতে যেন নীলাকাশের ছায়া! শায়লাকে অপূর্ব লাগছে! প্রতিবার দেখা হওয়ায় শায়লা কোন না কোনভাবে চিন্তিত থাকতো কিন্তু আজ চোখে মুখে যেন আনন্দ ঠিকরে পড়ছে! 
কি হলো চিনতে পারোনি?
শায়লার প্রশ্নে শিহাবের পলক পড়লো।
রিকশার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,সত্যিই  তোমাকে আমি চিনতে পারিনি।তোমাকে  অপূর্ব লাগছে! আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি!
বেচারে রিকশাওয়ালা এদের প্রেমালাপের মধ্য কাবাব মে হাড্ডি হয়ে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।আরে,,ভাড়াডা চুকাইয়া দিলেই তো সে পালাইতে পারে! 
শায়লা পার্স থেকে রিকশাভাড়া মিটিয়ে নেমে এলো। খোলা চুল বারবার মুখের উপর  উড়ে উড়ে আসছে আর শায়লা তা সরিয়ে দিচ্ছে।
শিহাবের ভেতরে কি যেন কী ঘটে যাচ্ছে!
শিহাব নিজেকে সামলে নিলো।ভালবাসার অনুভবের শুরুর ক্ষণটা যদি আজীবন  ধরে রাখা যেত! এ এক অপার্থিব  অনুভুতি! শিহাব শায়লাকে বাইকের দিকে এগিয়ে নিলো।কিছু মুরুব্বি গোছের খালাম্মারা সন্দেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফেরিওয়ালা তাদের ডাক থামিয়ে মনে হচ্ছে সুটিং দেখছে! 
সামনের ছয়তালা ভবন থেকে কয়েকজন বারান্দায় এসে স্থির হয়ে আছে,ভাবটা এমন নাটকের শেষটা দেখতে হবে!!
শিহাব বুঝলো চারিদিকে উৎসুক চোখ তাদের ঘিরে ধরেছে,শীঘ্রই লোকালয় ছেড়ে পালাতে হবে! 
শায়লা জানতে চাইল,কেমন লাগলো অপেক্ষা করতে?
হু, খুবই অস্বস্তিকর লাগছিল তবে তুমি আসার পর ভালোলাগাটায় তা ছাপিয়ে গেছে।
তাই, আর আমি যে এমন কত অপেক্ষায় থেকেছি!
হু,আজ সব অপেক্ষার অবসান হবে শায়লা।
আমি তোমাকে সেই ভরসাটাই দেবো যেখানে শুধু পাওয়ার আনন্দটাই থাকবে।শিহাব শায়লার অজান্তেই হাত বাড়িয়ে শায়লার হাত ধরলো।শায়লা চমকে উঠলো!
শিহাব শক্ত করে শায়লার হাত ধরে বললো বাইকে উঠে বসো। শিহাব শায়লার হাত ধরেই বাইকে বসিয়ে শাড়ি গুছিয়ে দিলো।চালকের আসনে নিজে বসে নিলো।পিছনে শায়লার দিকে তাকালো বুঝাতে,আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো কিন্তু।সে আর বলতে! অনেক অঘটন ঘটার পর আজ শায়লা, শিহাবকে হারানোর ভয় কাটিয়ে উঠেছে।আর সে ছাড়ছে না। শিহাব হেলমেট পরে লুকিং মিররটা সেট করে বাইকে স্টার্ট দিলো।বাইক চলতে শুরুর মূহুর্তে শায়লা শিহাবের পিঠে আছড়ে পড়লো।শিহরিত ভাললাগায় আবেশিত হলো দুজন।
বাইক ছুটছে তিন'শ ফিটের সেই খোলা যায়গায় যেখানে শিহাবের মন খারাপ থাকলে কখনো একা, কখনোবা বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই চলে আসে।তবে আজকের আসাটা ভিন্ন।আজ সাথে শায়লা আছে। উৎকন্ঠিত শায়লার ভরসাস্থল হয়ে আজ সে শায়লাকে তার ভালোবাসার কথা শোনাবে।


চলবে...

মন্তব্যসমূহ

সুন্দর ভিউজ নজর করুন

কবি সানি সরকারের কবিতা "দগ্ধ - মৃত - গাছ"

কবি আইরিন মনীষা এর কবিতা "বেদনার বালুচরে"

রীনা ঘোষ